ভ্রমণঃ মন ভোলানো পশ্চিম – ভূমিকা গোস্বামী

মন ভোলানো পশ্চিম
ভূমিকা গোস্বামী

অনেক বাধা অতিক্রম করে শেষপর্যন্ত বারোই আগস্ট এল। অনেক আগে থেকেই প্লেনের যাতায়াতের টিকিট কাটা, থাকার ব্যবস্থা করাই ছিল। সব প্ল্যানিং দিয়া আর দিয়ার বাবা নিতুর । আমরা দুজন বয়স্ক মানুষ। আজ ভাল তো কাল খারাপ। সাতদিন আগে তো রাধু বাবুর ধূম জ্বর। নার্সিংহোমে নিতে হয়েছিল। যদিও ভর্তি করতে হয় নি। দেখে ছেড়ে দিয়েছে। ভয়ে ভয়ে ছিলাম টিকিট ক্যানসেল করতে না হয়।
সকালে উঠে দেখি বাথরুমের গিজারটা দেয়াল থেকে খুলে ভেঙে ঝুলছে। আশ্চর্য ব্যাপার ! কি আর করবো! মেকানিক ডাকা হল । সে গিজারটা নিয়ে চলে গেল। বলে গেল – যদি সাড়াতে পারি ভাল। না হলে , নতুন কিনে নেবেন।
মনটা খারাপ হতে যাচ্ছিল– আবার কিছু টাকা গচ্চা। আবার ভাবলাম ― এত দূরের পথে যাচ্ছি– সব ফাঁড়া এই গিজার বস্তুটার ওপর দিয়েই যেন কেটে যায়।
কিছুক্ষণ পর মেয়ে জামাই নাতনি এল। জামাইকে দেখে তো মন খারাপ হয়ে গেল। চোখ মুখ বসে গেছে। ভীষণ ক্লান্ত । তিন দিন ধরে প্রবল জ্বরে ভুগছে ছেলেটা । আমাকে জানায়নি। চিন্তা করবো বলে।
ঈশ্বরের কৃপায় নিতুর আর জ্বর আসেনি। তবে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে। খেতে পারছে না ভাল করে।
আমরা বিকেল সাড়ে পাঁচটায় দুর্গা দুর্গা করে এয়ারপোর্টের দিকে যাত্রা করলাম। সাড়ে আটটার ফ্লাইট। এই সফরের প্রথমে আমাদের পুণে যাওয়া । এয়ারপোর্টে রাধুবাবুর জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করেছে আমার নাতনি কাম বেস্টফ্রেন্ড দিয়া।
ইন্ডিগোর এবার সুইট সিক্সটিন ইয়ার। সেই কারণে বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। চা ,কফি কোল্ড ড্রিংক ফ্রি। আমাদের ডিনারে অর্ডার অনুযায়ী খাবার দিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর এক্সট্রা আর এক প্যাকেট দিল ।
জানলা দিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে যাচ্ছি। আলোয় আলোময় আমার দেশ যেন বড় কোন ঝুলন – যেটা তাঁর সৃষ্টি। কখনো স্থল কখনো জলের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। কখনো মেঘ নিচে । হাত বাড়ালেই যেন আকাশ ছোঁয়া যাবে।
পুণে এয়ারপোর্ট সুন্দর সাজানো। আমরা লাগেজ নিয়ে বেরোতেই দেখি – আমার ছোট ছেলে অনিন্দ্য অত রাতে গাড়ি ড্রাইভ করে এসে পড়েছে।

পুনে এয়ারপোর্টে


আমরা সবাই ওর ফ্ল্যাটে এলাম। IISER ক্যাম্পাসের মধ্যে ষোলশো স্কোয়ার ফিটের বেশ বড় সুসজ্জিত ফ্ল্যাট।প্রসঙ্গত বলি, অনিন্দ্য IISER
এর অঙ্কের প্রফেসর। আমরা সে রাতে জল আর সুগারফ্রি কাজু কাটলি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় গাড়ি এসে গেল। আমার ছেলে বৌ নাতনিসহ আমরা আটজন মহাবালেশ্বর দর্শন করতে বেরিয়ে পড়লাম।
১৩ই আগস্ট । গাড়ি ছাড়ল সাড়ে সাতটায়। অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। আগস্ট মাসে প্রকৃতি মহারাষ্ট্রকে মনের মাধুরী দিয়ে অপূর্ব সুন্দর করে সাজায়। চারদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। মাঝে মাঝে ঝর্ণা আর নদী। অনিন্দ্য স্যান্ডউইচ বানিয়ে নিয়েছিল। নেহা (অন্বেষা)শুকনো খাবারও সঙ্গে নিয়েছিল। গাড়িতে বসে সেগুলোর সদ্ব্যবহার ও পাশাপাশি সবাই মিলে গান গাইতে গাইতে চলেছি। মাঝখানে কয়েকবার নেমে চা কফি স্ন্যাক্স খাওয়া হল। এখানে শীর্ণকায় ক্ষুধার্ত ছোট্ট একটা কুকুর আমাদের কাছে দৌড়ে এল। নেহা তাকে পর্যাপ্ত কেক বিস্কুট পাওরুটি খাওয়ালো। পেটভরে যাওযার পর ও চলে গেল। দোকানদারকে বললাম – বাসি রুটিও তো দিতে পারেন ওদের। কত খিদে ছিল বলুন তো এই ছোট্ট প্রাণীটার !
বেলা দেড়টায় ভাল একটি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে আবার গাড়িতে উঠলাম।
আমারা পঞ্চগোনি শ্রীক্ষেত্র মহাবালেশ্বর পৌঁছোলাম বিকেলে। এখানে সাড়ে সাতটায় সন্ধে হয়। পুজো দিয়ে আসতে আসতে সন্ধ্যা নামলো।
ঐতিহাসিক বহু পুরোনো এক মন্দির। এখানে আমাদের প্রাণ গৌর –শ্রীচৈতন্যদেব এসেছিলেন। নারায়ণ তাঁর দুই স্ত্রী ভূদেবী ও শ্রীদেবীকে নিয়ে বিরাজ করছেন। নিচে সোনার মতো ঝকঝক করছে একক কৃষ্ণ। বাঁশি হাতে ত্রিভঙ্গমুরারী। পাশে শিবলিঙ্গ । তার পাশে জগতমাতা। মাঝখানে জলাশয়।চারদিকে পাথরের পথ দিয়ে খুব সাবধানে যেতে হয়। বাবু (মন্দিরা )অম্পা (অনিন্দ্য) আর দিয়া আমাকে সবসময় সাবধান করে নিয়ে গেছে।
পুজো দিয়ে অত্যন্ত আনন্দ ও শান্তি পেলাম।
বাড়িতে এসে ডিনার করে শুয়ে পড়লাম সবাই। আমরা অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলাম। কিন্ত খুবই আনন্দিত ছিলাম। শুতে শুতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন ১৪ই আগস্ট। এই দিন আমি বাড়িতেই থাকলাম। তিতলির সঙ্গে খেলা করলাম। গল্প গান আড্ডা দিলাম পরিবারের সঙ্গে। সকালে একবার দিয়া আর তিতলি অনিন্দ্যর সাথে বাজারে গিয়েছিল। ইলিশ মাছ আর পাবদা মাছ নিয়ে এসেছে। মন্দিরা ভাপা ইলিশ রান্না রাঁধল। ব্রেকফাস্টের পর সবাই IISER ক্যামপাস দেখতে গেল। ওখানে সুপার কম্পিউটার ‘পরম ব্রহ্ম’ দেখে ওরা খুব খুশি।
খাওয়ার পর সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি আর নেহা গল্প করতে করতে বিকেল হয়ে গেল। নেহা চা করে সবাইকে ডাকতে লাগল।
সন্ধের পর আমি মন্দিরা নিতু ক্যামপাসের মধ্যে ই ঘুরতে গেলাম। তিতলি আমাদের গাইড।গোলাপ বাগান, পদ্ম বাগান, পার্ক ,টেনিস খেলার মাঠ,ভলিবল খেলার মাঠ। ঘুরে দেখলাম। দারুণ সুন্দর সুন্দর বিভিন্ন রংয়ের গোলাপ আর পদ্ম দেখে ফিরে এসে তিতলির সাথে দাবা খেললাম। এত ছোট বয়সে দুর্দান্ত খেলে। অনেক কষ্ট করে ওকে হারাতে হয়েছে। আজ বেশী রাত করা যাবে না। ভোর বেলা তিতলি সোনাকে বাঙালি শাড়ি গয়নায় সেজে স্কুলে যেতে হবে।বাঙলার বিশেষত্ব নিয়ে কিছু বলতেও হবে।
১৫ই আগস্ট ভোর থেকেই তিতলিকে সাজাতে শুরু করেছে নেহা মন্দিরা আর দিয়া। তারপর স্কুলের গাড়ি এলে দিয়া আর অনিন্দ্য ওকে তুলে দিয়ে এল। আমি স্নান সেরে বাড়িতে শিবপুজো করলাম। শ্রাবণের শেষ সোমবার। তিতলি স্কুল থেকে ফেরার পর আমরা সবাই মিলে সোমেশ্বর শিব মন্দিরে গেলাম। নয়শো বছরের পুরনো বিশাল বড় মন্দির। এই মন্দিরে শিবাজী তাঁর মাকে নিয়ে আসতেন। বিশাল লাইন। শ্রাবণের শেষ সোমবার বলে কথা ! পুজো দিয়ে আসার পর নেহা আমাদের একটি ইটালিয়ান বড় রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল। নাম -রসোবিয়াস্কোর ইটালিয়ান কুইসিন। নিরামিশ বিভিন্ন পদ আছে। বিভিন্ন রকম পাস্তার আইটেম আছে। আমরা সেখানে মধ্যান্নভোজন সেরে ওয়েস্ট এন্ড শপিং মলে গেলাম। মন্দিরা নিতু দিয়া ওরা শনিবার বারা ইত্যাদি দেখতে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর ওরাও মলে চলে এল। সবাই মিলে খুব মজা করে মলটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দিয়া আর অনিন্দ্য গেম খেলল।রাতে বাড়ি ফিরে সব কিছু গুছিয়ে নিলাম। পরের দিন ১৬ই আগস্ট ৭টা১৫মিনিটে পুনে স্টেশন থেকে ডেকান এক্সপ্রেস ধরতে হবে। রাত থাকতেই উঠতে হবে। গাড়ি ঠিক করা হল দুটো। তিতলিসোনাকে রাতেই আদর করলাম অনেক। আমরা যখন বেরোবো তখন ওর মাঝ রাত।
ভোর ৫ টায় চা খেয়ে গাড়িতে উঠলাম। তখনও রাত আছে । এখানে সকাল দেড়িতে হয়। নেহা আমাদের জন্য ব্রেকফাস্ট দিয়ে দিল। স্টেশনে পৌছে নিতু রাধু বাবুর জন্য হুইল চেয়ার আর মালপত্র সহ আমাদের সকলের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করল। যথা সময়ে ট্রেন এল। এসি চেয়ার কারে উঠে পড়লাম। জানলা দিয়ে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে চললাম।

ইন্ডিয়া গেট, মুম্বাই


ট্রেন আড়াই ঘন্টা লেটে মুম্বাই পৌঁছল। সেখান থেকে একটা বড় গাড়িতে আর বি আই অফিসার্স কোয়ার্টার। কিছু ফর্মালিটিস্ এর পর আমরা ফ্ল্যাটে এলাম। খুবই সুন্দর ফ্ল্যাট। সমস্ত সুবিধা আছে। ওখানেই ক্যান্টিন । সকলের ব্যবহার অত্যন্ত ভাল। খুব সাহায্য করেছে ওরা। ট্রেনে অতক্ষণ বসে থাকার জন্য রাধু বাবুর পা ফুলে ঢোল। উনি মুম্বাইতে কোথাও বেরোননি।ওঁর ওষুধ ভাগে ভাগে গুছিয়ে আমরা বেরোতাম। ক্যান্টিনের ছেলেরা সময়মত খাবার চা দিয়ে যেত। মাঝে মাঝে খোঁজ খবরও নিত। তিনটে দিন খবরের কাগজ পড়ে টিভি দেখে আর ঘুমিয়ে ওঁ সময় কাটিয়েছেন। ইনটারনাল ফোন ছিল ঘরে। ফোন করলেই কেউ না কেউ চলে আসতো। ওদের ভরসাতেই ওঁকে রেখে যেতে পেরেছি আমরা। তবে ও একা ছিল না সঙ্গে মন্দিরার গোপাল ছিল । টেবিলের ওপরে সুন্দর আসনে সেজেগুজে তিনি বিরাজ করছেন।
আমাদের পায়ে তো তখন সর্ষে। ১৭ই আগস্ট সকাল সকাল ঘরেই চা বানিয়ে খেয়ে তৈরী হয়ে বেড়িয়ে পড়েছি । উদ্দেশ্য এলিফেন্টা কেভ। ইন্ডিয়া গেট উল্টোদিকে তাজ হোটেল। সেখানে ফটো তোলা হল। ওখান থেকেই লঞ্চ ছাড়ে । অপেক্ষা করছি। বেশ কিছুক্ষণ পর জানতে পারলাম গত সাতদিন ধরেই লঞ্চ বন্ধ আছে। আরব সাগরের জলের স্রোত বেশী থাকার কারণেই এই সিদ্ধান্ত। দিয়ার মন খারাপ। কি করা যায়! নিতু সাইট সিইং এর টিকিট কাটল। কাছাকাছি রেস্টুরেন্টে দক্ষিণী ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা লাক্সারি বাসে উঠলাম। গাইড আমাদের জুহু বিচ , লতা মঙ্গেসকরের বাড়ি, শাহরুখ খানের বাড়ি, রেখার বাড়ি, সলমন খানের বাড়ি দেখাতে দেখাতে নিয়ে চলল। বাস থামিয়ে মহালক্ষ্মীর মন্দির , সিদ্ধি বিনায়কের মন্দির, ইলেভেন ডি শো , মিউজিয়াম এমন অনেক কিছুই দেখিয়েছে। তবে ইলেভেন ডি কোনদিন ভুলবো না। সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা। এযেন মার্কন্ড মুনির মায়া দর্শন। নিজের চেয়ারে বসে জলজ জীব ঠুকড়ে দিচ্ছে পায়ে। জল ছিটকে গায়ে এসে পড়ছে। আকাশে ওড়া বড় বড় পাখি মাথায় ঠোক্কর মারছে। এ্যামেজিং।
রাতে খুব সুন্দর পারসি রেস্টুরেন্টে ডিনার করে ফ্ল্যাটে ফিরলাম।

এলিফেন্টা কেভ, মুম্বাই
এলিফেন্টা কেভ, মুম্বাই
মেরিন ড্রাইভ, মুম্বাই


পরের দিন ১৮ই আগস্ট নিতু ফোনে জানতে পারল লঞ্চ চলছে। আমরা চটপট তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
লঞ্চে গিয়ে একদম মুখের কাছে গিয়ে বসেছি। বেশী লোকজন নেই। কিছুপরে চারপাঁচজন মহিলা উঠল।তাদের পোষাক অদ্ভুত রকমের। আমাদের পাশে এসে বসল। দিয়া লঞ্চে সাজানো দোকান থেকে বেশ কয়েকটি চিপস্ নিয়ে এল। আমরা চিপস্ খেতে খেতে সমুদ্রের বুকে যাত্রা করছি। সামনে পাহাড়। ওই মহিলারা আরবি ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। ওরাও চিপস্ নিয়ে এল। ধীরে ধীরে আলাপ হল। ওদের মধ্যে অল্প বয়সী মেয়েটা আমাদের সাথে কথা বলছিল। সাদা ধবধবে রং। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সাদা পোষাকে ঢাকা।ওরা দুবাই থেকে এসেছে। সব কাজিন বোন একসাথে ।ওদের দেখাশোনার জন্য একটি চাকর গোছের পুরুষ আছে। মেয়েটির বাবা ব্যবসার কাজে মুম্বাই আসতো প্রতিবছর। মেয়েটিও সঙ্গে আসতো। বাবা মারা যাবার পর ও একাই প্রতি বছর আসে। বলছিল― আই লাভ মুম্বাই। আমি ওর নাম জিজ্ঞেস করলাম । ওদের ভাষায় কি এক নাম বলল। আমি ওর নামের মানে জানতে চাইলাম। ও বলল ― মারমেইড। বললাম ― বাংলায় তোমার নামের মানে মৎস্যকন্যা। তুমি দেখতেও সেইরকম সুন্দর।শুনে কি যে খুশি হল কি বলবো ! বেশ কয়েকবার আওড়ে নিল। তারপর ওর বোনেদের ডেকে ডেকে বলতে লাগল ― মৎস্যকন্যা… মৎস্য কন্যা।
ও দিয়াকে আমার আর দিয়ার সম্পর্ক জানতে চাইল। গ্র্যান্ডমা শুনে ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলল― ইতনি ছোটী ? তারপর ডান হাতের পাঁচ টি আঙুল নিজের থুতনি ধরে বলল ―বিউটিফুল!
ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে আমাদের সবাইকে দিল। আমরা না নিয়ে পারিনি। ওই বিদেশিনী মহিলা ততক্ষণে আমাদের আপনজন হয়ে গেছে। উপলব্ধি করলাম― ঋষিবাক্য ―বসুধৈব কুটুম্বকম্ কথাটি পুঁথির পাতা থেকে উঠে বাস্তব রূপ পেয়েছে।

হাজী আলি দরগা, মুম্বাই


লঞ্চ থেকে নেমে একটি গাড়ি আমাদের চড়ের মতো শহরে নিয়ে গেল। প্রচুর দোকান পাট , রেস্টুরেন্ট । সেখানে লাঞ্চ সেরে আমরাএকশো কুড়িটা সিঁড়ি ভেঙে এলিফেন্টা কেভে গেলাম। অপূর্ব সুন্দর সব ভাষ্কর্য। কিছু কিছু ভেঙে গেছে। বিশাল বড় বড় সব মূর্তি যে শিল্পীরা বানিয়েছেন মনে মনে তাঁদের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম।
ইন্ডিয়া গেটের সামনে যখন ফিরলাম তখন শেষ বিকেল। দেখলাম নারী ,পুরুষ, শিশু সহ প্রচুর জন সমাবেশ। সবাই বেরাতে এসেছে। সেখান কিছুক্ষণ থেকে ক্যাবে করে হাজী আলী বাবার দরগায় গেলাম । দারুণ সুন্দর পবিত্র স্থান।দোকানি একটা ডালা দিল। তাতে চাদর ফুলের মালা নকুল দানা আর রঙিন ধাগা। সকলে মাথা ঢেকে সেখানে যেতে হয়। আমরাও সবাই সেই নিয়ম মেনে ভেতরে প্রবেশ করলাম। পুজো দিলাম। ধাগা বাঁধলাম। ঘুরেফিরে চারদিকটা দেখে। ক্যাব নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম। তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। ক্যান্টিনে ডিনার করে আমরা ঘরে এসে গোছাতে শুরু করলাম। আজই মুম্বাইয়ে আমাদের শেষ রাত। গোছাতে গোছাতে রাত বারোটা হয়ে গেল।
মুম্বাই থেকে গোয়ার পথে চলেছি। পাঁচটা দশে জনশতাব্দী এক্সপ্রেস ট্রেন। তিনটেতে উঠে রেডি হয়েছি।আর বি আই এ দুটো ট্যাক্সি রাতে থাকে- তাদেরকে নিয়েই স্টেশনে এলাম আমরা। স্টেশান থেকে ব্যাটারি কারে ভিস্টাডোম কোচের কাছে এলাম। উঠে তো অবাক। চারদিকে কাচে ঢাকা। নির্দিষ্ট সিটে বসে আরও অবাক ! সিটের হাতল তুলতেই টেবিল বেড়িয়ে এল। বাঁদিকের রডে চাপ দিতেই সিট ঘুরে গেল । পাশের কোন নবে চাপ দিতেই বসার সিট আধ শোয়া হয়ে গেল। দুটো সিটের মাঝে আবার ফোনে চার্জ দেওয়ার প্লাগ।
এসব আমার দিয়া আবিষ্কার করছে। ওর উৎসাহ আর উদ্দোগেই এতবড় জার্নি করার সাহস পেয়েছি। বড় বড় জানলা দিয়ে প্রাকৃতিক শোভা দেখছি। ছত্রপতি শিবাজী স্টেশন ছাড়িয়ে ট্রেন গোয়ার দিকে কিছুটা যেতেই পাহাড় ঝর্না আর সবুজের সমারোহ। বড় বড় কাঁচের জানলা দিয়ে প্রাকৃতিক অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য। কোনখানে মেঘ আমাদের সমতলে– কখনও মেঘ পাহাড়ের নিচে , কখনও মাঝে , কখনও পাহাড়ের মাথায় সাদা মেঘ। মনে হচ্ছে শত শত সদ্য ধরানো উনুন থেকে ধুঁয়ো উঠছে গলগল করে। মাঝে মাঝে টানেলের ভেতর দিয়ে চলেছে ট্রেন।পাহাড়ের গায়ে জাল দেওয়া আছে। ধ্বস এড়াতে হয়তো এই ব্যাবস্থা।
আমরা ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ থেকে উঠেছি। মাডগাঁও
পর্যন্ত যাত্রা। নিতু বলল ―পিছনের দিকে গিয়েছেন ? আমি বললাম ― না তো !
― গিয়ে দেখুন একবার।
ওরে বাবা ! এ কি বিস্ময় ! কিছুক্ষণ কোন কথা বলতে পারিনি। পুরো তিনদিক দৃশ্যমান। পাহাড় আর নদী । দুপাশে নদী মাঝখানে ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্রেন ছুটছে। আকাশে আজ নানা রংয়ের মেঘের খেলা। ট্যানেলের ভেতর যাওয়ার সময় অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে ট্যানেলের মুখটা দেখা যাচ্ছে।
একা একা সুখে আনন্দ পাই না। তাড়াতাড়ি গিয়ে রাধুবাবুকে ধরে আনলাম। নিতু ওঁর বসার ব্যবস্থা করে দিল। দেখতে থাকলাম আমরা। দেখতেই থাকলাম ……..
স-ব কিছুর একটা শেষ আছে। আমাদের এই ট্রেন যাত্রাও এক সময় শেষ হল। মাডগাঁও স্টেশনে নামলাম। আজ জন্মাষ্টমী। আমার মন্দিরার আর রাধু বাবুর উপবাস। দিয়া বড় একটা গাড়ি বুক করলো।গাড়িতে উঠে বসলাম। সূর্য তখন তাঁর তেজ হ্রাস করে শান্ত। পশ্চিম দিকে ঝুঁকেছে। আমরা চলি, সেও চলে পাশেপাশে। একসময়ে লাফাতে লাফাতে মান্ডবি নদীতে ডুবে গেল। সন্ধে নামলো।
রাত প্রায় নটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম নর্থ গোয়ার ‘এরিয়া ডি গোয়া’এ্যাপার্টমেন্টে। আমাদের লাগেজ নামাচ্ছে ড্রাইভার। আমরাও নেমেছি। এমনসময় উর্দি পরা একজন বৃদ্ধ দারোয়ান আমাদের দিকে চোখ বুলিয়ে নিজের বুক সমান মাপ দেখিয়ে বলল― ‘আওর এক ছোটা ল্যারকা হ্যায় না আপকা সাথ ?” আমি আর মন্দিরা চোখ চাওয়া চাওয়ি করছি। যে আছে। যার জন্মদিন করবো আমরা আজ রাতে। সে তো মন্দিরার ব্যাগের মধ্যে বসে আছে। তাকে এই বৃদ্ধ কিভাবে দেখলো !
বুদ্ধি দিয়ে সব কিছু বিচার করা যায় না। আমরা স্নান সেরে আসতে আসতে দিয়া বাসমতি চাল, তেল সবজি ,মাখন ,ব্রেড সব অন লাইনে এনে ফ্রিজ সাজিয়ে ফেলেছে। আমরা ইনডাকসানে চা করে সবাই খেয়ে,আলু ছাড়িয়ে ছোট ছোট করে বানিয়ে প্রেসারে বসিয়ে দিলাম। সাথে লবনও দিলাম । দুটো সিটি পড়তেই নামিয়ে নিলাম। এদিকে মন্দিরা টিভির নিচের বড় টেবিলে সাজিয়ে গুজিয়ে ওর গোপাল সোনাকে বসিয়ে দিয়েছে। মুম্বাই থেকে আনা প্যাঁড়া আর আলু দেওয়া অন্ন মাখন দিয়ে গোপালের ভোগ লাগালাম। ফুল তুলসী ছাড়াই পুজো করলাম। গান করলাম। তিনি তো দুর্যোধনের ছাপ্পান্নভোগ ফেলে বিদুরানির ঘরে ভালবাসায় কলার খোসা আনন্দ করে খেয়েছিলেন। আজ আমাদের ঘরে সেদ্ধ ভাত খেলেন। সেই প্রসাদের যে কি স্বাদ বলা যাবে না। আমাদের নিতু মাছ মাংস ছাড়া একদিন ও খায় না। ও পর্যন্ত তৃপ্তি করে খেল। আর বলল ― আহা ! যেন অমৃত খেলাম। পরেরদিন ২০ শে আগস্ট সকালে মন্দিরা অনেক কিছু রান্না করলো। ধনেপাতার বড়া ,পনিরের তরকারি মাসরুম । বেলা তিনটের সময় গাড়ি এল। আমরা আমভিম বিচ, আরামপোল বিচ , পাঞ্চিম ঘুরে রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরলাম।রান্না করাই ছিল। মাইক্রোওভেনে গরম করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। আমাদের গাড়ির চালক খুবই মিশুকে। অনেক গল্প করলো। আমাদের সাথে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গেল।পরেরদিন ২১শে আগস্ট ওই আবার এল সাউথ গোয়া ক্যাথলিক চার্চ , মিরামোর বিচ , মিউজিয়াম, অঞ্জুলা বিচ, পারারা রোডের ওপর পারারা মারানি তে নেমে অনেক ফটো তোলা হল। মারানি শব্দের অর্থ নারকোল। সুন্দর রাস্তা দুপাশে নারকোল গাছ । অপূর্ব সুন্দর । বাগা বিচে আবার এলাম। ঘুরলাম । সমুদ্রের উত্তাল জল পায়ে আছড়ে পড়ছে। বিভিন্ন বিচ থেকে নানা রকম ঝিনুক কুড়িয়েছি।


২২শে আগস্ট আমি আর রাধুবাবু কোথাও যাই নি। মন্দিরা পোস্তর বড়া আর যা কিছু সবজি ছিল রান্না করলো। তারপর মন্দিরা আর দিয়া সুইমিংপুলে খুব ঝাপাঝাপি করলো নিতু পাড়ে বসে ওদের ফটো তুলছিল। আমি একবার নিচে নেমে গিয়ে দেখে এলাম। খুব ভাল লাগছিল ওদের দেখে। দুপুরে খাওয়ার পর নিতু ,দিয়া মন্দিরা বেরোলো। বাগা বিচে কিছুক্ষণ থেকে দিয়া হাতে ছোটো একটা ট্যাটু করে ফিরে এল।
২৩শে বিকেলে আমাদের ফ্লাইট।এগারোটা নাগাদ বেরোতে হবে। গোছগাছ করে খেয়ে দেয়ে তৈরী হয়ে নিলাম। সাহিল মানে আমাদের চালক চলে এল। আমরা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। তিনদিনে সাহিল আমাদের আত্মীয় যেন। এয়ারপোর্টে নেমে রাধুবাবুকে জড়িয়ে ধরলো। ওকে ছেড়ে আসতে আমাদের কষ্ট হচ্ছিল। বুঝতে পেরেছি –ওরও সমান কষ্ট হচ্ছিল। আবার সেই ঋষিবাক্য সামনে এসে দাঁড়ালো। বসুধৈব কুটুম্বকম্।

One thought on “ভ্রমণঃ মন ভোলানো পশ্চিম – ভূমিকা গোস্বামী

  1. অসাধারণ। চোখের সামনে এই ট্যুর এর প্রত্যেকটা দৃশ্য আবার ভেসে উঠলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *