আত্মকথাঃ ভদ্র ব্যবহার
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)
এখনকার সময়কে অনেকেই ফেসবুক -এর যুগ বলে থাকেন। আমি সে কথা না বললেও একথা নিশ্চয় বলবো বা দ্বিধা না করে স্বীকার করবো ফেসবুক অনেক ভুলে যাওয়া বা হারিয়ে যাওয়া মানুষের সন্ধান দেয়। এটা অতি আধুনিক যুগের একটি সুন্দর যোগাযোগ মাধ্যম হয়ে উঠছে।
আমার এক স্বল্প পরিচয়ের বন্ধু কয়েকদিন আগে আমার ছোট বেলার কথা জানতে চেয়ে অনুরোধ করেছেন। গত চল্লিশ পঞ্চাশ বছর ধরে লেখা লেখির আর কখনো-সখনো ফোনে কথা হলেও কোনো দিন সামনাসামনি দেখা হয়নি। তাই এই দীর্ঘ দিনের ফে. বুকে আলাপকে মাত্র স্বল্প পরিচয়ের বন্ধু বলা ঠিক হবে না। তাই, থুরি, আর এরকম বলবো না।
আগে একটু নিজের কথা দিয়ে শুরু করি, কেমন !
আমার ছোটবেলা কেটেছে বর্ধমান জেলার আসানসোল চাঁদমারী রেল কোয়ার্টার্সে। এই আসানসোল শহরের অনেকটা অংশ জুড়ে রেল স্টেশন ছাড়া, রেল ইয়ার্ড, নানান দিকে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন মাপের রেল কোয়ার্টার্স, পার্ক, বিনোদনের জন্য বড় কক্ষে ক্লাবে খেলার মাঠে প্রায় শহরের সবটাই রেলওয়ে সম্পত্তি। বৃটিশ শাসনের সময় বলে সব কিছুই সাহেবী কায়দায় তৈরী করা হয়েছিলো।
আমার বড় জামাইবাবু ছিলেন রেল কর্মচারী। দেশ ভাগাভাগি হতে পূর্ব বঙ্গে এমনকি আসামের রেল ওয়ার্কশপে কে কোথায় থেকে চাকরি করতে চান, তার জন্য অপশনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। কেউ তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে বা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেতে পছন্দ করেছিলেন। আমার বড় জামাইবাবুর চাকরি পূর্ব বঙ্গে হলেও আসামের গৌহাটিসন্নিকট পাণ্ডু রেল কারখানায় চাকরি করতেন। দেশভাগের পর অপশন দিয়ে পাণ্ডু থেকে বদলি হয়ে এসেছিলেন আসানসোল রেল ওয়ার্কশপে। সেই থেকে চাঁদমারী রেলের ডাবল কোয়ার্টার্সে।
এই চাঁদমারী অঞ্চল শহরের শেষ প্রান্তে রেল কোয়ার্টার্স ছাড়িয়ে চারদিকে খোলা মাঠের আল দিয়ে ভাগ করা শস্য ক্ষেতের একপাশে মাটি পাথরের স্তূপ করে একটা নকল পাহাড় বানানো হয়েছিল। সেই টীলা বা পাহাড়ের পাদদেশে, সাদা বোর্ডের উপর কালো বলের আকারে আঁকা টার্গেট বোর্ড স্ট্যাণ্ডে দাঁড়া করিয়ে রাখা হয়। সম্ভবত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের সৈন্যরা রাইফেল, পিস্তল, বন্দুক চালানো প্র্যাকটিস করত। যুদ্ধ শেষ হলে সেখানকার দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন আসানসোল ও তার আশপাশের কিছু ধনী মানুষ আর কিছু স্পোর্টসম্যান । তাঁদের লাইসেন্স করা বৈধ বন্দুক পিস্তল নিয়মিত, অন্তত প্রায় প্রতি ছুটির দিনে দূর দূর থেকে গাড়ি করে এসে সারাদিন প্র্যাক্টিস করতেন। জায়গাটা সেই থেকে চাঁদমারী নামে পরিচিত হয়ে আসছে।
দেশভাগের পর দেশের প্রায় চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি, আলাপ পরিচয়ের ধারাবাহিকতা, হিন্দু মুসলিমের বহুদিনের ভাই-দাদার মধুর সম্পর্ক ও প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে একে অপরের জন্য এগিয়ে যাওয়ার স্বাভাবিক প্রবণতা সবকিছুকে ফেলে রেখে এপারে চলে আসেন আমার বাবা। ভারত সরকারে পক্ষ থেকে সকলকে রিফিউজি হিসেবে স্বাগত জানানো হয়। তবে বাবা তাঁর সাধনা- শ্রীচৈতন্য ও শ্রীগদাধর যুগল সাধনার জন্য এবং সেসব বিষয়ের উপর পড়াশোনা ও গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরি করার জন্য রিফুজি ক্যাম্পে থাকতে চাইলেন না। বড় দিদি তাই আমাদের তাঁদের কোয়ার্টার্সের একটা ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।
আমার ছোটবেলা কেটেছে আসানসোলে বড়দিদির কাছে জামাইবাবুর চাঁদমারী রেল কোয়ার্টার্সে। আমার ছোটবেলার খেলার সাথীরা আর বন্ধুরা সবাই রেল কোয়ার্টার্সের ঘরে বড় হয়েছে।
সেই চাঁদমারী রেল কোয়ার্টার্সের কথায় ফিরে আসা যাক।
মনে পড়ে মণির কথা। ওর মা ওকে ওর ছোট বেলাই ছেড়ে চলে গিয়েছেন ওপারে। ফলে ওর ঠাকুমাই ওকে বড় করে তুলেছেন আর আমাদের খগেনদা, যিনি মণির বাবা, আরকটি বিয়ে করে মণির জন্য একজন সৎ-মা এনে দিয়েছিলেন। তবুও ঠাকুমার কাছেই মণি বড় হয়েছিল। মণিদের বাসার পেছন দরজার উল্টো দিকে থাকতেন খান সাহেব। ওঁর গ্রামের বাড়ি সুদূর আফগানিস্তানে।
আফগানিস্তানের লোকজনদের আমরা কাবুলিওয়ালা বলায় অভ্যস্ত। আসানসোলের রেলওয়ের কারখানায় অর্থাৎ লোকো শেডের বিভিন্ন পদে কাজ করতেন নানান উপার্জনের মানুষ। তাঁদের মধ্যে যাঁরা স্বল্প আয়ের কথা মাথায় না রেখে ব্যয় করতেন তাঁদের সারা মাস সংসারের খরচ চালাতে প্রায় প্রতি মাসে ধার করতেই হয়। তাঁদের ধার দেবার জন্য দরাজ হাতে হাজির থাকতেন বেশ কয়েকজন কাবুলিওয়ালা। সুদের হার অন্যান্য মহাজনদের তুলনায় অনেক বেশি। তবে এঁরা শুধু হ্যাণ্ড নোট স্বাক্ষর করিয়ে সঙ্গে সঙ্গে টাকা ধার দিয়ে দেন, আর ধার শোধ করতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে হ্যাণ্ডনোট চোখের সামনেই ছিঁড়ে ফেলে দেন। অন্যান্য মহাজনদের সাগরেদরা মহাজনের গদি থেকে হ্যাণ্ডনোট আনতে বলেন। তবে টাকা ধার দেবার কাবুলিওয়ালারা বলেন – হাম অসলি নেহি মাংতা, স্ সুদ মাংতা।” কেউ কেউ মাসিক সুদ দিতে না পারলে কিন্তু ওঁরা ভয়ংকর হয়ে উঠে ঠিক মাসমাইনের দিন কারখানার গেটে দাঁড়িয়ে ঋণ গ্রহীতার আসার অপেক্ষা করেন সারা সন্ধ্যে। কোন কোনও দিন অনেক রাত পর্যন্ত গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট ঋণ গ্রহীতা চুপি চুপি বাইরে এলেই দুতিন জন তাকে জাপটে ধরে কেড়ে নেয় পুরো মাইনের টাকা। ঋণদাতা গুণে গুণে দুই মাসের সুদ নিয়ে বাকী টাকা ফেরৎ দিয়ে বলেন – ম্যায় অসলি নেহি মাংতা, স্ সুদ মাংতা।”
তবে মণিদের প্রতিবেশী খান সাহেব বৃটিশ আমলে রেলের কারখানায় কাজ পেয়েছিলেন। খুব শান্ত ভদ্রলোক তিনি। মাঝে মধ্যেই আমাদের সঙ্গে দুচার কথাও বলতেন। তখনকার দিনে টিভি ছিল না। এমনকি ট্রানজিস্টরও ছিল না। একটু স্বচ্ছল গৃহস্থের বাড়িতে ছিল বড় বড় রেডিও। খান সাহেবের কোয়ার্টার্সে তেমন একটি রেডিও ছিল। তবে সেটা তিনি নিজে এবং তাঁর স্ত্রী ছাড়া বাইরের কোনো লোক কি স্ত্রী কি পুরুষ কারোর তাঁর ঘরে ঢাকার সাহস হতো না। উমরিগর নরী কন্ট্রাক্টর এঁদের খেলা শীতের দুপুরে মাঝে মাঝেই হতো। খান সাহেব ঐ রেডিও চলাকালীন প্রায়ই নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আগে দরজা ভেজিয়ে আমাদের কাছে এসে খেলার গল্প করতেন। আমাদের মন্তব্য শুনতেন। তবে আমার নেহাৎ ছোট ছেলে হলেও কোনদিন তাঁর স্ত্রীকে দেখিনি। দেখার যে কৌতূহল ছিল না, তাও নয়। কাবুলিওয়ালাদের মত দেখতে ছিলেন না খান সাহেব। দাঁড়ি গোঁফ কাটা অন্যান্য মানুষের মত তিনি থাকতেন। বয়সে বড় হলেও আমরা তাঁকে বন্ধুর মতই ভাবতাম।
আসানসোলের চাঁদমারী রেল ডাবল কোয়ার্টার্সের গঠনের কথা একটু জানিয়ে রাখতে চাই। তা’ হল, এক একটি কোয়ার্টার্সে সামনের বারান্দা পেরিয়ে দুটো ঘর, রান্নার ঘর, উঠোন ও শৌচাগার আর পেছনের দিকে আরেকটা দরজা যেখান দিয়ে বাইরের জলের কল থেকে জল এনে ভেতরের চৌবাচ্চায় জল ভরে রাখা যেত। কোয়ার্টার্সে তিন দিকে উঁচু কংক্রিটের পাঁচিল। একটি পাঁচিল আবার কমন ছিল। ডাবল কোয়ার্টার্সের এক পাশের বসবাসকারী সময়ে অসময়ে আরেকজনকে ডাকতে পারতেন। তবে ছোট্ট উঠোনের কোন ছাদ ছিল না। কেউ যদি কোন প্রয়োজনে বাসার ছাদে মই টই দিয়ে ঘরের ছাদের উপর উঠতো সে অনায়াসে আশপাশের কোয়ার্টার্স গুলোর ছাদহীন উঠোন দেখতে পেত। তবে সচরাচর কেউ তেমন একটা করার কথা ভাবতোও না।
এর মধ্যে মণির ঠাকুমা তাঁদের কোয়ার্টার্সের উঠোনের মাটিতে একবার কয়েকটা লাউ গাছের চারা লাগিয়েছিলেন। সব চারা মরে গেলেও একটা মাত্র লাউগাছ কীভাবে যেন তর্ তর্ করে বেড়ে উঠে ছাদের দিকে চলে গিয়েছিল। দড়ি বেঁধে মণিকে দিয়ে বাকী লতা আর ডগাগুলি ঘরের ছাদে বিছিয়ে দিতে পেরে ঠাকুমা বেশ খুশি হয়েছিলেন। কয়েক দিন পর লাউয়ের ডাঁটা আর পাতার জন্য ঠাকুমা মণিকে ছাদে উঠতে বললে, মণি বৈকুন্ঠ প্রসাদ, অন্য আরেক প্রতিবেশীর কাছ থেকে ওঁদের ছোট একটা মই চেয়ে এনে ছাদে উঠে নিজের ঠাকুমার (আউশ) অর্থাৎ আশা মেটাতে পেরেছিল। লাউ ডাঁটার চচ্চরি আর সরষে পুর দিয়ে লাউ পাতার বড়া রান্না করে মা-হারা নাতিকে খাইয়ে দিয়ে ঠাকুমা নাতির দিকে তাকিয়ে একমুখ হাসি ছড়িয়ে বলেছিলেন – কীরে ক্যামন লাগলো ? ভাল্ না?”
সেদিন কারখানা থেকে ফিরে স্নান সেরে ধোপদূরস্ত রঙিন লুঙ্গি আর সাদা ঝকঝকে গেঞ্জি পরে খান সাহেব ঘরের বাইরে এসে মণিকে খুঁজতে লাগলেন। খবর পেয়ে মণি তাঁর খান চাচার কাছে যেতেই খান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন – মণি আঙ্কল , তুম ছাদমে উঠা থা ?”
- হ্যাঁ, আমি তো উঠা থা।” মণি জিজ্ঞেস করল – কেন, কোন অসুবিধা হয়েছে ?”
খান সাহেব বললেন – নেহি কুছ অসুবিধা নেই আছে। শুধু ছাদমে উঠনেকে সময় সবকো জানান দিতে হবে যে তুমনে ছাদ পর উঠ রহা হ্যায়। সব লোগ আপনা আপনা ঘর পে আপনাকো চলনমেঁ সাবধান হো সকে। জেনানা লোগ ওপেন কোর্ট ইয়ার্ড মে অপনা অপনা সরম বচা সকতী। ঠিক হয়না আঙ্কেল ?”
সেই থেকে মণি ছাদে ওঠার আগে – চেঁচিয়ে বলতে শুরু করল, ছাদপর উঠতা হ্যায়-য়-য়-য়….”
সেই মণিকে আজও আমি খুঁজে থাকি ফেসবুকের মধ্যে। হয়ত বা একদিন পেয়েও যাবো।