অণুগল্পঃ গন্ধ – পার্থ রায়

গন্ধ
পার্থ রায়

ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমের কাজ সেরে এক কাপ চা নিয়ে ব্যাল্কনিতে বসা বাসবদত্তার অনেক দিনের প্রিয় অভ্যাস। কিন্তু আজকাল সকালবেলা ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়ালে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। শখ করে লাগানো হ্যাঙ্গিং ফুলের টবগুলোর পাশে নানা রঙের চুলের কুণ্ডলী ঝুলতে ঝুলতে, দোল খেতে খেতে ওকে “গুড মর্নিং” বলে। ডিজগাসটিং! বেশির ভাগই ওপরের তলার মাসীমা ফেলেন। সাদা শনের মতো চুলের থেকে কড়া সুগন্ধি তেলের গন্ধ ছাড়ে। বুড়িকে কায়দা করে, রেখে ঢেকে অনেক বার বলেছে বাসবদত্তা। গুরুজন, মায়ের বয়েসি- বেশী কিছু বলাও যায় না। ফ্ল্যাট কমিটির মিটিংয়ে বার কয়েক তুলেছে। শুনে সেক্রেটারি গা জ্বালানো হাসি হেসেছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি। হাসির ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট। হুহু! বাবা, আমি বলে খারাপ হই, আর আমে দুধে মিলে যাও। আরে বাবা কেউ বাড়ি বয়ে এসে তরকারী, আচার এটা সেটা যদি দিয়ে যায়- তাকে কি না বলা যায় ? তোদের গা চুলকায় কেন? এটা সত্যি বুড়ী দারুন রান্না করে। লতির পাতুরি, চালতার টক, মোচার ঘণ্ট, নানা রকম আচার মুখে লেগে থাকে। এমনকি মাসীমার শুঁটকি মাছ রান্নার সময় যে বাসবদত্তা নাকে কাপড় দেয়, একবার নির্জনের জন্য দেওয়া শুটকির বাটি থেকে মেয়েলি কৌতূহলের রাশ আলগা করে আঙ্গুল দিয়ে তুলে খেয়ে ব্যোম মেরে গেছিল। ওই পচা মাছগুলোর এমন অসাধারণ স্বাদ হয়? সত্যি বুড়ীর হাতে যাদু আছে। তাছাড়া নির্জন পছন্দ করে না। চায় না বাসবদত্তা কিছু বলুক। আসলে ছোটবেলা মা মারা যাওয়াতে, মাসীমার প্রতি ওর একটা দুর্বলতা আছে। সব ঠিক আছে। নিজেরতো আর রোজ রোজ ঝাড়ন দিয়ে ওই বস্তুগুলো সাফ করতে হয় না।
আজকে ব্যাপার কী? বাহারি ফুলগুলোর পাশে ঝুলন্ত চুলের দোল খাওয়া নেই। আজ সুজ্জি মামা “লিচ্চয়” রাস্তা ভুল করেছে। বাসবদত্তা চায়ের কাপে একটা জম্পেশ চুমুক দিয়ে নিজের মনে কুলুকুলু হেসে উঠল। ফুল গাছগুলোতে একটু জল দিয়ে উঠতে না উঠতেই কলিং বেলের আওয়াজ। কাজের বউটা এল। নির্জন দরজা খোলার আদেশনামা শুনিয়ে দিয়ে খবরের কাগজে ঢুকে পড়ল। কথায় বলে না “মেন আর মেন”। আবার কলিং বেলের আওয়াজ, আবার। কাজের মেয়েগুলো যেন ঘোড়ার পায়ের খুড় লাগিয়ে রাখে। “ যাই ইই…” বলে দরজা খুলতেই কাজের বউ রত্না হাউমাউ করে উঠল, “তোমরা টের পাওনি, বৌদি? উপরের ফ্যলাটের মাসীমা আর নেই গো। ভোর রেতে ইষ্টোক হয়ে মারা গেছে”।
নির্জন লাফ মেরে উঠে দাঁড়ালো। “মানে? কী বলছ কী? কেউ একটু খবর দিল না” । বাসবদত্তাও কেমন থ মেরে গেল।
“ফ্যালাট হোল এমনই গো দাদা, শহরের বস্তী। দজ্জা বন্দ করলি, জগত সংসার থেকে আলাদা । খালি কুট কাচালির খপর ঘোরে ফেরে। আসল খপরটা এই রত্না ছাড়া…. “
“বাসু, চলো” বাসবদত্তার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে সিঁড়ি দিয়ে ছুটল নির্জন। ও কাঁপছিল। মাসীমাদের ফ্ল্যাটের বাইরে অনেক চপ্পল। এক লহমা মুখ চাওয়া চায়ি করল নির্জন আর বাসবদত্তা। অপরাধী চলনে দুজনে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকল। নিজের ঘরের বিছানায় সাদা চুলগুলো ছড়িয়ে শুয়ে আছেন। যেন অপার শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন। এতটুকু বিকৃতি নেই। সমস্ত জাগতিক মোহ, বন্ধন ছিন্ন করে মুক্তির আনন্দে পাড়ি দিয়েছেন সেই দূর দেশে, যেখান থেকে আর ফেরা যায় না। ঘরজুড়ে সেই তেলের গন্ধটা। কেমন জানি স্নেহ মাখা! বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল। “একটু আসছি” বলে, হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে হাঁটা দিল বাসবদত্তা। ওই গন্ধটা থেকে মুক্তি পেতে একান্তে একটু কান্নার ভীষণ দরকার।

3 thoughts on “অণুগল্পঃ গন্ধ – পার্থ রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *