দেশ
মৌসুমী চৌধুরী
আজ প্রতিদিনকার মতো পড়াশোনার দিন নয়। আজকের দিনটি স্কুলে পালনীয় দিন। তবু
ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতির সংখ্যা জানার জন্য নাম ডাকার খাতাটা হাতে নিতে ক্লাস ইলেভে- নের ঘরে ঢুকল শ্রমণা। কারণ আজ স্কুলে ওদের জন্য দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ক্লাসরুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ছেলেমেয়েগুলো সবাই একসঙ্গে শ্রমণাকে উইশ করল ,
— ” হ্যাপী 75th ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডে, ম্যাম।”
আজ পনেরোই আগস্ট, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হল আজ। শ্রমণা দেখল ক্লাসরুমটাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে -ছে ছাত্রছাত্রীরা। আর ভারী অবাক হল দেখে যে ওদের প্রত্যেকের চোখমুখ কেমন আনন্দে জ্বলজ্বল করছে। সেটা কি উৎসবের আনন্দে, নাকি দেশের প্রতি ভালোবাসায়? দেশের গুরুত্ব ওদের কাছে কতখানি? দেশ আসলে কি তা ওরা কি জানে? শ্রমণা নিজেই বা কতটা জানে? নিজের মনেই খটকা লাগে।
এ ক্লাসটা শ্রমণার নয়। সীমাদি এদের ক্লাস টিচার। তিনি আজ আসেননি। তাঁর সাবস্টি- টিউট হিসেবে এ ক্লাসে এসেছে শ্রমণা। নাম ডাকা শেষ হলে শ্রমণার ইচ্ছে হল আজ ওদের সঙ্গে একটু গল্প করে।
— “আজ যে আমাদের দেশের ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবস সাড়ম্বরে উদযাপন করা হচ্ছে তোমরা সবাই জান তো?”
— ” হ্যাঁ ম্যাম, জানি-ই-ই…”
সবাই একসঙ্গে উত্তর দেয়।
— “আচ্ছা, তাহলে এবার বলো তো ‘দেশ’ বলতে তোমরা কে কি বোঝ? যে যার অনুভব অকপটে বলবে, হেজিটেট করবার কিছু নেই।”
শ্রমণা জানতে চায়,
— ” তুমি বলো তো, রাহুল।”.
সরল, অপাপবিদ্ধ মুখে রাহুল জানায়,
—” দেশ মানে আমার কাছে একটি ভূখন্ড, তার নদী-সাগর-পাহাড়-অরণ্য-তার মানুষ। আর সেই মানুষদের বেশিরভাগই তো আজও দরিদ্র সীমার নিচে বাস করে। তাই ‘দেশ’ বলতে, ম্যাম, আমার মনের পাতায় ভেসে ওঠে একটি গরীব দেশ-এর ছবি।”
একে একে অনেকেই উঠে দাঁড়িয়ে জানাতে থাকে “দেশ” সম্পর্কে তাদের অনুভব।
রুমা অনেকটা পড়া মুখস্থের স্টাইলে বলে ,
— ” এই বিশাল ভূখন্ডের যে অংশে মানুষ জন্ম
-গ্রহণ করে, যে মাটি-আকাশ-আলো-বাতাসে সে প্রতিপালিত হয়, সে-ই তার দেশ। কিন্ত আমাদের সেই মাটি-আকাশ-বতাস তো ধীরে ধীরে দূষণ বিষে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে, ম্যাম। তবে কি দূষণের চাদর জড়ানো এই ভূখণ্ডই আমাদের দেশ?”
এ তো এক কঠিন প্রশ্ন, মনে মনে ভাবে শ্রমণা! হাতড়ে বেড়ায় এর উত্তর।
গভীর দু’ চোখ তুলে নীলিমা বলে,
— “দেশ? সে তো ঠাম্মির কাছে শুনি দেশের বাড়ির গল্প। ঠাম্মি যে দেশের কথা বলেন সেই দেশ হল বরিশালের স্বরূপকাঠি। নদী খাল বিল ঘেরা সবুজ একটুকরো দেশ ছিল ঠাম্মির। সেই দেশ নাকি একদিন আর তাঁর নিজের দেশ রইল না। পর হয়ে গেল! এখনও সেই দেশের জন্য ঠাম্মির চোখে জল পড়ে! তাই “দেশ” মানে আমার কাছে ঠাম্মির চোখের জল, ম্যাম।”
নীলিমার ঠাম্মির আদলে শ্রমণা যেন ৭৫ বছরের বৃদ্ধা এই স্বাধীন দেশকেই অনুভব করতে থাকে। কাঁটাতারে টুকরা করা এ দেশ কি আজও কাঁদছে?
ফিরদৌস বলে ওঠে,
— ” দেশ মানে আমার কাছে তো ম্যাম, কিছু বিদ্রূপ আর সন্দেহ। ভারত-পাকিস্থানের ম্যাচ হলে আমাকে শুনতে হয় যে ভারত হারলে আমার নাকি আনন্দ হবে! আমাদের নাকি পাকিস্তানে চলে যাওয়া উচিত! কিন্তু বিশ্বাস করুন ম্যাম, ভারত হারলে আমার খুব কান্না পায়, জানেন? খুব কষ্ট হয়। “
চুপ করে বসে থাকে শ্রমণা। গলার কাছে কি যেন একটা পাকিয়ে আসতে থাকে।
লাস্ট বেঞ্চের আগের বেঞ্চে বসেছে ময়ূরী। বেশ ডাকবুকো মেয়ে হিসেবে গোটা স্কুলে পরিচিত। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বেশ গম্ভীর মুখে
সে বলে,
—” দেশ মানে আমার কাছে লাইন অফ কন্ট্রোল, কাঁটাতার, কার্গিল, কাশ্মীর, গান স্যালুট আর বাবার চলে যাওয়া। যেদিন কাশ্মীর থেকে কফিন বন্দী হয়ে বাবা বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন, তখন তাঁর মৃতদেহ জাতীয় পতাকায় মোড়া ছিল। সবাই বলাবলি করছি -লেন বাবা নাকি দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। সেই থেকে দেশ শব্দটির ওপর আমার তীব্র রাগ আর অভিমান! এই “দেশ”ই আমার বাবাকে অকালে কেড়ে নিয়েছে।
ইলেভেনের ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে করিডর ধরে অন্যমনস্কভাবে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে শ্রমনা। চারদিক থেকে দেশাত্মবোধক গান ভেসে আসছে। দূরে কোন ক্লাবের অনুষ্ঠানে স্বাধীনতা দিবস বিষয়ে গরমাগরম ভাষাণ দিচ্ছেন হয়তো কোন জন-প্রতিনিধি। শুধু শ্রমণার বুকের ভিতরে “দেশ” নামের একটা তীব্র মন খারাপ করা অনুভূতি যেন আছড়ে পড়তে থাকে।
যে প্রশ্নটা শ্রমণা জিজ্ঞেস করল ছাত্র ছাত্রীদের সেটাই যদি ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্য থেকে কেউ একজন উঠে দাঁড়িয়ে উল্টে
তাকেই জিজ্ঞেস করত, কি উত্তর দিত তবে? থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল শ্রমণা। তার ভাবনাটুকু এগিয়ে গেল স্মৃতির সরণি বেয়ে।
কলকাতার বুকে শ্রমণাদের তিন পুরুষের পুরোনো বাড়িটা বাবা কিছুতেই বিক্রি করতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু বাবা জীবদ্দশায়ই বাড়িটাকে এক প্রোমোটারের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন অবাসন তৈরির জন্য। সেই প্রোমোটার যেদিন পুরোনো বাড়িটা ভাঙতে শুরু করেছিলেন, সেই হাতুড়ির ঘা যেন বাবার বুকে এসে পড়েছিল। আর তখন বাবা প্রায়ই বলতেন ,
— ” এই পোড়া দেশে আইন বলে কিছু নেই! আইন এদেশে ঠুঁটো জগন্নাথ, রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে!”
সেটাও তো ছিল একটা ভাঙনের গল্প।
যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই কি জন্ম নেয় কি এই “দেশ” বোধটা? নাহলে আর আলাদা করে আমরা “দেশ”কে নিয়ে ভাবছি কই? যতক্ষণ সব ঠিকঠাক থাকে ততক্ষণ তার কথা মনেও আসে না। মাথার ওপর যখন কোন বিপর্যয় নেমে আসে, তখন আমরা তাকে খুঁজে ফিরি। তাকে শিখন্ডি করে মনের যত ক্ষোভ-দুঃখ উগড়ে দিই। আর সে যেন সুশীতল আঁচল বিছিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে, অনেকটা মায়ের মতো।
স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়েই হঠাৎ শ্রমণার একবার তার মা’কে ফোন করতে ইচ্ছে হল।