প্রবন্ধঃ রেশম শিল্পের ইতিবৃত্তে বাঁকুড়া জেলার পটভূমিকা – মধুসূদন দরিপা

রেশম শিল্পের ইতিবৃত্তে বাঁকুড়া জেলার পটভূমিকা
মধুসূদন দরিপা

ইংরেজি silk শব্দটি এসেছে ল্যাটিন sericum> serious >seres থেকে । গ্রীক ভাষায় Seres শব্দের অর্থ হল
an oriental people অর্থাৎ একজন প্রাচ্যের মানুষ। শব্দ ভাবনার উৎস অনুষঙ্গে চমকপ্রদ তথ্য হল
পৃথিবীর বুকে রেশম ভাবনা সর্বপ্রথম এসেছিল প্রাচ্যের বৃহত্তম দেশ চিন থেকে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ পূর্বে
চিনে রেশমকীট থেকে গুটি ও গুটি থেকে সুতা উৎপাদন পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয় । কথিত আছে, একাদশ লিঙশি
রাজকন্যা একদিন একটি তুঁত গাছের নিচে বসে চা পান করছিলেন। হঠাৎ সেই গাছ থেকে একটি রেশমগুটি তার
চায়ের কাপের মধ্যে এসে পড়ে। ঘটনাচক্রে চায়ে ভেজা সেই কোকুন থেকে রাজকন্যা প্রথম রেশম সুতা
আবিষ্কারের ধারণা লাভ করেন। আবিষ্কারের পর দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চিন রেশম চাষ ও উৎপাদনে গোপনীয়তা
বজায় রাখে। পরবর্তীকালে সিল্ক রোডের মাধ্যমে চিনের বেইজিং থেকে ভূমধ্যসাগরের উপকূল বেয়ে প্রথমে
গ্রিস ও পরে রোমান সাম্রাজ্যে রেশম ব্যবসা প্রসার লাভ করে। আরও পরে দক্ষিণ ইয়েমেন, বার্মা
(মায়ানমার) ও ভারতবর্ষে সম্প্রসারিত হয় সিল্ক রুট। উল্লেখ্য জুন ২০১৪ সালে ইউনেস্কো এই সিল্ক
রোডের চাং’আন-তিয়েনশান করিডোরকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্থান দিয়েছে।
জন্ম থেকেই silk মানেই আভিজাত্য। ইংরেজিতে take silk বলে একটা কথা আছে, যার অর্থ হল become a
Queen’s or King’s Counsel. কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বঙ্গে সূক্ষ্ম বস্ত্র সম্পর্কে বর্ণনা আছে। সেখানে
পত্রোর্ণ নামক বস্ত্রের উল্লেখ আছে, যেটি একপ্রকার বুনো রেশম বস্ত্র। পত্রোর্ণ (জাত) বস্ত্র পুণ্ড্র
দেশে (পৌণ্ড্রিক্য) উৎপন্ন হত। পত্রোর্ণ জাত বস্ত্র বলতে এণ্ডি ও মুগ জাতীয় বস্ত্রকে ( পত্র হইতে
যাহার উর্ণা > পত্রোর্ণ ) বোঝানো হয়েছে। অমরকোষ এর মতে পত্রোর্ণ সাদা অথবা ধোয়া কোষের বস্ত্র।
কীটবিশেষের জিহতারস কোনো কোনো বৃক্ষপত্রকে এই ধরণের উর্ণায় পরিণত করে ।
প্রায় ২০০০ বছর পূর্বেই রেশমি বস্ত্র বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে গণ্য ছিল। তাঁতীদের বস্ত্র বিশেষত সূক্ষ্ম,
সতচ্ছ মলমল যা ইউরোপে মসলিন নামে পরিচিত ছিল। গ্রীক ও রোমের লেখকদের লেখা প্রাচীন গ্রন্থে ‘ গাঙ্গেয়
মসলিন ‘ এর উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রাচীন যুগে এগুলো ভারত থেকে আগত বিলাস সামগ্রীর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়
ছিল। সে সময় রোমে এসব পণ্যের সুন্দর কাব্যিক নাম ছিল । যেমন ‘ নেবুলা ‘ যার অর্থ কুয়াশা, বাষ্প বা
মেঘমেঘ এবং ‘ ভেন্টিটেক্সটিলেন ‘ যার অর্থ বুনন করা হাওয়া। নবম শতকের পর থেকে পূর্ব ভারতে
আগমনকারী আরবীয়, চিনা ও ইউরোপীয় পরিব্রাজকেরা বাংলার ধনী বণিকদের সম্পর্কে তাদের বিবরণে
জানিয়েছেন যে, চিন, ভারত থেকে আবিসিনিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় সংঘটিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের
অন্যতম পণ্য ছিল প্রথমে সুতি পরে রেশম বস্ত্র। পর্তুগিজ ও ইংরেজরা ভারতে আসে ১৬শ শতকে। তখন
বাংলায় সামুদ্রিক বাণিজ্যের একচেটিয়া দখল ছিল আরব, পারস্য ও অবাঙালি ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণে। তারা
সাতগাঁও (হুগলি) ও চট্টগ্রামে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করলে ধীরে ধীরে ব্যবসার প্রসার ঘটে। ঐসময় সাতগাঁও
অঞ্চলে সুতি বা পাটের জমিনের উপর হলুদ তসর বা মুগা (পূর্ব বাংলা ও অসমের বুনো রেশম) সুতার সূচিকর্ম
উৎপন্ন হত। যা ইংল্যান্ড ও পর্তুগালে খুবই সমাদৃত ছিল। ১৬৩২ সালে হুগলিতে পর্তুগিজদের পতন ঘটে এবং
এর সাথে সাতগাঁও কাঁথাও বিলীন হয়ে যায় । তবে সাদা সুতিতে মুগা বা তসরের সূচিকর্ম টিকে থাকে।

১৭ শতকের মধ্যভাগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মুগল সরকার থেকে বাংলায় কয়েকটি ফ্যাক্টরি খোলার অনুমতি
পায়। তারা মালদহ জেলার কাসিমবাজারে চাষ করা রেশম এবং মিশ্র বস্ত্রবস্ত্র, ময়ূরভঞ্জ তথা মেদিনীপুরের
রেশম এবং সুতি মিশ্রণ ও সুতি কাপড়, ঢাকা এবং শান্তিপুরের সূক্ষ্ম মসলিন, এছাড়া শুধু ঢাকায় উৎপন্ন
সূক্ষ্ম সূচিকর্ম ( সাদা কাজ করা মসলিন বা চিকন নামে পরিচিত ছিল) নিয়ে কাজ করে। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে
ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সাথে বিলাসদ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং তখন থেকে ১৯ শতকের
প্রথম দিক পর্যন্ত প্রচুর পরিমাণে বাংলার থান কাপড় ব্রিটেনে রপ্তানি হয় ।
বাংলায় ঠিক কখন থেকে মালবেরি রেশম প্রস্তুত শুরু হয়, এ সম্বন্ধে কোনো প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া না গেলেও
এটা নিশ্চিত যে, একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ শিল্প এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান উপকরণ হিসেবে এই
রেশম তৈরি প্রক্রিয়ার ইতিহাস শুরু হয়েছিল বহু শতক আগেই। বাংলায় রেশম উৎপাদনের দীর্ঘ ইতিহাস থেকে
দেখা যায় যে, গ্রামের গৃহস্থরা রেশম উৎপাদনের প্রথম তিনটি পর্যায় সম্পন্ন করে। মালবেরি বা তুঁত চাষ,
রেশমগুটি লালনপালন এবং সুতা কাটা। রেশম উৎপাদন একটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। রেশম হল বমবিকস্
মোরি বর্গভুক্ত রেশমপোকার গুটি থেকে তৈরি সুতা দিয়ে বোনা একপ্রকার সূক্ষ্ম ও কোমল তন্তু। রেশমগুটি
থেকে রেশম তৈরি করা হয়। রেশমগুটি আসলে রেশম মথের শুঁয়োপোকা। এদের একমাত্র খাদ্য তুঁত পাতা।
রেশমকীট ডিম থেকে জন্মায় এবং গুটিতে রূপান্তরিত হওয়া শেষ করে তারা রেশম মথ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
স্ত্রী মথ তখন কালচক্র পুনরায় শুরু করার জন্য ডিম পাড়ে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রেশম পিউপা বা কীটগুলোকে
মেরে ফেলে সেগুলোকে সিদ্ধ করে সুতা ছাড়ানো হয় এবং গোটানো হয়। বাংলাদেশে রেশমগুটি প্রতিপালককে বলা
হয় ‘ বোসনি ‘ , রেশমগুটিকে ‘ পোলু ‘, গুটির সুপ্তাবস্থাকে ‘ চোঞ্চ ‘ বা ‘ বিজনগুটি ‘, গুটি মেলার বাঁশের
চালনাকে ‘ চন্দ্রোকি ‘ বলে।
রেশমগুটি বা কোকুন দেখতে অনেকটা পায়রার ডিমের মতো। কোকুনের সুতা অবিন্যস্ত, কিন্তু ভেতরে ৫০০
মিটারেরও বেশি লম্বা একটি মাত্র সুতা সমকেন্দ্রীয় ভাবে বিন্যস্ত থাকে। একটি কোকুন তৈরি হতে তিনদিন
সময় লাগে। ছটি গুটির সুতা একত্রিত করে একটি রিল তৈরি করা হয়। বাইরের পরিত্যক্ত সুতাগুলো পাকিয়ে
স্প্যান সিল্ক প্রস্তুত করা হয়, যা দিয়ে তৈরি হয় মটকা জাতীয় সিল্ক। বাংলায় দীর্ঘদিন থেকে চার ধরনের
রেশম তৈরি হয়ে আসছে। মালবেরি, এণ্ডি, মুগা এবং তসর। প্রথমটি তৈরি হয় বমবিকস্ বর্গের রেশম পোকার
গুটি থেকে হয়, যে পোকা মালবেরি বা তুঁত গাছের পাতা খায়। দ্বিতীয়টি তৈরি হয় ফিলোসেমিয়া বর্গের রেশমগুটি
থেকেথেকে, যারা ক্যাস্টর গাছের পাতা খায়। তৃতীয়টি তৈরি হয় অ্যান্থেরিয়া অ্যাসমেনসিন বর্গের রেশমগুটি থেকে,
যারা কুল, তেজপাতা ও কর্পূরের পাতা খায়খায় এবং চতুর্থটি অ্যানথেরি বর্গভুক্ত রেশমগুটি থেকে, যারা ওক
গাছের পাতা খায়। বলা বাহুল্য যে, এদের মধ্যে মালবেরি রেশম হল সবচেয়ে মূল্যবান।
কথিত আছে, রেশম চাষের পদ্ধতি ও ব্যবসা সম্পর্কে হাতে কলমে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য টিপু সূলতান
মহীশূরের তাঁতীদের পাঠিয়েছিলেন বাংলায়। বাংলা থেকেই পরে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে গুটিপোকা তার জাল
বিস্তার করে, রেশম বিস্তৃত হয়।
মৌর্যযুগ, গুপ্তযুগ ও কুষাণ যুগে নির্মিত বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন টেরাকোটা যক্ষ-যক্ষিনী ও অপ্সরা
মূর্তিগুলিতে সুদৃশ্য বিভিন্ন অলঙ্কার ও খুব সূক্ষ্ম বস্ত্র পরিহিত দেখা যায়। আপাতদৃষ্টিতে যা নগ্ন বলেই
প্রতীয়মান হলেও সম্ভবত পরিহিত বস্ত্রের সূক্ষতা বোঝানোর জন্যই শিল্পীরা এইভাবে তা নির্মাণ করেন।
কবিকঙ্কনের লেখায় উল্লেখ আছে :

‘ চন্দনে চর্চিত তনু হেন দেখি যেন ভানু
তসর বসন পরিধান ‘
ঐতিহাসিক অভয়াপদ মল্লিক বিষ্ণুপুরের ইতিহাসে উল্লেখ করেছেন, মল্লরাজাদের আমলে বালুচরী ও
স্বর্ণচরী শাড়ি পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। সেসময় মটকা, কেটিয়া, বাপ্তা, সাপ্তা, চন্দ্রলেখা, মেঘমালা
প্রভৃতি শাড়ি জনপ্রিয় ছিল । গড়মান্দারন ও বর্ধমান থেকে বহু বস্ত্রশিল্পী এসে মল্লরাজ্যের বিভিন্ন স্থানে
বসতি স্থাপন করে, যারা বর্ধমান্যা ও মান্দারণ নামে পরিচিত ছিল। এরা ছিল মধ্যকুলের অন্তর্গত। আর
মুর্শিদাবাদ থেকে আগত বস্ত্রশিল্পীদের বলা হত উত্তরকুল। মল্লরাজ্যের বস্ত্র ও সিল্কের বিভিন্ন দ্রব্য
উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্রগুলি মল্লরাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল মল্ল রাজধানী বিষ্ণুপুর,
সোনামুখী, বাঁকুড়া শহর, রাজগ্রাম, গোপীনাথপুর, বীরসিংহপুর, জয়পুর, কেঞ্জেকুড়া, মদনমোহনপুর ও
পাঁচমুড়াতে ।
বালুচরী শাড়ির জন্মকাল অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ। এ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। অধুনা মুর্শিদাবাদ
জেলার আজিমগঞ্জ-জিয়াগঞ্জ ছিল সেসময় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র। দূরদূরান্ত থেকে মাড়োয়ারি,
গুজরাটি, আর্মানী, ইহুদী, পঞ্জাবী, ইংরেজ, ফরাসি ও ওলন্দাজ বণিকেরা বাণিজ্যের জন্য আসতে থাকেন এই
অঞ্চলে। একটি মত অনুসারে সেই সময় গুজরাটি তাঁতীদেরও আগমন হয় এবং তার ফলেই ভাগিরথীর পূর্ব পাড়ে
বালুচরে গড়ে ওঠে বয়নশিল্প। অন্য একটি মতে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ ১৭০৪ সালে সুবে বাংলার রাজধানী ঢাকা
থেকে মকসুদাবাদে স্থানান্তরিত করার পর তার বেগমদের জন্য নতুন শাড়ি তৈরির হুকুম দেন বালুচরের
তাঁতশিল্পীদের। তারা যে নতুন শাড়ি সৃষ্টি করেন, তাই বালুচরী নামে খ্যাত হয়। মুর্শিদাবাদে এই শিল্পের শেষ
বিখ্যাত কারিগর দুবরাজ দাস মারা যান ১৯০৩ সালে, যিনি চিত্রশিল্পীদের মতো তাঁর তৈরি শাড়িতে নিজের নাম
সই করতেন। এরপর গঙ্গার বন্যায় সেই গ্রাম বিধ্বস্ত হলে শিল্পীরা আশ্রয় নেন বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর
গ্রামে। সেখানে মল্লরাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই শিল্পের সমৃদ্ধি ঘটে। টেরাকোটার মন্দির ও অন্যান্য
শিল্পের প্রভাব পড়ে এই শাড়ির নকশায়। পরে ব্রিটিশ জমানায় অন্যান্য দেশীয় বয়নশিল্পের মতো বালুচরীও
দুর্দশাগ্রস্থ হয়। ১৯৫৬ সালে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সুভো ঠাকুর বা সুভগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে এই
শাড়ির বাণিজ্যিক বিস্তার ঘটে। তিনি তখনকার বিখ্যাত কারিগর অক্ষয় কুমার দাসকে রিজিওনাল ডিজাইন
সেন্টারে (সুভো ঠাকুর এর ডিরেক্টর ছিলেন) সাবেক জালা তাঁতের পরিবর্তে জ্যাকার্ড তাঁতের ব্যবহার শেখান।
পরের বছর অক্ষয় দাস অজন্তা ইলোরার মোটিফ লাগিয়ে নতুন বালুচরী বাজারে আনলে এই শিল্পের উত্থান
ঘটে।
তসর বস্ত্র উৎপাদনে বাঁকুড়া জেলার ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল, কারণ এই তসর চাষ হয় মূলত শাল গাছে, যা
বাঁকুড়া জেলার সম্পদ। তাছাড়া অন্য তিন ধরণের গাছ আসান, কুল, সিধা, অর্জুন গাছেও তসর চাষ হয়। আসান ও
সিধা গাছের বাহুল্য এ অঞ্চলে নেই। শালগাছের তসর সর্বোৎকৃষ্ট। পরবর্তীতে অর্জুন গাছে চাষের প্রসার
ঘটে, কারণ ব্রিটিশ সময়কালেই শাল জঙ্গলের ব্যাপক হ্রাস ঘটে।
১৯০৫ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদন ‘ The state of the Tusser Silk Industry in Bengal and Central
Provinces ‘ – এ N. G. Mukherjee বাঁকুড়ার তসরকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলেছেন ও ঢাকা-ময়মনসিংহে এর কদরের
কথা বলেছেন। তিনি তসর শিল্পে যুক্ত পরিবারের সংখ্যা বলেছেন সোনামুখীতে ১০০০, বিষ্ণুপুরে ৫০০-৭০০,

গোপীনাথপুরে ৪০০, রাজগ্রামে ৪০০, রাজহাটীতে ৪০০ এবং মোট জড়িত মানুষ ১০০০০ । সেখানে ১৯৫৯ সালে
তসর তাঁত কমে দাঁড়ায় ৬৫ টি ও কর্মসংস্থান ছিল ২৩১ । এ সময় মালবেরি চাষের জমি দাঁড়ায় ১৮০ একরে ও
একর প্রতি পাতা উৎপাদন ছিল ৬০০০ ।
১৯২১ সালে জেলাশাসক গুরুসদয় দত্ত প্রশাসনিক ভাবে ও কৃষি সমিতির মাধ্যমে রেশম-তসর শিল্পের
পুনরুজ্জীবনে সক্রিয় ভূমিকা নেন। ওন্দায় ২০ বিঘা ও পুনিশোলে কয়েক বিঘা জমিতে রেশম চাষের ব্যবস্থা করা
হয়। ওন্দায় তিনজন রেশম বিভাগীয় কর্মী নিয়োগ করা হয়। পুনিশোলের দুজন ‘সমিতি’-র ব্যয়ে রেশম বিদ্যালয়ে
প্রশিক্ষণ পান। শিরোমণিপুরে (বর্তমানে কোতুলপুর) মল্ল যুগের রেশম গৌরব ফিরিয়ে আনতে সন্নিহিত ১৮ টি
গ্রামে ‘ কোতুলপুর সমিতির ‘ মাধ্যমে
রেশম চাষের ব্যবস্থা করা হয়। মড়ার, চিঙ্গানি, কুলপুকুর প্রভৃতি গ্রামগুলিতে বিনামূল্যে বীজ বিতরণ করা
হয়। ১৯২৫ সালে রামানুজ কর তসর চাষ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘ এ জেলার জঙ্গলে তসর জন্মে। বিষ্ণুপুর,
সোনামুখী গুপিনাথপুর, রাজগ্রাম, কেঞ্জাকুড়া ও বীরসিংহপুর গ্রামে তসরের ধুতি, শাড়ি ও চাদর তৈয়ার হয়।
শালবন থেকে তসরগুটি সংগ্রহ ছিল উপজাতি ও অর্ধ -উপজাতীয় মানুষদের অন্যতম আয়ের উৎস। ‘
স্বাধীনতা উত্তর ভারতে চার দশক পরে রেশম চাষী, ঝওরেশম ব্যবসায়ী ও অনুসারী শিল্পের স্বার্থ রক্ষার
উদ্দেশে ১৭ মার্চ ১৯৮৯ সালে The West Bengal Silkworm seed, cocoon and silk yarn ( Regulation
of productionproduction, supply, distribution and sale Act, 1988 ) এই আইনের প্রবর্তন হয়।
বর্তমানে বীরভূম, মালদা, মুর্শিদাবাদ, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর ইত্যাদি জেলায় রাজ্য সরকার পরিচালিত
sericulture department এর কার্যালয়ের মাধ্যমে বহু বিধ প্রকল্পের মাধ্যমে রেশম শিল্পে নিযুক্ত
উদ্যোগের সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। বাঁকুড়া জেলার তালডাংরা ও ভোলারখাপ গ্রামে দুটি সরকারি গবেষণা
কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। দক্ষিণ বাঁকুড়া অঞ্চলে এই শিল্পের উল্লেখযোগ্য প্রসার ঘটেছে। জেলায়
বর্তমানে ৫০০০ রেশম চাষী আছেন এবং রেশম গুটি থেকে সুতা গোটানো অর্থাৎ silk reeling এর কাজে যুক্ত
আছেন ৮০০ জন উদ্যোগী। সোনামুখীতে কয়েক শতাব্দী ধরে এই কাজ হয়ে আসছে। এখান থেকেই মূলত সিল্কের
বিভিন্ন রঙের ও বিভিন্ন প্রকারের থান বিষ্ণুপুর শহরের তাঁতীরা সংগ্রহ করেন। এছাড়াও জেলার বেশ কিছু
গ্রামে self help group গড়ে রেশম শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন মহিলা উদ্যোগীরা। এ বছর প্রায় ১.৫ কোটি
রেশম গুটি উৎপাদন হয়েছে এবং গুটি পিছু ৮ টাকা বাজার মূল্য পাওয়া গেছে, যা কিনা এযাবৎ কাল পর্যন্ত
প্রাপ্ত সর্বোচ্চ দর। বিষ্ণুপুর শহরে পর্যটকদের দৌলতে বালুচরী শাড়ির বিক্রি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি
পেয়েছে। বিষ্ণুপুরের বালুচরী শাড়ি সম্প্রতি কালে Export promotion council for Handicrafts (EPCH-
INDIA) কর্তৃক GI (Geographical Indication) Tag লাভ করেছে । যাকে পরিভাষায় Invaluable
Treasures of Incredible India পণ্য হিসেবে আন্তর্জাতিক স্তরে একটি স্বীকৃতি বলে মান্য করা হয়।
বর্তমানে বিষ্ণুপুর বালুচরী ও স্বর্ণচরী শাড়ি বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন আনারকলি, ধূপছায়া, চন্দ্রলেখা,
চন্দ্রহার, ফুলম, পারিজাত, পথে হল দেরী, স্মৃতিরেখা, অগ্নিবীণা ইত্যাদি। এগুলি ছাড়াও ইদানীং কালে আরও
কয়েকটি নাম জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। যথা মীরার বঁধুয়া, হরধনুভঙ্গ, পঞ্চপাণ্ডব, আদিবাসী নৃত্য, কাঠি নাচ
নকশা, সীতাহরণ, দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভা, শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা, গোপীদের বস্ত্রহরণ প্রভৃতি নকশা যুক্ত শাড়ি।
এককথায় বলা যায় যে, এই শিল্পের মাধ্যমে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের বঙ্গের এবং মল্লরাজ্যের
সাংস্কৃতিক বিবর্তনের চিত্রসহ সমকালীন মানুষের আর্থসামাজিক ও শৈল্পিক জীবনের প্রতিচ্ছবি সুন্দর
ভাবে ফুটে উঠেছে।

রাজ্যের মধ্যে রেশম চাষে সেরা জেলা হল বীরভূম । প্রায় ১৬ হাজার চাষী তুঁত এবং ২৫০ পরিবার তসর চাষের
সাথে যুক্ত আছেন। রেশম শাড়ির জন্য বিখ্যাত হল মুর্শিদাবাদ। পরিশেষে বেদনাহত হৃদয়ে এ কথা বলতেই হয়
যে, সহস্রাধিক বর্ষ প্রাচীন রেশম শিল্পের সেই ঐতিহ্য ও গৌরব এখন আর এই বাংলায় নেই। একসময়ে সারা
পৃথিবীর sericulture and silk trade guide বাংলা আজ দেশের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় অনেকটাই পিছনে।
কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, অসম এই তিনটি রাজ্য রেশম শিল্পে দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা পালন
করছে এই সময়। এদের মধ্যে কর্ণাটক একাই বছরে ৮২০০ মেট্রিক টন রেশম উৎপাদন করে। ১৭৮৫ সালে
মহীশূরের বাঘ টিপু সুলতান তাঁর রাজ্য থেকে রেশম চাষ সম্পর্কে দক্ষ হয়ে উঠতে কিছু শিক্ষানবিশ
পাঠিয়েছিলেন মল্লরাজাদের দেশে । টিপু স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর রাজ্য একদিন রেশম চাষে দেশের সেরা হয়ে
উঠবে। বলা বাহুল্য যে, তাঁর সেই স্বপ্ন আজ সার্বিক ভাবে সফল হয়েছে।

তথ্যসূত্র :
১. বাঁকুড়া জেলার বিবরণ : রামানুজ কর ও ফকির দাস চট্টোপাধ্যায়
২. অতীত বাঁকুড়ার আর্থচিত্র : রথীন্দ্রমোহন চৌধুরী
৩. বাঁকুড়ার বাণিজ্য জীবন : সুদীপ্ত পোড়েল
৪. বিভিন্ন পোষাক-পরিচ্ছদ ও অলঙ্কার : মানুষের আর্থ-সামাজিক বিবর্তনের প্রতিচ্ছবি : চন্দন কুমার ভট্টাচার্য
৫. তরুণ চৈরা, উপ অধিকর্তা, সেরিকালচার দপ্তর, বাঁকুড়া
৬. The Concise Oxford Dictionary of Current English
৭. আন্তর্জাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *