নিরুদ্দেশের যাত্রী
দেবাংশু সরকার
অমর সপরিবারে পুরী বেড়াতে যাচ্ছে। সপরিবারে নয়, বলা যেতে পারে সদলবলে চলেছে। সঙ্গে স্ত্রী পর্ণা, বাবা, মা ছাড়াও রয়েছে মামা, মামী, মামাতো ভাই রাহুল।
অমর এক বহু জাতিক সংস্থায় উচ্চ পদে কর্মরত। কাজের চাপে খুব একটা ঘুরতে বেড়াতে যেতে পারে না। দুর্গাপুজোর চারদিন ছুটি। সাধারনত পুজোর ছুটিতে অমর ঘর ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না। সারা বছর কাজের চাপে তার পরিবারের দিকে সে নজর দিতে পারে না। তাই যখন যেটুকু সময় পায় বাড়িতে কাটাতে পছন্দ করে। এবছর ব্যতিক্রম হতে চলেছে। অবশ্য এবছর ঘুরতে যাওয়ার বায়নাটা পর্ণা করেছে। অমরের বাবা মাও পর্নাকে জোরালো ভাবে সমর্থন করেছেন। রাজি হয়ে যায় অমর। হাসতে হাসতে সে বলে, “ঠিক আছে তোমরা যখন ভোটে জিতেই গেলে কালই ফ্লাইটের টিকিট কাটছি।”
“প্লেন! ওতো চল্লিশ মিনিটে পৌছে দেবে। ওতে মজা নেই। যাবো ট্রেনে চেপে। লুচি আলুরদম খেতে খেতে। নদী পাহাড় দেখতে দেখতে।” পর্ণার কথায় তার শ্বশুর শাশুড়িও সায় দেন।
ঠিক এই সময়ে ফোন আসে অমরের মামা বিজন বাবুর। বিজন বাবু নিয়মিতই ফোন করেন। খবরাখবর নেন। বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ চাপতে না পেরে অমরের মা তার দাদাকে বলেই ফেললেন তাদের পরিকল্পনার কথা। শুনে বিজন বাবু বললেন, “আমাদেরও অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় নি। তাহলে আমরাও যাবো। একসাথে সবাই মিলে গেলে বেড়ানোর মজাটাই হয় আলাদা।” অবশ্য অন্য একটা কথাও তার মাথায় আসে।
স্ত্রী নমিতা আর ছেলে রাহুলকে নিয়ে বিজন বাবুর ছোট সংসার। বিজন বাবু একজন সফল ব্যবসায়ী। বড় বাজারে তার বিরাট বড় কাপড়ের পাইকারি দোকান। সারা বাংলা থেকে তার দোকানে খদ্দের আসে। এমনকি বাংলার বাইরে থেকেও খদ্দের আসে। সব কিছু থেকেও তারমধ্যে এক দুশ্চিন্তা আছে তার ছেলেকে নিয়ে। রাহুল একজন আঠাশ বছরের তরতাজা যুবক। ছফুট এক ইন্চি লম্বা। পাকা ধানের মত গায়ের রঙ। কিন্তু সাংসারিক জীবনে তার মন নেই। আধ্যাত্মিক মার্গেই সে বিচরণ করে। এক গুরুর প্রভাবে জপ, তপ, সাধন, ভজন, গেরুয়া বসন এই নিয়েই তার জগৎ। এর বাইরে কোনো কিছু সে চিন্তা করে না।
এর আগেও একবার বিজন বাবু দার্জিলিঙে যাওয়ার কথা ভেবে ছিলেন। কিন্তু রাহুলের অনিচ্ছায় যাওয়া হয় নি। অবশ্য পুরীতে অনেক মঠ মন্দির দর্শনের আশায় রাহুল রাজি হয়ে যায়। বিজন বাবু ভাবেন অন্য কথা। পুরীর সমুদ্রে নব দম্পতিদের আনন্দ উচ্ছ্বাস দেখে যদি রাহুলের মনে কোনো পরিবর্তন আসে।
যথা সময়ে হাওড়া স্টেশন থেকে পুরীগামী ট্রেন ছাড়লো। রাহুল অবশ্য গেরুয়া বসন ছেড়ে সাধারন পোশাক পরেই এসেছে। মসৃণ ভাবে সেভ করেছে। রীতিমত ঝকঝকে লাগছে তাকে।সবাইয়ের সঙ্গে হেসে কথা বলছে। অবশ্য পর্নার থেকে কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখেছে। পর্ণার সঙ্গে কথা বলছে না যে তা নয়। তবে তার আড়ষ্টতা সকলের চোখে পড়ছে।
রাহুলের আড়ষ্টতা দেখে অমর পর্ণাকে মজা করে বলে, “তোমরা মেয়েরা অনেক ছলাকলা জানো। পুরীতে এমন সাজগোজ করবে, এমন কিছু করবে যা দেখে আমার ব্রহ্মচারী ভাইয়ের মনে বিয়ের ইচ্ছা জাগে।”
“তোমার ভাইকে যদি পাল্টে দিই। মানে পাল্টানোর চেষ্টা করি। তুমি হিংসা করবে নাতো?” হাসতে হাসতে পালটা প্রশ্ন করে পর্ণা।
“হিংসা! আমার ব্রহ্মচারী ভাইয়ের মনে বিয়ের ইচ্ছা জাগাতে পারলে যা চাইবে তাই দেবো।” উত্তর দেয় অমর।
“মনে থাকবে, পরে পাল্টি খাবে না তো?” কথার চিমটি কাটে পর্ণা।
ট্রেনের মধ্যেই পর্না কাজ শুরু করে দেয়। রাহুলের পাশে বসে গল্প করতে করতে হেসে ঢলে পড়ে রাহুলের গায়ে। খাবার পরিবেশন করতে করতে রাহুলের প্লেটে বেশি করে চাপিয়ে দেয়। বাঁধা দিতে গেলে রাহুলের হাত চেপে ধরে। আড়ষ্ট রাহুল কোনো রকমে খাওয়া শেষ করে নিজের জায়গাতে গিয়ে শুয়ে পড়ে।
পুর্ণ গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। বেশ ভোরেই ঘুম ভেঙে যায় রাহুলের। দেখে চা ওয়ালাদের আনা গোনা শুরু হয়েছে। সকলের জন্য চা কেনে রাহুল। আগের সন্ধ্যার আড়ষ্টতা কাটিয়ে বেশ সাবলীলভাবেই বলে, “বৌদি চা খান।” চোখ রগড়াতে রগড়াতে পর্না চায়ের কাপ নেওয়ার সময় রাহুলের আঙুলে আঙ্গুল ঠেকে।
ট্রেন থেকে নেমে পুরী স্টেশনের বাইরে এসে অমর একটা বড় অটো রিক্সা ভাড়া করে। নিজে ড্রাইভারের পাশে বসে, পর্ণাকে রাহুলের পাশে বসার সুযোগ করে দেয়। চলন্ত গাড়ি ডানদিকে ঘুরতেই সমুদ্র দেখে আনন্দে চিৎকার করে রাহুলের গায়ে হেলে পড়ে পর্না। গাড়িটা এসে দাঁড়ায় হোটেলের সামনে। লাগেজ নিয়ে এগোতে থাকে সবাই। পর্ণার হাতেও একটা ট্রলি ব্যাগ।
“বৌদি ট্রলিটা আমাকে দাও।” রাহুল পর্ণার হাত থেকে ট্রলিটা নিয়ে এগিয়ে যায়।
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে পর্ণা অমরকে বলে, “কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আপনি থেকে তুমি! আগে আগে দেখো হোতা হ্যায় কেয়া।”
“ক্যারি অন।” অমর বলে।
সারারাত ট্রেনে ঠিক ঠাক ঘুম হয়নি। দিনটা সবাই হোটেলে কাটিয়ে বিকালের দিকে গেল সমুদ্রের ধারে। বালির মধ্যে থেকে ঝিনুক কুড়োতে থাকে পর্ণা। দিতে থাকে রাহুলের হাতে। অমর উর্দ্ধমুখি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উৎসাহিত করে পর্নাকে। রাহুল প্রতিটা ঝিনুক উল্টে পাল্টে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। রাহুলের এই অদ্ভুত আচরণ দেখে পর্ণা প্রশ্ন করে, “কি দেখছো ওভাবে?”
“দেখছি কোথায় মুক্ত থাকে।” সোজা সাপটা উত্তর দেয় রাহুল।
“ঝিনুকের মধ্যে মুক্ত খুঁজে কি হবে? ওতো টাকা দিলেই পাওয়া যায়। খুঁজতে হলে মনের মুক্ত খোঁজো।” বলে পর্ণা।
“মনের মুক্ত! সে মুক্ত কোথায় পাওয়া যায়?” কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে রাহুল।
সমুদ্রের দিকে আঙুল দেখিয়ে পর্ণা বলে, “ঐ যে দেখছো সমুদ্র। ওর থেকেও বড়, ওর থেকেও গভীর আর একটা সমুদ্র আছে। তার নাম মন। তার মধ্যেই লুকোনো থাকে সেই মুক্ত।”
“মন নামে সমুদ্র আছে! কিন্তু আমার গুরুদেবতো আমাকে বলে নি!” অবাক হয় রাহুল।
“বলেনি! এতো ভারি অন্যায়! ঠিক আছে যে কদিন পুরীতে আছো, আমাকে তোমার গুরুদেব বলে মেনে নাও। অনেক কিছু এই কদিনে তোমাকে শেখাবো।” পর্ণার জটিল কথাগুলোর মানে বুঝতে না পেরে চুপ করে যায় রাহুল।
হোটেলে ফিরে দরজা বন্ধ করে অমর প্রায় কান্নাকাটি জুড়ে দেয়, “হায় হায়, পুজোর সময় ঘুরতে এসেও তোমার থেকে দুরে দুরে থাকতে হচ্ছে! কি দুর্ভাগ্য আমার!”
- তুমি আর কথা বলো না। কোথা থেকে একটা কৌপিন পরা সাধু বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছো। সাধারন সাধু হলেও কথা ছিল। এটাতো একেবারে মাথামোটা। আবেগ অনুভূতি বলে কিচ্ছু নেই। আমাকে জিজ্ঞাসা করছে – মনের মুক্ত কোথায় পাওয়া যায়? ভাবলাম আমাদের পাড়ার হারু স্যাঁকরার ঠিকানাটা দিয়ে দিই।
- তবে যাই বল, হি ইজ রিয়েলি ইনোসেন্ট।
- সেইজন্যইতো বদার করছি।
অভ্যাস মত বেশ ভোরেই উঠে পড়ে রাহুল। টোকা দেয় অমরের রুমের দরজায়, “অমর চল সানরাইজ দেখে আসি।”
“যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু ঐ দেখো, অমর এখনো নাক ডাকাচ্ছে।” দরজা খুলে উত্তর দেয় পর্ণা।
“ঘুরে এসো।” ঘুমে ভেজা জড়ানো গলায় বলে ওঠে অমর।
“এইতো অমর পারমিশন দিয়ে দিয়েছে। আমরা দুজনেই ঘুরে আসি। চটপট তৈরি নাও পর্ণা। বেলা হয়ে গেলে সানরাইজটা এনজয় করা যাবে না” অন্তত একজন সঙ্গী পেয়ে উচ্ছসিত হয়ে ওঠে রাহুল।
যেতে যেতে পর্ণা অমরকে ফিসফিস করে বলে যায়, “এক রাতেই বৌদি থেকে পর্ণা! পিকচার আবভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত।”
সমুদ্রের ধারে হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা দুরে চলে যায় ওরা। রাহুল দেখছে সমুদ্রের ঢেউ অনেক কিছুই ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বেলাভূমি থেকে। আবার অনেক কিছু নিয়ে আসছে বেলাভূমিতে । শুধু বেলাভূমি নয় রাহুলের মন থেকেও যেন আকাশ নীল সমুদ্র অনেক কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আবার নিয়ে আসছে অনেক কিছু।
“এবার ফিরতে হবে পর্ণা। অনেকক্ষণ বেরিয়েছি। আর দেরি করলে বকুনি খেতে হবে।” ব্যস্ত হয়ে ওঠেন রাহুল।
রাহুলের কথায় কান না দিয়ে পর্ণা বলে, “দেখো দেখো, ছেলে মেয়ে দুজন যেন ঢেউয়ের মাথায় দোল খাচ্ছে! কি অনাবিল আনন্দে হাসছে! আমার এখনো সমুদ্রে স্নান করা হলো না!”
“ওরা ইয়ং জেনারেশন। হৈ হুল্লোড়তো ওদেরই মানায়।” উত্তর দেয় রাহুল। - ও তাই! কত বয়স হবে ঐ ছেলেটার?
- পঁচিশ ছাব্বিশের আশেপাশেই হবে।
- তোমার কত বয়স রাহুল?
- আমি এখন টোয়েন্টি এইট প্লাস।
- সত্যিই তুমি ওদের থেকে অনেক বয়স্ক।
“তাছাড়া মনে হচ্ছে ওরা নিউলি ম্যারেড কাপল। ওরাতো উচ্ছ্বাস দেখাবেই।” সমুদ্র স্নানরত ঘনিষ্ঠ দুজনের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না রাহুল। - তুমি জানো নিউলি ম্যারেড কাপলরা কি করে?
- এই যা দেখছি।
- নিউলি ম্যারেড কাপলরা আর কি করে?
উত্তর না দিয়ে চুপচাপ হোটেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন নিজের অজান্তেই পর্ণার হাতটা ধরে ফেলে রাহুল। নিছকই হোটেলে ফেরার তাড়া আছে বলে নাকি মনের অন্তরালে কোনো বোবা আবেগের কুঁড়ি ধিরে ধিরে প্রস্ফুটিত হচ্ছে?
“কিরে, বলা নেই কওয়া নেই কোথায় গিয়েছিলি তোরা? ফোন গুলোও ফেলে গেছিস। আমরা পুজো দিতে যাবো বলে কখন থেকে তৈরি হয়ে বসে আছি।” রাহুলকে দেখে মৃদু ধমক দেন রাহুলের মা।
“ওরা সান রাইজ দেখতে গিয়ে ছিলো। আর কিছুক্ষন থাকলে সান সেটটাও দেখা হয়ে যেতো।” অমর রসিকতা করলো না বিরক্ত হলো ঠিক বোঝা গেল না।
দুটো অটো ভাড়া করেছে অমর পুজো দিতে যাবে বলে। মামা মামীকে একটা অটোতে উঠতে দেখে পর্ণা অন্য অটোতে উঠে ইশারায় ডেকে নেয় রাহুলকে।
পুজো দিয়ে ফিরতে বারোটা বেজে গেল। অমরের মা জোর করেই অমর আর পর্ণাকে সমুদ্র স্নানে পাঠালেন। রাহুলও যাচ্ছিলো। কিন্তু বিজন বাবু ইশারায় বিরত করেন। সমুদ্রে নেমে পর্ণা আনন্দে আত্মহারা। কিছুটা বালি তুলে অমরের ভুঁড়িতে মাখিয়ে দেয়।
সন্ধ্যা বেলায় সদলবলে রুটিন ভিজিট সমুদ্র তীরে। চা, সিঙাড়া খাওয়া। কিছু কেনাকাটা। অমর অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে যে কাল আর সানরাইজ দেখা নয়, সকাল সকাল তৈরি হতে হবে ভুবনেশ্বর যাওয়ার জন্য। সে গাড়ি বুক করে রেখেছে।
চন্দ্রভাগা, কোনারক, লিঙ্গরাজ, ধৌলি হয়ে গাড়ি পৌছলো খন্ডগিরিতে। পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে অনেকটা ওপরে উঠতে হবে বলে বিজন বাবু প্রথমেই হাত তুলে দিলেন, “আমরা বুড়ো বুড়িরা আর যাচ্ছি না। তোরা তিন জন যা।”
রাহুল, অমর, পর্ণা তিন জনে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলো। কিঞ্চিত স্থূলকায় অমর কিছুটা উঠেই একটা পাথরের সিঁড়ির ওপর বসে হাঁফাতে লাগলো। পর্ণার দমেও টান ধরছে। সুঠাম চেহারার রাহুল অবশ্য সাবলীল ভাবে সিঁড়ি ভাঙছে। পর্ণার অসুবিধে হচ্ছে দেখে তার হাতটা ধরে নেয় রাহুল। দুজনে উঠতে লাগলো উপরে, উপরে, আরো উপরে! অমর বসে বসে দেখতে থাকে ক্রমশ যেন দুরে চলে যাচ্ছে ওরা। দুরে, দুরে, অনেক দুরে!
আজ রাতের ট্রেনে ফেরার পালা। সকালে অবশ্য রাহুল পর্ণাকে নিয়ে বেরিয়েছে। কিন্তু বেলা দশটা বেজে গেছে, এখনো তাদের পাত্তা নেই! অমর দুবার হোটেলের বাইরে গিয়ে দেখে এলো। কিন্তু আসে পাশে কোথাও কেউ নেই। মনে মনে অস্থির হয়ে উঠছে সবাই।
ছোট্ট একটা চিরকূট রাহুলের মা পেলেন রাহুলের বিছানা থেকে – আমরা এখন নিরুদ্দেশের যাত্রী। আমাদের খোঁজ কোরো না।তোমরা বাড়ি ফিরে যাও।
অমরও নিজের ঘরে পেলো আর একটা চিরকূট – তুমি বলেছিলে, তোমার ব্রহ্মচারী ভাইয়ের মনে বিয়ের ইচ্ছা জাগাতে পারলে যা চাইবো তাই দেবে। আমি রাহুলকে চাইছি।