শব্দ ও শূন্য-গান
অনিরুদ্ধ সুব্রত
আমার কতগুলো কথা খুঁজে পাচ্ছি না
ভেবেছি, তোমার কাছে, রেখেছি কি
খুব করে শব্দ গুলো খুঁজেছি, যদিও আবার ভুলেছি…
ভাবছি সত্যিই তো
সে কি তোমার কাছেই,
নাকি পুরোটাই নিপাট বিড়ম্বনা !
— ও ! তাই বুঝি ? ভুলেছ,
রেখেছ আমার কাছে কিনা ?
— হ্যাঁ, তেমনই তো, যতদূর মনে আছে…
যে সব কথা এর আগে, তোলা ছিল সিন্দুকে
কখন যে তারপর কথায় কথায়…
— রেখেছিলে কিনা, মনে পড়ছে না,
সে কেবল তোমার একার কথা যদি
তাহলে সে আমি গুছিয়ে রাখিনি।
— কিন্তু তেমন অবিশ্বাস তো করিনি,
সিন্দুক থেকে একটা একটা করে নামিয়েছি
বলেছি…
— হ্যাঁ, মনে পড়ছে যেন,
কোনো দিন হয়তো তেমন করে বলেছ…
— তাহলে এবার খুঁজে পাবে ঠিক
দেখো না একবার, একটু এদিক ওদিক
অনেক দিনের জমানো তো সেই..।
— খুঁজতে হবে না, সে সব কথা
সিন্দুক খুলতে খুলতেই,
তুমিই বলেছিলে, যা তুমি বলেছ প্রথমবার
হ্যাঁ, তেমন করেই।
— বলেছিলাম ?
যে পুরোনো স্যাঁতসেতে দেয়ালের দখলে
অনেক অনেক দিন পড়ে ছিল
লোহার বাক্স, যেখানে
মরচেয় তার খোলা যায় না তালা
সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় জ্বালা।
— অথচ তুমি ঠিক ধীরে ধীরে
খুলে ফেললেই, আমাকেই ডেকে
জং ধরা কপাট ধাক্কায় দিলে ভেঙে।
— হ্যাঁ, গড়গড় করে তারপর, তারপরই
বলেছি,দেখো, ভিতরটার কী অবিকল ধকল
অন্ধকারের ভিতর, যেমন কয়লার খনন,
হীরক দ্যুতির জন্য নয়,
তবে শুধু জ্বলনের নিশ্চয়।
— আনন্দে, উৎসাহে কাঁপছিলে তখন তুমি
জোর করে ছুঁইয়ে দিলে শব্দ, কথা
বললে বহু বছরের, জমেছে, পচেছে
হয়েছে এখন উপযুক্ত জীবাশ্ম মতো।
— সিন্দুকের ভিতরের সিন্দুকে
যা বলে বলুক নিন্দুকে,
চুরি তো নয়
বললে,দেখো যেন প্রতি মুহূর্তে
প্রত্নের আবিষ্কার হয়।
— ঠিক তাই
কথা গুলো গুপ্ত, গুপ্ত যুগের নয়
অথচ অরক্ষিত শত শত বর্ষ
ওজনে ভারি, পাকা চাঁদির মতো,
নকশা কাটা নীরেট ও নিখাদি
যা ওঠেনি কখনও পার্থিব বাজারে…
— প্রাণের পুরাতন পরম্পরা,
বড় দামি বলে ভাবা হয়নি তবু সেভাবে,
হ্যাঁ থেকেছি অভাবে আর নষ্ট স্বভাবে
চির চৌকাঠে— লিখিনি বিজ্ঞাপন,
বন্ধ দরজা-ঘর— একদিন হাত বদল হবে।
— জানি বলবে এমন করেই,
বললে, রেখে দাও, যদি উৎসাহ পাও
বললাম, পতিত জায়গা আছে খানিক,
বুকের ভিতর
ইচ্ছে-খেলার, সাইকেল-বেলার,
কেবল ঘুণ ধরেছে এই ঘরটির খুঁটির ভিতর।
— তুমি তখন যেমন করে, তেমন করেই
তাকিয়ে দেখলাম,আছে পরিসর,
আজ থেকে এ শুধু যে নয় একার
নতুন কোনো মালিক পেলাম।
— হ্যাঁ, তখন তেমন করেই—
গোপন যেন কিচ্ছু নয়, মূল্যবানের
তুলে নেওয়া মূল্যমানে, যত্ন নিলে
বুকের ভেতর আপন হয়।
— প্রাচীন পাঁজরে, নতুন করে, রেখে
হাঁটতে যাওয়া যায় সংগোপনের মাঠে
চিৎকার করে বলে যাওয়া যায় না, ঠিকই
যাপন কাঁটার দূর প্রান্তর হেঁটে ।
— ঘন ও গভীর কন্ঠ সুরে, উচ্চারণে উচ্চারণে
অকপট, থরথর সে সব কথার, আওয়াজ বড় চমৎকার,
শব্দ চরম বাজল এই শরীরে,
ধ্বনি শরীরে, সুরে সুরে বারংবার।
—এখন বাজে ? না বাজে না ?
বেজে আর ওঠে না—
কোনো দিন বেজে উঠেছিল না বলেই, আজও
স্মৃতি-প্রতারক ।
তোমাকে ফেলে রেখে সময়ের মাঝখানে
কিছুটা তরল, বিস্মৃত ভুল করে করে।
— এ মিথ্যে, কষ্ট কল্পনা, সস্তা মনে হয়,
গুপ্ত গহনা ? নাকি এও এক নব বঞ্চনা ?
— কষ্ট কল্পনা, নষ্ট কল্পনা যা কিছু বলো,
তুমি তা ধ্বংস করোনি, স্থাবরে, প্রচুর প্রাচুর্যে,
হয়তো স্থান সঙ্কুলান হয়নি কেবল—
তোমার ব্যস্ত মনের ভিতর।
পরাভূত পাঁজরের জীবন-সম্পদে
পড়ে থেকেছে বাইরে, রোদে আর জলে বাতাসে
ঢেকে গেছে, ধুলোতে বালিতে হেলাতে
ধোঁয়ার কল্কা আঁকা শীত-চাদরের
শেষ ঝুলে পড়া ছেঁড়া আঁচলে।
— তুমিও তাহলে নিন্দুক,
সিন্দুক কি কেবল তোমারই আছে…
ঘর ও উঠোন, ফুলবন সব তোমার একার ?
আলোতে যতদূর দৃশ্যমান, তেমন মেহমান ?
— মেহমান নই, দান দিলে দরিদ্র নারায়ণ
আর ছুঁড়ে দিলে— ভিখারি, দুর্জন।
কথা গুলো ফিরে পেলে, পথে ফের
ফিরে যেতে পারি, ফিরতি পথের ডাকে
যদি না পারি, তবে আড়াল, ধোঁয়ার ওপাশে
যতদূর তাকাবে— কোথাও আঁকা নেই কিছু
বাঁকা হয়ে পথ অন্ধ অন্ধকারে, এলোমেলো
হয়ে গেছে, মন মুছে রেখো, দিন গেছে বলে।
— বিকোনোর সাধে, পরখ নরক করে ?
তবে নষ্ট বাতাসে উড়ে গেছে, ধূসর হতে হতে ?
কীভাবে এলে এমন ধ্বংসের উপসংহারে ?
সব লেনদেন একেবারেই
নিজের মতো করে ?
— বলি, শেষ বার দাঁড়াও এখানে,
সেই সব কথার শ্মশান পারে।
ফেরৎ তুমি নাই বা দিলে। ছিলই বা কী আর ?
কতক কালো পুঁথি, দুর্বোধ্য, অসম্ভব পাঠোদ্ধার
কতক সমুদ্র পারের বেলে পাথরের দুর্বল নুড়ি।
— হোক তেমনই যদি, তবে ফেরৎ কেন ?
টোকা দিলে যেখানে শব্দ বাজে না, অথর্ব
সংলগ্ন রেখে দিলে, নামে না কান্না যার —
শূন্য ভর্তি সিন্দুক, ফিরিয়ে কী লাভ তার।
— হয়তো সত্যিই, মানছি পরশপাথর ছুঁয়ে
হয়ে উঠেছিল সে সব, মণিকাঞ্চণ ভার
গর্ব আর অহংকারের ব্যর্থ সাঁতার,
যে ভুলে গিয়েছিল তার সমস্ত জং ধরা রূপ…
— সে আজ ভার হলো কেন ?
তুমি কখনও কি দেখেছ সে যত্ন ?
প্রত্যক্ষ ? পরোক্ষ ?
পাতালের গোপন কক্ষের যক্ষ পাহারায়
যে রেখেছে পরম প্রতিশ্রুতির মর্ম মায়ায়,
তাকেই আজ বিশ্বাস হয় না।
— অবিশ্বাস নয়।
প্রতিটি বিভৎস রাত, জেগে যে খনিতে
নেমে যেতে হয়, খনন করে ওঠে না কিছুই,
সকালে তারই কালো মেখে উঠে এসে
এক একটি নিটোল মৃত্যু আঁকতে হয়।
তাকে বাঁচতেই তোমাকে মুক্তি দিতে হয়, ফিরতে
লাঘব করতে হয় ভার। কতদূর আর
নিয়ে যাবে এ লৌহ বাক্স, পাষান ?
— যে নিয়েছে, তার মুক্তির দুঃস্বপ্ন নাই বা দেখলে,
মৃত্যুর গল্প এতো সহজ করে নাইবা লিখলে,
যে কথা গুলো খুঁজছিলে— নাইবা খুঁজলে আর।
নতুন কথার দিন, আরও অনন্ত কথার সাধ
এক পৃথিবীর মতো এখনও শূন্য সিন্দুকে
না হয় নতুন করে করলে সঞ্চয়…
— না, তা আর নয়।
— কেন নয়, সেও তো কোনো নতুন কাব্য হয়।
যে কথা হারিয়ে ফেলার, সে কথার নবজাতকের জন্য
কেন আশ্বাস নয় ?
ফিরবার, খুঁজবার, ফেরৎ নেবার এ কি
তেমন কথার ? অর্থহীন রূঢ়তার আবরণ।
কোথায় কী পথ তোমার ? কোথায় বিসর্জন দিতে চাও ?
যা আমার সঞ্চয় !
— বেশ, এ এক দীর্ঘ ক্লান্তি বিঘ্নিত সময়
আমার ঘুম পায়। ঘুম ভেঙে পুনরায় চেয়ে নেব।
রেখে দিও মাথার কাছে—
আমার হারিয়ে ফেলা কথা, শব্দ, নষ্ট পচনের
যত সব ধ্বনিত আবর্জনা
যা কিছু বাধা, বাহুল্য মনে হয়।
— না, আমি চেয়ে নেব আবার,
আরও মোহময় মূল্যবান, আরও যত যত বালি
মাটি,জল, পাথরের মতো যা কিছু কথা।
শুধু বলো আমাকে বিশ্বাস হয়…
— যদি সুরক্ষিত নতুন,
তবু পুরনো সে সিন্দুক, একবার
এ দরিদ্র হাতে, ইচ্ছে হয় যে ছুঁতে !