প্রবন্ধঃ কুশীলব যখন ইনসুলিনঃএক দীর্ঘ আবিষ্কারের নাটক – অদিতি ঘোষ দস্তিদার

কুশীলব যখন ইনসুলিনঃ এক দীর্ঘ আবিষ্কারের নাটক
অদিতি ঘোষ দস্তিদার

অক্টোবর ১৯২৩। স্থান, কানাডার টরেন্টো। সময়, সকালবেলা।
ফোন বাজছে। সকাল হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। কিন্তু ব্যান্টিং মগ্ন গভীর ঘুমে।
ঘুম চোখেই ফোন ধরলেন।
ফোনের ওপারে বন্ধুর উচ্ছ্বাস, “অভিনন্দন বন্ধু! খবরের কাগজ পড়েছো?”
“না! ঘুমোচ্ছিলাম, কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে জিজ্ঞেস করছো? আরে তুমি নোবেল প্রাইজ পেয়েছ হে!”
বন্ধু হয়ত আরো কিছু বলছিলেন, কিন্তু রিসিভার ক্রেডলে রেখে ততক্ষণে রাতের
পোষাক পরেই ব্যান্টিং ছুটছেন খবরের কাগজের সন্ধানে। মনে আনন্দ উপচে
পড়লেও পাশাপাশি এক অজানা আশঙ্কাও!
এত খুশির মধ্যেও মনে কীসের চিন্তা ব্যান্টিংএর?
আজ লিখতে বসেছি জীবনমঞ্চে অভিনীত এক নাটক – যাতে আছে দুর্নীতি,
আকাশছোঁয়া অহঙ্কার আর পাশাপাশি তীব্র অবিচার। সামনাসামনি অনেক চরিত্রকে
দেখতে পেলেও এ নাটকের পশ্চাদপটে আছে একটি অসুখ – মধুমেহ বা ডায়াবেটিস।
তাই ডায়াবেটিসের ওষুধ ইনসুলিনও এই নাটকের এক কুশীলব হয়ে গেছে।
প্রদীপ জ্বালার আগে একটু সলতে পাকাই।
প্রাককথনঃ ২০২২ সালের হিসেব অনুযায়ী, সারা পৃথিবীতে প্রায় এক কোটির
কাছাকাছি মানুষ টাইপ -১ (Type-1) মধুমেহ বা ডায়াবেটিসে ভুগছেন – কিন্তু শুধুই
বেঁচে আছেন যে তা নয়, মোটামুটি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। এই বিশাল
সংখ্যার মানুষের ওষুধ একটাই – ইনসুলিন!
ইনসুলিন আবিষ্কারের আগে টাইপ -১ ডায়াবেটিস চিহ্নিত হবার মানেই ছিল রোগীর
সাক্ষাৎ মৃত্যু। রোগী কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার হজম করতে পারে না, যে কোন
ধরণের মিষ্টি জিনিস যাতে গ্লুকোজ বা সুক্রোজ আছে সেসব খেলেই শরীরে জমা হতে
থাকে বিষাক্ত পদার্থ, যার নাম কিটোন (Ketone)। রোগীর কিডনি ক্রমশ কাজ করা
বন্ধ করে দেয়, রোগী দুর্বল হতে হতে একসময় কোমায় চলে যায়, তারপর একদিন
ঢলে পড়ে চিরঘুমে।
আগে এই রোগের কারণ জানা যেত না, নানা রকম ঝাড়ফুঁক, তন্ত্র মন্ত্রের সাহায্য
নেওয়া হত রোগ সারাতে। তার ফল যে কী হত তা আর ব্যাখ্যার দরকার পড়ে না।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে রোগটা যে মিষ্টি জাতীয় খাবার খেলে হয় সেটা
আন্দাজ করা গেল। ডাক্তাররা রোগীর খাওয়া দাওয়ার তালিকায় কার্বোহাইড্রেট
একেবারে বন্ধ করে দিলেন। এতে রোগীর আয়ু হয়তো কয়েক বছর বাড়ানো যাচ্ছিল,
কিন্তু ব্যাপারটা তেমন আশাপ্রদ ছিল না। অনেক সময় আবার রোগী প্রায় সব
খাওয়া ছেড়ে দিয়ে দুর্বল হয়েই মারা যেত।

১৮৮৯ সালে সালে, দুই জার্মান গবেষক, অস্কার মিনকোস্কি এবং জোসেফ ভন
মেরিং কুকুরের শরীর থেকে অগ্ন্যাশয় গ্রন্থি কেটে বাদ দিয়ে দেবার পর
দেখেছিলেন কুকুরের মধ্যে ডায়াবেটিসের লক্ষণ। কুকুরটা মারা গেলও তাড়াতাড়ি।
আরো কিছু পরীক্ষার পর তাঁরা এই সিদ্ধান্তে এলেন যে অগ্ন্যাশয় এমন একটা
জায়গা যেখানে ‘অগ্ন্যাশয় পদার্থ’ উৎপন্ন হয়।
পরবর্তীকালে আরো পরীক্ষা করে দেখা গেল গোটা প্যাংক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয় নয়,
অগ্ন্যাশয়ের একটা অংশ যাকে ল্যাঙ্গারহ্যান্সের দ্বীপপুঞ্জ বা আইলেটস অফ
ল্যাঙ্গারহ্যানস বলা হয় সেখান থেকেই ওই রস বের হয়। ১৯১০ সালে, স্যার
এডওয়ার্ড অ্যালবার্ট শার্পে-শেফার জানান যে তিনি লক্ষ করেছেন ডায়াবেটিস
রোগীদের অগ্ন্যাশয়ে ওই রস অনুপস্থিত। তিনি এই রসের নাম দেন ইনসুলিন,
ল্যাটিন ভাষায় ইনসুলা শব্দের অর্থ “দ্বীপ” – দ্বীপ থেকে আসা রস তাই ইনসুলিন।
মূল কথনঃ
পাঠক হয়ত ভাবছেন, দূর বাপু ব্যান্টিং কে তাই জানি না, তার আনন্দ আর
আশঙ্কার কথা একটুখানি বলেই খুলে বসলে সাতকাণ্ড রামায়ণ!
একটু ধৈর্য ধরুন, কথা দিচ্ছি এবার বলব সব একে একে!
ওই যে আগে বলেছি না ইনসুলিনের কথা, সেই হচ্ছে আসল অঘটন- ঘটন- পটিয়সী!
যেই না জানা গেল, প্যাংক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয় থেকে বেরোনো ইনসুলিনই হল
ডায়াবেটিসকে যুদ্ধে হারানোর একমাত্র অস্ত্র, দেশে দেশে অগ্ন্যাশয় থেকে
ইনসুলিন বের করার চলতে লাগল প্রাণপণ চেষ্টা।
ফিরে আসি এবার ব্যান্টিং এর প্রসঙ্গে – যাঁর পুরো নাম ফ্রেডরিক ব্যান্টিং ।
ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার থেকে যুদ্ধে আহত হয়ে কানাডায় ফিরে আসার পর সময়টা
ভালো যাচ্ছিল না ব্যান্টিং এর। নিজে ডাক্তার তিনি, কিন্তু পসার জমাতে পারছেন না
একেবারেই। অন্য নানা রকম চেষ্টা চালাচ্ছেন পেটের দায়ে, কিন্তু সাড়া মিলছে না
কোনোটাতেই। ভালো ছবি আঁকতে পারেন, তাই চেষ্টা করলেন চিত্রশিল্পী হিসেবে নাম
করার, কিন্তু সেখান থেকেও পাওনা হল শুধু অবসাদ।
এই সময় একদিন ব্যান্টিং দেখা করলেন ম্যাক্লিওডের সঙ্গে, ইচ্ছে তাঁর
ল্যাবরেটরিতে কাজ করার।
কে এই ম্যাক্লিওড জানেন? ব্যান্টিং এর সঙ্গে আর একজন যিনি নোবেল
পুরস্কার ভাগ করে নিয়েছিলেন ইনসুলিন আবিষ্কারের জন্যে!
আর সেটাই ব্যান্টিংএর আশঙ্কা ছিল! নোবেল প্রাইজ পাবার পরেও মনে তীব্র ঘৃণা
এই লোকটির ওপর!
কেন! বলছি আস্তে আস্তে, ধৈর্য রাখুন!

ব্যান্টিং তো এসে দেখা করলেন ম্যাক্লিওডের সঙ্গে, জানালেন যে তিনি পরীক্ষা
চালাতে চান পশুদের দেহ থেকে আলাদা করে ইনসুলিন বের করে মানুষের শরীরে
প্রয়োগ করার ব্যাপারে।
ব্যান্টিং এর কথা যেন শুনেও শুনলেন না ম্যাক্লিওড, এমনকি মুখ তুলে তাকালেনও
না বক্তার দিকে। একমনে একটা চিঠি পড়ে যেতে লাগলেন।
মনে ম্যাক্লিওডের তখন কী চলছিল জানা যায় না, কিন্তু পরে ল্যাবরেটরিতে কাজ
করার সুযোগ দিলেন ব্যান্টিং কে। তবে ব্যান্টিংএর ওপর সম্পূর্ণ আস্থা না থাকায়
একজন সহকারী ঠিক করে দিলেন। ছেলেটি সাইকোলজি আর বায়ো কেমিস্ট্রির
স্নাতক স্তরের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র, নাম চার্লস বেস্ট।
সময়টা ১৯২১ সালের বসন্তকাল।
বেস্টকে কোনোদিনই মেনে নিতে পারেননি ব্যান্টিং । কিন্তু কাজ শুরু করতে হল। সে
বছর সারাটা গরমকাল ধরে ঘাম ঝরালেন দুজনে। অজস্র পরীক্ষা চলল সুস্থ কুকুরের
প্যাংক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন বের করে ডায়াবেটিক কুকুরের ওপর প্রয়োগের
মাধ্যমে।
জমা হল অসংখ্য রিপোর্ট আর তথ্য।
ম্যাক্লিওড তখন ইউরোপে – গ্রীষ্মের ছুটি কাটাচ্ছেন। ব্যান্টিং চিঠি লিখলেন
তাদের পরীক্ষার আশাব্যঞ্জক ফলাফল জানিয়ে। কিন্তু ম্যাক্লিওড গুরুত্বই দিলেন
না সে ফলাফলের।
ছুটি শেষে ফিরে এসে একরাশ চোটপাট করলেন ম্যাক্লিওড, অজস্র ভুল ত্রুটি বের
করলেন ব্যান্টীং আর বেস্টের কাজের। হুমকি দিলেন যে এভাবে কাজ করলে টরেন্টো
ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট বন্ধ করে দিতে পারে।
ব্যান্টিং ও ছোড়নেওয়ালা নন। ম্যাক্লিওডের সঙ্গে তর্ক চালিয়েই যান- নিজের
কাজের ওপর অগাধ আস্থা তাঁর। বেশ বুঝতে পারছেন যে এগিয়ে যাচ্ছেন লক্ষ্যের
দিকে।
বাগবিতণ্ডা তুঙ্গে উঠল এই বছরেরই শেষ দিকে। ম্যাক্লিওড বাধ্য হলেন ব্যান্টিং
আর বেস্টের কাজকে বিজ্ঞানীদের সামনে মেলে ধরতে।
কিন্তু বেচারা ব্যান্টিং!
কনফারেন্সে নিজের কাজের প্রেজেন্টেশন করতে গিয়ে উত্তেজনায় নার্ভ ফেল
করল। পরে নিজেই সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে সাংবাদিকদের
জানিয়েছেন, যে ভালো করে মনে পড়ে না কী যে হয়ে ছিল তাঁর। শুধু মনে আছে সারা
শরীর যেন চলৎশক্তিহীন, জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে।
সুযোগের পুরোপুরি সদ্বব্যবহার করলেন ম্যাক্লিওড। পরিষ্কার ঝরঝরে ভাষায়
আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পরিবেশন করলেন তাঁর ল্যাবরেটরির কাজ – উপযুক্ত তথ্য
আর ফলাফলসমেত।
প্রশংসা আর অভিনন্দনের বন্যা বয়ে গেল। চারদিকে জয়জয়কার তখন
ম্যাক্লিওডের।

ব্যান্টিং ডুবে গেলেন গভীর ভাবনায়। মনে ভয় সেই তখন থেকেই, ম্যাক্লিওড না ভাগ
বসান তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতিতে!
আরো কাজ করতে হবে তাহলে! আরো পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে, যেখানে
ম্যাক্লিওডের কোনো ভূমিকা থাকবে না। ব্যান্টিং এক বিন্দু সহ্য করতে পারেন না
বেস্টকেও। কিন্তু উপায় নেই! সারাক্ষণ মনে হয়, যে কাজের জন্য স্বীকৃতি তাঁর
একলার পাওয়ার কথা, সেখানে ভাগ বসাচ্ছে কতকগুলো অযোগ্য অপোগণ্ড!
যাই হোক, সুযোগ এসে গেল অপ্রত্যাশিতভাবে।
১৯২২ সালের জানুয়ারি মাস।
১৪ বছরের লিওনার্ড থম্পসনকে তাঁর বাবা টরন্টোর জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে
আসেন, ছেলেটি ভুগছে দুরারোগ্য টাইপ-১ ডায়াবেটিসে। ফ্যাকাসে চেহারা ছেলেটার।
রোগা ডিগডিগে, সব চুল পড়ে গেছে, খালি চাইছে মরে যেতে।
১১ই জানুয়ারি বেস্টের বানানো ইনসুলিন ইঞ্জেকশন দেওয়া হল।
মনে আকাশছোঁয়া আশা ব্যান্টিং আর বেস্টের- কিন্তু ফল আশানুরূপ তো নয়ই, বরং
বেশ খারাপই। যদিও থম্পসনের রক্তে শর্করার মাত্রা ইঞ্জেকশন দেবার পর
কমেছে ২৫%, কিন্তু শরীরে টক্সিন কিটোনের পরিমাণ বেড়ে গেছে মারাত্মক
পরিমাণে। এছাড়াও ইঞ্জেকশন দেবার জায়গায় দগদগ করছে বিষাক্ত ঘা!
তাও হাল ছাড়লেন না দুই বিজ্ঞানী।
দু সপ্তা পরে ২৩শে জানুয়ারি আবার ইঞ্জেকশন দেওয়া হল থম্পসনকে।
আরে! এবার তো দারুণ কাজ দিল ইঞ্জেকশনটা! ওষুধ পড়ার পর থেকে রোগী বেশ
চনমনে, মুখ চোখ উজ্জ্বল, খেতে চাইছে। রক্তে শর্করার পরিমাণ বেশ কম, আর শুধু
তাই নয়, শরীরে বলতে গেলে কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই!
আশ্চর্য ব্যাপার তো! হলটা কী দু সপ্তার ভেতরে!
এই বার রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ এক হতভাগ্য নায়কের। আসল কাজটা করেও যিনি
কোনদিন স্বীকৃতি পেলেন না, পুরস্কার তো দূরে থাকুক!
তবে তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই বিজ্ঞানী, খ্যাতি বা যশের কোনো আকাঙ্খাই ছিল
না তাঁর!
তিনি হলেন জেমস কলিপ!
কী করেছিলেন তিনি যাতে ঘটল এই মির‍্যাকল!
ব্যান্টিং আর বেস্ট প্রথমদিকে সংগ্রহ করা ইনসুলিন একেবারে সরাসরি
বিশুদ্ধভাবেই (raw) প্রয়োগ করতেন। পরের দিকে শোধন করতেন অ্যালকোহল
দিয়ে। কিন্তু সঠিকভাবে সেই শোধনের কাজটা হচ্ছিল না বলেই মারাত্মকভাবে
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে শুরু করছিল।

কলিপই প্রথম সঠিক মাত্রার মানুষের শরীরের উপযোগী ইনসুলিন তৈরি করলেন।
এক বিরাট কাজ করেছিলেন কলিপ, যা আজকের দিনেও প্রযোজ্য! সঠিকমাত্রার
ইন্সুলিন মানুষের শরীরে প্রয়োগ। কম দিলে তো ক্ষতিই, বেশি দিলেও হঠাৎ করে
রক্তে চিনির পরিমাণ কমে গিয়ে হাইপোগ্লাইশেমিয়া হয়ে রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে
তৎক্ষণাৎ!
ফিরি আবার ব্যান্টিং এর কাহিনিতে। ব্যান্টিং এর এখন শত্রুর তালিকায় আর
একজনের নাম এসে জুটল। যদিও কলিপ নাম যশের ধার ধারেন না, কিন্তু ব্যান্টিং
এর সদা হারাই হারাই ভাব। এই বুঝি তাঁর পুরস্কার ফসকে যায়!
হতাশা গ্রাস করেছে ব্যান্টিং কে।
এমন সময় ম্যাক্লিয়ড তাঁর ল্যাবরেটরির গবেষণার ফলাফল ঘোষণা করলেন
ওয়াশিংটনে। সেটা জুন, ১৯২২।
তারপর ১৯২৩ সালে নোবেল পেলেন ম্যাক্লিয়ড আর ব্যান্টিং।

বেস্ট আর কলিপের ভাগ্যে জুটল না কিছুই। মাঝখান থেকে দুর্নীতি করে পুরস্কার
পেয়ে গেলেন ম্যাক্লিয়ড!
আজীবন ম্যাক্লিয়ডকে ক্ষমা করতে পারেননি ব্যান্টিং!
পুরস্কার পাচ্ছেন জেনে ব্যান্টিং অবশ্য বেস্টকে তাঁর পুরস্কারের অর্ধেক টাকা
দেবার কথা জানান। বেস্ট তাতে রাজি তো হনই না, বরং বিরক্তি প্রকাশ করেন।
বেস্ট আর ব্যান্টিংএর সম্পর্ক আজীবন তিক্ত ছিল।
রেষারেষি এমন পর্যায়ে গেল যে ১৯৪১ সালে ব্যান্টিং যখন এক যুদ্ধকালীন গুপ্ত
মিটিং এ যাচ্ছেন, বলেই ফেললেন সরাসরি যে তিনি যদি দেখেন তাঁর চেয়ারে বেস্ট
বসেছেন, তাহলে তিনি কবরেও শান্তি পাবেন না!

কিন্তু এমনই ট্রাজেডি, মিটিংএ যাবার সময় এক মর্মান্তিক প্লেন দুর্ঘটনায় প্রাণ
হারান ব্যান্টিং । তার বেশ কিছু বছর আগেই মারা গেছেন ম্যাক্লিয়ড। এই প্রজেক্টে
রইলেন শুধু দুজন, বেস্ট আর কলিপ।
বেস্ট এবার নিজ মূর্তি ধারণ করলেন। তিনি প্রচার করতে লাগলেন যে ইনসুলিন
আবিষ্কার আর প্রয়োগের কৃতিত্ব একমাত্র ব্যান্টিং আর তাঁর। কলিপের কোনো
অবদানই নেই।
বেস্ট আমেরিকায় এসে খ্যাতির শীর্ষে গেছিলেন। কিন্তু সেই মসনদে ওঠার সময়
কলিপের নাম একেবারে মুছে দিয়েছিলেন।
তবে শুধু কলিপ নয়, দুর্ভাগা ছিলেন আরো দুজন। যাঁদের কপালেও জুটতে পারত
নোবেল প্রাইজ।
একজন হলেন জার্মানির জর্জ জুয়েলজার আর অপরজন হলেন রুমানিয়ার পলেস্কু।
জুয়েলজার অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন বের করেছিলেন ব্যান্টিংএর দশ বছর আগে।
কিন্তু সেই সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডব, আর জুয়েলজার বিশুদ্ধ ইনসুলিন
ব্যবহার করার জন্যে আশানুরূপ ফল পাননি বলে বাইরের বিশ্বের কাছে তাঁর কাজ
প্রকাশও করেননি।
পলেস্কুর কাজ জানা গেল না কারণ রুমানিয়ায় তখন হলোকাস্টের তাণ্ডব।
যাই হোক, দীর্ঘ পরিক্রমার পর জীবজন্তুর শরীর থেকে নয়, ১৯৭৮ সালে মানুষের
শরীরের ইনসুলিন ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করলেন ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞানীরা।
ইনসুলিন প্রাণ বাঁচাচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের!
তবে একথা সত্যি যে বিজ্ঞানীদের মতে ইনসুলিনের ক্ষমতা ঐশ্বরিক হলেও এর
প্রয়োগে চাই সঠিক মাত্রা, চূড়ান্ত সাবধানতা আর ধৈর্য্য!
তথ্যঋণঃ
Levine, Israel E. (1959). The Discoverer of Insulin: Dr. Frederick G.
Banting. Copp Clark Publishing Company.
Rosenfeld, Louis (December 1, 2002). “Insulin: Discovery and
Controversy”. Clinical Chemistry. 48

Bliss, Michael (1982). The Discovery of Insulin. Chicago: University of
Chicago Press.
চিত্রঋণঃ অন্তর্জাল

One thought on “প্রবন্ধঃ কুশীলব যখন ইনসুলিনঃএক দীর্ঘ আবিষ্কারের নাটক – অদিতি ঘোষ দস্তিদার

  1. তথ্যসমৃদ্ধ সুন্দর লেখা,বড় ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *