ললিতবালা স্মৃতি উদ্যান
পলাশ দাস
মন্দার বেশ খানিকটা সময় নিয়ে গুছিয়ে কাজ করতে ভালোবাসে। কিন্তু পৃথিবীতে সব কাজ কি আগে থেকে
গুছিয়ে, বলে কয়ে হয়? আর মন্দার এই দিকটা এখনও গুছিয়ে উঠতে পারেনি। কারণটা আমরা জানিনা,
মন্দারও বোধহয় জানে না। আর জানে না বলেই মাঝেমধ্যে যখন এমন পরিস্থিতিতে পড়ে তখন নিজেকে
নিজেই দোষারোপ করে। এমনিতে খুব ঝকঝকে ছেলে মন্দার। ক্লাসেও ঝকঝকে ছিল, মানুষের সাথে কথা
বলায়, মেলামেশায়, আর গায়ের রঙেও। তাই আমরা ওকে সাহেব বলেই মাঝেমধ্যে খেপিয়ে দিতাম। তবে
খেপিয়ে দিলেই যে খেপে লাল হয়ে যাবে, সে পাত্র মন্দার নয়। খুব বুদ্ধি করে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। বরং ওর
এই ব্যবহারে আমরাই মাঝখান থেকে কেমন এলোমেলো হয়ে পড়ি। যেমন এখন। মন্দার আগামীকাল কবিতা
পাঠ করবে, রবি ঠাকুরের কবিতা। এরজন্য টানা এক সন্ধ্যা থেকে আরেক সন্ধ্যা ও সময় নিয়েছে, ভেবেছে,
তারপর ডিসিশনে পৌঁছেছে।
এইরকম মন্দার কালকে সন্ধ্যা থেকে খুব এলোমেলো হয়ে আছে। আমাদের যে কথায় কথায় এলোমেলো করে
দিত, সেই মন্দার এখন নিজেই এলোমেলো। এমনিতে মন্দার বেশি কথা বলে না, তাই মনের ভিতর ঘরে ঠিক
কি চলছে সবটা বুঝে ওঠা যায় না আর কখনও যদি বা বুঝে ওঠা গেলও ট্রেন ততক্ষণে স্টেশন ছেড়ে চলে
গেছে। তাই, আমরা কেউ বুঝতে চেষ্টা করি না। কিন্তু, কাল সন্ধ্যা থেকে আজ সন্ধ্যা পুরো একটা দিন
কেমন আকাশ জুড়ে থমথমে মেঘ, হাওয়াও নেই, বৃষ্টিও নেই আবার রোদও নেই।
আমরা এখন ললিতবালা স্মৃতি উদ্যানে বসে আছি। আমাদের ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ানো নেই অথচ আমরা চুপ,
গাছের পাতা পড়লেও মনে হয় শোনা যাবে। মাসের প্রথম রবিবার মন্দার ট্রিট দেয় আমাদের। গণাদের
দোকানের তেলেভাজা। আমরা এখনও এদিক থেকে একটু ব্যাক ডেটেড বলতে পারেন। মোগলাই, বিরিয়ানির
যুগে আমরা ঠোঙায় করে তেলেভাজা খাই এই পার্কে বসে। তবে তেলেভাজা সহযোগে আমাদের আড্ডা এই
পার্কে যা জমে ওঠে তা হয়তো বিরিয়ানি সহযোগে কনো রেস্টুরেন্টে হত না। কিন্তু আজ মন্দারের মুখে কথা
নেই, আমাদেরও মুখের কথা নেই। হাতে তেলেভাজাও নেই। আমরা সময় গুনছি কখন মন্দার মেঘ গর্জনের
মতো কথা বলে উঠবে আর এই থমথমে পরিবেশ ভেঙে যাবে।
ললিতবালা স্মৃতি উদ্যান সন্ধ্যা থেকে রাতের তিন-চার ঘণ্টা আমাদের বসার এবং আড্ডার জায়গা। টুকটাক
কাজের ফাঁকে আমরা যখনই সময় পাই পাঁচ বন্ধু একত্র হই। আমি, মন্দার, জীবেশ, লোকনাথ আর আমাদের
সারাই ছোট্টু। একটু কানে বাজল না সারাই ছোট্টু নামটা। এ আবার কেমন নাম! না একটা ঠিক নাম নয়,
চলতি নাম। ওদের একটা সাইকেলের দোকান আছে। আগে ওর বাবা বসত এখন ছোট্টু নিজে বসে। তবে খুব
চমৎকার একটা নাম আছে ছোট্টুর, সেটি হল অর্ণব।
আজকে ছোট্টু অবশ্য আসেনি। বিকেল বেরবার আগে ফোনটা বাজতেই দেখলাম ছোট্টুর ফোন। ধরলাম। সাথে
সাথেই ওপার থেকে ভেসে উঠল, “আজ আর যাব না ভাই, হেবি চাপ। কাজ না হলে বাবা মেরে ফেলবে।
অনেকগুলো টাকার কাজ।” এক নিশ্বাসে বলে গেল। ছোট্টুর বাবা অমল বিশ্বাস। আমরা সবাই অমলকাকু বলে
ডাকি। এমনিতে খুব শান্ত, খুব ভালো মানুষ। কিন্তু, আমাদের দেখলে কেন যে ক্ষেপে যান, কে জানে!
আমাদের দেখলেই বলেন, তোমরা সব এ যুগের ছেলে, নাট লুজ আছে, একটু টাইট দিতে হবে। তারপর দেশ –
কাল – সমাজ নিয়ে লম্বা একটা লেকচার। আমাদের অধপাতে যাওয়ার ছবি আঁকেন। মাঝে মাঝে মনে হয়, কেন
যে উনি সাইকেলের দোকানের মালিক হলেন! কোনো কলেজের প্রফেসর হলে খারাপ হতেন না। ছাত্র তৈরি
করতে পারতেন। তারা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অধিকারী হতো। ছোট্টু এহেন বাবাকে হেবি ভয় পায়। এই আজ
যদি আসতে বলতাম বলত, “আমার বাবার সাথে তো থাকতে হল না, থাকলে বুঝতে পারতে জীবন কি জিনিস।
ভালো আছ, ভালো থাক। অন্যকে বাঁশ দেওয়ার মনোবৃত্তি ছাড়।” তাই সব দিক চিন্তা ভাবনা করে বললাম,
“ঠিক আছে।” এখন আমরা তিনজন আর আমাদের থেকে একহাত দূরে একই বেঞ্চে বসে আছে মন্দার। কী
ভাবছে আমরা কেউ জানিনা, আবার হয়তো জানি! মন্দারের মুখটা আষাঢ়ের আকাশের মতো গুম মেরে আছে।
সন্ধ্যার সময় পার্কে অনেক লোক ঘুরছে। ফেরিওয়ালা ঘুরছে, আমাদের দিকে দেখছে আর মনে মনে হেসে যে
চলে যাচ্ছে, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। কেম্ন জোকারের মতো আমরা বসে আছি আজ। এদিকে মন্দারকে যে কিছু
বলব সেটাও করতে পারছি না, যদি উঠে চলে যায়!
আসলে ওই যে বললাম না আমরা জানি আবার জানিনা, এখানেও একটা ঘটনা আছে। আর সেই ঘটনার সাথে
এই ঘটনার যোগ আছে বলেই মনে হয়। এখনও পর্যন্ত জীবনে যা কিছু কাজ করেছে মন্দার তা বেশ গুছিয়ে
করেছে। পড়া শেষ করতে না করতেই একটা মোটা মাইনের চাকরি বাগিয়ে নিয়েছে। সেই জন্য আমাদের
আবদার মিটিয়ে মাসের প্রথমে ট্রিট দেয়। আবার আমাদের আপদে বিপদে হাত বাড়িয়ে দেয়। ছেলে ভালো শুধু
একটু আগে থেকে পিপারেশন নিয়ে কাজ করার বদ অভ্যাস ছাড়া তেমন কোনো বদ অভ্যাস নেই। মন্দার যে
নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে সেইজন্য অনেকের চোখের মণি আবার অনেকের চোখের বালিও। মন্দারের পিছনে
কিন্তু বহু মানুষ ছুটেছে আবার হোঁচট খেয়ে পড়েছে। কেউ কেউ এখনও হোঁচট দেওয়ারও চেষ্টা চালিয়ে
যাচ্ছে।
পার্কের মতো অকাজের জায়গার মতো আমাদের একটা কাজের জায়গাও আছে, সেটা মন্দারের কোচিং
ক্লাস। কলেজে পড়ার সময় কোচিং ক্লাস খুলেছিল মন্দার। চাকরি পাওয়ার পর এখন অবশ্য টিমটিম করে
চলছে। এই কোচিং ক্লাসের ঘরেই ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে আমরা রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করি। মন্দারের বাবা
সনাতন গোস্বামী আমাদের ললিত শিক্ষা নিকেতনের শিক্ষক ছিলেন। বাবার আদর্শ নিয়ে অল্প খরচে
পড়ানো শুরু করেছিল মন্দার, আমরাও অচিরেই তার সঙ্গী হয়েছিলাম। আমাদের হাত খরচের টাকার একটা
ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল। আর উপরি পাওনা বলতে ছাত্রছাত্রীরা যখন স্যার বলে ডাকত তখন একটা
ঝিমঝিমে গর্ব জেগে উঠত বুকে। মনে হত অঙ্কের প্রফুল্লবাবুকে একটা জুতসই জবাব দেওয়া গেছে।
প্রফুল্লবাবু আমাদের অঙ্ক করাতেন। বীজগণিতের কঠিন সূত্র উনি হুবহু মনে রাখতে পারতেন। আমরা
যারা পারতাম না তাদের প্রথমে বেঞ্চে দাঁড় করিয়ে তারপর পায়ে স্কেল দিয়ে মারতেন। নয়তো ক্লাসের
বাইরে বের করে দিতেন। ক্লাস শেষ হয়ে গেলে বেরনোর সময় খানিক দাঁড়িয়ে আমাদের দেখতেন চশমার কাচ
নামিয়ে আর ঠোঁট উলটিয়ে বলে যেতেন, “লিখে রাখ, যদি বুকে সেই জোড় থাকে একটা খাতা নিয়ে আয় লিখে
রাখ, তোদের জীবনে কিচ্ছু হবে না!” তারপর ঘড়ি পরা হাত নাড়তে নাড়তে চলে যেতেন টিচার্স রুমের দিকে।
এহেন প্রফুল্লবাবুকে যে একটা জবাব দেওয়া গেছে একথা ভেবেই খুব ভালো লাগত। মনে হত ডেকে এনে
দেখাই, “দেখুন, কেমন স্যার বলে ডাকছে সবাই। আপনি তো বলতেন কিচ্ছু হবে না। কিচ্ছু কি হয়নি?”
আগামীকাল রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই মহড়া চলছে। সবাই খুব উৎসাহের সাথে লেগে
পড়েছি। আজকে সকালেই ছিল ফাইনাল মহড়া। সেইমতো সকালে গিয়ে দেখি মন্দার আসেনি দেখে আমি চলে
গিয়েছি ওদের বাড়িতে। কলিং বেল বাজাতেই মন্দারের মা দরজা খুলে দিল। কাকিমাকে কখনও দেখিনি গম্ভীর
মুখে থাকতে, কিন্তু আজকে কেমন যেন গম্ভীর বলেই মনে হল। দরজা খুলেই বললেন, “তোদের কি ঝগড়া-
টগড়া হয়েছে নাকি রে?” আমি বিস্ময়ের সাথেই বললাম, “না তো! কেন?” কাকিমা উত্তরে বললেন, “না,
এমনিই বললাম। যা ও ঘরেই আছে।” বলেই চলে গেলেন।
এমন সিরিয়াস সময়ে মন্দারকে এতোঅমনোযোগী হতে আগে কখনও। ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই আমার দিকে
একবার তাকাল মন্দার। যেন খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। পার্কার কোণে যে ফুচকা নিয়ে বসে সারা সন্ধ্যা বসে
থেকেও যেদিন তেমন বিক্রি কম হয় না, সেদিন এমন একটা মুখভঙ্গি দেখি তার। অন্যমনস্ক হয়েই একবার
বলল, “কারা কারা এসেছে?” পরক্ষণেই বলল, “যা, আমি আসছি।”
ওই যে বলছিলাম না কারণটা আমরা জানি আবার জানি না। সেটা এখন আমি খানিকটা বুঝতে পারছি। কালকে
সন্ধ্যায় আমরা যখন এখানে বসেছিলাম তখন সুতপা এসেছিল। সুতপা ও মন্দার একটু বেশিই ভালো বন্ধু।
তারপর মন্দারকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল খানিকটা দূরে। যতটা দূরে গেলে আমরা কোনো কথা
শুনতে না পারি, ঠিক ততটা দূরে। সুতপা কালকে কি বলেছিল, আমরা জানতে পারিনি। তারপর থেকেই, হ্যাঁ
ঠিক মনে পড়ছে তারপর থেকেই মন্দার চুপচাপ। ওখানেই কিছু হয়েছিল মনে হয়। যাইহোক, পুরোটা জানতে
আমরা এখন অধির আগ্রহে বসে আছি। কিন্তু জীবেশ ক্রমাগত আমার কোমরে আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে চলেছে
আর ফিসফিস করে বলছে, “বাড়ি চল। দেরি হয়ে যাচ্ছে। কাল তো সকালে উঠতে হবে। আমি আবার সকাল
সকাল ওঠায় ডাহা ফেল।” আমি একটু অস্বস্তির ভাব দেখাতেই মন্দারকে ডাকল। “মন্দার? এই মন্দার?”
একহাত দূরে বসে থাকা মন্দার ফিরে চাইল। “বাড়ি যাবি?” জীবেশ জিজ্ঞাসা করল। কোনো কথা না বলেই
মন্দার উঠে পড়ল। আমরাও পিছু পিছু উঠলাম। পার্ক থেকে বেরিয়ে আমরা হাঁটছি। এখনও বেশ গুমোট
পরিবেশ। রাত থেকেই বৃষ্টি হয় কিনা কে জানে! জীবেশরা চলে গেল ওদের বাড়ি আসতেই। মন্দারের বাড়ির
থেকে একটু আগেই আমার বাড়ি, এখন আমি আর মন্দার হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতেই চুপচাপ পরিবেশ ভেঙে প্রায়
একদিন পর হঠাৎ মন্দার বলে উঠল, “কালকে একটা কবিতা পড়ব, রবি ঠাকুরের। আমার নামটা জুড়ে দিস,
কেমন।” আমি থমকে গেলাম। মন্দার কবিতা পড়বে। তাহলে, এই কি এতক্ষণ ধরে ভাবছিল। কি ভাবনা বাবা!
বিস্ময়ের সাথেই বললাম, “তুই, কবিতা পড়বি?” শুনেই বেশ ঝাঁঝ দিয়ে বলল, “কেন, কোনোদিন পড়িনি বলে কি
পারব না ভাবছিস? দেখই না কেমন হয়। না হয় খারাপ হবে। ভালো হতেই হবে কে বলেছে।” বাড়ি যেতে যেতে
মনে হল, এই সারপ্রাইজ দেবে বলেই হয়তো এতক্ষণ চুপ করে ছিল!
অনুষ্ঠানের দিন সকালে
অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে বেশ খানিকক্ষণ। বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী তাদের নিবেদন রেখেছে। এবার মন্দারের পালা।
বরাবরের মতো ছোট্টু আমাদের সঞ্চালক। ছোট্টু নামটা বেশ জোরেই উচ্চারণ করল। আমরা সবাই চেয়ে
আছি। মন্দার কবিতা বলবে। এই প্রথমবার মন্দারের গলায় আমরা কবিতা শুনব। খুব ধীর পায়ে মন্দার
এগিয়ে গিয়ে কর্ড লেস মাইক হাতে তুলে নিল। কোনো ভূমিকা না করেই শুরু করল, “আমার প্রাণের ’পরে চলে
গেল কে/বসন্তের বাতাসটুকুর মতো!…” বেশ ভার ভার একটা পরিবেশ তৈরি হচ্ছে আমাদের মধ্যে, গত
একদিনের থেকেও বেশি ভার মনে হচ্ছে!