ধারাবাহিক উপন্যাস: দ্বিতীয় পৃথিবী
(দশম তথা শেষ পর্ব)
অনিরুদ্ধ সুব্রত
অমৃতার ফোন রিসিভ করে সুমিত।
“— হ্যাঁ, সুমিত তোমার সঙ্গে খুব দরকারী কয়েকটা কথা ছিল । তুমি এখন কোথায় ?
— পলাশ পুর স্টেশনে, ট্রেন থেকে নামব এখনই।
— ও ! তাহলে…
— কী এমন দরকারী কথা অমৃতা ? তোমার গলা উদ্বিগ্ন শোনাচ্ছে কেন ?
— না, উদ্বিগ্ন নয় ঠিক। মানে…
— আচ্ছা, আমাকে স্পষ্ট করেই বলো অমৃতা। ট্রেন থেকে নেমে আমি প্লাটফর্মের কোথাও বসে শুনছি।”
শ্রাবণের শেষ বিকেলে পলাশপুর স্টেশনে মেঘের ফাঁক দিয়ে রোদ্দুর এসে পড়েছে। শহর ফিরতি যাত্রীরা ট্রেন থেকে নেমে পায়ে পায়ে ঘরের দিকে হাঁটছে। ক্রমশ রক্তিম সূর্য ঢলেছে পশ্চিমে। মানুষের পায়ের ছায়া দীর্ঘ হতে হতে পেরিয়ে চলেছে প্লাটফর্ম। সুমিত ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মের শেষ দিকটায় দ্রুত হেঁটে চলে যেতে চায়। ওদিকে লাইন পেরিয়ে একটা ঝুপড়ি চায়ের দোকান আছে। দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টার ট্রেন জার্নিতে ধুমপান বন্ধ ছিল। মুখটা যেন আড়ষ্ঠ হয়ে গেছে। চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে চা সিগারেট খেতে খেতে অমৃতার সঙ্গে কথা বলতে মন্দ লাগবে না। সুমিত দ্রুত পা চালিয়ে যায়। দোকানের বাইরের দিকে বেঞ্চে বসে । কানে তার মোবাইল চেপে ধরা। অমৃতা কথা বলে চলেছে। সুমিত চায়ের অর্ডার দিয়ে বসে। যখন অমৃতা বলছিল,
“— আমি ঠিক জানি না, বিক্রম কীভাবে জানল।
— মানে ? কী জানল ? কী জানার কথা বলছ অমৃতা ?
— হাউসিং এর সিকিউরিটি ছেলেটি বলেছে কিনা ,তাও বুঝতে পারছি না। তবু যদি কোনো ভাবে বিক্রম তোমার ফোন নম্বর জোগাড় করে, তোমাকে ফোন করে । তুমি জাস্ট অস্বীকার করবে। এটা মনে রেখো।
— কী বলছ অমৃতা ? কী অস্বীকার করব ? তোমার ফ্ল্যাটে একটা রাত থেকেছি, সেটা ?
কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব ?
— সম্ভব এবং সম্ভব। সম্ভব না হওয়ার কী আছে ? বিক্রমের এটা একটা কয়্যারি মাত্র। ও অত কিছু ভাবতে যাবে না।
—- এতো অকপটে বলছ তুমি অমৃতা ?
কিন্তু আমি তো ছিলামই একটা বিপদগ্রস্ত রাত। সেটা বললেই বা সমস্যা কোথায় ?
—- না, একদম না। আমি তোমাকে শুধু সাবধান করে দিচ্ছি। বিক্রম তেমন কিছু হয়তো শুনেছে।
ওর কথার ভাবে যা মনে হয়েছে আমার।
— তেমন কিছু বলতে, ঠিক কী শুনেছেন ?
— আমি জানি না। তবে ওর কথায় মনে হয়েছে আমার। হয়তো ও শুনেছে, কেউ একজন এসেছিল আমাদের ফ্ল্যাটে একদিন রাতে।
— ও ! তিনি কি এই ব্যাপারে জানতে চেয়েছেন ?
— না , যদিও এমন কোনো প্রশ্ন এখনও পর্যন্ত বিক্রম আমাকে করে নি। তবু আমার একটা টেনশন হচ্ছে। যদি কখনও কোনো ভাবে তোমার প্রসঙ্গ আসে, জাস্ট অস্বীকার করবে। বাকিটা আমি…
— প্লীজ, তুমি টেনশন কোরো না অমৃতা। তাছাড়া এটা যদি তিনি জেনেও থাকেন, যে কেউ একজন একদিন রাতে তোমার বাড়িতে এসেছিল, তাতেও তো সত্যি বলায় কোনো সমস্যা থাকে না। বিপদে পড়েই, তোমার পরিচিত কেউ এসেছিল, এমন তো হতেই পারে। তাই না ?
— হ্যাঁ, তা হয়তো ঠিক সুমিত। তোমার কথা যুক্তির। কিন্তু সে কথা আমি নিজে থেকে তো তাকে কখনো জানাই নি। এবং তারও ঊর্ধ্বে একটা কথা আছে, তোমাকে কখনো বলিনি।
— কী কথা অমৃতা ?
— বিয়ের পর প্রথম ভালবাসার দিন গুলোতে বিক্রমের কাছে আমি তোমার গল্প করেছি । তার কিছু কিছু ওর এখনও মনে আছে হয়তো। পরে যখন তোমার সঙ্গে আমার ফের যোগাযোগ হলো, সে কথাও একদিন ওকে বললাম। সেদিন বিক্রম হেসেছিল শুধু। তারপর যখন দায়িত্ব নিয়ে তোমার কবিতার বই বের করলাম, তখন একদিন বিক্রম শুনে খুব একটা স্বাভাবিক রিয়্যাক্ট করে নি।
— ও ! আচ্ছা। তাহলে তুমি কেনই বা জোর করে…
—- এরপর যদি সে সত্যিই জানতে পারে, যে সেদিন রাতে তুমিই এসেছিলে ফ্ল্যাটে, তাহলে বিক্রম যে কেমন রিয়্যাক্ট করবে, ঠিক ভাবতে পারছি না। তাই, তুমি অন্তত…
— স্বীকার করব না ? তাইতো ?
— হ্যাঁ, এটুকুই। বাকিটা আমি দেখো ঠিক সামলে নেব।
— আর কোনো সমস্যা নেই তো অমৃতা ?
আর যদি কোনো কিছু অস্বীকার করতে হয় বলো ?
— না না, আর কিছু কেন ? এটা শুধু আমাদের ভালোর জন্যই বললাম । তুমি কি অন্য কিছু ভাবছ সুমিত ?
— আমি এখনও তেমন কিছু ভাবছিই না অমৃতা। শুধু ভাবছি, সেদিন আমি শিয়ালদহ স্টেশনে দিব্যি তো কাটিয়ে দিতে পারতাম রাতটা। আমার সঙ্গে সেটা যায়। মিছি মিছি তুমি সেদিন আমার জন্য অতটা সমব্যথী না হলেই পারতে। তোমার মনে পড়ছে অমৃতা, সেদিন তুমি আমাকে কোনো প্রশ্ন করতে বারণ করেছিলে ? অথচ দেখো, একদিন সেই প্রশ্নের কী চরম প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হচ্ছে !
— ছাড়ো সে কথা। এখন আমি রাখছি। পরে সুযোগ হলে কথা বলব। বিক্রম হয়তো এক্ষুণি অফিস থেকে ফিরবে।”
পলাশ পুর স্টেশন থেকে সুমিতের বাড়ি ফেরার তাড়া থাকার কথা এখন। এমনিতেই তার মন ছিল বেদনায় আর্দ্র, ঋকে হস্টেলে রেখে এসে বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল তার। কিন্তু অমৃতার ফোন পেয়ে, এইমাত্র সে যা শুনল, তাতে মন তার হঠাৎই বড্ড এলোমেলো হয়ে গেল।
সুমিত অনেকক্ষণ চায়ের দোকানের বেঞ্চ ছেড়ে উঠতে পারল না। কয়েকটি ক্লিশে প্রশ্নের জটিল আবর্তে সে যেন বার বার পেঁচিয়ে যাচ্ছিল,
“— কোনো সম্পর্ক কী এমন লঘু ও আত্মশক্তিহীন দোদুল্যমান হয় অমৃতা ? আমি তো চির সাধারণ একজন ছিলাম । কোনো জোর, কোনো বাধ্যবাধকতা আমার কখনও নেই। একদিন কৈশোরে, যে কবিতাময়ীর স্বপ্ন দেখতাম, ভেবেছিলাম তুমিই সে। তারপর অযোগ্য আর অনধিকারের অপমানে দূর হয়ে গিয়েছিলাম তোমার জীবন থেকে শত যোজন। কখনও তোমার সামনে আসতেও চাই নি।
অথচ জীবনের মাঝপথে কেন নতুন করে ডাক দিলে ? সে কি আমার কবিতাকে অনুগ্রহ করতে ? কবিতা বা জীবন, কেউই যে অনুগ্রহ নিতে পারে না অমৃতা। বলেছ যা সে তো শুধু ভালবাসার কথা। দৃঢ় করে উচ্চারণ করেছিলে, বিশ্বাসের এক একটি কথা। ছোঁয়া যাক বা নাই যাক, দিগন্তে এক দ্বিতীয় পৃথিবীর স্নিগ্ধ সবুজ রূপ তোমার চোখ দিয়ে মুহূর্তের জন্য হলেও প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলাম।
আজ আমার সেই অস্পষ্ট দর্শন নিজেকে নগ্ন করে দেখাল তার সত্যি। কোনো একটি সম্পর্ক, সে যে ভাবেই শুরু হোক, যেখান থেকেই শুরু হোক, তাতে যদি এতটুকু শক্তি না থাকে, তবে তা মিথ্যে। বিক্রম বাবুর শূন্যতায় তুমি আমাকে কাছে ডেকেছ ঠিকই, আসন দাও নি। বিশেষ বন্ধুত্বের যে গল্পটা তুমি রচনা করেছ, সে একান্ত তোমার নিজের জন্য। জগতের কাছে, সময়ের কাছে, বিক্রমের কাছে তার জন্য আজ তোমার জবাবদিহির বিন্দুমাত্র জোর নেই। সুমিত একটি খেলনা, তাকে আদর করেও প্রয়োজনে ছুড়ে ফেলা যায়। সুমিত নিস্প্রাণ হলে আজ তোমার সবচেয়ে ভালো হতো অমৃতা। তবে তুমি বেশ করেছ, অন্তত নিজেকে প্রকাশ করে দিতে পেরেছ একটি আবেগ সর্বস্ব মানুষের কাছে। “
এমন নানান স্বগত অনুচ্চারিত কথায় সুমিত স্টেশনের চায়ের দোকানের বেঞ্চে যেন মিশে যাচ্ছিল বিকেল গড়িয়ে সন্ধের প্রথম অন্ধকারে। তবু বিন্যস্ত নিজেকে হাতড়ে নিয়ে সুমিত উঠতে চাইল বেঞ্চ ছেড়ে। এমন সময় আবার তার মোবাইল বেজে উঠল। মোবাইলের ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো সুমিত,
” —- আবার অমৃতা ?”
প্রথম কয়েক বার রিং হয়ে চলল, সুমিতের রিসিভ করতে ইচ্ছে করল না। শুধু তাকিয়ে থাকল ঘসে যাওয়া পুরনো মোবাইলটার বিবর্ণ ডিসপ্লের দিকে। কিন্তু তাও সে পারল না বেশিক্ষণ।
আবার রিং হতে থাকল সুমিতের মোবাইল। হঠাৎ কী মনে হতে রিসিভ বোতামে আঙুল ছুঁয়ে,
“— হ্যাঁ, বলো অমৃতা ?
— তুমি ভয় পেও না সুমিত ।
— কেন অমৃতা, ভয় পাবো কেন আমি ?
—- না, মানে বিক্রম ওসব নিয়ে কোনো চাপই নেয় নি জানোতো।
—- আচ্ছা বেশ।
—- হ্যাঁ, এই মাত্র অফিস থেকে ও ফিরল দিল্লির টিকিট নিয়ে । এক সপ্তাহ আগেই , মানে কালই আমাদের ফ্লাইট । এক সপ্তাহ দুজনে বেড়ানোও হবে, তারপর বিক্রম ওর ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকবে আর আমি প্রোজেক্ট নিয়ে। মোটামুটি দিন কুড়ির আগে ফেরা হচ্ছে না।
—- বাহ্ ! খুব ভালো খবর অমৃতা।
— আর হ্যাঁ, সুমিত এর মধ্যে তুমি কখনও ফোন কোরো না। আমি সুযোগ হলে করব। ঠিক আছে ? ফিরে এসে না হয় তোমার কবিতা শুনব ।
— একদম ঠিক আছে অমৃতা, ততদিনে আমি বেশ কিছু কবিতা লিখে ফেলব।
—- ওয়াও ! দারুণ ! তাহলে রাখছি।
— হ্যাঁ, রেখে দাও। তুমি খুব ভালো থেকো অমৃতা।”
কথা বন্ধ হলে, নিজের এক হাতের আঙুল গুলোকে অন্য হাতের আঙুলে ছুঁয়ে দেখতে থাকে। সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রের কোথায় যে কী বিষাদ বেজে উঠছে, মুহূর্তে তা সে পূর্ণ মাত্রার বোধ দিয়ে বুঝে উঠতে পারে না। শৈশবের কলাপাতায় বাঁধা খেলাঘর, দিনের শেষে ডানপিটে ছেলেরা ভেঙে দিত। তখনও সুমিতের খুব কান্না পেত। কিন্তু চির দুর্বল সে খুব কিছু প্রতিবাদ করতে পারত না। বরং ডানপিটে ছেলেরা বলত,
“— পাতা দিয়ে বাঁধা ঘর, থাকে নাকি !”
অমৃতার সঙ্গে তার তো ঘর নয়, বরং গভীর এক মনোজগতের খেলাঘর গড়ে উঠেছিল বলে ভেবে নিয়েছিল সে। কিছুই ছিল না তার প্রামাণ্য। শুধু গভীর এবং গোপন এক অঙ্গীকার। আজ সামান্য কিছু কথায় সে অঙ্গীকার কতটা সারবত্তাহীন সুস্পষ্ট হয়ে গেল সুমিতের মনের কাছে। আজকে আবার সে নতুন করে বুঝল, মহানুভবতা কোনো দিনই ভালবাসা নয়। বুঝল যা ভালবাসা নয়, তাকে গভীর অরণ্য পথের অন্ধকারে হাত ছেড়ে দিয়ে ফিরে যাওয়া যায়। অমৃতার জীবনের বিশেষ সময়ের জনৈক কবিয়াল এই সাধারণ সুমিত। এই সহজ ও সত্যি আজ পরোক্ষে বলে চলে গেল অমৃতা।
সুমিত আবার বসে পড়ল চায়ের দোকানের বেঞ্চে। ফের এক কাপ চা চেয়ে নিল। পকেট থেকে সিগারেট বের করতে গিয়ে, দেখল নেই। হাতড়ে দশ টাকা বের করে দোকানদারকে দিয়ে বলল,
“— বিড়ি পাঁচ টাকার।”
প্রায় সকাল থেকে অভূক্ত পেটে ফের গরম চা। সুমিত যন্ত্রের মতো চুমুক দিচ্ছে পাত্রে। দেশলাইটা টেবিলে ঠুকে যাচ্ছে অনবরত। চা শেষ হলে বিড়িতে আগুন ধরিয়ে টানতে শুরু করল। তারপর মোবাইলটা পকেট থেকে বের করল আবার। হঠাৎ চোখ ভিজে এলো তার। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল, কেউ দেখছে কিনা তাকে। বাঁ হাতের চেটো দিয়ে মুছে নিল চোখ। আর ঠিক তার পরেই হঠাৎ কী যেন ভেবে, মোবাইলের কন্টাক্ট তালিকা থেকে অমৃতার নম্বরটা ব্লক করল আঙুলে । মুখ তুলে দূর রেল লাইনের দিকে তাকিয়ে এক দৃষ্টে কী সব ভাবল। তারপর বেঞ্চ ছেড়ে উঠে হাঁটতে শুরু করল ঘরের দিকে।
প্রান্তিক ছোটো শহর-গ্রামের মেশা জনপদ এই পলাশপুর। সুমিত ঘুলিয়ে ওঠা সন্ধের জনৈক পথচারী। জুলাই মাসের অনাবৃষ্টির গুমোট বাতাস স্যাঁতসেতে গন্ধ নিয়ে বিলম্বিত লয়ে মাঝে মাঝে গায়ে এসে লাগছে। স্টেশন থেকে এক কিলোমিটারের মতো পথ সুমিতের ঘর। অথচ আজ সে কী ভীষণ মন্থর হাঁটছে। গত দু’তিনটে বছর সাদামাটা সুমিত যেন পুরোনো ছ্যাদলা দেওয়ালে বিজ্ঞাপনের রঙে রঙিন হয়ে উঠেছিল মনে। তার প্রতিবাদী তীক্ষ্ণ, রূঢ় কবিতা গুলোর গায়ে ধীরে ধীরে লাগতে শুরু করেছিল প্রেমের মেদ ও মাংস। যৌবনের এক সুদীর্ঘ অধ্যায় সুমিত কেবল অস্বস্তির কবিতা লিখে আসছিল। হঠাৎ করেই সেই পথ বেঁকে গিয়েছিল স্নিগ্ধ, শান্ত, কল্পিত শান্তির দিকে।
কিন্তু জীবনকে যেভাবে সহজ মনে হয়, আসলে জীবন তা নয়। বারংবার তার সামনে এসে হাজির হয় ঘাড় ঘুরিয়ে দেওয়া সময়। কৈশোরের ছিন্ন-স্বপ্ন সুন্দর, সুমেধা অমৃতা আশ্চর্য ধুমকেতুর মতো এসেছিল। না, আজ আর এসেছে বলে, ভাবতে পারছে না সুমিত। অবাক অতীতের ছায়ায় আজকের অমৃতা ঢাকা। যে বিষণ্ণ অমৃতা পাথর হয়ে কাছে এসেছিল, হয়তো সেদিন তার সত্যিই সাধারণ এক কবি সুমিতের মতো মানুষকে পাশে দরকার ছিল। আজ সেই অমৃতা হয়তো মধ্যবর্তী মনন-স্তরের খুব বেশি প্রয়োজন আছে বলে আর মনে করে না। ফলে এই অদৃশ্য সম্পর্কের ভূত কেনই বা সে বৃথা বয়ে নিয়ে চলবে সম গুরুত্বে।
বড় রাস্তা ছেড়ে ছোটো গলির আপাত অন্ধকার পথে ছোটো ছোটো দোকানের অল্প অল্প আলোয় খানা খন্দ পেরিয়ে সুমিত তার ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে এগিয়ে যায় এক চিলতে পরিচিত ভাড়া ঘরের দিকে। অথচ সে জানে না, সেখানেই বা কী উপকাহিনি অপেক্ষা করছে তার জন্য।
নিজেদের এই ভাড়া ঘরটির নিয়মিত ভাড়াটা এখনও সুমিত তার স্বল্প আয় থেকেই মেটায় । সে শুধু কানে শুনেছে, রণিতা একটি ফ্ল্যাট বুক করেছে প্রফুল্ল নগরে। কিন্তু শত অবাক হলেও নিজের ব্যর্থতা আর অক্ষমতার জন্য কখনও সেই নব নির্মিয়মাণ ফ্ল্যাটের রূপ বা আকার আয়তন নিয়ে বিন্দুমাত্র কৌতুহল দেখায় নি সে। তাছাড়া রণিতার বিজনেস যত ভালোই হোক, তা থেকে একটি ফ্ল্যাট কেনার সাহস যে রাতারাতি তৈরি হওয়া সম্ভব নয়, যদি না পিছনে বাপ্পাদিত্যর মতো ধনীর গ্যারান্টি থাকে — তাও বুঝতে পারে সুমিত। কিন্তু তা নিয়ে অভিযোগ দেখানোর জোর সে করেনি। দীর্ঘ দাম্পত্যের ফাটল যখন বড় হা হয়ে গভীর খাড়া গর্ত তৈরি হয়েছে, তখনও সুমিত ধীরে ধীরে চুপ হয়ে যেতে চেয়েছে। যা রণিতা একেবারেই মেনে নিতে পারে নি। দীর্ঘ দিন কেবল একটা রাত্রি বাসের ঠিকানা ছাড়া এই সংসার, দাম্পত্য শূন্য হয়ে পড়েছে। ক্রমশ পরস্পর মানিয়ে নিয়েছে আপাত স্তব্ধতার শূন্য ভবিতব্য।
শুধু মাঝখানে ঋ ছিল একটি নোঙর। যেখানে সারাদিন ভেসে চলা নৌকো দুটি অন্ধকারে এসে থামত। তারপর আবার রাত পোহালে পাড়ি দিত যার যার উজান ভাটিতে।
আজ এই ক্লান্ত ব্যর্থ সন্ধেবেলা সুমিত ফিরেছে সেই পুরনো নিচু স্বল্পায়তন ভাড়া ঘরের দরজায়। যখন তার মাথাটা যেন যন্ত্রণায় দু’ভাগ হয়ে আছে। ঋর এই অবধারিত অনুপস্থিতি যেমন সেই যন্ত্রণার এক ভাগ, তেমনি আকস্মিক ভাবে এমন দিনেই অমৃতা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে বাকি অর্ধেক মস্তিস্ক।
খানিকটা জড় অথর্বের মতো সুমিত ঘরের দরজায় হাত ছোঁয়ায়। সঙ্গে সঙ্গে আশ্চর্য হয়ে দেখে দরজার কপাট ভিতর থেকে খোলা থাকায় হা হয়ে খুলে গেল। সুমিত ঘরের ভিতরে পা দিয়ে ঢুকতেই চমকে ওঠে,
“— কান্নার শব্দ ?”
দ্রুত ঘরের ভিতর দিকে এগিয়ে যায় সুমিত। দুটো ঘরের শেষ ঘরটা থেকে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ আসছে।
কিন্তু এ কান্নার শব্দটি তার চেনা। যার পর নাই হতবাক সে। তাহলে কি,
“— রণিতা ? কাঁদছে ? তাও এতটা ভেঙে পড়া কান্না ? কিন্তু হঠাৎ কী হলো তার ? তবে কি তার ঋকে ছেড়ে থাকার কষ্ট ? কিন্তু তা-ইবা কেন হবে ! ঋকে হস্টেলে রেখে পড়ানোর স্বপ্নটা রণিতার দীর্ঘদিনের। আর এই ব্যাপারে সন্তান বাৎসল্যে কাঁদবার মতো মনের মানুষ রণিতা কখনো নয়। তাহলে সে কাঁদছে কেন ? সে তো স্বপ্ন, সুখ, আর আত্ম সাফল্যে আজ নিশ্চিন্ত হাসবে !”
অনেক দিন রণিতার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের জোরে বিশেষ কথাবার্তা নেই তাদের। সুমিতের গলার স্বর কিছুতেই উঠছে না। তবু সে হাত বাড়িয়ে দরজার কপাট সরাল। এটা আসলে দীর্ঘ দিন সুমিতের ঘর। এ ঘরে রণিতা প্রায় দু’বছর হলো দাম্পত্যের মায়া নিয়ে প্রবেশ করে নি। ঋকে নিয়ে পাশের ঘরে থেকেছে। সুমিত তার বইপত্র, লেখার খাতা ইত্যাদি নিয়ে এই ঘরে কাটিয়ে দিয়েছে, একা একা রাতের পর রাত।
অথচ ঘরে ধীরে পা ফেলে প্রায় নিঃশব্দে ঢুকে, সুমিত অবাক— রণিতা উলটো দিকে মাথা দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মুহূর্ত কী করবে বা বলবে বুঝতে পারে না সুমিত। তবু খারাপ লাগে তার। ভাবে রণিতা কী এমন আঘাত থেকে এভাবে নিজের অসহায়তায় কাঁদছে ? আস্তে আস্তে নিজের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করে সুমিত ডান হাতটা বাড়ায় রণিতার দিকে। গলায় তার শব্দ প্রায় নেই। তবু হাত দিয়ে সামনে রণিতার পায়ে স্পর্শ করে। বলে,
“— এভাবে তুমি কাঁদছ কেন রণিতা ? আমাকে কি বলা যায় ?”
কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ সুমিতের হাতের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে ওঠে রণিতা। গুটিয়ে নিয়ে পা কুঁকড়ে যায় যেন সে। ফুঁপিয়ে কান্না থামে। উপুড় শরীর পাশ ফিরিয়ে নেয়। তারপর হাত দিয়ে চোখ মুছতে চেষ্টা করে। সুমিত দেখে এ যেন কোন অন্য রণিতা। যাকে সে এভাবে ভেঙে চুরমার হতে দেখেনি । চরম কোন অসহায়তা তার চোখে মুখে। যে মুখ মেজাজ আর বিরক্তিতে তীক্ষ্ণ ফলার মতো খুরধার নয়। বরং বড্ড জবুথবু ঝড়ে বিন্যস্ত কোনো গুল্মের মতো মুচড়ে পড়েছে মাটিতে। রণিতা কোনো মতে উঠে বসার চেষ্টা করে। মুখ তুলে সুমিতের দিকে তাকাতেও আজ যেন কিছুতেই পারছে না রণিতা। তবু সে নিজের মধ্যে জোর হাতড়ে হাতড়ে অস্ফুট জিজ্ঞাসা করে,
“— ঋকে ঠিক ঠাক বুঝিয়ে এসেছ তো ? মেয়েটা কোনো দিন একা থাকেনি ?”
সুমিত আবার একটু অবাক হয়। রণিতা তার সঙ্গে এমন নরম করে কতদিন পরে কথা বলছে। কিন্তু সে কি মেয়েকে ছেড়ে থাকতে হবে, এই দুঃখে কাঁদছিল ? বুঝতে পারে না সুমিত। তবু মুখে বলে,
“— হ্যাঁ, ঋকে সব বুঝিয়ে এসেছি। তাছাড়া সামনে পুজোর ছুটিতে বেশ কিছু দিন ও বাড়িতে এসে থাকতে পারবে । “
সুমিতের কথা শেষ না হতেই রণিতা বলল,
“— তোমার সারাদিনে খাওয়া হয়নি নিশ্চয়ই ?”
রণিতার মুখে আবার আশ্চর্য উচ্চারণ ! স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছে সুমিত। রণিতার এ কোন পরিবর্তন দেখছে সে ! ভালো করে ভাবতে পারে না সুমিত। তবু তার মুখ থেকে অবলিলায় বেরিয়ে আসে একটি প্রশ্ন ,
“— তুমি অমন করে কাঁদছিলে কেন রণিতা ?”
রণিতা এবার যতটুকু নিজেকে গুছিয়ে নিতে পেরেছিল, আবার ঠিক ততখানি ভেঙে খানখান হয়ে যায়। কী ভাবে বলবে অথবা ঠিক কী বলবে কিছুই বুঝতে পারে না সে। এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে অপেক্ষমান সুমিতের দিকে। সুমিত বুঝতে পারে, এমন কিছু একটা ঘটেছে রণিতার যা সে অকপটে বলতে পারছে না। এমন কোনো চরম আঘাত, যা তাকে ভিতরে ভিতরে দুমড়ে মুচড়ে ফেলেছে।
রণিতার ঠোঁট আবার কাঁপছে। আবার সে যেন হড়পা বানের মতো প্রচণ্ড জলরাশি নিয়ে আছড়ে পড়বে। এমন অসহায় অবস্থা দেখে সুমিত রণিতার কাছে এগিয়ে যায় অজান্তেই। রণিতা আর নিজের ভিতরের প্রচণ্ডতা রক্ষা করতে পারে না। যেন আছড়ে পড়ে সুমিতের কাঁধে। হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে। সুমিত বলে,
“— যা-ই হোক রণিতা, আমার কাছে নির্দ্বিধায় বলতে পারো।”
রণিতা আরও জোর খানিকটা কাঁদে। সুমিত আবার তাকে শান্ত হতে বলে। সুমিত রণিতার পিঠে হাত রাখে। রণিতা যেন ভরসায় স্তিমিত হয়ে আসে। সুমিত জিজ্ঞাসা করে,
“—বলো রণিতা তোমার কী হয়েছে ? বাপ্পাদিত্য কিছু… ?”
রণিতা এবার পুরোপুরি ভেঙে পড়ে,
“— জানো সুমিত, বাপ্পাদিত্যর স্ত্রী আজ আমাকে চরম অপমান করেছে বাপ্পাদিত্যর সামনে। অথচ বাপ্পাদিত্য তার জন্য এতটুকু প্রতিবাদ পর্যন্ত করেনি।”
সুমিত এমন কিছু একটা আশঙ্কা করেছিল। এমন কিছু, যে আঘাত হয়তো বাপ্পাদিত্যর দিক থেকে এসেছে। সুমিত রণিতাকে তো গভীর থেকে চেনে। তার রাগ, অনুরাগ, অভিমান এবং ঘৃণার প্রতিটি আবেগ সুমিতের বহুদিনের জানা। কিন্তু আজ এই অসহায় রণিতাকে দেখে সুমিতের মনে মুহূর্তে আজকের অমৃতার প্রসঙ্গটিও এসে ধাক্কা দেয়। যেখানে দায়বদ্ধতাহীন সম্পর্ক গুলো স্বপ্ন দেখায় হয়তো, কিন্তু স্বপ্নভঙ্গে এতটুকু দেরি করে না। অথচ যা নিয়ে অভিযোগ জানানোর সুযোগ ও ইচ্ছে একদিন নষ্ট হয়ে যায়।
সুমিত দুহাতে রণিতার মুখ যেন গভীর কালো খনি থেকে তুলে এনে আপন আলোতে শান্ত করতে চায়। রণিতা ভেজা চোখে তাকায় বহুদিন পর চেনা সেই সুমিতের দিকে। সুমিত বলে,
” কান্না বন্ধ করো রণিতা। কার জন্য এবং কীসের জন্য কাঁদবে বলো। দ্বিতীয় পৃথিবী একটা দুঃস্বপ্ন । সেটা স্বপ্নের চেয়েও প্রবল প্রতারক। আমাদের দুজনেরই সেই দ্বিতীয় পৃথিবীর লক্ষ্য, আজ ভ্রষ্ট। কবিতার পংক্তিতে তাকে মানিয়ে গেলেও মাটিতে তা বড় বেমানান। তাই আমাদের চোখ মুছে ফেলা উচিৎ।”
রণিতা এবার নিজেই যেন খানিকটা চমকে যায়। সে জানত খুব অল্প অল্প অমৃতার কথা। মনে মনে ভেবেছিল, কবিতার নৈকট্যে হয়তো সুমিতের সঙ্গে অমৃতার একটি আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যেহেতু দীর্ঘদিন সুমিতের সঙ্গে রণিতার কথাবার্তা, ভাবের বিনিময় ছিল না, তাই এর বেশি সে জানত না। কিন্তু আজ সুমিতের ভাঙা গলায় এই সহানুভবতার উচ্চারণে রণিতা তেমন কিছু আন্দাজ করে। ভাবে, কোনো না কোনো ভাবে সুমিত অমৃতার কাছ থেকে আঘাত পেয়েছে। ফলে সুমিতের মতো, রণিতার হৃদয়েও হঠাৎ করেই সুমিতের প্রতি একটা সহানুভব কোত্থেকে এসে হাজির হয়।
শুধু মুখ ফুটে রণিতা বলে,
“— আচ্ছা সুমিত, আমরা কি পারিনা এই অধরা স্বপ্নের ধাঁধা থেকে মুক্ত হয়ে আর একবার নতুন করে বাঁচার চেষ্টা করতে ?”
সুমিত নিজেই তখন হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে । রণিতার কাঁধে তার মাথাটা এমনিই ভরসায় রাখে। ঘরের বাইরের আকাশ থেকে তখন ঘন মেঘের শ্রাবণ ; অন্ধকার ভেদ করে প্রবল বেগে পড়তে শুরু করেছে, সুতীব্র বৃষ্টি।।
–সমাপ্ত–
চমৎকার উপন্যাস দুই পৃথিবী। মানুষ আলেয়ার পিছনে মোহের ঘোরে ছুটে ক্লান্ত হয়। মোহ কখনও চিরস্থায়ী হতে পারে না। অভিনন্দন । খুব সুন্দর লিখেছেন।