এমনও হয়
ভূমিকা গোস্বামী
ছটায় এলার্মের বিশ্রী আওয়াজে ধড়মড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে ,চটপট রান্নাঘরে যায়। স্টিলের সসপ্যানে চায়ের জল চাপিয়ে বাথরুমে গেল মণি। বাবাইকে স্কুলের জন্য তৈরী করতে হবে , স্কুলের বাস সাড়ে ছটায় এসে যায়। তারপর শুভর অফিসের ভাত । এদিকে স্বপ্না আবার আজকে তারাপীঠ গেছে। চার পাঁচ দিন আসবে না ।
তোয়ালেটা কাঁধে ফেলে ছুটে যায় রান্নাঘরে। জল ফুটে গেছে। গ্যাসটা অফ করে। কমপ্ল্যানের জন্য গ্লাসে ফুটন্ত জল ঢেলে তাক থেকে চায়ের বয়াম নামিয়ে ঢাকনা খুলে এক চামচ চা-পাতা ফেলে দেয়। স্টিলের ডিস দিয়ে ঢেকে দেয়। বাঁ হাতে প্লাস্টিকের বয়াম ধরা। বয়ামের ডাকনাটা কোথায় গেল ?এই তো এখানেই রেখেছে … এদিক ওদিক চোখ বোলাতে থাকে মণি। গেল কোথায় ? বেশিক্ষণ খোলা থাকলে তো চা-পাতার গন্ধ চলে যাবে। তাড়াতাড়ি একটা ডিশ চাপা দেয় বয়ামের মুখে। দুটো কাপ ছাকনি গুছোতে থাকে। পাশাপাশি এটা ওটা সরিয়ে ঢাকনাটা খুঁজতে থাকে। নিচু হয়ে মেঝেতে খোঁজে। তাড়াহুড়োতে মেঝেতে পড়ে যায় নি তো ! সবুজ ঢাকনা পরিস্কার কালো স্ল্যাপের ওপর দেখা যাওয়ার কথা। কোথায় যে গেল ! বেশি সময় খোঁজাখুঁজির জন্য ব্যায় করা যাবে না বাবাইকে তুলে খাইয়ে স্কুল বাস ধরাতে হবে।
বাবাইকে বাসে তুলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সবুজ ঢাকনাটার কথাই মাথায় ঘুরছিল। সকাল সকাল বাঘের মতো রোদ উঠেছে। শ্রাবণ মাস বৃষ্টির দেখা নেই। ঘামতে ঘামতে হাঁটছে মণি।ভাবল – সাজানো গোছানো রান্নাঘর। কোথায় যেতে পারে!
বাড়ি ফিরে ফ্রিজ থেকে সবজি বের করে সিঙ্কে ভাল করে ধুয়ে কালো স্ল্যাপের ওপর রেখে সবজি কাটার ছুড়িটা হাতে নিতেই অবাক হল মণি, দেখল সবুজ ঢাকনাটা ওভেনের গায়ে হেলান দিয়ে রয়েছে। তাড়াতাড়ি চা-পাতার বয়মের মুখ আটকে , তাকে তুলে দিল। মনেমনে বলল ― কি সব ভুতুড়ে কান্ড রে বাবা। তখন এতো করে খুঁজলাম…
এদিকে মণি , চটপট সবজি কেটে তপ্ত কড়াইয়ে দিতেই ছ্যাঁ-ক করে উঠল। কড়াইটা ঢেকে রাতে ভিজিয়ে রাখা চাল প্রেসারে দিয়ে জল মেপে অন্য ওভেনে বসিয়ে দিল। ফ্রিজ থেকে ভাজা মাছ বের করে মশলা রেডি করতে লাগল।
শুভ স্নান সেরে অফিসের যাবার জন্য তৈরী হচ্ছে। মণি ওর খাবার সাজিয়ে টিফিন বক্স রেডি করছে-এমনসময় শুভর চিৎকার। – মণি শিগগিরি এসো।
মণি টিফিন বক্সের ঢাকনা আটকে দৌড়ে গেল বেডরুমে। শুভ বলল, – ― আমার গাড়ির চাবি কোথায় ?
–কোথায় আর যাবে , যেখানে রেখেছো সেখানেই আছে।
বাঁ হাত দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপরের ছোট ড্রয়ারটা দেখিয়ে শুভ বলল ― এই , এইখানেই রোজ রাখি। গতকালও রেখেছি। মণি কথা না বাড়িয়ে ড্রয়ারটা খুঁজতে থাকল। পাশাপাশি অন্য ড্রয়ার গুলোও। খুজতে খুঁজতেই বলল ― টেবিলে ভাত বেড়ে এসেছি খেয়ে নাও। তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি খুঁজে দেখি। ছটা ড্রয়ার খুঁজে চলেছে মণি কোথায় গাড়ির চাবি ? জ্বরের ওষুধ রয়েছে একপাতা । এক্সপেয়ার ডেট – জুন ২০২১ , মেঝেতে ফেলে দিল।নতুন সিঁদুরের কৌটো , আলতার বাক্স। বিভিন্ন সাইজের টিপের পাতা। ফ্রিজের চাবিটাও পড়ে আছে এককোণে। গাড়ির চাবি টা চোখে পড়ছে না। ওদিকে শুভ খেতে খেতে হাঁক পাড়ছে ― কি হল , মণি! পেয়ছো ?
-― না , তন্ন তন্ন করে সব ড্রয়ার খুঁজলাম। ভুল করে অন্য কোথাও রাখনি তো ?
–অন্য কোথাও কেন রাখবো । ঝাঁঝিয়ে উঠল শুভ।
মণি চুপ করে গেল। কথা বাড়াল না। চাবিটা না পেলে খুবই অসুবিধা হবে শুভ-র।
বেশ কদিন ধরেই এক একটা কাজের জিনিস হঠাৎ করেই হারিয়ে যাচ্ছে। ছ’ টা টেবিল চামচের চারটে দেখতে পাচ্ছে দুটো হারিয়ে গেছে। পিলারটাও পাচ্ছে না দুদিন ধরে।মণি ভেবেছে ― স্বপ্না এসে থেকে যা তাড়াহুড়ো করে, তরকারির খোসার সাথে হয়তো বাইরে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে।
আজকে ড্রেসিং টেবিলের সব ড্রয়ার পরিস্কার করে গুছিয়েছে মণি। অনেক আজেবাজে জিনিসে ভরে গিয়েছিল। ঘর মুছে , বাসন মেজে , স্নান সেরে আসতে আসতেই একটা বেজে গেছে। ব্রেকফাস্ট করারও সময় পায় নি। ইচ্ছেও করছে না। গাড়ির চাবিটা তো শুভ রোজ প্যান্টের পকেট থেকে ওপরের ছোট ড্রয়ারেই রাখে। কিচ্ছু ভাল লাগছে না।
ঠাকুরের আসনে জল মিষ্টি দিতে দিতে বলে ― এসব কি হচ্ছে গোপাল। চাবিটা কোথায় গেল ? খুঁজে দাও গোপাল। খুঁজে দাও।…..
বাবাইকে নিয়ে ফ্ল্যাটে আসতে আসতে মণি বলল – আজকে তোর পাপার গাড়ির চাবি উধাও। বাবাই চিন্তিত মুখে বলে – পাপা কিভাবে অফিস গেল ?
— ক্যাব বুক করে। কি করবে ? এদিকে সকাল থেকে যে বিশ্রী গরম ! ব্যাগ থেকে ফ্ল্যাটের চাবি বার করতে করতে বলল মণি।
― তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে খেতে আয়। আমি খাবার বাড়ছি।বলে রান্নাঘরে গেল মণি।
বাবাই জুতো খুলে তাকে রেখে ড্রয়িং রুমের বড় টিভির নিচের ওপরের ড্রয়ারটা খুলেই আশ্চর্য হয়ে ডাকল – মা মা শিগগিরই এসো।
রান্নাঘর থেকে মণি বলল – এখন আসতে পারবো না বাবাই, বোঝার চেষ্টা কর। খেতে বস তাড়াতাড়ি।
মা একবার এসে দেখে যাও না প্লিজ । কী….কান্ড…
টেবিলে দুটো থালা নামিয়ে বাবাই এর পিছনে গিয়ে দাঁড়ায় মণি।
উত্তেজনায় টগবগে বাবাই একটা একটা করে ড্রয়ার থেকে তুলতে তুলতে বলে – এই দেখ গাড়ির চাবি। এই তোমার চামচ আর পিলার। এই আমার রং পেনসিলের বড় বাক্সটা। তুমি বলেছিলে আমি নাকি স্কুলে ফেলে এসেছি। দেখেছো তো……
মণি কি বলবে ? অবাক হয়ে ভাবছে ― এই সব হারানো জিনিস একখানে কি করে ? চারদিকে ভয়ে ভয়ে তাকায় মণি। গা ছম্ ছম্ করে ওঠে ওর।