ছোটগল্পঃ পাখিদের মিড-ডে মিল – শ্রাবণী ভট্টাচার্য

পাখিদের মিড-ডে মিল
শ্রাবণী ভট্টাচার্য

শিল্পাকে বারণ করলেও মনে রাখতে পারেনা,এই ওর এক দোষ। বকা খাবে,কোমড় বেঁধে ঝগড়া করবে তাও একই কাজ করবে।বলতে বলতে ক্লান্ত অসীমা এখন নিজেই বারান্দা মোছে। শরীরটা এই বয়সেই আর সাথ দিতে চায়না-অযতনে সে ও আজ অভিমানী, শোধ তুলছে যখন তখন। একে একে সবাই ছেড়েছে তাকে, শুধু মনের জোরটা এখনো ছেড়ে যায়নি।
গত সপ্তাহে এমনই বর্ষণক্লান্ত সকালে বারান্দা মুছতে গিয়ে প্রপাত ধরণীতল! লাদেন ও টুইন-টাওয়ার ধ্বংসযজ্ঞের সময় এত আওয়াজ করেনি,যতটা না অসীমা পড়ে যাওয়াতে হয়েছিল। যাই হোক,তেমন কিছু লাগেনি ভাগ্য ভালো।একেকটি পতনে ক্ষতির চেয়ে শব্দ দূষণ বেশী হয়।
রোজ ‘ভোর হলো,দোর খোলো’ ব’লে চড়ুইগুলো ডাক দিয়ে যায়,স্কুল যেতে হবে।এ বছর থেকে ওদের স্কুলে শালিককুল ও যুক্ত হয়েছে। এই লকডাউন এর পর শালিক দের বাবারা ঘরে ব’সেই কাজ সামলাতে পারছে।তাই বাড়ির কাছেই অঙ্গনবাড়ি ‘পাখি সব’ বলে যে পাঠশালা চালায়-সেখানে ভর্তি করেছে। দিয়ে আসা নিয়ে আসার ঝামেলা থেকে মুক্তি।কিন্তু, মায়েদের আর স্বভাব বদলাবে না,তাই বাচ্চাদেরকে পুরোপুরি ছেড়ে দেয়না! স্কুলে যাওয়া অবধি নজরদারি চালায়।এই কারণে,খাবার দিতে দেরী হলে অসীমার কপালে বকাও জোটে,কারণ খালিপেটে যে লেখাপড়া হয়না সে ব্যাপারে চড়ুইদল খুব সচেতন।
অসীমার বারমাস্যার জলখাবার ওদের অনেকটাই ‌নিশ্চিন্ত করেছে।যা দিনকাল পড়েছে,একটু আধটু সেভিংস না থাকলে আগামীতে অনাহারে কাটাতে হতে পারে।তাই, সকালের জলখাবারের পাট এখান থেকেই চুকিয়ে নেয় আর সারাদিন যা জোগাড় করে তা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ফুড ব্যাংকে রাখে।অসীমা যে পরিমাণ খাবার দেয় তাতে ওদের ডিনার ও সেরে নিত কোন কোনদিন,কিন্তু বিধি বাম।শালিকের দল আসাতে রেশনিং এ একটু টান পড়েছে! আপাত নিরীহ চড়ুইরা রাগ হলেও নিজেকে সামলাতে জানে, ব্রক্ষ্মকুমারীর একটি সংস্থার ছাদে ওদের এক পরিচিত বাসা বেধেঁছিল,তখনই মেডিটেশন করা শিখে নিজেদের শান্ত করতে শিখেছে।
শালিকরা আবার চেহারা ও আর্থিক দিক থেকে এগিয়ে থাকার কারণে অহমিকা বেশি, ফলত: ব্যবহারে রূঢ়তাও চোখে পড়ার মতো। চড়ুইদের অধিকারে ভাগ বসিয়ে ওদের সঙ্গেইএমন গলা ফুলিয়ে ঝগড়া করবে শালিকগুলো যে কান পাতা দায়। বিশেষতঃ দুপুরবেলা, মিড-ডে মিলের ব্রেকের সময় মা-চড়ুইরা আসে বাচ্চাদের জন্য টিফিন নিতে তখন এমন গালিগালাজ চলে, সংস্কৃতির মান যে ক্রমশঃই নিম্নমুখী তা দেখলে বাচ্চাদের ভবিষ্যত নিয়ে সত্যিই চিন্তায় পড়েন অসীমা; এছাড়া পাড়ার শান্তি কমিটির চেয়ারক্রো মি:কাকেশ্বর কুচকাওয়াজ অসীমাকে শাসিয়ে দিয়ে গেছে খাবার দেওয়া বন্ধ করার জন্য। এরপর খুব বিরক্ত হয়েই অসীমা জানিয়ে দিয়েছে,এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে তিনি খাবার দেওয়া বন্ধ করে দেবেন। কারণ,প্রতিটি স্কুলেই এখন মিড ডে মিল চালু হয়েছে,তার খাবার দেবার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এই হুকুমনামা পেয়ে শালিকদের দল সমঝে গেছে,তাদের বাবা-মায়েরাও বুঝিয়েছে যে করোনার পর হাইজিনিক ফুড কতটা দরকার।স্কুলে সেই প্যারামিটার মেনে খাবার দিচ্ছে কিনা,সেটা তারা জানেনা। ফলে,ঝগড়া মিটিয়ে একসঙ্গে চললে সবাই ভালো থাকতে পারবে।
এখন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে অসীমার ওদের নিয়ে ভালোই দিন কাটে। অসীমা জানে,আর কোথাও ওঁর জন্য কেউ অপেক্ষায় না থাকলেও এই পাখির দল থাকে আর অসীমা ভোরের অপেক্ষায়!!! এই তো জীবন।

One thought on “ছোটগল্পঃ পাখিদের মিড-ডে মিল – শ্রাবণী ভট্টাচার্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *