অপত্য
নীলাঞ্জন ভৌমিক
আজ রোববার। আমারও ছুটি, তনুরও ছুটি।
আমি কাকভোরে ওঠা পাবলিক, আজও উঠলাম। ব্যালকনিতে পাতা চেয়ারে হাতছানি দিয়ে ডাকে। তনু তখন ঘুমোচ্ছে। এই ভোরের ঘুমটা ওর কাছে দুর্লভ বিলাসিতা। গোটা বিছানা জুড়ে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমোয় ও। দেখে মায়া হয়।
সামনের মাঠটায় সবুজের প্লাবন — জনাকয়েক চক্কর মারছে। হাত পা ছুঁড়ছে। শরীরটাকে মোচড় দেওয়াচ্ছে। একবার নিচু হচ্ছে, একবার সোঁজা হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। বেঁচেবর্তে থাকার জন্য এত কসরৎ করতে হয়, এদের না দেখলে যেন বুঝতেই পারতাম না।
এই অল্প আলোর ভোরে রোজ দু কাপ চা বানাই। এক কাপ নিজের জন্য, অন্য কাপ তনুর। আমার হাতের বানানো চায়ে তনুর তৃপ্তি হয় না। চা চিনি দুধ— কোনোটারই নাকি অনুপাত ঠিক হয় না। প্রথম দিককার তোয়াজ স্তুতিতে একসময় বড় প্রীত হয়ে পড়েছিলাম। সেই যে টুপিটা নিজের হাতে পড়লাম, তো পড়লামই। সে আর মাথা থেকে খুলতে পারিনি। চাইও নি।
ব্যালকনিতে এখন বেশ খানিক সময় বসে ভোর দেখব। তারপর কিচেন। সময় ঠিক করা আছে। আগেও না, পরেও না। চা নিয়ে এসে তনুর ঘুম ভাঙাব। অবিন্যস্ত বেশবাসে তনু কোনরকমে আধখানা শরীর ওপরে তুলে আমাকে চোখ ইশারা করে চায়ের কাপটা বেডসাইড টেবিলে রাখতে বলবে। তারপরও খানিকক্ষণ। চা জুড়িয়ে প্রায় জল। আমাকে এসে ঠেলে দিতে হবে। ‘কি ব্যাপার? কি হল? চা যে জল—’ এর উত্তরে ‘চা একটু ঠান্ডা খাই আমি তুমি জান—’ বলে আবার বালিশে মাথা। এইভাবে এক আয়েসী সকাল উৎরে গিয়ে রোদটা একটু তেজী হবে। হলে তনু উঠবে। উঠে আধঘন্টা চা নিয়ে ব্যালকনিতে এসে বসবে। আমার চা শেষ ততক্ষণে। ওর শুরু।
আমি তখন একটা পাখিতে আটকে। যে পাখিটা উড়ে এসে জাহাজের মাস্তুল ভেবে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাটার চুল্লিতেও বসতে পারে। যে পাখিটা এসে বসল তার নাম আমি বলতে পারব না। সামুদ্রিক পাখি কোনগুলো? বেশ বড়োসড়ো বিশাল আকারের হয়। অনেক উড়তে পারে, কঠিন সমুদ্র পরিক্রমা করতে ডানায় জোর লাগে তো। সেরকম একটা বিরলদর্শন অতিকায় পাখি ঐ মাঠের পরিত্যক্ত কারখানার চুল্লিতে এসে বসলে আচমকা একটা সোরগোল পড়ে যাবে। পাখিটা দেখতে এ পাড়াটা ভেঙে পড়বে। নানারকম বিশেষজ্ঞের মতামত দেবে সবাই।
‘সাইবেরিয়া থেকে উড়ে এল। ভুল পথে ঢুকে পড়েছে। বনদপ্তরে খবর পাঠানো দরকার।’ আর একজন হয়ত ধমকে উঠবে— ‘কলকাতা শহরে বনদপ্তর কোথায়?’ ‘কেন? রাইটার্সে।’ ‘ওরা পাখি ধরতে আসবে?’ ‘আলিপুর জু-গার্ডেনে থবর দিতে হবে।’ ‘দিন গিয়ে।’ ‘আমার ফোনটার রিচার্জ কাল রাত্তিরে ফুরিয়েছে।’ দেখা গেল এত মানুষজন, হৈ হল্লা কথাবার্তাতে পাখিটা ভয় টয় পাচ্ছে না। নড়ছে চড়ছে না।
‘এটা তো এ্যালবেট্রস্?’
‘কি করে জানলেন? জীবনে তো সমুদ্র পাড়ি দেননি অথচ এমন করে বলছেন যেন এ্যালবেট্রসের ছানা বিক্রীর ব্যবসা আপনার বাড়িতে—’
এমন সব কল্পিত সংলাপ ধীরে ধীরে আমার মনের মধ্যে জমে উঠতে থাকে ভীড়ের অবয়বে। আমি একটার পর একটা চিত্রনাট্য বানিয়ে যাই মনে মনে। যেন মনে মনে ঘুরে আসি কারখানার চাতালটা যেখানে ওপরে ওঠার সিঁড়ি আছে। সেই সিঁড়ি বেয়ে অনেকটা উঠলে ওপরের পাখিটাকে অনেক কাছ থেকে দেখা যায়।
নাঃ। আর না। এবার উঠব। কিচেনে যাব। দু কাপ চা এবার বানিয়ে নিতে হবে। তনুর খাওয়ার সময় হয়ে গেল।
অতএব ব্যালকনির চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখি হাতে দু’কাপ চা নিয়ে তনু এসে দাঁড়িয়েছে। কখন উঠল ও?
কখনই বা চায়ের জল বসিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে এল? শুধু কি তাই? বেশ পরিপাটি করে মাথার চুল আঁচড়িয়ে শাড়ি পাল্টে পরিচ্ছন্ন হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি অবাক।
‘উঠে পড়লে এর মধ্যে?’
‘শুধু ওঠা? দেখছ না চা করে নিয়ে এলাম।’ হাত বাড়িয়ে কাপটা নিলে তনু পর্দা সরিয়ে আবার ব্যালকনিতে আসে। এসে বসে চেয়ারে।
আমি তনুর পাশের চেয়ারটা দখল করে বসি।
‘আজ কি ভাবছিলে? নতুন কিছু? নাকি সেই মাঠ, নদীতে ডুবে গিয়ে সমুদ্র হয়ে যাওয়ার গল্প?’ ‘না। আজ একটা সামুদ্রিক পাখির কথা ভাবছিলাম।’
‘মাই গড্! নদী থেকে সমুদ্র? সমুদ্র থেকে সামুদ্রিক পাখি! কল্পনা, ভাবনা কেমন এলিভেট করছে তোমার মধ্যে! কি পাখি?’
—কি পাখি তা জানি না।
আমি সত্যি সমস্যায় পড়ি। পাখি তো এমনিতেই চিনি না। যে পাখিটার কথা ভাবছি সেটা আসলে কী পাখি তাও জানি না ছাই।
এসব নিয়ে প্যাঁচ পয়জার না করে সরাসরি তনুকে সেটাই বললাম।
—ভাল। তোমার একটা না একটা এরকম অপ্রত্যাশিত ভাবনা-চিন্তা থাকা চাই-চাই। এটা মানসিক রোগ।
—তা হোক। কিন্তু আমার পক্ষে এটা সুখপ্রদ। আমার ভাবতে ভালো লাগে।
চায়ের কাপটা শেষ করে খুব গম্ভীর মেজাজে তনু কাপটা নামিয়ে রাখে টি-টেবিলে। তারপর আমার দিকে তাকাল।
—ঘটনা একটা চাই-ই তোমার। আমি একটা ঘটনার কথা বলব যেটা তোমার ধারণার একেবারেই নেই। আদপেই নেই অথচ ভীষণ প্লীজিং।
কি আর বলবে ও? কি ঘটনা? তনুর গল্প মানেই ওর স্কুল সংক্রান্ত কোন খবরাখবর। সেক্রেটারী বনাম শিক্ষাদপ্তরের মির্চমশলা, না হলে কোন কলিগের পারিবারিক সঙ্কট, নির্দিষ্ট চৌহদ্দির মধ্যেই ঘোরাফেরা। আজকাল আর ‘ও হেনরী-র গল্প শোনায় কই ?
—তোমার গল্প মানে, স্কুল, স্কুলের চৌহদ্দি। একটু নতুন করে কিছু ভাব।
আমি ভেবে নিয়েছিলাম এবার তনু ফোঁস করে উঠবে। তীব্রভাবে প্রতিবাদ জানাবে। আমার অলীক কল্পনা নিয়ে বানানো তির্যক মন্তব্য করবে। কিছুই হল না। বেশ পরিশ্রুত প্রসন্ন মুখ।
—কি গল্প চাইছ তুমি?
—গল্প? না, গল্প না। ঘটনা।
—কি ঘটনা?
—যে ঘটনা একেঘেয়ে জীবনটাকে কিছুটা সময়ের জন্য অন্যরকম করে দেবে— মানুষ যেমন বাড়ি ছেড়ে বেড়াতে বেরোয়। নতুন পথ, নতুন জায়গা, নতুন দৃশ্য—। সব অন্যরকম। তেমনি নতুন ঘটনা—।
এমন ঘটনা চাইছ?
আমি খুব নিরাসক্তভাবে মাথা নাড়ি — “জানি, তুমি একটা ট্র্যাশ গল্প বানাবে। শোনো তাহলে— বলে যা বলবে, সেটা একেবারেই পাতে দেবার যোগ্য নয়। এক্কেবারে জোলো টাইপ কিছু একটা হবে”।
—নতুন একটা ঘটনা তোমার চাই-ই চাই যেটা সব কিছু অন্যরকম করে দেবে— তাইতো?
—ধ্যাৎ। এক ভ্যানতারা বারবার।
—তোমার অজান্তেই একটা ঘটনা ঘটে গেল।
তেমন কোন ঔৎসুক্য দেখাই না। তনু খুব গদ্যময়। নিজে কোন গল্প বানাতে পারে না। ঘোর বাস্তববাদী, রেলগাড়ীর মতো সোজা সাপটা পথে চলা মানুষ। কাজেই কি ঘটনার কথা বলবে তা না শুনেও বলে দিতে পারি আদপেই ওটা এমন কিছু নয়।
—আমি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। দেয়ার্স্ এ সারপ্রাইজ ফর্ য়্যু।
হোঁচট খেলাম। একটা শিরশিরানি বুকের মধ্যে। আচমকা। মনে হচ্ছে— কি যে মনে হচ্ছে— আমি বুঝতে পারছি না। বোঝাতেও পারব না।
—ডাক্তার মানে—
—সিরিজ অব ইনভেস্টিগেশনস্ এবং শেষে … তনু বাকীটা বলতেই পারছে না। হাসছে, প্রাণখোলা হাসি। চোখ বুজে ওপরে তাকাল। ব্যালকনির সিলিং-এ যেন বদ্ধ ঘরের চৌহদ্দিতে মাথার উপর তাকিয়ে ও ওর প্রার্থিত ঈশ্বর দর্শন করল। চোখ মুখে তেমনি ওর এক প্রাপ্তির প্রসন্নতা।
—আর মাঠঘাট সামুদ্রিক পাখি ভেবে ভেবে কাতর হওয়ার প্রয়োজন নেই। সময়ও পাবে না। কারণ অঘটনটা এখন তোমার ঘরে, তোমার সংসারে ঘটে যেতে বসেছে। সব … সব কিছু পাল্টে যাবে।
দুর্বোধ্য রহস্যময় কথাবার্তা আমার বোধগম্য হয় না। এসব ক্ষেত্রে তলিয়ে কিছু বুঝতে গেলে খেই হারিয়ে ফেলি। আজ কিন্তু স্পষ্ট করেই বুঝে ফেললাম।
—একেবারে শূন্য থেকে অঙ্কে চলে এলে !
এলাম। সত্যি এলাম। ফ্রম্ জিরো টু এ নাম্বার।