প্রবন্ধঃ বাংলা কাব্যে কবি যতীন্দ্র প্রসাদ ভট্টাচার্য – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

বাংলা কাব্যে কবি যতীন্দ্র প্রসাদ ভট্টাচার্য
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

আকাশবাণীতে কবি স্বয়ং আত্মপরিচয় দিয়েছিলেন “জন্মেছিলাম রাজশাহী জেলার বলিহারে ১৮৯০ খৃষ্টাব্দে ২৭মে (বঙ্গাব্দের ১৪ জ্যৈষ্ঠ )। শৈশবেই পিতার কর্মস্থল মৈমনসিংহ-গৌরীপুরে স্থায়ী বাসিন্দা হলাম। ছাত্রজীবন কাশী ও কলকাতায় কেটেছে। প্রথম কাবাগ্রন্থ ‘মর্মগাথা’ প্রকাশিত হয় ১৯১৪ খৃষ্টাব্দে। তারপর ‘হাসির হল্লা’ ১৯২৩-এ, ‘ছায়াপথ’ ১৯২৫-এ, ‘রামধনু’ ১৯২৬-এ, ‘নভোরেণু’ ১৯২৭-এ প্রকাশিত হয়। শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলন প্রকাশিত হয়েছে ১৯৬৩ খৃষ্টাব্দে।”
মাসিক ‘প্রবর্তক’ পত্রিকায় ১ :৫৮-৫৯ বঙ্গাব্দে তাঁর ‘সংস্কৃত ছন্দের বাংলা রূপ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হলেও তাঁর জীবনদশায় তিনি তা গ্রন্থবদ্ধ দেখে যাননি। ১৯৭৫ খৃষ্টাব্দের ১৪ মার্চ তিনি দেহত্যাগ করেছেন। কবির জন্মশতবার্ষিকীর পূর্বেই আমরা তা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছি। আজ আবার এতগুলো বছর পরে অবেক্ষণে সেই লেখাটি প্রকাশ করতে চলেছি। কারণ কবি যতীন্দ্র প্রসাদ ভট্টাচার্যকে নিয়ে এখনো অনেকের জিজ্ঞাসা রয়েছে।
কবির দেহত্যাগের স্বল্পব্যবধানে সঙ্গীতাচার্য বীরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ৩ জুলাই ১৯৭৫ এবং তাঁর সহোদরা হেমন্তবালা দেবী চৌধুরাণী ১ জুন ১৯৭৬ দেহরক্ষা করেন। বীরেন্দ্রকিশোর ও হেমস্তবালার পিতা ব্রজেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী মৈমনসিংহ-গৌরীপুরের রাজবাড়ীতে ‘দত্তক পুত্র হবার পূর্বে ছিলেন রজনীপ্রসাদ ভট্টাচার্য। তাঁর সহোদর অগ্রজ রোহিনী প্রসাদ ভট্টাচার্যের পুত্র যতীন্দ্রপ্রসাদ আশৈশব একই মমতার বৃত্তে বেড়ে উঠেছেন। ভাইএকের মৃত্যু অপরকে গভীর ভাবে স্পর্শ করেছে এবং স্বল্প সময়ের ব্যবধানে এই তিন ভাই বোন একে-একে বিদায় নিয়েছেন।
কবি তাঁর প্রথম জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন ত্রৈমাসিক ‘নবান্ন’ পত্রিকায় ( ১৮৮১ শকাব্দ চৈত্র-জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা ) ‘মা কালীর ছবি’ নিবন্ধে। তার উদ্ধৃতি থেকেই কবির প্রথম জীবন সম্পর্কে একটি ধারণা করা যাক :
“সে ১৩১৫-১৬ সনের কথা। আমার বয়েস তখন ১৮ কি ১৯। কাশীধামের পাতালেশ্বরে পিতামহ হরিপ্রসাদ ভট্টাচার্যের কাছে থেকে হিন্দু কলেজিয়েট স্কুলে পড়তাম। কাশীতে তখন বিপ্লবীদের জোর পাঁয়তারা চলছে। আমিও তাদের সঙ্গে জুটে পড়েছিলাম ; শচীন সান্যাল, নরেন বন্দ্যোপাধ্যায়, এরাই তখন আমার ডানে বাঁয়ে।
অথচ এই জাতীয় সংশ্রবের জন্যই আমাকে মৈমনসিংহ থেকে আমার কাকা ব্রজেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী (হরিপ্রসাদ ভট্টাচার্যের দ্বিতীয় পুত্র) সুদূর কাশীতে সরিয়ে একটু আড়াল দিয়েছিলেন। কেননা সেখানে সিটি স্কুলে পড়তাম আর রমনী দাস, যোগেন্দ্র চক্রবর্তী, উমেশ দাস প্রভৃতির সঙ্গে আনাগোনা করতাম। এইসব বিপদজনক স্বদেশী বন্ধুদের স্পর্শ থেকে আমাকে বাঁচাবার জন্যই কাশীতে আমাকে যে চালান দেওয়া হয়েছিল, এমন কথা নিশ্চয়ই বলব না, তাতে আমার কাকার প্রতি অবিচার করা হবে। কেননা, আমার কাকার এই সব বিপ্লব আন্দোলনে কিঞ্চিৎ প্রশ্রয় ছিল। কিন্তু পুলিশের ছাপ ফিকে করার জন্যই তিনি ঠাঁই-নাড়া করেছিলেন আমাকে।
হঠাৎ একদিন পাতালেশ্বরের বাড়ীটা শেষ রাত্রিতে পুলিশ ঘেরাও ক’রে রাখল। ভোরে দরজা খুলতেই তাদের দর্শন লাভ করলাম। খানাতল্লাসী চললো। আমার ঘরের ফটোগুলির সঙ্গে আমাকেও নিয়ে যাওয়া হল দশাশ্বমেধ ঘাটের পুলিশ ফাঁড়িতে। ছবির দোষে আমি যাচ্ছি, না আমার দোষে ছবি যাচ্ছে, আমার প্রতিবেশীদের কেউই তা ঠাওর করতে পারছিলেন না। সেই ফাঁড়ি থেকে প্রায় ৩ মাইল দূরে সিগ রোল ক্যান্টনমেন্টে বেনারস বিভাগের কমিশনার ষ্ট্রেট ফিল্ড সাহেবের কুঠিতে চালান গেলাম। ছবির সঙ্গে সঙ্গে আমিও সাহেবের প্রতীক্ষা করতে থাকলাম। এ তো জানাই ছিল যে, এতদূর যখন গড়িয়ে এসেছি, তখন বেশ সতর্ক থেকেই জবাব দিতে হবে।
যে খবর এড়িয়ে চলব ভেবেছিলাম, ঠিক সেই খবরটিতেই সাহেবের ভীষণ প্রয়োজন। তিনি সরাসরি প্রশ্ন করলেন, যোগেন্দ্রচক্রবর্তী ও উমেশ দাসকে আমি আশ্রয় দিয়েছিলাম কিনা। বুঝলাম, প্রশ্ন এড়াবার চেষ্টা করে লাভ নেই। জানালাম, হ্যাঁ।
এদের দুজনের কেউ আজ নেই। উমেশ বিশ্বাসঘাতকতার জন্য দলের লোকের হাতেই ঢাকার বুড়িগঙ্গার পাড়ে বাকল্যাও বাঁধে হাওয়া খেতে-খেতে পিস্তলের গুলিতে শেষ হয়েছিল। আর যোগেন শ্রীহট্টের পুলিশ কমিশনার গর্ডন সাহেবকে হত্যা করতে গিয়ে বাগানের বেড়া ডিঙোবার সময় মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, আর সঙ্গে সঙ্গে তার ক্যাপ লাগানো বোমাটিও ফেটে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে নিজেও।
আমি কেন তাদের দুজনকে আশ্রয় দিয়েছি, সাহেব পরিষ্কার জানতে চান। তারা আমার গাঁয়ের লোক, এই পরিচয় ছাড়া আর কোনো পরিচয় সাহেবের কাছে দেওয়া চলেনা। তা ছাড়া আমি যে সত্যি-সত্যি একই গাঁয়ের ছেলে, একথা প্রমাণ করতে আদৌ বেগ পেতে হয় না। কিন্তু কোথায় তারা গেছে, তা যে আমি সত্যিই জানিনা, এইটি প্রমাণ করতে আমাকে হিম সিম খেতে হয়েছিল।
এবার মা-কালীর ছবির কথায় আসি। আমার ঘরের ছবিগুলি সাহেবের কাছেই একটা বাক্সে গোছানো ছিল। বাক্সের ডালা খোলা হল। একের পর এক ছবি সাহেবের হাতে উঠতে থাকল। মা-কালীর ছবিটি হাতে নিয়েই সাহেব চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন, চোখ মুখ টেনে ধমকে ধমকে হরিবল্ বলতে থাকলেন। আমার রাজদ্রোহিতার অকাট্য “একটি প্রমাণ তিনি পেয়ে গেছেন, এমনি তাঁর ভাব। ইনি যে বিপ্লবীদের একচেটে দেবী নন, সকল হিন্দুরই দেবতা শিবের গিন্নী কালীদেবী, এই কথাটি সহজে তাঁকে বোঝাতে পারিনি।”
কবি তাঁর কলেজ জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন তাঁর ৭০-তম জন্মদিনের ভাষণে ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৩৬৬ বঙ্গাব্দে। তাঁর সেই ভাষণটি ‘আমার মিষ্টি বিশ্বাস’ নামে প্রকাশিত হয় ত্রৈমাসিক ‘নবান্ন’ পত্রিকায় (১৮৮১ শকাব্দ পৌষ-ফাল্গুন সংখ্যা)। তার উদ্ধৃতি থেকেই কবির মনোভঙ্গি ও দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে একটা ধারণা করা যাক—
“মেট্রোপলিটান কলেজ, এখন যার নাম বিদ্যাসাগর কলেজ, সেখানে ইণ্টার মিডিয়েট ক্লাসে যখন পড়াশুনা করি, তখন আমার সতীর্থদের মধ্যে অমল হোমেরও সাহিত্যের নেশা ছিল। তখন আমরা সাহিত্য বলতে এক সঙ্গে ভাব ও তার প্রকাশ বুঝতাম। আগে দেখতাম কি বলা হচ্ছে, তারপর বিচার করতাম কেমন করে বলা হল। মনে হয় আজকাল উল্টোটাই সত্যি। কি বলব, তা নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা নেই; কেমন করে বলব, কি ঢঙে বলব, তাই নিয়ে পাল্লা চলেছে। কিন্তু আমরা তেমন ক’রে ভাবতে চাইনি। কেননা সময়টা তখন ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক চলছে।রেনেশার জের ভথনো জোরদার।
প্রথমটা ব্রহ্মানন্দ কেশব সেনের সমন্বয়ের ধ্যান-ধারণায় নিজেকে অনুপ্রাণিত বোধ করেছি। বিশ্বাস করেছি, পৃথিবীর সব ধর্মের দেশাচারগুলি বাদ দিলে, যে সার সত্যের সন্ধান পাওয়া যায়, তা সবই এক। কোনো বিরোধ সেখানে নেই। ব্রহ্মানন্দের নব বিধানকে এইজন্যই সব ধর্মের
গ-সা-গু মনে হয়েছিল। তাছাড়া এই নব বিধান সত্যি-সত্যি নব নয়। আমাদের দেশের বাউলরা এমনি সার সত্যের ওপর দাঁড়াবার চেষ্টা করেছিলেন। রাজা রামমোহন হিন্দু ধর্মকে দেশাচারমুক্ত ক’রে এ-ধর্মের মূল সত্যকে উদ্ধার করেছিলেন; যাকে সকল কালের সকল মানুষ গ্রহণ করতে পারে। ব্রহ্মানন্দ আরো এগিয়ে অন্যান্য ধর্মের সার সত্যের সঙ্গেও তাকে মিলিয়ে নিলেন। রবীন্দ্রনাথ ‘মানুষের ধর্ম’ গ্রন্থে এই ধারণাকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। এটা যে বাউলের পথ এ সম্বন্ধেও তিনি অবহিত ছিলেন এবং নিজেকে চলনে-বলনে আদর্শ বাউল করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই আমার বোধ জন্মালো যে, সকল কালের সকল মানুষ শুধু সার-সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য তার লোকাচারগুলি ছাড়তে রাজী হবে না। সে তার সার-সত্যকে যতটুকু ভালবাসে, সংশ্লিষ্ট দেশাচারগুলির বৈচিত্র্যও তেমনি আবেগের সঙ্গে ভালবাসে। তাই এমন কিছু মাপকাঠি চাই, যাতে সকলের সবটুকুই স্বীকৃতি পায়। এঁরামকৃষ্ণের যত মত তত পথ’ বাণী এমনি একটি প্রত্যয় আগেই দেশে সঞ্চারিত করেছিল। আমি ক্রমশঃ সেই বিশ্বাসে ঝুঁকে পড়লাম। আধুনিক পরিভাষায় এই ‘যত মত তত পথ’ সিদ্ধান্তকে বিশ্বাসের পঞ্চশীল বলতে পারি। অর্থাৎ সকলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সত্য। কেউ কাউকে আঘাত করবে না। আধুনিক পরিভাষায় একে সহ-অবস্থান নীতিও বলতে পারি। এটা ঠিক ধর্মসমন্বয় নয়। বরং অঙ্কের পরিভাষায় সমীকরণ বা ইকুয়েশন বলতে পারি। ০*০=০
আমি আরো বৃহত্তর সম্ভাবনার কথা ভাবি। বিশ্বাসীদের সমীকরণ শুধু নয়। সব বিশ্বাসের ল-সা-গু আমার প্রার্থনা। আমাদের কুম্ভমেলা কি তেমন ল-সা-গু হতে পারে না? ল-সা-গু এমন একটা মিলন যার মধ্যে সকলে তার বৈচিত্র্য নিয়েই অঙ্গীভূত হয়। ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায় তাদের
নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়েই কুম্ভমেলার অন্তর্ভুক্ত আছে। ইজরাইল, প্যালেষ্টাইন, আরব প্রভৃতির বিশ্বাস কেন তাদের সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিয়েই কুম্ভমেলার অঙ্গীভূত হতে পারবে না?”
লেনিনের মৃত্যুসংবাদ গৌরীপুরে কবির কাছে পৌঁছেছিল অনেক পরে। শোনামাত্র অধীর হয়ে উঠেছিলেন এবং লেনিন সম্পর্কে এক দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন ২ চৈত্র ১৩৩০ বঙ্গাব্দে। কবিতাটি রমা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের
রঙ্গবাণী পত্রিকার, জ্যৈষ্ঠ ১৩৩১ সংখ্যায় মুদ্রিত হয়। এই সূত্রে মৈমনসিংহ জেলার গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান কর্মচারী কবির কাছে হাজির হয়েছিলেন তৎকালীন জেলা শাসকের হুকুমনামা সহ। সঙ্গে তার বঙ্গবাণী পত্রিকার সংখ্যাটি। তাতে প্রকাশিত ‘লেনিন’ কবিতার পাশে লাল পেন্সিলে দাগ কেটে কবির রাজনৈতিক মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল এবং প্রয়োজন হলে তাঁকে গ্রেপ্তার করার হুকুমও ছিল। সৌভাগ্যবশতঃ কবির ঘনিষ্ঠ লোকটি এসেছিলেন খোঁজ খবর নিতে। সর্বভারতীয় সাহিত্যে লেনিনের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলির সর্বপ্রথম নিদর্শন রূপে কবিতাটি ঐতিহাসিক মূল্য পেয়েছে। আধুনিকতার অন্যতম প্রধান লক্ষণ রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা এই কবির কাব্য সাধনায় ওতপ্রোত।
ছান্দসিকতার ক্ষেত্রে কবি যতীন্দ্র প্রসাদ যুগপৎ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে স্মরনীয়। দেশী বিদেশী শতাধিক ছন্দ তিনি জানতেন এবং তাঁর অসংখ্য কবিতায় নানা সময়ে তার যথা নিপুণ প্রয়োগও করেছেন। তিনি শুধু ছন্দ প্রেমিক কবি নন, তিনি ছিলেন ছন্দ-দার্শনিকও। তাঁর রামধনু কাব্য গ্রন্থটির প্রথম কবিতাই ‘ছন্দ-স্পন্দন, যাতে তিনি বলেছেন :
“বিশ্ব সংসার চলছে ছন্দে,
সৃষ্টি ভরপুর ছন্দ স্পন্দে !
সূর্য-ইন্দু, সপ্ত সিন্ধু
ধায় আনন্দে ছন্দোবন্ধে !
ছন্দেপক্ষী ঝাপটে পক্ষ,
উঠছে পড়ছে ছন্দে বক্ষ ;
সুরতরঙ্গে, নৃত্য-ভঙ্গে,
ছন্দ সঙ্গে রাখছে সখ্য
….

ছন্দে উদ্ভব, ছন্দে লয় সব,
ছন্দোময় প্রাণ বিশ্বে দুর্লভ!
ছন্দে যৌবন আজকে উন্মন,
স্বপ্ন হয় মোর ছন্দে বাস্তব।”
এই সুদীর্ঘ কবিতাটি ‘আরবী রমল ছন্দানুকরণে রচিত’ এই স্বীকৃতি কবিতার সঙ্গেই উল্লিখিত। কবিতাটির রচনাকাল ২৮ আষাঢ়, ১৩৩১ ।
আধুনিক প্রকাশভঙ্গীর দিক থেকে কবির ‘ছায়াপথ’ গ্রন্থটি বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক দলিল। গ্রন্থটি ১৩৩২ বঙ্গাদের মাঘী পূর্ণিমায় প্রকাশিত। প্রকাশকের মুখবন্ধে ঘোষণা করা হয়েছে : ‘বর্তমান বইখানিতে নতুন ছন্দের এবং সম্পূর্ণ নতুন ধরনের যে কবিতাগুচ্ছগুলি দেখা যাচ্ছে, সেগুলির জন্যে, আমি যতদূর জানি, কবি কারো কাছে ঋণী নন। তাঁর আগে খুব কম ক্রিয়াপদ ব্যবহার করে এ-রকমের ইঙ্গিত পূর্ণ কবিতা বাংলায় সম্ভবত কেউ লিখতে পারেন নি। ছায়া-পথের কবিতাগুচ্ছগুলি, ১৩২৩ সাল থেকে ১৩২৯ সালের মধ্যে রচিত।” এই গ্রন্থের প্রায় সব কবিতাই প্রবাসী, ভারতী, উপাসনা, বঙ্গবাণী, মাধবী, প্রতিভা, সৌরভ, পল্লীশ্রী প্রভৃতি পত্রিকায় পূর্বেই প্রকাশিত । ছায়াপথের কবি কবিতায় যা করেছেন, ‘ইঙ্গিত’ গল্পগ্রন্থের লেখক কৃষ্ণদাস আচার্য চৌধুরী বাংলা গল্পে তা করতে এগিয়ে এলেন। যতীন্দ্র প্রসাদ ও কৃষ্ণদাস উভয়েই মৈমনসিংহের মানুষ। মৈমনসিংহ গীতিকার মতই নতুন যুগের উল্লেখযোগ্য ছায়াপথ ও ইঙ্গিত বাংলা সাহিত্যে মৈমনসিংহের দান। কৃষ্ণদাস স্বয়ং ইঙ্গিতের মুখবন্ধে লিখেছেন: “লেখাগুলি বড় গল্পের চুম্বক বা সিনপসিস নয়। সাজেস্টিভ বা ইঙ্গিতে পূর্ণ, অল্প কথায় একটি বিশেষ রস, আংশিকরূপে একটি চরিত্র, অথবা একটু মনস্তত্ব ফুটাইয়া তুলিতে চেষ্টা করিয়াছি। কোনটিতে বা শুধুই আভাস, গড়িয়া তুলিবার ভার পাঠকের ওপর।” এই গল্পগুলির কয়েকটি ১৩৩১ মাঘে সৌরভে প্রকাশিত হয়েছিল এবং ১৩৩২ সালে গ্রন্থবদ্ধ হয়েছিল।
সাহিত্য সমালোচক যাদব চন্দ্র দাশ তাঁর ‘দুটি উল্লেখযোগ্য বই’ নামক নিবন্ধে এই দুইটি বই সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন ত্রৈমাসিক নবান্ন পত্রিকায়, ১৮৮১ শকাব্দ চৈত্র-জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। তিনি তাঁর নিবন্ধর উপসংহারে লিখেছেন :
“যতীন্দ্র প্রসাদের প্রথম কাব্যগ্রন্থ মর্মগাথা-র কবিতা নির্বাচন রবীন্দ্রনাথ সাদরে স্বয়ং করেছিলেন, সেই গ্রন্থের ভূমিকাতে তার উল্লেখ আছে ; কিন্তু ছায়াপথ সম্পর্কে তিনি মৌন ছিলেন। কৃষ্ণদাসের ইঙ্গিত প্রকাশিত হবার পর রবীন্দ্রনাথ অভিনন্দন জানালেন : ‘ইঙ্গিত বইখানি পড়িয়া আনন্দ লাভ করিলাম। ইহার ইঙ্গিতগুলি বিচিত্র রসে পূর্ণ।’ ছায়াপথ পূর্বে প্রকাশিত হলেও সেই কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে মনস্থির করতে প্রবাসীর দেরী হয়েছিল; কিন্তু ইঙ্গি ত সম্পর্কে প্রবাসী ১৩৩২ সালের মাঘে বললেন : ‘কবিতার মত মনোহর, বড় ভাবের উন্মেষক, অখণ্ড রসের খণ্ড খণ্ড দ্যোতনা। গল্পগুলি হৃদয়কে স্পর্শ করে, আনন্দিত করে, ম্রিয়মান করে, মুগ্ধ করে। এইটি লক্ষ্য করবার মত যে কৃষ্ণদাসের ইঙ্গিতময় গল্পগুলি কবিতার কোল ঘেঁসে গেছে, যেমন যতীন্দ্রপ্রসাদের ছায়া-পথের কবিতা আবার ছোটগল্পের একটু আমেজ রক্ষা করতে চেয়েছে। পথ চলতে চোখে দেখা নানান স্তরের মানুষকে উপলক্ষ করে ছায়াপথের কবিতায় যতীন্দ্রপ্রসাদ চিত্রসৃষ্টি করতে চেয়েছেন। এই দুটি বই রবীন্দ্রনাথের লিপিকার পরবর্তী হলে, তাদের সম্বন্ধে বিশেষ আলোচনার অবতারণা করতাম না; কিন্তু বই দুটি লিপিকার পূর্ববর্তী এবং এইজন্যই তারা মূল্যবান।”
আজ অনেক কবিই ছায়াপথ-এর চাইতেও ছায়া সম্পাতে আরো বেশী শক্তিমত্তার পরিচয় দিতে পেরেছেন; কিন্তু ছায়াপথ-এর জন্মলগ্নে যতীন্দ্রপ্রসাদ একাকী ছিলেন। যতীন্দ্রপ্রসাদের সমকালীন কবি কালিদাস রায় কবিশেখর
সর্বাধুনিক কবিতা সম্পর্কে আস্থাহীন; কিন্তু তিনিই তৎকালে ছায়াপথকে এমনি সম্বর্ধনা করেছিলেন : “কাব্যগ্রন্থখানির বেশ একটু বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য আছে। কবি দুই চারিটি তুলির আঁচড়ে ৪ ছত্রে বা ৮ ছত্রে এক একটি বিষয়ের বৈচিত্র্য ফুটাইতে চেষ্টা করিয়াছেন। বাংলা সাহিত্যে এ এক নতুন ঢং। এ এক নূতন ভঙ্গিতে রচিত ইঙ্গিতের সঙ্গীত। ইঙ্গিতগুলি নির্বাচনে বাহাদুরী আছে, সেগুলি এত জোড়ালো যে এক নৌকা করিয়া কথা মনে পড়ায়, সেগুলি যেন রসভাণ্ডারের চাবি।”
কবির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল ১৯৭২-র ৬ ফেব্রুয়ারী। কলকাতায় বাংলাদেশ বিজয়োৎসবের মরশুম চলছে। কবির জ্যেষ্ঠপুত্ৰ পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন ক্রিস্টোফার রোডে কবির বাসস্থানে। তাঁর পরম স্নেহাষ্পদ কবি নজরুল ইসলাম তাঁর কাছাকাছি থাকতেন, কিন্তু তিনি তখন সব স্মৃতিমুক্ত। সেদিন এপার বাংলা ও ওপার বাংলার স্মরণীয় দিন- মুজিবর রহমান সপরিষদ রাজভবনে এসেছিলেন এদেশের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য। আমার কাছেও স্মরণীয় দিন, বৃদ্ধ কবির প্রথম চরণ স্পর্শের অনুভূতির জন্য। কবি তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলন এক কপি ক’রে আমাদের স্নেহোপহার দিয়েছিলেন। আমার কপিটিতে কবির স্বহস্তে লেখা নানারকম নোট ছিল, ফলে সেটা বেশি মূল্যবান। শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলনটি সম্পাদনা করেছেন ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য।
কবিও আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। নিজেই উদ্যোগী হয়ে তিনি তাঁর নাতনী ভূমিকার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছিলেন ঐ বছরেই ২২মে। ফলে ঘনিষ্ঠতাও বেড়ে গেল। নাত জামাই হবার ফলে বয়সের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও রসিকতা করার সুযোগ আমরা কেউ ছাড়তাম না। তাঁর ‘হাসির হল্লা কাব্য গ্রন্থটিও তাঁর রসিক মনেরই সাক্ষ্য দেয়। তবু অনুভব করতাম, তিনি এক অনাবিস্তৃত খনি। অনাবিস্তৃত থাকার জন্য তাঁর তেমন কোনো ক্ষোভও ছিল না। কবি কখনো কখনো তার নাতনী ভূমিকাকে গাইতে বলতেন : ‘আপন মনে আমায় থাকতে দে না’ । ভূমিকাও সঙ্গে সঙ্গে শুরু করত। এখন ঐ গান কোথাও শুনলেই আমাদের চোখে জল আসে। অপ্রচারিত কবি বলেই কবির মৃত্যুতে আকাশবাণী ও দৈনিক কাগজগুলোয় যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত সংবাদ দেওয়া হয়েছিল; অব্শ্য সাহিত্যিক বর্ষপঞ্জীর ৫ম বর্ষ ৬ষ্ঠ খণ্ড ১৩৮২ সংখ্যায় শ্রীঅশোক কুণ্ডু পরলোকগত সাহিত্যিক স্মরণে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ মুদ্রিত করেছিলেন।… কবির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

4 thoughts on “প্রবন্ধঃ বাংলা কাব্যে কবি যতীন্দ্র প্রসাদ ভট্টাচার্য – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

  1. খুব ভালো লাগলো।অনেক কিছু জানতে পারলাম।

  2. Well researched and simple way of writing touched my heart. Many thing which I didn’t know about my grandfather were brought to light. In our childhood we his grandchildren used to have a great time with him. He was a very jovial person shared many jokes with us. Yes though he was a great poet of his time but didn’t received his due recognition. Thanks to the author ( Radhakrishna Goswami) for writing this essay 🙏

    1. I preferred and still prefer honesty and sincerely , so God cooperates me every respect including writing articles on my one of the most lovely Jatindraprasad Bhattacharya. ‘ If good tell others, if not tell me ‘ for my correction. Thank you Dada. Remain happy.

  3. খুব ভালো লাগলো। কবিকে আরও জানতে চাই। কবি নওগাঁর বলিহারের মানুষ। আমিও তার নিকট প্রতিবেশি অঞ্চলের। ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যর শ্রেষ্ট কবিতা’ বইটি কীভাবে সংগ্রহ করবো জানাবেন। হোয়াটস আ্যাপ +৮৮০১৮১৮৮৮১২৯৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *