ছোটগল্পঃ অন্ধকার সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে – জয়ন্ত বাগচী

অন্ধকার সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে
জয়ন্ত বাগচী

কাজে গতি থাকুক আর নাই থাকুক মুখের গতি যে বেড়েছে এ কথা স্বীকার করতেই হবে । কোন কথা মাটিতে পড়তে পারে না । টু শব্দ হলেই তাই নিয়ে কথার সাইক্লোন বয়ে যায় । ট্রেনে বাসে তো আর চলার উপায় নেই ।বিশেষ করে আমাদের মত রিটায়ার্ড- লাইফের বুড়োদের ।একান্ত প্রয়োজন না হলে আর ট্রেন বাসে চাপি না ।অথচ এরই ভিতর আছেন বেশ কিছু নিরাকার যোগী । পা রাখার ঠাঁই না মিললেও তাঁদের থ্রি স্পেডস ,ফোর ডায়মন্ডস ,ডবল -এর ঠ্যালায় অস্থির হতে হয় ।
খোশ মেজাজে তারা চালিয়ে যান তাঁদের অশিক্ষিত পটুত্বের অলিম্পিক ক্রীড়া কৌশল ।তার মাঝে আছে এ দল ও দলের দলাদলি আলোচনা , ফুটবলের গোলাগুলি এবং অল্প বয়সীদের কনুইয়ের ঠেলাঠেলি ! মধ্যিখানে আমরা বুড়োরা দেখে শুনে চুপ করে থেকে করি পেন্ডুলামের মতো দোলাদুলি ।তারই মধ্যে হঠাৎ শোরগোল ! কি হলো?কি হলো? পাশে দাঁড়ানো এক ছোকরা বললো,একজন ভোগে গেল । মানেটা বুঝলাম না ।আবার কিছুক্ষনের মধ্যেই আওয়াজটা জোরদার হলো ।আমার পাশে থেকে কয়েকজন অতি উৎসাহী তরুণ আমাকে ওভারল্যাপ করে এগিয়ে গেল স্পটের দিকে ।যাওয়ার পথে মোটা জুতোর সোল দিয়ে আমার পায়ের পাতাটা একেবারে গিলে করে দিল ।একবার ছিঁহি করে উঠলাম বটে কিন্তু তিনি আমার দিকে না তাকিয়েই ছুঁড়ে দিলেন একটা “সরি” । অর্থাৎ কথা বলো না বাপ,সরি বলেছি সাতখুন মাফ ।
কিন্তু হৈ চৈ যে বেড়েই চলেছে ক্রমশঃ ।সবাই যেন একটা লোককে নিয়ে পড়েছে মনে হলো ।এবার শুনলাম একটা লোক ব্যাগে করে মানুষের দুটো কাটা মাথা নিয়ে চলেছে ।ব্যস আর যায় কোথায়!বাঙালির সুপ্ত পৌরুষ হু হু কোরে উথলে উঠলো । অতগুলো লোকের চিৎকারের ভিতরে লোকটি যে কি বলছে তা আর কেউ কানে নিচ্ছে না ।শুধু মার আর মার !ভয়ে মেয়েরা কেউ কেউ গায়ে আঁচলটা যুৎসই থাকা সত্ত্বেও আর একটু টেনে দিল ।কেউ চিলতে রুমাল ধরলেন রক্তিম অধরের তলায় ।ওদিকে যখন চলছে পাক -ভারত যুদ্ধ !
স্টেশনে ট্রেন থামতেই হুড়মুড় করে সবাই নেমে পড়লো ,আমিও নামলাম ।হৈ চৈ ব্যাপার ।যেন একটা তুষার মানব ধরা পড়েছে ।পুলিশ এলো হন্তদন্ত হয়ে ।ভিড় কাটান,ভিড় কাটান বলতে বলতে ট্রাফিক পুলিশি কায়দায় তারা হাত ছুঁড়তে লাগলো ।বুড়ো মানুষ জায়গা নিলাম একধারে ।
পুলিশ কর্তা সেই ব্যক্তির জামার কলার ধরেই দিলেন সপাটে এক চড় ।একজন বলে উঠলো পুলিশ গুলি চালাচ্ছে ।একথা শুনেই কিছু জনতা সটকে গেল মুহূর্তেই ।চড় খেয়ে তোবড়ানো মুখটা পচা ল্যাঙরা আমের মতো হয়ে গেল ।ঠোঁটের কোণে একটু রক্তও দেখা গেল ।একজন ছোকরা ব্যাগটা ধরে আছে ।পুলিশ অফিসার বললেন,কই দেখি? ছেলেটি ব্যাগের মুখটা একটু ফাঁক করলো ।অফিসার এক পলক তাকিয়েই চোখ বন্ধ করলেন ।পরক্ষণেই আফ্রিকান প্যান্থারের মতো চোখ দেখিয়ে নিমেষেই দিলেন লোকটার পেটে একটা গোত্তা ।লোকটা ওয়াক করে উঠেই কি যেন বলতে গেলেই অফিসার বললেন,চো–প !
এবার লোকটা মরিয়া হয়ে ছোকরার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়েই উপুর করলো স্টেশনের বাঁধানো মেঝেতে ।অনেকেই চোখ বন্ধ করলেন ।কিন্তু এ কি ! কি দেখছি আমি ! ঠিক দেখছি তো ? নাকি বুড়ো বয়সে চোখে ভুল দেখছি ? ঘোর কাটতে কিছুটা সময় লাগে ।ততক্ষনে উৎসাহী জনতার সাথে মান্যবর পুলিশ অফিসারটিও হওয়া ।কারন স্টেশন চত্তরে গড়াগড়ি খাচ্ছে ফ্যাকাশে গোলাপি রঙের দুটো গোল গোল সাঁতরাগাছির ওল ।ধন্য বাঙালী!
ধীরে ধীরে বাড়ির পথ ধরলাম ।রাত হয়েছে ।পথে একটা ছেলে আমাকে দেখে বললে,দাদু ,তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখুন ।শুনেই বুকের মধ্যে ধড়াস করে ওঠে ।কার আবার কি হলো ! আমার “ওগো”-র আবার কিছু হয়নি তো!সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে তাড়াতাড়ি পা চলালাম ।
বাড়ী থেকে প্রায় একশো গজ দূরে বিরাট জটলা ।এগিয়ে যেতেই আমার “ওগো” আমায় দেখতে পেয়েই চিৎকার করে ওঠে, ওগো আমাদের সব্বনাশ হয়ে গেল গো! আমি জিজ্ঞেস করি,ব্যাপার কি ? কিন্তু তার কান্না থামে না ।নাতনি বললে,দাদু বাড়ির ছাদে রকেট ভেঙে পড়েছে ।আগুন জ্বলছে ! কদিন ধরেই কাগজে দেখছিলাম বটে কিন্তু সে তো বিদেশে,আমাদের দেশে তো নয়! তবে এটা আবার কি ? ভারত রকেট ছেড়েছে কটা,তাহলে কি তাদেরই একটা ভেঙে আমার বাড়ির ছাদে পড়লো !হায়রে ইসরোর ভুলের মাশুল শেষে কি আমাকেই দিতে হলো!পুলিশ দমকলের লোকজন চারিদিকে ।দমকলের একজন এসে বললো,মনে হচ্ছে আগুনটা নিভে গিয়েছে।এবার আমরা বাড়ির ছাদে উঠবো ।
আমিও তাদের সঙ্গে যাব বলতেই প্রথমে একটু আপত্তি করলেও শেষে আমার জবরদস্তিতে রাজি হলো ।বিশাল বাহিনী নিয়ে উঠলাম ছাদে ।
সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে লোকের মুখ থেকেই জানতে পারলাম ঘন্টা দুয়েক আগে ওটা প্রচন্ড শব্দ করে ছাদে পড়ে ।আগুনের হালকা ওঠে।যাই হোক টর্চের আলোয় দেখলাম কালো মতো একটা কি যেন পড়ে আছে সত্যি ।পুলিশ অফিসার বললেন কাছে যাবেন না।অনেকরকম রেডিয়েশন হতে পারে ।দমকলের একজন একটা কিম্ভুত কিমাকার পোশাক পরে হাতে একটা লাঠির মতো জিনিষ নিয়ে বস্তুটার দিকে সতর্ক পায়ে এগিয়ে গেলেন।আস্তে আস্তে হাতের লাঠিটা দিয়ে নাড়া দিলেন ।খানিকটা নড়লো ।এবার আর একটু সাহস নিয়ে আর একটু কাছে গিয়ে আবার একটা খোঁচা মারলেন।এবার সেটা গড়িয়ে গেল।ভালো করে পর্যবেক্ষন করে বললেন,স্যর একটা তেলের টিনের ভেতর সাইকেলের টায়ার ভরে কেউ বদমায়েসী করেছে ।
শব্দ শুনে আগুন দেখে বাড়ির মেয়েরা ভয় পেয়ে ধুন্ধুমার কান্ড বাঁধিয়েছে ।ভাগ্য ভালো কোন মিডিয়া খবর পায়নি,না হলে হয়তো এতক্ষন আমার বাড়ির ছাদটাই গোটা বিশ্বের কাছে দর্শনীয় হয়ে উঠতো ।আমার “ওগো র কান্নার বাইট দেখা যেত ।বুঝলাম রাস্তায় যে ছোকরা আমাকে খবর দিয়েছিল এটা তাদেরই কাজ ।
শুনি বিদেশে যুবক যুবতীরা দেশের অগ্রগতি নিয়ে অনেক ভাবনা চিন্তা করে ।দুর্নীতির বিরুদ্ধে ,অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করে ।অথচ আমাদের এখানে তাদের রঙ্গ রসিকতায় মানুষজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে ক্রমশঃ ।
এইতো কদিন ধরেই বাড়িতে ফিসফাস শুনছি।আড়ালে আমার “ওগো “র কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানলাম,নাতি নাতনি ছেলে বৌ এমনকি আমার ” ওগো ” দিল্লি বেড়াতে যাবে পুজোয় ।তারই পরিকল্পনা চলছে ।আমাকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না কারন জানে সারা বছর যেখানেই যাই না কেন,পুজোর সময় বাড়ি ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না ।এখনই দেখছি ফ্যাশন হয়েছে পুজোতে তল্পী -তল্পা নিয়ে বাইরে যাবার ধুম অথচ আমাদের কালে ছিল ঠিক এর উল্টো ।দিনকাল বদলে গিয়েছে ।পুজোর সময় সকলে বাড়ি ছেড়ে যাবে আর আমাকেই সব ঝামেলা পোহাতে হবে ।এই তো গতবার পুজোর তিন দিন আগে ওরা পুরী বেড়াতে গেল ।বাড়িতে রইলাম এক ।সকাল থেকেই কেবল শুনছি ,দাদা বাড়ি আছেন নাকি,এমনি সব কথা ।আমাকে বারান্দায় দেখেই বললো,দাদু এটা নিন।বলেই ফস করে একটা বিল ছিঁড়ে হাতে ধরিয়ে দিলো ।টাকার অংকটা পাঁচশো ।
চমকে বললাম,পাঁচশো ! অমনি একজন বলে যা দিনকাল পড়েছে ওর কমে আর হয়না দাদু ।—হে হে বুঝতেই তো পারছেন- – – –
একজন বলে,দাদু বাড়িতে কেউ নেই?এক গ্লাস খাবার জল দিতে বলুন না।
বুঝতে পারি যে নিশ্চই আমার নাতনি সম্পুকে রাস্তায় দেখেছে আর সেই বাসনাতেই——
কিন্তু বাড়িতে তো কেউ নেই ভাই।
ও আপনি একা বুঝি?তাহলে তো দারুন মস্তিতে আছেন দাদু ।
আর একজন বলে,আবে কাকে কি বলছিস বে।দেখছিস না দাদু—-
যাই হোক একটু গলা নামিয়ে বলি,টাকাটা বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে না ভাই?একটু কম করো ।
ওমনি একটা ছেলে বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ফস করে হাত গলিয়ে আমার পা ছুঁয়ে বলে, মাইরি দাদু আপনি পাড়ার লোক হয়ে যদি এমন চেত্তা মারেন তাহলে তো আমাদের পুজো মায়ের ভোগে যাবে !
কি ভাষা রে বাবা ।যাই হোক পঞ্চাশ টাকা কম করে কোনরকমে রফা করলাম ।এমনি আরো কত এলো গেল ।কত ফিকির দরিদ্রনারণ সেবা, বালক বালিকাদের বস্ত্র বিতরণ,শীতের কম্বল বিতরণ কত কি ! সব এই শর্মা একা ঠেকালাম ।
ঢাকে কাঠি পড়লো।চতুর্দিকে মাইকে বীরেন বাবুর চিৎকার । আবির্ভুতা হলেন মহামায়া মহিষাসুরমর্দিনী ।একা বাড়ি ফেলে কোথাও যেতে পারছিনা তাই চুপ করে বারান্দায় বসে আছি ।সামনের রাস্তা দিয়ে জোড়া জোড়া ছেলে মেয়েদের ভিড় ।হঠাৎ দেখি আমার বাগানে পেয়ারা গাছের তলায় দুজন ।জিজ্ঞেস করি, কে ভাই ওখানে ? তোমরা কে ? কিছুক্ষন পরে চাপা গলায় উত্তর আসে,চেপে যান দাদু,আমরা রাধাকেষ্ট !
রাধারমণ! কি সুন্দর উত্তর ।বলি,তোমরা ওখানে কি করছো?
বলা যাবে না দাদু।ডিস্টার্ব করবেন না ।কত লোক যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে গুনতে থাকুন ।
একজন ছোকরা বাড়ির সামনে ল্যাম্প পোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে বলে,শালা জ্বালাচ্ছে খুব—বলেই দমাস করে একটা ঢিল মেরে দিলে বাল্বটাকে ভেঙে।অন্ধকারে রাস্তা ডুবিয়ে দিয়ে সেও কোথায় ডুবে গেল !
উৎসব মানে এখন আর মুক্ত মনে জমায়েত নয় ।উৎসবের সুযোগে চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচার আর জৈব তাড়নার নিবৃত্তিই হলো বর্তমান উৎসবের মূলমন্ত্র ।
রাতে রাস্তার ভিড় কমলে প্রতিমা দর্শনে বের হলাম ।বাড়ির কাছেই ।মন্ডপে তখন কেউই নেই দেখলাম ।মন্ডপে এসে দাঁড়াতেই মৃদ্যুশব্দে দুদ্দার আওয়াজ শুনতে পেলাম ।প্রতিমার পিছনে খানিকটা জায়গায় কিছু তরুণ সেই বাজনার তালে তালে শরীর ঝাঁকিয়ে কাঁপিয়ে তান্ডব নৃত্য কছে ।বাতাসে এলকোহলের কটু গন্ধ ।আমাকে দেখেই একজন বলে,দাদু বুড়ো বয়সে একবার ভেলকি দেখাবেন নাকি ?
পালিয়ে এলাম ।ভাবলাম বাড়ির ওরা ভালোই করে বাইরে গিয়ে ।বেড়াতে চলে গেলে তো এই সব নররাক্ষসের লীলা দেখতে হতো না ! সংস্কৃতির এই পরিণতি দেখে মনটা ভারাক্রান্তও হতো না ।দূর থেকে বসে বসেই আকাশের লক্ষ নক্ষত্র চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম,আমাদের বাংলায় আজ পুজো হচ্ছে।এ আমাদের প্রাণ,আমাদের আপন সত্ত্বা—- কি সুন্দর — কি পবিত্র!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *