গল্পঃ বলি – চিত্রাভানু সেনগুপ্ত

বলি
চিত্রাভানু সেনগপ্ত

আজ পিতৃপক্ষের অবসান , কাল থেকে সূচনা দেবীপক্ষের । বাতাস তাই উতলা হয়ে নারকেল সুপারী গাছের সারির গায়ে মৃদু কাঁপন জাগিয়ে বয়ে চলেছে আপন খেয়ালে। উঠোনের একপাশে বড় শিউলি গাছের তলায় ঝরে পড়া ফুলের সুবাসে আকুল করে তুলছে চতুর্দিক। দূর থেকে ভেসে আসছে আগমনীর সুর…..বাজলো তোমার আলোর বেণু। বট আর অমলতাসের ফাঁক দিয়ে ভোরের সোনালী আকাশটা যতদূর দেখা যায়, ততদূর মাখামাখি খুশির আমেজ । ঢাকে কাঠি পড়ল বলে! উমা আসছেন তার বাপের ঘরে। ওদিকে আর এক উমা বাপের ঘরে মাটির উনুনে ফুঁ দিয়ে গনগনে করে তুলছে আঁচ। এইমাত্র রেডিওতে মহালয়া শেষ হল, ঘরের ছেলেরা কিছুক্ষণ আগে গঙ্গায় চলে গেছেন তর্পণ সারতে। মধুমিতা পেছন থেকে এসে জাপটে ধরে বললে…ও ছোড়দি, এখনো চা বানালি না, তাড়াতাড়ি হাত চালা! সেই কখন ঘুম ভেঙেছে, বড্ড চা-চা করছে মনটা।
ইস্! আমি যেন ওনার কেনা বাদী! যা না বাপের বাড়ি থেকে খান কয়েক দাসী নিয়ে আয়। আনতাম রে আনতাম, তোকে বলতে হত না। তবে তোর মত ফাটাফাটি এককাপ চা গোটা ভূ-ভারতে কেউ বানাতে পারে না বুঝলি? ওখানেই মার খেয়ে গেলাম ।
উমা এক গাল হেসে বললে…দূর হ মুখপুড়ি! আর এতো গ্যাস মেরে গাছে তুলিস না। পাঁচটা মিনিট দে, এক্ষুনি চা নিয়ে হাজির হব।

গ্রামের পুজো এর আগে কখনো দেখেনি মধুমিতা। এ যেন এক নতুন ভালোলাগা, পাশাপাশি একটা ভীতিও কাজ করছে বটে। বর্ধমানের ঘোষ বাড়ির বনেদী পুজো, হাজারো তার নিয়ম-নিষ্ঠা। যদিও নতুন পরিবেশ, তবু এখানকার লোকজন বড় অমায়িক, কালো মুখে কথা কেউ বলতে জানেনা, এই যা শান্তি। যে কটা দিন সে এ বাড়িতে এসেছে, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন সকলেই। তবু কোথাও একটা চাপা উত্তেজনা, কোথাও যদি ভুল হয়ে যায়! মধুমিতার বিয়েটা এখনো এক বছর পূর্ণ হয়নি। বিয়ের আগে দুই বছর বিশ্বরূপের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম চলেছে। শহরের ভিড়, হৈচৈ, পুজোর জমাটি আড্ডা, কৃত্রিম আলোর রোশনাই দেখে বিশ্বরূপ বলতো….আর কয়েকটা দিন ম্যাডাম! কলকাতা উপভোগ কর। তারপর, পুজোর সময়টা তোমাকে বর্ধমানেই কাটাতে হবে।
দেখতে দেখতে আলো ঝলমলে আকাশটা স্বচ্ছ নীলাভ হাসিতে সেজে উঠেছে। পেঁজা মেঘের আনাগোনা তেমন একটা না থাকলেও কে যেন মধ্যে মধ্যে সাদা তুলির হালকা টানে ঢেউ এঁকেছে আকাশের দেওয়ালে। ছাদের উপর একাকী দাঁড়িয়ে দূরের সবুজ ক্ষেতের গা ঘেষা মেঠো পথখানা, পুকুরের ঘাট আর কাশের বনে দোল খাওয়া দেখতে দেখতে কত কি ভাবনা যে মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে! পেছন থেকে ডাক এলো…..এই নিন মহারাণী, আপনার চা। গিলে উদ্ধার করুন।
ও ছোড়দি! এই বাড়ির পুজোর নিয়ম কানুন বুঝি খুব কঠিন? কোথাও ভুল হয়ে গেলে কি হবে? উমা চোখ পাকিয়ে বললে ….তবে তো ভারি বিপদ! ভুল হয়ে গেলে রীতিমত শাস্তি। হুম! মধুমিতা একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল ….এই সেরেছে! বল নারে ছোড়দি এখন কি করি? উমা বেশ মজা পেয়ে খিলখিল করে হাসলে খানিক। তারপর বলল….ওলো না রে না! আগের নিয়মকানুন এখন আর আছে? আমাদের ছোটবেলায় পুজোর অনেক ঘটা হত। এখন সবাই বাইরে বাইরে। তারই মধ্যে এই কটা দিন একটু হাতে হাতে মানিয়ে গুছিয়ে যেটুকু নিয়ম রক্ষা না করলেই নয় সেটুকুই হয়। ও নিয়ে তুই ভাবিস না । কথা বলার ফাঁকে উমার মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে দেখছিল মধুমিতা। সকালের ঘুমভাঙা রোদটা নথের উপর চলকে পড়ে ঝিলিক দিয়ে উঠছে । হাসির ছটায় ঠোঁটের কোনায় গজদাঁতের উঁকি আর নথফুলের ঝিকিমিকিতে কি এক অদ্ভুত মায়াবী করে তুলছিল উমার মুখখানা। আলুথালু ছড়িয়ে পড়া কোঁকড়ানো একরাশ কালো চুলের কয়েকগাছি ঝুমুর ঝুমুর লুটিয়ে পড়ছিল চোখে-মুখে। সেগুলো আবার আঙুলে টেনে নিয়ে কানের পেছনে গুঁজে, আপন মনে বাপের ঘরের পুজোর নানান বিবরণী দিয়ে হেসে কুল পায় না উমা। জানিস মধু, দেড়শো বছরের পুরানো আমাদের বাড়ির পুজো। শুনেছি, কোন এক কালে একান্নটা মোষ বলি দেওয়ার চল ছিল।
একা-ন্ন-টা? হুম, তারপর বাবাদের কিরকম এক কাকার খুব ছোটবেলায় ওই অতো রক্ত দেখে ধুম জ্বর !একদিনের অসুখে হঠাৎ মারাই গেলেন বেচারা। তারপর থেকে সব বন্ধ। কেউ মানত রাখলে এক-আধটা পাঁঠা বলী হয়। না হলে ওই চালকুমড়ো দিয়েই কাজ সারে।
কি!পাঁঠার জায়গায় চালকুমড়ো? ভারি মজা পেল মধুমিতা। ওমা! হাসছে দেখ! নবমীর দিন দেখবি কি রমরমা ব্যপার। গোটা গ্রামের লোক আসবে ভোগ খেতে। তবে জানিস, এবার শুনছি একটা পাঁঠা বলি হবে। ছোট কাকিমনি মানত করেছিল বিশুর সরকারি চাকরি আর টুকটুকে বৌয়ের জন্য। একবারেই পাশ হয়ে গেছে। আমার মায়ের মতন নয়, টানা পাঁচটা বছর ধরে গো ধরে বসে আছে।
সেকি! এযে ভারি গোঁজামিল। সরকারি চাকরি না হয় বুঝলাম, কিন্তু এই কেলেকুলে বৌমা নিয়ে টুকটুকে বৌ বলে চালানোটা কি ঠিক হল? উমা আবার হাসলো …..আহারে! বড্ড কেলেকুলে উনি। তবু আমাদের বিশ্বরূপের যে মনে ধরেছে তোকে। তারা মায়ের চরণে ফুল নৈবেদ্য সাজিয়ে গায়ের রঙের বিচার করা যায়? তারপর দুই হাতে মধুমিতাকে কাছে টেনে নিয়ে গালে চুমু খেয়ে বলল….এর থেকে টুকটুকে বউ চাইনা আমাদের। উমার মুখের দিকে অপলক চেয়ে দেখছিল মধুমিতা। কি অপরিসীম প্রাণচঞ্চল হাসিখুশি মেয়ে উমা। বাইরের জগতের জটিলতা, মলিনতা যেন আঁচ ফেলতে পারেনি তার অন্তরে। উদাসীনতা যেন ওর স্বভাব বিরুদ্ধ, চোখের জল যেন তার দু-চোক্ষের বিষ। চোখে মুখে বুদ্ধিমত্তার দীপ্তি আর চলতি ফিরতি এক মায়ার পুটুলী যেন! ….ওমা! অমন করে তখন থেকে কি দেখছিস মধু? তোকে। সাক্ষাৎ উমার আর এক রূপ তুই। যেমন তোর রূপ তেমন কাজকর্ম, কোত্থাও কোন ত্রুটি নেই। আমি ভেবে পাইনা, কি করে ওরা তোকে ভুল বুঝে এভাবে দূরে ঠেলে রাখল ছোটদি।”
কারা?কথাটা বলতে বলতে আগুনে জ্বলে উঠলো উমার চোখদুটো। ….আমি কি তোদের গলার কাঁটা মধু? এমন একটা দিনে হঠাৎ কেন ওদের কতা মুখে আনলি? এমন তো সাত জনমের শত্তুরেও করে না। এতো খেটেখুটে তোদের হাতের সামনে সব জোগাড় করি তবু মন পাইনে। মাও তাই, দিন রাত্তির কেবল ঠাকুরের কাছে মাথা ঠোকে আমাকে ওই লোকগুলোর কাছে পাঠাতে। তোর সাথেই যা দুটো মনের কথা বলি, তুইও ওদের সুরেই তাল মেলাস? আমারও কপালে একটা দড়ি কলসী জোটে না! তাহলেই সক্কলের হাড় জুড়োত বোধহয়। ছিঃ,ছিঃ ওমন কথা বলিস না ছোড়দি। বড়মা তোর ভালোর কথা ভেবেই হয়তো ঠাকুরের কাছে মানদ করেছেন। পুরানো দিনের লোক হাজার হোক্।
একটা হালকা বিদ্রুপের হাসি হেসে উমা বললে…. হ্যাঁ ভালোর জন্যই বটে। আমাদের সমাজ মেয়েমানুষের জন্য ভালটা কি আর মন্দটাই বা কি ভেবে দেখেছে কখনো?উল্টে সমাজের হাজারটা অন্যায়কে মান্যতা দিতে মরিয়া সমাজের মানুষজন। কত মেয়ে এইভাবে দিনের পর দিন মা-বাবা মান রক্ষার জন্য নীরবে নিজেই নিজের বলি চড়িয়েছে। লোকের কথাটাই বড়, মেয়ে কি চায় কেউ ভাবে না।
একটা অপরাধবোধ চেপে বসছিল মধুমিতার মনে।
ঘাট হয়েছে ছোড়দি! আমি তোকে ওদের কাছে ফিরে যেতে বলিনি। ওরা তোর যোগ্য নয়। আসলে, তুই হলি একখানা খাঁটি হীরে। সবার তোকে ধারণ করার ক্ষমতা নেই। উমা কোনমতে চোখের জল লুকিয়ে বললথাক, খুউব হয়েছে।
সত্যি বলছি ছোড়দি, আমি তোর মন পড়তে পারি। পারিস? তবে চুপিচুপি আমার একখানা কাজ করে দিবি?
দেব। বল কি করতে হবে? উমা চারিদিক ভালো করে দেখে নিয়ে একটু ইতস্তত করে বললে…. ত্তুই কিন্তু কাউকে বলবি না কথা দিলি। দিলাম। নির্ভয়ে বল।
আমায় একখানা বিবাহ বিচ্ছেদের ফরম এনে দিবি? মধুমিতা বেশ হতচকিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল….সত্যিই তুই বিচ্ছেদ চাস ছোড়দি? উমা মাথা নেড়ে বললে…. হুম। আমি এনে দিতে পারি, কিন্তু আমায় বিশ্বরূপের সাহায্য নিতে হবে।
কেঁপে উঠে উমা বলল…. ওকাজ খবরদার করিস নে মধু। ওরা কেউ জানতে পারলে এটা আমাকে করতে দেবে না।
কেন? তুই জানিস না, এই বাড়ির সম্মান, নিয়ম, আভিজাত্য এইসব ঠুনকো আবেগ ওদের মজ্জায় বসে আছে। ওখানে তুই কিচ্ছু করতে পারবি না।
মধুমিতাকে বেশ একটু চিন্তিত দেখালো। উমার হাতটা চেপে ধরে বলল….বেশ, আমি যা করার করব। তবে তুই ও আমায় একটা কথা দে। পুরো পুজোতে শুধু কাজ কাজ করে দৌড়ে মরবি না। আমি তোকে নিজের হাতে সাজাব। দেখি কেমন করে চোখ সরিয়ে নিয়ে চুপ করে থাকেন চক্রবর্তী মশাই।
উমা হেসে উঠে বললে…..তুই তো ভারি সাংঘাতিক মেয়ে! কোন দিন কোন বিপদে ফেলবি আমায়।
ওও, আমি বিপদে ফেলব? নিজে এদিকে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছেন। আমার যেন চোখে পড়েনা, গাছে জল দেওয়ার আছিলায় মেসবাড়ির জানলার দিকে চেয়ে হঠাৎ চোখজোড়া চঞ্চল হয়ে ওঠে কেন শুনি? চক্রবর্তী বাবু যখন তিতলীকে পড়াতে আসেন তোর কাছেই বা রোজ জল চেয়ে খান কেন, বুঝি না বলছিস? কথা শেষ হবার আগেই উমা উঠে দাঁড়িয়ে বলল…কি যে আবোল তাবোল বকিস! মধুমিতা চট করে উমার হাতখানা চেপে ধরে বললে…. আমার চোখকে ফাঁকি দিবি? গা ছুঁয়ে বল আমি ঠিক বলিনি? আমি তোর মন পড়তে পারি না? লাজুক হেসে আলতো মাথা ঝুকিয়ে উমা বললে….হয়তো তাই! তবে তাতে কি? এমন ঘরভোলা ছন্নছাড়া মানুষকে কে কবে বাঁধতে পেরেছে? তুই বা তাঁকে বাঁধতে চাস কেন ছোড়দি? সবাইকে এক গতে নাই বা বাঁধলি। সময় দে একটু।
তারপর গুনগুন করে গান ধরল……
‘ঘর ছাড়া এই পাগলটাকে এমন করে কে গো ডাকে করুণ গুঞ্জরী,
যখন বাজিয়ে বীণা বনের পথে বেড়ায় সঞ্চারি ।

উমা: আমি তোমায় ডাক দিয়েছি ওগো উদাসী,
আমি আমের মঞ্জরী।
তোমায় চোখে দেখার আগে তোমার স্বপন চোখে লাগে,
বেদন জাগে গো…..
না চিনিতেই ভালো বেসেছি…..’


চুলের কাঁটায় গোলাপ গেঁথে উমার কাধ পর্যন্ত ঝুলন্ত খোঁপার খাঁজে আঙুলের আলতো চাপে ফুল গুঁজে দিচ্ছিল মধুমিতা। মাথার উপর চুলটাকে বেশ ফুলিয়ে বেঁধেছে। ছোট ছোট একরাশি চুল পেঁচিয়ে এসে জড়ো হচ্ছে কপাল, গাল আর গলার দুপাশে। পরনের হালকা গোলাপি কাতান বেনারসিতে চমৎকার মানিয়েছে উমাকে। একটা ছোট্ট কালো রঙের গোল টিপ কপালে পরিয়ে দিয়ে নিজেই অবাক হয়ে চেয়ে ছিল মধুমিতা।…..আমি ছেলে হলে আজ তোর কপালে দুঃখ ছিল ছোড়দি।
উমা একটু অন্যমনস্ক ভাবে বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছিল। …. বাইরে কিসের যেন শোরগোল হচ্ছে মধু।
হোক গে! তুই আয়না দিয়ে নিজেকে একবার চেয়ে দেখ! আহঃ! চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। মনটা কু ডাকছে মধু। ডান চোখটা নাচছে সকাল থেকে। কেন বল তো?
উফ্ ছোড়দি!কেবল উল্টোপাল্টা বকিস… কথার ফাঁকে হঠাৎ বড়মা ঘরে এসে ঢুকলেন।….কই রে তোদের সাজ হল? ওদিকে ধুন্ধুমার কান্ড! কি হয়েছে বড়মা?
বড়মা উমার মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন হতবাক হয়ে বললেন….এ কেমন সাজ উমা? আজ মহাষ্টমীর দিন, কপালে সিঁদুর দিসনি?
উমা কিছু বলার আগেই বড়মা আবার বললেন….কই গো, অবনী বাবাজীবন! ভেতরে এসো। এই দেখ এখানে লুকিয়ে বসে আছে আমাদের উমা। বড় লাজুক তো!
দেখতে দেখতে ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে মাঝ বয়সী একজন পুরুষ ভেতরে প্রবেশ করলেন। পরনে মটকার পাঞ্জাবি, কোঁচা পারে ধুতি। গলায় রোলগোল্ডের মোটা চেনটাকে হাতের আঙুলে জড়িয়ে নিয়ে মোটা গোঁফের ফাঁক দিয়ে একটা ফিচেল বিশ্বজয়ের হাসি টেনে উমার দিকে অপলক চেয়ে রয়েছে। উমার হাসি মুখখানায় যেন হঠাৎ গ্রহণ লাগল। দুই চোখে আগুনের হল্কা ঠিকরে বছর হচ্ছে, হাতের পাতায় ধরা গোলাপের পাপড়িগুলো শক্ত মুঠির চাপে নিংড়ে শতছিন্ন হল। বড়মা কড়া সুরে বললেন….এ কিরকম ব্যবহার তোর উমা? কতদিন পর অবনী এলো, প্রণাম করে। ওকে ঘরে নিয়ে যা।
উমা অবজ্ঞার চোখে অবনীর দিকে একবার চেয়ে দেখেই পাশ কাটিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। তাই দেখাদেখি অবনীর পিছু নিলেন উমার। মধুমিতা জিজ্ঞেস করল….উনি কে বড়মা?
__ উমার স্বামী। এবাড়ির জামাই।
কিন্তু এই পাঁচ বছর পর উনি কি মনে করে এখানে এলেন? যা মনে করেই আসুক, এসেছে এইটেই বড় কথা নয়?
তাই? তুমি জানতে চাও না বড়মা? তোমার মেয়ের প্রতি এতো নির্যাতনের পর উনি আবার কোন মুখে এবাড়ি এলেন ?এতোদিনে একটিবারের জন্যও কেন ওরা ছোড়দির খোঁজ নেয়নি? না উনি উমার স্বামী। কোন রাগের বসে মন কষাকষি করেছিলেন, এটা ওদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যপার। আজ উনি স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন ঠিক করেছেন। আমরা বাঁধা দেওয়ার কে?

কথাগুলো শুনে কেমন অস্থির লাগছিল মধুমিতার। এ কেমন নিষ্ঠুরতা? একটা মানুষের মনের খবর রাখেনা কেউ, জানতেও চায়না। বড়মার পথ আটকে ধরে মধুমিতা বলল….তুমি ছোড়দিকে জিজ্ঞাসা করেছ, সে কি চায়? ও কি সুখী হবে তোমাদের অবনীর সঙ্গে?
বড়মা বললেন… দেখ মধু, এসব কথা অবান্তর। স্বামীর ঘরই মেয়েদের জীবনে সব। এই যে ও সংসার ধর্ম ফেলে বাপের ঘরে পড়ে রইল একি খুব সুখের? আমার পরে কে দেখবে ওকে? তুমি আজ নয় কাল কলকাতায় চলে যাবে। ও কি করবে? দেখতে পারবে তুমি?
__ ও নিজে নিজেকে দেখবে, চাকরি করবে। ও তো পড়াশুনা জানে।
বড়মা রাগান্বিত হয়ে বললেন….এতো সহজ নয় মধু। গ্রামের বাইরে ও একা বের হয়নি কখনো। ও করবে চাকরি?”
মধুমিতার কথাগুলো একরকম উড়িয়ে দিয়েই বড়মা বের হয়ে গেলেন। যাবার সময় বিশ্বরূপকে ডেকে একবার কি যেন বললেন। বিশ্বরূপ ঘরে এসে দরজায় ছিটকিনি দিল।
তোমার কোন কথার আমি আজ পর্যন্ত অমর্যাদা করিনি মধু, তবে এবার থামো। এটা ওদের ব্যাক্তিগত ব্যপার। ওদের ব্যাক্তিগত ব্যপার? ছোড়দি তোমার কেউ না? আমরা তবে এক পরিবারে নই? পরিবারে একজনের অসুবিধায় আরেকজন কথা বলবে না তবে কিসের বাঁধন? আমরা সমাজের কেউ নই? সামাজিক দায়বদ্ধতা কি সব সময় কটা অন্ধকার কুশংস্কারে ঘেরা? একটা মেয়ে চরম নিষ্ঠুরতার মধ্যে দীর্ঘদিন কষ্ট পেয়েছে। ওরা রাতের বেলা ছোড়দিকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল, এতোদিন খোঁজটাও রাখেনি। আজ ওরা এসে দাঁড়ালেই যেতে দেব? একটা প্রতিবাদও হবে না? তুমি একজন ভাই হয়ে বোনের প্রতি তোমার কোন দায় নেই?

বিশ্বরূপ মাথা নেড়ে বললতুমি হয়তো ঠিকই বলেছ কিন্তু ছোড়দির ভবিষ্যত কি হবে তা নিয়ে তো একটা আলোচনা দরকার। মধুমিতা হঠাৎ কেঁদে উঠে বললতবে আলোচনা কর! তুমি ওকে সাহায্য কর রূপ, ছোড়দির মন ওই পাষন্ড গুলোর থেকে হাজার মাইল দূরে। ওখানে থাকতে গেলে সে মরে যাবে। অবনীকে ছোড়দি ভালোবাসে না, ঘৃণা করে।
বিশ্বরূপ দুই হাতে মধুমিতা কে আঁকড়ে ধরে বলল…. আচ্ছা আচ্ছা! সে হবে ক্ষণ। রাতের আগে তো কিছুই হবেনা। এখন আমার কথা শোন।
কি? এদিকে তাকাও আগে! এতো খেটেখুটে সাজলে, এখন চোখের কাজল ধেবড়ে দিও না প্লিজ। চার ঘন্টা ধরে সেজেছে, আরো চার ঘন্টা যাবে মেকাপ ঠিক করতে।
বিশ্বরূপের কথায় হঠাৎ স্বলজ্জ মুখে হেসে ফেলল মধুমিতা। বিশ্বরূপ বলল….এটা আমাদের বিয়ের পর প্রথম পুজো মধু! হচ্ছে টা কি? আজ আমরা খালি গম্ভীর গম্ভীর আলোচনা করব ?
মধুমিতা একটু অবাক হয়ে বললে….তবে?
_ তবে? মুখে বলতে হবে? মধুমিতা লজ্জায় লাল হয়ে বিশ্বরূপের বুকের মধ্যে মুখ লুকাল…. ছোড়দিকে নিয়ে কি করি আগে তাই বল। মধুমিতা কে আরো খানিকটা কাছে টেনে নিয়ে বিশ্বরূপ বলল _ দেখছি! আমি বড়মা আর বাকিদের সাথে এবিষয়ে কথা বলব, তবে একটু পরে। এখন তুমি চাইলে আমি কিন্তু ঘরে খিল দিয়ে বসতে পারি।
নাহলে…. এখানকার আরো কয়েকটা পুজোয় আমাদের নিমন্ত্রণ থাকে। অনেক করে বলেছে, নতুন বৌ নিয়ে আসতেই হবে। চট করে রেডি হও, একটু ঘুরে আসি।
মধুমিতা বিশ্বরূপকে ঠেলে সরিয়ে বলল…. যাবে তো চল। আমি রেডি।
ঘর থেকে বের হবার সময় উমার সঙ্গে আর দেখা হয়নি মধুর, কেবল উপরের ঘরে থেকে উমার কান্নার সুর ভেসে আসছিল কানে। এমন করে পুজোর দিনে কেউ মেয়েকে কাঁদায়! একটু থমকে দাঁড়িয়েছিল মধু। বিশ্বরূপ চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছিল…. আমি সব ঠিক করে দেব।

ঘন্টা দুই গ্রামের অলিতে গলিতে পুজোর আমেজে মনটা ভালো হয়েছিল ঠিক, কিন্তু ছোড়দির কান্নার আওয়াজটা কানে বাজছে বড়। তবু বিশ্বরূপের কথার উপর অগাধ আস্থা মধুমিতার। কোন অনর্থ সে হতে দেবে না সে বিষয়ে মধু নিশ্চিন্ত। বের হবার সময় বাড়ির একেবারে সদর দরজার বাইরে প্রকান্ড এক মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল মধু। উমার শশুরবাড়ি নাকি বিরাট অবস্থাপন্ন। ফিরে এসে সে গাড়িখানা আর দেখা গেল না। মধু মনে মনে ভাবল….চলে গেছে? গেলেই ভালো। এতোদিন বাদে ছোড়দিকে নিতে এসেছিল কোন সাহসে? এবার আমি ছোড়দিকে কলকাতায় নিয়ে যাব। ও চাকরি, ব্যবসা যাহোক করবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। এভাবে ঘরে পচে মরতে দেব না।
আবার ভাবল….জামাই বাবাজীবন কাছাকাছি কোথাও গেছে হয়তো। বড়লোক বাড়ির সুপুত্তর। উপঢৌকন ছাড়া খালি হাতে এসেছে বোধহয়।
মূল ফটক পেড়িয়ে উঠোন থেকে গলা তুলে চেঁচিয়ে ডাকল…. ছোড়দি! ও ছোড়দি।
কোনদিক থেকে কোন সারা মিলল না। আত্মীয় পরিজন, ঠাকুর চাকর সকলকে উমার ব্যপারে জনে জনে জিজ্ঞেস করল । সকলেই চুপ। এক ছুটে উপরের ঘরে গিয়ে দেখল ঘর ফাঁকা। দূরে বড়মাকে দেখে এক ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল….ছোড়দি কোথায় গো?
ঘরে। কই? ঘরে তো নেই।
নিজের ঘরে। অবনী তাকে নিয়ে গেছে। চোখের সামনে সমস্ত পৃথিবী যেন দুলে উঠলো মধুমিতার। দুলছে সমস্ত ঘর, করিকাঠ, খিলান, সিঁড়ি। দেওয়ার ধরে কোনমতে টাল সামলে এগিয়ে চলল মধু নিজের ঘরের দিকে। ঘরে ঢুকেই দরজায় খিল আটকে দিল । দরজার বাইরে থেকে বিশ্বরূপ ডাকল অনেকবার…. দরজাটা একবার খোল। আমি সব বুঝিয়ে বলছি মধু। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে অবিচল বসে ছিল মধুমিতা। মনে মনে একরাশ অভিমান বাহানা বানিয়ে এভাবে আমাকে বাইরে সরিয়ে নিয়ে গেলে? এতোবড় বিশ্বাসঘাতকতা! ভাগ্যিস চোখ খুলে দিলে! তুমিও তবে কারো মনের খবরের ধার ধারো না। এবার নিজের জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আমাকেও তো নিতে হবে রূপ।
সারা রাত একবারের জন্যও দরজা খোলেনি মধুমিতা। বসে থেকে থেকে কখন যে চোখের পাতা লেগে এসেছে কে জানে?

আজ মহা নবমী। ঢাকের বাদ্যি বেজে উঠেছে কোন সকাল থেকে। পুজোর আজ বিরাট ঘটা, অনেক আয়োজন। গ্রামের সকলে ঘোষবাড়ির পুজোয় নিমন্ত্রিত। জোড়া পাঁঠা বলি দেওয়া হবে আজ। একটা বিশুর চাকরি আর টুকটুকে বউ, অন্যটা উমার নামে। কালো ছাগল দুটোকে স্নান করিয়ে মন্ত্র পড়ে জোর করে মাথায় লেপে দেওয়া হচ্ছে সিঁদুর। মধুমিতা কালেকের পর এই সবেমাত্র দরজা খুলেছে, কানে ভেসে আসতে পাঁঠার পরিত্রাহী আকুতি। বাড়ি শুদ্ধু ধুন্ধুমার! মধুমিতা ধীর পায়ে এসে বিশ্বরূপের সামনে দাঁড়ালো।
বলি যে বন্ধ করতে হবে বিশ্বরূপ। যতদূর জানি পাঁঠাবলি হচ্ছে টুকটুকে বৌয়ের জন্য। সেই চাওয়াটাই যদি মিথ্যে হয়ে যায়? আর তাছাড়া আমি যে কোন ধর্মীয় সংস্কারের বশে বলি প্রথার বিরোধী। সে পশুই হোক বা মানুষ। কি বলছ? তুমি এভাবে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে অন্যকিছু নিয়ে আসছ?
__অন্যকিছু কেন? তুমি আমায় প্রতারণা করেনি? আমি আজ বিষয়টাকে এভাবে ছেড়ে দিলে আমিও একদিন তোমার হাতের মোয়া হয়ে রইব। আমি ছোড়দিকে কথা দিয়েছিলাম, তার পাশে আমি সব সময় থাকব, বন্ধু হিসাবে। তাই আমি আজই ছোড়দিকে আনতে যাব। যদি ফেরাতে পারি তবেই ওকে নিয়ে এখানে ফিরব। অবশ্য তোমরা যদি চাও তবেই। নচেৎ……

একটু দূরে চক্রবর্তী বাবুর দিকে তাকিয়ে মধুমিতা বলল আপনি কি আমার সাথে যেতে চান চক্রবর্তী বাবু? চক্রবর্তী মাথা নেড়ে বললেন চলুন।
মধুমিতা চক্রবর্তী বাবুর সঙ্গে সদরের দিকে এগিয়ে চলছিল। বিশ্বরূপ পেছনে ডেকে বলল…. একটু দাঁড়াও। যাবে বললেই কি অম্নি যাওয়া যায়? কিভাবে যাবে? পায়ে হেঁটে ? গাড়িটা বের করতে দেবে তো!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *