গল্পঃ গোত্র – দেবাংশু সরকার

গোত্র
দেবাংশু সরকার

বিয়ের পরের দিন রমা যখন শ্বশুর বাড়িতে এলো, হাজার মানুষের ভিড়, জটলার মধ্যেও কোনো এক সময়ে রমার জাঠ শ্বশুর রমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। অকৃতদার বৃদ্ধ মানুষটা কথা বলতে বলতে একবার বলে ফেললেন, “বৌমা, আমি না মানলেও বাংলায় একটা কথা আছে, সোনার আংটি আবার ট্যারা ব্যাঁকা! আমাদের বংশের এক সময়ে জমিদারী ছিল। এখন সে সব আর না থাকলেও, আমাদের বংশের কোনো কোনো আংটি একটু ট্যারা ব্যাঁকা থেকে গেছে। একটু মানিয়ে নিও। মনে রাখবে দোষ গুন নিয়েই মানুষ। প্রত্যেকেরই কিছু দোষ যেমন আছে, তেমন কিছু গুনও আছে। মানুষের গুনটাকে গুরুত্ব দেবে, দোষটাকে ইগনর করবে। দেখবে এতে তুমি জীবনে সুখী হবে, অন্যকে সুখী করতে পারবে।”
গোসাবার এক গাঁয়ের মেয়ে রমা। অপরূপা সুন্দরী। রমার রূপ দেখেই তার শ্বশুর শাশুড়ি তাকে পছন্দ করে ঘরে এনেছেন। প্রথম দিন শ্বশুর বাড়িতে এসে বিরাট অট্টালিকা দেখে চোখ কপালে ওঠে রমার। এতো বড় বাড়ি! চারি দিকে পরপর বেড রুম। কোনটা কার কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না সে। বারে বারে দেখিয়ে দেওয়ার পরেও নিজের ঘরটা খুঁজে বের করতে হিমশিম খায়। কোন দিকে রান্নাঘর, কোন দিকে ভাঁড়ার ঘর, কোন দিকে বাথরুম কিছুই ঠিক করতে পারে না! রমার সমস্যা দেখে তার শাশুড়ি আরতিকে বলেন রমার সঙ্গে থেকে তাকে দেখাশোনা করতে, সাহায্য করতে।
আরতি জন্ম থেকেই এ বাড়িতে আছে। এখানেই ব্ড় হয়েছে। বহু বছর পূর্বে আরতির ঠাকুরদা এসে এই জমিদার বাড়ির সেরেস্তায় চাকরি পায়। তারপর জমিদার প্রথা বিলোপ হয়েছে, কিন্তু সম্পত্তি বিক্রি করে সেই টাকায় জমিদার বংশের বিচক্ষণ ছেলেরা লোহার ব্যবসা করে বিপুল টাকা উপার্জন করে নিজেদের ঠাটবাট অনেকটা বজায় রেখেছে। সেই বিশাল অঙ্কের টাকা ঘরে জমিয়ে না রেখে বিভিন্ন ব্যবসায় নিয়োগ করে জমিদার পরিবার এক বৃহৎ ব্যবসায়ী পরিবারে পরিবর্তিত হলেও বাড়ির নামটা এখনো জমিদার বাড়ি নামেই পরিচিত হয়ে রয়েছে। রয়ে গেছে পুরানো কর্মচারীরাও। জমিদার বাড়ি থেকে কিছু দুরে রয়ে গেছে স্টাফ কোয়ার্টারগুলো।
জমিদার বংশের জন্মালেও শোভনের নাকটা কিন্তু উঁচু নয়। সে যেন মাটির মানুষ। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মালেও পা দুটো তার মাটিতেই থাকে। স্টাফ কোয়ার্টারে তার অবাধ যাতায়াত। কর্মচারীদের ছেলে মেয়েরাই তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। খোকন, রমেশ, আরতিরাই তার খেলার সাথী। এদের সঙ্গেই তার ওঠা বসা, স্কুলে যাওয়া। দিন, মাস, বছর যায়। বড় হতে থাকে শোভনরা। তারা এসে দাঁড়ায় বয়ঃসন্ধিতে। ক্রমশ যেন একটু বেশি কাছাকাছি আসতে থাকে শোভন আর আরতি। শোভনের মনে যেন বিশেষ এক আকর্ষণ জন্মায় আরতির প্রতি। কিন্তু আরতির মনে তার প্রিয় ছোট বাবুর প্রতি কি আছে শোভন বুঝতে পারে না। বারে বারে সে নিজেকে প্রশ্ন করে, আরতি কি তাকে ভালোবাসে? নাকি শোভনের মনে জন্মেছে এক তরফা প্রেম? কি করবে সে? সে কি আরতিকে আরো কাছে টেনে নেবে? নাকি দুরে সরে যাবে? কিছুই ভেবে পায় না সে! সরাসরি জিজ্ঞাসা করতে তার কেমন যেন সঙ্কোচ হচ্ছে। একবার ভাবে সরাসরি আরতিকে তার মনের কথা বলবে, আবার মত বদলে মনের কথা মনে চেপে রাখে। তার মনের মধ্যে এক তোলপাড় শুরু হয়েছে। কিছুই ভাবতে পারছে না সে! কিছুই না!
না, পারলো না সে! অনেক চেষ্টা করেও মনের কথা মনের মধ্যে ধরে রাখতে পারলো না। একদিন সরাসরি আরতিকে বলে বসলো, “তোকে আমি খুব ভালোবাসি আরতি। তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।”
– একথা বোলো না ছোট বাবু। কোথায় তুমি আর কোথায় আমি! কোথায় তোমাদের পরিবার, আর কোথায় আমরা! আমাকে বিয়ে করলে তোমাদের পরিবার অনেক নিচে নেমে যাবে।
– কেন? নিচুতে নামবে কেন? এমন কথা কেন বলছিস? তুই কি মানুষ নয়? তোদের বংশ কি মানুষের বংশ নয়?
– কিন্তু বংশ পরিচয়ের একটা মানদণ্ড আছে। একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে। আমাদের পরিবারের মান সম্মান কি তোমাদের পরিবারের সমান? নিশ্চয়ই নয়। তোমাদের পরিবার হচ্ছে মনিবের পরিবার। আর আমাদের পরিবার হচ্ছে কর্মচারীর পরিবার।
– আমিতো কোনো দিন কারো সাথে ভেদাভেদ করিনা। কাউকে উঁচু নিচু মনে করিনা। আমার চোখে সব মানুষ সমান। ছোট থেকে তোদের সঙ্গে মেলামেশা করেছি। খেলা ধুলো করেছি। এক সঙ্গে খেয়েছি। কোনো দিন কি মনে হয়েছে তোদের থেকে আমি নিজেকে আলাদা মনে করেছি?
– তুমি মানুষ নওগো ছোটো বাবু। তুমি দেবতা। তোমার মত উঁচু মন মানুষের হয় না। তুমি সবার থেকে আলাদা। কিন্তু সাধারন মানুষের সংখ্যাইতো বেশি ছোটো বাবু। তারাইতো ভিড় করে আছে নিচু মন নিয়ে। তারা তোমার মত করে চিন্তা করতে পারে না। মানুষকে ভালোবাসতে পারে না। তোমাকে শ্রদ্ধা করা যায়। ভালোবাসা যায়। নিজের সব সত্ত্বাটুকু উজাড় করে দিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু টেনে নামানো যায় না।
– আমাকে দেবতা বললি! কিন্তু দেবতাতো মানুষের থেকে অনেক দুরে থাকে। আমিতো সেটা চাই না। আমিতো মানুষের কাছে থাকতে চাই। তোদের কাছে থাকতে চাই। তোর কাছে থাকতে চাই। আমাকে উঁচু নিচু দেখিয়ে দুরে ঠেলে দিস না। বুঝতে পারছি তুই আমাকে ভালোবাসিস না। সেইজন্য কথার জাল বুনে আমাকে দুরে সরিয়ে দিতে চাইছিস। ঠিক আছে তুই একবার বল আমাকে ভালোবাসিস নাকি ভালোবাসিস না? একবার সত্যি কথাটা বল? তারপর আর তোকে বিরক্ত করবো না।
– আমাকে ক্ষমা করো ছোট বাবু। এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারবো না।
– আমাকে কাঙাল করে দিয়ে যাস না আরতি। তোকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ।
এরপর আরতিকে আর দেখতে পাওয়া যায় না। বাড়ির মধ্যেই নিজেকে বন্দি করে ফেলেছে সে। আরতির বাবা ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন মা মরা মেয়েটার বিয়ে দেওয়ার জন্য। যোগাযোগ করছেন বিভিন্ন জনের সঙ্গে। এক জায়গায় স্থির হয় সম্বন্ধ। কথা পাকা হয়। দেখতে দেখতে এগিয়ে আসতে থাকে বিয়ের দিন।
জমিদার বাড়ির ব্যবসা দেখা শোনার গুরু দায়িত্ব আরতির বাবার উপর। কখনো কখনো যেতে হয় দুর দূরান্তরে। ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। অনেক সময়ে রাতে ফেরা হয় না। আরতি একাই ঘরে থাকে। এমনি একদিন আরতির বাবা কাজে গিয়ে রাতে বাড়ি ফিরতে পারলেন না। আরতি একাই ঘরে রইলো। অবশ্য এভাবে মাঝে মাঝে একা ঘরে থাকতে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এখন আর রাতে একা থাকতে তার ভয় করে না। মাঝ রাতে হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। চমকে ওঠে আরতি।
ব্যবসার কাজে এদিন শোভনও সহরে গিয়েছিল। ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছে। সকাল থেকেই তার শরীরটা একদম ভালো নেই। কিন্তু জরুরি প্রয়োজনে তাকে সহরে যেতে হয়েছিল। যত বেলা বাড়ছে, তত তার শরীরটা খারাপ হচ্ছে। জ্বর এসেছে। সঙ্গে মাথার যন্ত্রণা। কোনো রকমে স্টাফ কোয়ার্টারের সামনে আসতেই মাথা ঘুরে গেল। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল রাস্তায়। আবার উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু শরীর ভীষণ দুর্বল। সামনে সে আরতিদের ঘরটা দেখতে পেল। এখান থেকে জমিদার বাড়ি বেশ কিছুটা দুরে। অত দুরে যাওয়ার ক্ষমতা এখন তার নেই।
– দরজা খোল আরতি। আমি দাঁড়াতে পারছি না। ভীষণ জ্বর হয়েছে আমার। খুব মাথা ঘুরছে। তাড়াতাড়ি দরজা খোল, না হলে এখানেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবো।
ছোট বাবুর গলা পেয়ে দরজা খুললো আরতি। সত্যিই জ্বরে সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছে শোভনের। কোনো রকমে ঘরে ঢুকিয়ে খাটে শুইয়ে দিল। সারা রাত তাকে সেবা যত্ন করে সারিয়ে তুললো। অসুস্থ, অসহায়, জ্বরে বেঁহুশ শোভন সারা রাত আরতিকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার আশ্রয় খুঁজছিলো। সেই রাতে কখন কি ঘটে গেল কিছুই মনে রইলো না শোভনের। সেই রাতে আরতি যে তাকে সব কিছু উজাড় করে দিয়েছিলো, জানতেই পারলো না শোভন। পরের দিন সকালে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলো সে।
কিছু দিনের মধ্যেই বিয়ে হয়ে গেল আরতির। বছর ঘোরার আগেই সুখবর এলো। এক ফুটফুটে ছেলের মা হয়েছে সে। খুশির খবর এলো জমিদার বাড়িতে। শোভনও খবরটা শুনে খুশী হয়েছে। এতদিনে সে দুঃখকে জয় করতে পেরেছে, ক্রমশ ফিরে আসছে স্বাভাবিক জীবনে। সে আরতির ছেলের নাম রাখলো জয়। নবজাতকের জন্য অনেক উপহার নিয়ে সে গেল আরতির বাড়ি। আরতিকে বললো পুরানো কথা ভুলে যেতে। সংসার নিয়ে, সন্তান নিয়ে সুখে থাকতে। সেই সঙ্গে জানালো সেও খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চলেছে।
কিন্তু হায়! সুখ যে বড় ক্ষণস্থায়ী! একটা পথ দুর্ঘটনা চুরমার করে দিল একটা সুখী পরিবারকে। ছেলেকে নিয়ে আরতি আবার ফিরে এলো তার বাপের বাড়ি।
কোনো এক অমোঘ আকর্ষণে শোভন বারে বারে ছুটে আসে আরতিদের ঘরে। জয়কে আদর করে। ঘুরতে নিয়ে যায়। প্রায় প্রত্যেক দিন উপহার নিয়ে আসে জয়ের জন্য। আরতিকে আশ্বাস দিয়ে বলে, “তোর ছেলেকে নিয়ে কোনো চিন্তা করিস না। আমি দায়িত্ব নিচ্ছি, তোর ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করে তুলবো। কি সুন্দর দেখতে হয়েছে তোর ছেলেকে। যেন দেব শিশু।”
আরতি মনে মনে ভাবে – সত্যিই এ দেব শিশু। দেবতার সন্তান। কিন্তু তুমি জানতে পারলে না ছোট বাবু!
এতদিনে রমা এসে গেছে শোভনের ঘরে। সুখেই আছে দুজনে। তবু রমা একটু যেন অবাক হয় জয়ের প্রতি শোভনের বিশেষ আকর্ষণ দেখে। জমিদার বাড়ির আশে পাশে আরো অনেক বাচ্চা ঘুরে বেড়ায়। তাদেরও শোভন ভালোবাসে। কিন্তু জয়ের প্রতি আকর্ষণ যেন সবার থেকে আলাদা।
কয়েকদিন হলো আরতি আসছে না। তার জন্য অবশ্য রমার খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না। চাঁপা নামের আর একজন রমার কাজকর্ম করে দেয়। খবর আসে জয়ের শরীর খুব খারাপ। ডাক্তার দেখাতে হয়েছিলো। চাঁপাই জয়ের অসুখের খবর রমাকে এনে দেয়। আজও খবর এনেছে যে, শোভন আর আরতি জয়কে নিয়ে ডাক্তারখানাতে গেছে। সেই সঙ্গে চাঁপা রমাকে সতর্ক করে বলে, “বৌদি একটা কথা বলছি কিছু মনে করো না । ছোট বাবুকে একটু চোখে চোখে রেখো। আরতির স্বভাব ভালো নয়। এক সময়ে ছোট বাবুর সঙ্গে কি ঢলাঢলি করতো! ছোট বাবু পাত্তা দিতো না। কিন্তু আরতির যা গায়ে পড়া স্বভাব, সারাক্ষণই ছোট বাবুর সঙ্গে লেপ্টে থাকতো। ম্যাগো! চরিত্তির বলে কিছু নেই মেয়েটার!” সত্যি মিথ্যে মিলিয়ে আরো অনেক কথাই সে বললো ।
ক্রমশ শরীর খারাপ হচ্ছে জয়ের। উৎকন্ঠা বাড়ছে আরতির, শোভনের, এমনকি রমারও। সর্বদা রমা জয়ের আরগ্য কামনা করে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে চলেছে।
বেশ কয়েক দিন অসুখে ভোগার পর সুস্থ হলো জয়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রমার কাছে ফিরলো শোভন। রমা শোভনকে জানালো সে মা বিশালক্ষীর কাছে জয়ের আরগ্য কামনা করে পুজো মানত করেছে। তাই তাকে একদিন গোসাবাতে মা বিশালক্ষীর এক জাগ্রত মন্দিরে নিয়ে যেতে হবে। এক কথায় রাজি হয় শোভন।
গোসাবার উদ্দেশ্যে রওনা হলো রমা, শোভন। ভেবেছিলো জয়কে নিয়ে যাবে। কিন্তু জয় তখনো অত্যন্ত দুর্বল, তাই যেতে পারলো না। আরতি গেল না, জয়কে দেখা শোনার জন্য।
মন্দিরে ঢুকে পুজো দিল রমা। পুরোহিত জানতে চাইলেন, “জয়ের গোত্র কি?”
রমা জানালো, “আলীম্মান।”
শোভন ভুল শুধরে দিয়ে বললো, “না, না, ওদের গোত্র শান্ডিল্য। এখানে আসার আগে আমি আরতির থেকে জেনে নিয়েছি। আলীম্মানতো আমাদের গোত্র।”
তীক্ষ্ম স্বরে রমা বললো, “না। জয়ের গোত্র আলীম্মান।”
শোভন খুব একটা ঈশ্বর বিশ্বাসী নয়। তাই সে আর কথা বাড়ালো না। তবে ফেরার পথে সে রমাকে বললো, “তুমি আজ একটা বড় ভুল করলে!”
উত্তরে রমা বললো, “আমি আজ কোনো ভুল করিনি। ভুলটা জয়ের জন্মের দশ মাস আগে অন্য একজন করেছিলো।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *