না-অঙ্গীকার
পৌলমী চক্রবর্তী
বড্ড তাড়াতাড়ি বদলে যাচ্ছে চারপাশটা! হয়তো মেনে বা মানিয়ে নিতে গিয়ে নিঃশব্দে বদলে যাচ্ছি আমরাও! আজ যে দৃশ্য টা বা ভালো লাগলে মোবাইলে ছবি তুলে নিই , কালই তা মোবাইলের মেমরী ফুল হয়ে যাচ্ছে বলে ডিলিট, এইভাবেই আজকাল প্রিয় বা ভালো লাগার জিনিস গুলো একটা একটা করে ডিলিট হতে থাকে! হয়তো প্রিয় মোবাইলটাও অল্প কদিনেই পুরোনো হয়ে যায়, আবার প্রিয় হয়ে জায়গা নেয় নতুন ফিচারের সাথে নতুন মোবাইল !আর এরই মাঝে, হারিয়ে যেতে থাকে সেভ করে রাখা মানুষের নম্বও আবার যুক্তও হয় নতুন কেউ ! আজকাল বোধায় মানুষ আবেগে যতটাই কাউকে জড়িয়ে ধরে বা কাছে চলে আসে দূরে সরে যেতেও বোধায় বেশী সময় লাগেনা!
আসলে কোনো কোনো ঘটনা মনকে খুব নাড়া দিয়ে যায়, সময় কেটে যাবার পরেও কোথাও একটা ছাপ থেকে যায় তার। সেদিন মুভি দেখতে গেছিলাম, মেয়ের আবদারে। মুভি শুরু হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর একটি cuple হাত ধরাধরি করে হলে ঢুকলো, ছেলেটির হাতে cold drink আর মেয়েটির হতে পপকর্ন। আমার পাশের সিটে মেয়েটি আর তার পরের সিটে ছেলেটি , তাড়াহুড়ো করে বসে ছেলেটি মেয়েটির জন্য পকেট থেকে রুমাল বের করে দিলো হাত আর মুখ হাত মোছার জন্য। বুঝলাম বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। হলে সিনেমা চলছে, চলছে আমার পাশের দুজনের টুক টাক খুনসুঁটিও , ছেলেটা মেয়েটিকে মেঝে মাঝে পপকর্ন খাইয়ে দিচ্ছিল, আর আর মেয়েটির চোখ তার নিজের স্মার্ট ফোনে ,কখনো বা সিনেমার দিকে। হঠাৎ ছেলেটি একটি গলায় কিছু আটকে ভীষম খেলো, তাড়াতাড়ি করে হাতের কাছে cold drink এ সিপ দিয়ে নিজেকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করলো, পারলো না সামলে নিতে, বরং কাশির বেগ টা আরো বেশি জোরে! হলের প্রায় সবাই এক বারের জন্য হোলেও ছেলেটির দিকে তাকালো, মেয়েটিও তাকালো, কিন্তু, ভীষম টা কমানোর জন্য তার সঙ্গীকে সাহায্য করার কোনরকম মানসিকতা চোখে পড়লো না! কিছুক্ষন পর পর ছেলেটি যতোই নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছে কিন্তু কমছে না ! এভাবে প্রায় পাঁচ মিনিট বা আরো একটু বেশী সময়! পরিস্থিতি বুঝে আমার মেয়ে আর হাজবেন্ড একবার আমার দিকে তাকালো! ততক্ষণে বুকের ভিতর কেমন একটা দমবন্ধ করা আতঙ্ক আর কষ্ট অনুভব করছিলাম বেশকিছুক্ষণ ধরে , কারণ ছোটবেলা থেকে দেখেছি কোনো কারণে কেউ ভীষম খেলে বাড়ির বড়রা কতোটা তত্পর হয়ে ওঠে সেটা কমানোর জন্য! পিঠে হাত বুলিয়ে দেওয়া, হাওয়া করে দেওয়া, আরো কতো কি! আর, আমার মা শিখিয়েছিল, ভীষম খেলে আগে নিজে নিজের বাঁ হাতের পালস্ টা জোরে চিপে ধরবে, সব সময় সামনে কেউ নাও থাকতে পারে , বুঝিয়েছিল এভাবে শ্বাস নালীতে বা গলায় আটকে মানুষ নিমেষের মধ্যে শেষ হয়ে যেতে পারে । হয়তো অন্য কোনো ক্ষেত্রে আমি নিজেই গিয়ে ছেলেটির বাঁ হাতের রিস্ট মানে পালস টা চেপে ধরতাম, কিন্তু এই ক্ষেত্রে হয়তো এটা “মার থেকে মাসীর দরদের…” মতো হতে পারে বলে সাহসে কুলালো না, ছেলেটিকে ডেকে তখন নিজের বাঁ হাতের পালস্ টা জোরে চাপতে বলার পরিবর্তে ঠিক উল্টোটা, মানে ডান হাতের টা চাপতে বললাম। মেয়েটি আমার দিকে তাকালো, জনিনা ঠিক কি ভেবে! আমার কথা শুনে ছেলেটি ডান হাতের রিস্ট টা টিপেও ধরেও কাশি টা অদ্ভূত ভাবে কমে গেলো। মনে মনে হেসে ঠাকুরকে একটা ছোট্ট করে ধন্যবাদ দিলাম , পরিস্থিতি টা আয়ত্তে এনে দেবার জন্য। একটু স্বস্তি পেয়েই ছেলেটি তখন তার বান্ধবীকে পুরো বিস্ময় মাখা গলায় বার তিনেক বললো , “রিস্ট টা ধরতেই , পুরো কমে গেলো! কিকরে পুরো ম্যাজিকের মতো কমে গেলো!” মেয়েটি শুনলো , অভিব্যাক্তি কি ছিল ছিলো বলতে পারবো না, আমার চোখ তখন সিনেমার স্ক্রীনে।
একটু পরে কানে এলো “excuse me”, ছেলেটি ডাকছে ,”Thanks” জানানোর জন্য, 3D চশমা আর মুখে মাস্ক , তাই ঘুরে তাকিয়ে হাত নেড়ে স্বাগত জানালাম। ইন্টারভেল এর সময় আবার ওরা দুজনে পপকর্ন আর কোল্ডড্রিংস নিয়ে হাত ধরা ধরি করে….! সিনেমা শেষ হবার পর হল থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে, কি ভেবে ভিড়ের মধ্যে পিছন ফিরে তাকাচ্ছিলো ছেলেটি!
বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম সত্যিই কি এই প্রজন্মের কাছে হাত ধরার কোনো দৃঢ়তা আছে? আজকাল শুনি ব্যাকআপ এর পরও নাকি সেলিব্রেশন হয় সেটা নিয়ে! কোথাও কি আমাদের, মানে , আমরা যারা আজকের বাবা মা, তাদের পরিবারিক বন্ধন, বা বন্ধুত্বের গভীরতা, এগুলো বোঝাতে কোথাও ভুল হচ্ছে ? নাকি অধিক বাস্তববাদী , “নিজেকে সময় দাও”, “একা বাঁচতে শেখো” এই কথা গুলোই মাথায় গেঁথে দিচ্ছি আমরা ! কতো ছোটো খাটো জিনিস তো আমরা বড়দের কাছেই শিখেছি যেগুলো আজ বড্ড দামী! যেগুলো কোনো বই এ লেখা থাকে না, টাকা খরচ করলেও মিলবে না! তবে আজ কি আমাদেরই সময়ের অভাব? নাকি, ওদের সময় দেওয়াটা আমাদের কাছে সময়ের অপচয়?