গল্পঃ কীট দংশন – সুলেখা আক্তার শান্তা (বাংলাদেশ)

কীট দংশন
সুলেখা আক্তার শান্তা

অনন্ত কাল ধরে বাঙালি সমাজের ইচ্ছা একান্নবর্তী পরিবার। রক্তপিণ্ড থেকে মানুষ করে তোলা সন্তানদের নিয়ে একসঙ্গে থাকার প্রবল বাসনা। ভরপুর থাকবে সংসার। মৃত্যুর সময় একত্রে সব সন্তানের মুখদর্শন করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন। এমনই ইচ্ছের বাসনা হয়। বাবা-মা নাম রেখেছে জোনাকি। অন্ধকারে ফুটে ওঠা জোনাকির আলোর মতোই তাঁর রূপ। বিয়ে হয় সরকারি চাকুরের সঙ্গে। ঘরভরা সন্তান। দুই পুত্র পাঁচ কন্যা। সন্তানরা বড় হয়। একে একে কন্যাদের বিয়ে হয়। জোনাকি বেগমের স্বামীর মৃত্যু হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর সংসার বৈতরণী পার করতে লাগলেন দুই পুত্রকে আঁকড়ে ধরে। সময়ের স্রোত এগিয়ে চলে। ইচ্ছা পূরণ জীবনের সংঘাত কখনো হয়ে ওঠে বিষাদময়। সংগ্রামে চলতে থাকে জীবন। সব কিছুই সামাল দিতে হয় জোনাকিকে। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ তৈরি করে বাড়তি চাপ। বড় ছেলে সেলিমের উপর চাপটা একটু বেশি প্রত্যক্ষকরণ। বৈষয়িক উদাসীন স্বভাবের সেলিম ভবিষ্যৎ আর্থিক প্রয়োজন সংকলনের কোন প্রস্তুতি ছিল না। সেলিম মেধাবী উচ্চ শিক্ষার্থে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানে সে ব্যর্থ হয়।
বড় ছেলে সেলিম উদাসীন আর ছোট ছেলে রহিম কর্মঠ। পৃথিবীর সবাই এক প্রকৃতির হয় না। তেমনি সেলিম আর রহিম। এক ভাই আরেক ভাইয়ের দোষ ক্রটি মেনে নিয়েই সংসার এগিয়ে নেয়। জোনাকি দুই ছেলেকে বিয়ে করান। সংসার বড় হয় বাড়তে থাকে সংসারের প্রয়োজন আর খরচ। জোনাকির যৌথ পরিবারের সংসার তিনি আদর্শ নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। সেলিম সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে হাত পাততে হয় ছোট ভাই রহিমের কাছে। কালের বিবর্তনে স্বার্থের অনুভূতি তখন ভাতৃত্বের বন্ধনকে শিথিল করে ফেলেছে। মুখ্য হয়ে ওঠে লেনদেনের বাস্তবতা। রহিম প্রয়োজনীয় টাকা দিতে রাজি। কিন্তু তার বিনিময়ে বড় ভাইয়ের বসতবাড়ির প্রাপ্য অংশ ছোট ভাই রহিম নামে লিখে দিতে হবে। এমন প্রস্তাব সেলিমের জন্য ছিল মর্মান্তিক। রহিম বলেন, টাকার জন্য বিক্রি নয় সম্পত্তি বন্ধক রাখবে। রহিম স্ত্রী রেহেনার প্ররোচনায় বন্ধকীর কাগজপত্র তৈরি করতে গিয়ে এমন ভাবে লিখে নেয় যাতে নির্দিষ্ট সময় পর সেলিম সম্পত্তির মালিক সে হয়ে যাবে!
সময় গড়িয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক সংকট বাড়তে থাকে। দুই ভাইয়ের সংসার আলাদা হয়ে যায়। মায়ের মৃত্যু ঘটে। পারিবারিক দ্বন্দ্ব আরও গভীর হয়। সেলিমের একসময় মোটামুটি আর্থিক অবস্থা ভালো হয়। সেলিম বসতভিটার বন্ধকী ঋণ পরিশোধ করে তার সম্পত্তির সীমানা নির্ধারণ করতে চায়। বসত ভিটার সীমানা নির্ধারণের প্রশ্ন উঠতেই রহিম জানিয়ে দেয় এই সম্পত্তির সম্পূর্ণটার মালিক সে। সেলিম এমন কথা শুনে চমকে উঠে! সেলিমের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। চোখে অন্ধকার দেখে সে। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একি নিষ্ঠুর প্রতারনা তাও আবার আপন ভাইয়ের কাছ থেকে। বন্ধকী ঋণের চুক্তিতে লেখা আছে এক বছরের মধ্যে গৃহীত ঋণ পরিশোধ করা না হলে ঋণদাতা সম্পত্তির মালিক হবে। সেলিম বলেন, এমন কোন অঙ্গীকার সে করেনি! তাঁর সরলতার সুযোগ নিয়ে চুক্তিতে কথাটি লেখা হয়েছে। কথা কাটাকাটি আর কলহে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চরমে ওঠে! বাদানুবাদের একপর্যায়ে মনের দুঃখে বড় ভাই সেলিম গুরুতর একটি কথা বলে ফেলে। বুক ফাটা কষ্ট নিয়ে দুঃখের সঙ্গে কথাটি বলেন সে।
-তুই যদি মিথ্যা কথা বলিস তোর মুখের পোকা পড়বে! আর কোন কথা না বলে, সেলিম পরিবারসহ বাড়ি ছেড়ে চলে যান। পরিবার নিয়ে দুর্দশায় তার দিন পার হয়। ভাই হয়ে ভাইয়ের সঙ্গে বেইমানি মেনে নিতে পারেনা সেলিম। নিজের আপন জনের কাছে থেকে যদি নিজের প্রতারিত হতে হয় মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! নিজের অস্তিত্বকে কিভাবে সে খুঁজে পাবে! হয়ে পড়বে সে দিশে হারা পথের পথিক! না আমি যে ব্যথায় ব্যথিত সে ব্যাথায় অন্য কেউ যেনো আপনজনের কাছ থেকে ব্যতীত না হয়। তাই আমার আশা। দুই ভাই দুই ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। ভাই ভাইয়ের সঙ্গে চেনা পথ অচেনা হয়ে থাকে।
সময় পরিবর্তিত আর জীবন পরিণত হতে থাকে। আসে বার্ধক্য। রোগ ব্যাধি জরায় আক্রান্ত হয় দেহ। রহিম অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জানা যায় সে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত। জিভের ছোট্ট ক্ষতস্থানে ক্যান্সার বাসা বেধেছে বুঝতে পারেনি সে। দেশে বিদেশে যথাসাধ্য চিকিৎসা হয়। পরিশেষে চিকিৎসায় মুখগহবর থেকে সম্পূর্ণ জিভটি অপারেশন করে বাদ দিতে হয়। রহিম কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলে। ক্যান্সার চিকিৎসার বিশেষ পদ্ধতি রেডিওথেরাপি। ক্যান্সার আক্রান্ত স্থানের দেহকোষ গুলি মরণ রশ্মির মাধ্যমে মেরে ফেলা হয়। এতে আক্রান্ত জীবকোষ ছাড়াও ভালো জীবকোষ মরে গিয়ে আক্রান্ত স্থানে অনুভূতিহীনতা সৃষ্টি হয়। মুখের ক্যানসার হওয়ার কারণে সব সময় রহিমের মুখ হা হয়ে থাকে। তাই চিকিৎসকরা এজন্য বিশেষ সতর্কতাঃ গ্রহণ করতে বলেন যাতে মশা মাছি থেকে আক্রান্ত স্থান রক্ষা করা যায়। মশা মাছি বসার সুযোগ পেলেই ডিম পাড়বে এবং ডিম থেকে শুক্রকীট জন্ম নেবে। অসতর্কতার কারণে রহিমের ক্ষেত্রে ঘটে যায় সেই ভুলটি। একদিন রহিমের স্ত্রী রেহেনা আতঙ্কিত হয়ে বিষয়টি লক্ষ্য করে। সে দেখতে পায় রহিমের মুখ থেকে জীবন্ত কীট বেরিয়ে আসছে। রহিম যাতে দেখতে না পায় সেজন্য রেহেনা তার শাড়ীর আঁচলে সেটি লুকিয়ে ফেলে। কতদিন এভাবে লুকিয়ে রাখা সম্ভব একদিন রহিমের চোখে পড়ে বিষয়টি। এবং তার পরদিন রহিম মৃত্যুবরণ করেন। রহিমের স্ত্রী রেহেনার কানে বড় ভাইয়ের কথা আজও বাজে। ‘মিথ্যে কথা বললে তোর মুখে পোকা পড়বে।’ সে ভাবে ঘটনাটি কি বড় ভাইয়ের অভিশাপের পরিণতি হলো! নিজের পাপে নিজেকে শেষ করে। মানুষের লোভের কাছে মনুষ্যত্ব হারিয়ে যায়। কখনো কখনো ন্যায়-নীতির আদর্শ থেকে তারা দূরে সরে যায়। নিজেকে লোভের কাছে জিম্মি করে ফেলে, ভেবে দেখেনা। এতে যে অপরাধের কারণে একদিন নিজেকেই দাঁড়াতে হবে অপরাধের কার্ড গড়ে। সেই বোঝার বাহক হিসেবে নিজেকেই বইয়ে বেড়াতে হবে বোঝা। বোঝার ঘানি এতই ভারী হবে সেখানে নিজে ছাড়া হবে না অন্য কেউ বাহক। তারপরও আমরা সব জেনে মিথ্যা লোভ লালসার কাছে বন্দী হয়ে পড়ি। পারিনা সেখান থেকে নিজেকে বের করতে। কখনো কারো এমন হয় নিজে কি করলাম তার অনুভূতি ভাব জাগ্রত হয়। নিজেকে শোধরানোর চেষ্টা করেন। কেউ লোভের কাছে এমনই জিম্মি হয় সত্যিই ভাবটাকে জাগ্রত হয় না তাদেরই সেই ভোগান্তি পোহাতে হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *