চটকপুরের চটক
তপন কুমার কর

দার্জিলিং জেলার তিন কন্যের সরলতায় ভরপুর হিমেল নিশ্বাস আর বিনীত সুরে দু’হাত সম্মুখে তুলিয়া উষ্ণ অভ্যর্থনা গায়ে জড়াইবার মাদকতায় সস্ত্রীক দার্জিলিং মেলে সওয়ার হইলা কন্যে – সিটং ও দাওয়াইপানি অনুক্ত রহিলো । যথাসময়ে তাহাদিগের অপার সৌন্দর্য ভান্ডার পাঠকের কাছে উন্মুক্ত করিতে উদ্যোগী হওয়ার চেষ্টা করিবো। বরং ইত্যবসরে, চটকপুরের চটকে – ভরা ভ্রমণ সুধার পাত্রখানি উপস্থাপন করিতে প্রবৃত্ত হইলাম।
৩৮.৬ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এবং প্রায় ৮০০০ ফুট উচ্চতায় সবুজে মোড়া দুর্গম বনাকীর্ণ সিঞ্চল অভয়ারণ্যে, রহস্যময় অসীমতা ও বিরাটত্বের ভয়াল গা – ছম – ছম করানো সৌন্দর্য নিবিড়ভাবে দেখা এক অনন্য অনুভূতি। অভয়ারণ্যের প্রবেশ পথ হইতে হোমস্টেগুলির অবস্থান প্রায় আট কিলোমিটার দূরত্বে। ছোট – বড় বিবিধ আয়তনের উপলরাশি বিছানো সর্পিল খাড়াই পথ ঘুরিয়া ঘুরিয়া সমস্ত অন্তর বাহিরকে আচ্ছন্ন করিয়া যেন আকাশ ছুঁইতে চলিয়াছে। পথের দু’ধারে নিচ্ছিদ্র ছায়াঘন বনপথ যেন কল্পনায় কোন বাহুবলী দু’দিক হইতে চাপিয়া ধরিয়াছে। অনেকাংশে, দুইখানি গাড়ির পাশাপাশি পরস্পরকে অতিক্রম করা অত্যন্ত দুরূহ । তবুও চালকের মুন্সিয়ানায়, মুচকি হাসির টানে কিংবা পরিহাসে পথ হইয়া উঠে অকৃপণ।
এই মুক্তাঞ্চলে কোন প্রকৃতি প্রেমিক যদি একবার আসিয়াছেন, এ’পথের শিহরণ জাগানো অভিজ্ঞতা এবং অখণ্ড আনন্দ তাঁহার মনের গভীরে নিরন্তর জারিত হইতে থাকিবে। পাইন, ওক, ব্রুস ও অন্যান্য মোচাকৃতি বৃক্ষের দুর্ভেদ্য বনাঞ্চল। শ্বাপদসংকুল এই অভয়ারণ্যের সাথে প্রেমে – অপ্রেমে দিগন্ত বিস্তৃত কাঞ্চনজঙ্ঘার খুনসুটি। কখনো হাতে হাত রাখিয়া, কখনো বা ব্যথার আড়ালেতে দাঁড়াইয়া উহারা প্রেমালাপ সারে। এ’হেন মধুর মিলনের সাক্ষী হইতে পরিব্রাজককূল অনাদিকাল ধরিয়া দূরদূরান্ত হইতে ছুটিয়া আসেন।

পুরুষ ব্ল্যাক বিয়ার সহচরীকে লইয়া আসিয়া পাইন গাছের নিম্নাংশ আঁচড়াইয়া কামড়াইয়া প্রবল বিক্রম প্রদর্শন করিয়া গিয়াছে। যাহার নিদর্শন যত্রতত্র বড় প্রকট হইয়া রহিয়াছে। এতদ অঞ্চল পক্ষীকূলের অবাধ বিচরন ক্ষেত্র। দূরে গহন অরণ্যে আচ্ছন্ন ফরেস্ট রেঞ্জারের অফিস, বনবাংলো এবং আরো দু’ চারিটি ঘরবাড়ি যেন আকাশের সাথে নিভৃতে গোপন কথা সারিতেছে।
ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যবোধ দূরে ঠেলিয়া সরাইয়া দিয়া — এই বনভূমি, কতিপয় মানুষজন, তাহাদের সুমধুর আচার ব্যবহার, জীবনধারণ, ঘরবাড়ি, চড়াই-উতরাই পথঘাট, সবুজ পাহাড়ি উপত্যকা, পশ্চাতে শিল্পীর নিখুঁত তুলির টানে আঁকা হিমালয় পর্বতশ্রেণীর পটভূমি — সবেতেই অতি দ্রুত একাত্ম হইয়া যথেচ্ছ বিহারে ডানা মেলিয়া মাতিয়া উঠিবার দুর্দমনীয় বাসনা জন্মাইল।
কিন্তু স্থানীয় মানুষের কড়া শাসন ও পরামর্শে, ৯০ বছরের তরুন পথপ্রদর্শকের তত্বাবধানে ও পরম বাৎসল্যে উড়ন্ত কাঠবিড়ালি, বার্কিং ডিয়ার, বন্য শূকর, ভালুক, এমনকি চিতাবাঘের পরিবারের পাড়ার মধ্য দিয়া কালাপোখরির উদ্দেশ্যে দীর্ঘ ট্রেকিং অতিশয় আনন্দদায়ক ও রোমাঞ্চকর ঠেকিল। চলার পথে সদ্য মুকুলিত সংখ্যাতীত রডোডেনড্রন ( স্থানীয় মানুষের কাছে গুরাস নামে পরিচিত ) গাছের সাক্ষাৎলাভ নয়নতারায় উজ্জ্বল হইয়া রহিল।
যে কোন হোমস্টে হইতে দশ – পনের মিনিটের চড়াই পথ ধরিলেই ওয়াচ – টাওয়ারে পোঁছানো যায়। এখান হইতে অরুণোদয় ও অস্তাচল কালে একাধিক রঙে রঞ্জিত বনাঞ্চল, পর্বত উপত্যকা ও পর্বত শীর্ষের অপরূপ শোভা সতত মনের গভীরে চির ভাস্বর হইয়া বিরাজ করিতেছে।

নির্জনতায়, নীরব মানুষের হাতেগোনা বসতি — সাড়া নাই, শব্দ নাই, পাহাড় – জঙ্গল বেষ্টনীর মধ্যে যেন অন্য কোন অজানা গ্রহে বনপথের ধারে বাস করিতেছি। সোপান চাষ, পর্যটকদের নিবিড় আনাগোনা, বনৌষধি সংগ্রহ — পরিবেশ বান্ধব এই ক্ষুদ্র পল্লীবাসীদের জীবন জীবিকার উৎস।
সন্ধ্যা নামিতেই পাইন গাছের মাথা ভেদ করিয়া তারাগুলি আকাশ ভরিয়া জ্বলিতে থাকিত। রাত বাড়িলে নাম না জানা রাতজাগা পক্ষীকূলের বিরামহীন কলতানে অখণ্ড নিস্তব্ধতায় ছেদ পড়িল। মাঝেমধ্যে খুচখাচ শব্দ কাঠের দেওয়াল উপেক্ষা করিয়া ভাসিয়া আসিতে লাগিল। মনে হইতে লাগিল কোন বন্য প্রাণী বুঝি অতি সন্তর্পণে একবার থামিয়া, ধারালো চক্ষু দ্বারা কিছুক্ষণ চতুর্দিক নিরীক্ষণ করিয়া আবার অভীষ্ট লক্ষ্যে চলিতে শুরু করিয়াছে।
পুরুষের সর্বাঙ্গে কাঠিন্য, চিকন মেজাজ — রমণীর পাখির নীড়ের মতো শান্ত, স্নিগ্ধ চক্ষুযুগল, পিঠের উপর সুবিন্যস্ত চকচকে রেশমতুল্য কেশরাশি, অধরতে অনন্ত হাসির ছোঁয়ায় কত সহজে নীরবে মন চুরি হইয়া যায়। সকলে যেন ঘড়ির কাঁটার বাঁধনে নিজেদেরকে বাঁধিয়া রাখিয়াছেন। কর্তব্যে তিলমাত্র শৈথিল্য প্রদর্শনের পাঠ বোধহয় কস্মিনকালেও ইঁহারা রপ্ত করেন নাই।
মহাসমাদরে পরিবেশিত বিবিধ উপকরণে সমৃদ্ধ চার বেলার খোরাক রসনাবৃত্তি তৃপ্ত করিতে যথেষ্টই বোধ হইল। জৈব – চাষে উৎপন্ন শাকসবজির অমৃত স্বাদে মনে হইল, সেই শৈশব – কৈশোর – যৌবনের জীবনধারা কেন একই খাতে বয়ে যায় না!!
বর্বর প্রাচুর্য, অতিরিক্ত কিছু অর্থের আস্ফালন যাহার বলে মানুষ নিজের সীমাহীন সীমাবদ্ধতা আড়াল করিতে সচেষ্ট হন, অত্যুচ্চ স্পর্ধার অশুভ বেদিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে দু:সাহসী হইয়া ওঠেন, এহেন মনুষ্য প্রবৃত্তির লেশমাত্র এখানে নাই। বরং প্রাচুর্যপূর্ণ হৃদয়ের সন্ধান এখানে কষ্টার্জিত নয়। তথাকথিত আরামদায়ক ব্যবস্থা বলিতে যাহা বোঝায় তাহার অভাব মোচন করিতে চেষ্টায় ত্রুটি চোখে পড়ে নাই। প্রতিটি পর্যটকের পছন্দ – অপছন্দ, বিবিধ ফরমাশ, নিপুণভাবে মস্তিষ্কে ধারণ করিয়া, যথাসময়ে স্মৃতির ভান্ডার হইতে তাহা বাহির করিয়া নীরবে যথাস্থানে পৌঁছাইয়া দিতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব কিংবা খেদ পরিলক্ষিত হয় নাই।
নিজের মাতৃভূমির সকলই দেখিয়া ফেলিয়াছি, চিনিয়া ফেলিয়াছি — এরূপ বাক্যের প্রয়োগ
বড়ই অনভিপ্রেত এবং অনুভূতি পীড়ন – তুল্য বলিয়াই উপলব্ধ হয়।
যাহা দেখিলাম না তাহার আক্ষেপ মিটাইতে বিলম্ব হইল না, যাহা দেখিলাম তাহাই আমার কাছে যথেষ্ট মনে হইল। প্রসন্ন হাসি বিনিময়ে যখন বিদায় লইলাম, প্রাকৃত উপলখণ্ডের অনিয়ন্ত্রিত ঝাঁকুনিতে আনমনে বিশিষ্ট সংগীতস্রষ্টা, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানের কলির অনুরননে নিজেকে বিস্মৃত হইলাম…….
” সে কেন দেখা দিল রে,
না দেখা ছিল যে ভালো। “
—————==————–