মুক্তগদ্যঃ দিবারাত্রির কাব্য – নীলাঞ্জন ভৌমিক

দিবারাত্রির কাব্য
নীলাঞ্জন ভৌমিক

দিনরাতের মাথামুন্ডু নেই। তাই ভিক্ষে চাওয়ারও কোন মানে হয় না।
এত পাথর ভাঙবার ছিল, এত জল বইবার ছিল, এত বীজ বোনবার ছিল … ইস্পাতফলায় সুফলা মাটির মৃত্যু, চিকণ জলে চিনিয়েছে মুখ দেখার আয়না। পড়শীদের বাড়িগুলোর গায়ে নাম ঠিকানা একাকার। জলে ভিজতে ভিজতে, রোদে পুড়তে পুড়তে, ধাঁধা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। যতবারই কড়া নাড়ি, পাথরে লেগে ফিরে আসে শব্দের লাশ। মানুষের রক্তে হাড়ে মজ্জায় কোন পরিচয় স্থির হয় না। অনুক্ষণ গেলাস প্লেট চামচের বাজনায়, বুকের ভিতর এক পরম নিভৃতির জন্ম। এমন ক্ষেত্রে যা হওয়ার কথা, তাই-ই হয়। সারাক্ষণ একই রকম মেপে মেপে লোকায়ত চলা। মনের ভিতরে, অন্তরে অন্দরে ভোঁতা হয়ে যাওয়া পুরনো জিজ্ঞাসায় প্রতিরাতের বাসি বিছানা পচতে পচতে টানটান।

এমন রুদ্ধনিঃশ্বাস দড়িদড়া আটকানো গলার নলির খুব কাছে, বুকের চাদরের নীচেই বাঁদিকে রয়েছে এক বহতা নদী। তাতে পলিমাটি পেরিয়ে নতুন বীজ বোনার স্বপ্ন। দুর্ধর্ষ বাতাসে নৌকো ঘোরানো দায়, ছেঁড়া পালে, ভাঙা হালে, তার গলুই ফৎরাফাঁই। সময়ের করাতের দাঁতে চামড়া ছিঁড়েছে – ছিঁড়ুক, মাংস চিরেছে – চিরুক, হাড়ে লেগেছে আঁচড় – লাগুক। একাগ্র উত্তাপে দগ্ধ পাষাণ প্রচ্ছদে, দুহাতে দশ আঙুলের ডগা আজ অগ্নিবিন্দু, পাথর ঠোকা ঝাঁক ঝাঁক স্ফুলিঙ্গ মেখে।

ঘুর্ণি আপাততঃ স্থির হয়ে আছে। আকাশ থেকে ঝুলছে সময়, দুলছে টিকটিক, ক্লান্তির ঘাম ঝরে পড়ছে মাটিতে। বিঘের পর বিঘে নাবাল জমি তার আলাভোলা গাছপালা, ছোটবড় খানাখন্দ, টিমটিমে রাস্তাঘাট নিয়ে একটি চারার বীজের আশ্বাসে আকাশের নীলে ক্লান্ত অপেক্ষার আলতো নিঃশ্বাস ফেলে। কথার গর্জন নেই, ব্যথার কাতরানি নেই। কাগজপত্তর কলম এলিয়ে রয়েছে দেরাজে। তাদের দেয়ালায় ঘুরেফিরে পানাপুকুর ঝোপঝাড় ফেলে ব্যাঙ্গমাব্যাঙ্গমী একছুটে দুদ্দাড় হিমঘর থেকে তেপান্তরে যাবে, নাবাল জমিতে কান পাতলে শোনা যায় ওই এক ধুকপুক ধুকপুক।

কত যোজন দূরে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে মাঠ। কত কথা হারিয়ে চুপ করে থাকে নদী। এক পাড় ভাঙে তো অন্য পাড় গড়ে। জানি না কেমন করে চরের শিকড়ে শিকড়ে রোদ বৃষ্টি নামে। বুকের পাটায় পড়ে, পাঁজরের অলিগলি বেয়ে, চলে যায় শহরের অন্য পথে, যেখানে গাছের পাতা ঝরে, পাতা আসে। শিশুরা শীতের ফসল ভরা ক্ষেতে ঘনিষ্ঠ আগুন পোহায়। হোই তুমি কোথা আছ? এই যে এখানে। জলোচ্ছাসের কলরোলে নাকাড়া বাজছে হৃৎপিন্ডের দামামায়। উতরোল ঘন্টাগুলো দিগন্তে দোলে মাতাল হাতির মত। বিকেলের মেঘে মেঘে দমকা হাওয়ার ঝোঁকে দর্পণে দেখা দেয় সমুদ্রের আভাস। এক পথ পার হ’য়ে আর এক পথ, বাঘবন্দী ছক কেটে রক্তপায়ে যাত্রা শুরু হয়, যেখানে স্থায়ী আর অন্তরায় রাত বুনছে ইমন কল্যাণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *