মুক্তগদ্যঃ রবি কথা – ভূমিকা গোস্বামী

রবি কথা
ভূমিকা গোস্বামী

শরৎ এলেই যেমন আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ , বৈশাখ এলেই তেমনি রবীন্দ্রনাথ। বৈশাখের ভোরের হাওয়ায় , বেল ফুলের গন্ধে , কোকিলের কূহুতানে , দুপুরের প্রখর তপন তাপে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছেন তিনি। যদিও সারাবছর সব ঋতুতে , সুখে দুঃখে , আনন্দে বিষাদে , মিলনে বিরহে , জন্মে মরণে তিনি তাঁর গান নিয়ে চির সখার মতো পাশে এসে দাঁড়ান। ঘোর বিপদে সাহস জোগান। কখনো কখনো একলা পথে চলতে গিয়ে তাঁর অনির্বচনীয় পরশে আনন্দময় হয়ে ওঠে আমার চলা ।
তাঁকে চিনতে চিনতে শাস্ত্র চিনেছি । সুন্দরকে চিনেছি। সবচেয়ে বড় কথা নিজেকে চিনতে শিখেছি। কিন্তু তাঁকে কি সবটা চিনে উঠতে পেরেছি ! যত তাঁর কাছাকাছি আসার চেষ্টা করেছি দেখেছি , তাঁর ঐশ্বর্য – সমুদ্রের মতো গভীর আর হিমালয়ের মতো বিশাল। তাঁকে মাপার সাধ্য কি আমার ! মাঝে মাঝে সমুদ্রের গভীর থেকে মূল্যবান কিছু মণি মানিক্য তাঁর কৃপায় আমার কাছে ধরা পড়েছে । সেই উপলব্ধি আমাকে মুগ্ধ করেছে। অনিত্য সুখ দুঃখের উর্ধ্বে যেখান থেকে নিত্য আনন্দধারা নেমে আসছে আমাদের মাঝে তার সন্ধান দিয়েছেন তিনি। মর্ত্যের কাছে স্বর্গ যে মাধুরী চায় সেই মাধুর্যের হদিশ রয়েছে তাঁর কাছে।
পরমের খোঁজে নানা পথে মন যখন দিশেহারা তখন করুণাময় গুরুর মতো দিশা দেখালেন তিনি –
“কোথায় ফিরিস পরম শেষের অন্বেষণে ?
অশেষ হয়ে সেই তো আছে এই ভুবনে। তাঁর বানী দুহাত বাড়ায় শিশুর বেশে। আধো ভাষায় ডাকে তোমায় বক্ষে এসে। তারি ছোঁয়া লেগেছে ওই কুসুম বনে। পর হয়ে সে দেয় যে দেখা ক্ষণে ক্ষণে। তার বাসা যে সকল ঘরের বাহির দ্বারে। তার আলো যে সকল পথের ধারে ধারে। তাহারি রূপ গোপন রূপে জনে জনে।”
আবার বললেন –
“তাঁহারে কোথা খুঁজিছ ভব অরণ্যে কুটিল জটিল গহনে ওরে মন।
দেখ দেখ রে চিত্ত কমলে চরণপদ্ম রাজে- হায়।
অমৃতজ্যোতি কিবা সুন্দর।”
কখনো নিরাকারে কখনো সাকারে সেই পরমের প্রকাশ । জগতের সর্বত্র তাঁর সাকার রূপ। ঈশা বাস্যম্ ইদং সর্বম্। তিনি আবার হৃদয় দেবতা হয়ে প্রাণে বিরাজ করছেন। রবীন্দ্রনাথ
গুরু হয়ে নির্দেশ দিলেন “হৃদয় দেবতা রয়েছ প্রাণে মন যেন তাহা নিয়ত জানে।” যে জানে প্রাণে তাঁর আসন পাতা , সেই প্রাণে কি সে পাপ চিন্তার প্রবেশ ঘটাতে পারে ? গুরুদেব বললেন- “পাপের চিন্তা মরে যেন দহি দুঃসহ লাজে”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে আধ্যাত্মিক জ্ঞান যেটুকু আড়ালে রেখেছিলেন , শান্তিনিকেতনে সবটুকু খুলে বললেন―
” যিনি ইচ্ছাময় তিনি আমাদের প্রত্যেককে একটি করে ইচ্ছার তালুক দান করেছেন। দানপত্রে আছে যাবচ্চন্দ্রদিবাকরৌ আমরা একে ভোগ করতে পারব।
আমাদের এই চিরন্তন ইচ্ছার অধিকার নিয়ে আমরা এক একবার অহংকারে উন্মত্ত হয়ে উঠি।
বিশ্ব সাম্রাজ্যের আর সমস্তই তাঁর ঐশ্বর্য, কেবল ওই একটি জিনিস তিনি নিজে রাখেন নি– সেটি হচ্ছে আমার ইচ্ছা। ওইটি তিনি কেড়ে নেন না ― চেয়ে নেন, মন ভুলিয়ে নেন। ওই একটি জিনিস আছে যা আমি তাঁকে সত্যিই দিতে পারি। ফুল যদি দিই সে তাঁরই ফুল , জল যদি দিই সে তাঁরই জল― কেবল ইচ্ছা যদি সমর্পণ করি তো সে আমারই ইচ্ছা বটে।…
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের ঈশ্বর আমার সেই ইচ্ছাটুকুর জন্যে প্রতিদিন যে আমার দ্বারে আসছেন আর যাচ্ছেন তার নানা নিদর্শন আছে। এইখানে তিনি তাঁর ঐশ্বর্য খর্ব করেছেন, কেননা, এইখানেই তাঁর প্রেমের লীলা। এইখানে নেমে এসেই তাঁর প্রেমের সম্পদ প্রকাশ করেছেন ― আমারও ইচ্ছার কাছে তাঁর ইচ্ছাকে সংগত করে তাঁর অনন্ত ইচ্ছাকে প্রকাশ করেছেন― কেননা ইচ্ছার কাছে ছাড়া ইচ্ছার চরম প্রকাশ হবে কোথায় ? তিনি বলছেন , রাজখাজনা নয়, আমাকে প্রেম দাও।”
“ওরে অন্তরের যে নিভৃততম আবাসে চন্দ্রসূর্যের দৃষ্টি পৌঁছায় না, যেখানে একলা কেবল তাঁর ই আসন পাতা, সেইখানকার দরজাটা খুলে দে, আলো জ্বেলে তোল্। যেমন প্রভাতে সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তাঁর আলোক আমার সর্বাঙ্গে পরিবেষ্টন করে আছে যেন ঠিক তেমনি প্রত্যক্ষ বুঝতে পারি তাঁর আনন্দ, তাঁর ইচ্ছা, তাঁর প্রেম আমার জীবনকে সর্বত্র নীরন্ধ্র নিবিড়ভাবে পরিবৃত করে আছে।
যেদিন আমার প্রেম জাগবে সেদিন তাঁর প্রেম আর লেশমাত্র গোপন থাকবে না। কেন যে আমি ‘আমি’ হয়ে এতদিন এত দুঃখে দ্বারে দ্বারে ঘুরে মরেছি সেদিন সেই বিরহদুঃখের রহস্য এক মূহুর্তে ফাঁস হয়ে যাবে।”
ভব সমুদ্রের কান্ডারী রবীন্দ্রনাথ । আমাদের ভালবাসতে শেখালেন। প্রেয় আর শ্রেয়র জ্ঞান দিলেল। মায়ার খেলা নাটকে বললেন― এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম , প্রেম মেলে না। শুধু সুখ চলে যায় এমনই মায়ার ছলনা। এরা ভুলে যায় কারে ছেড়ে কারে চায়। তাই কেঁদে কাটে নিশি তাই দহে প্রাণ , তাই মান অভিমান। তাই এত হায় হায়। প্রেমে সুখ দুঃখ ভুলে তবে সুখ পায়।
(শান্তিনিকেতন তিন থেকে)
“প্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বরের কোন স্বরূপ দেখতে পাই ? তাঁর শান্তস্বরূপ। যেখানে , যারা ক্ষুদ্র করে দেখে তারা প্রয়াসকে দেখে, যারা বৃহৎ করে দেখে তারা শান্তিকেই দেখতে পায়। চেয়ে দেখো, সূর্য নক্ষত্রলোকের প্রবল উত্তেজনার মধ্যে অটল নিয়মাসনে মহাশান্তি বিরাজ করছেন। সত্যের স্বরূপ ই হচ্ছে শান্তম্।
সত্য শান্তম্ বলেই শিবম্। শান্তম্ বলেই তিনি সকলকে ধারণ করেন, রক্ষা করেন, সকলেই তাতে ধ্রুব আশ্রয় পেয়েছে। আমরাও যেখানে সংযত না হয়েছি অর্থাৎ সত্যকে জানি নি এবং সত্যের সঙ্গে সত্য রক্ষা করে চলি নি, সেখানে আমাদের অন্তরে বাহিরে অশান্তি এবং সেই অশান্তি ই অমঙ্গল―নিয়মের সঙ্গে নিয়মের বিচ্ছেদ ই অশিব।
আমাদের দেশে যে তিন আশ্রম ছিল― ব্রহ্মচর্য গার্হস্থ্য ও বানপ্রস্থ, ঈশ্বরের তিন স্বরূপের উপর প্রতিষ্ঠিত। শান্তস্বরূপ, শিবস্বরূপ , অদ্বৈতস্বরূপ।
ব্রহ্মচর্যের দ্বারা জীবনে শান্তস্বরূপকে লাভ করলে তবে গৃহধর্মের মধ্যে শিবস্বরূপকে উপলব্ধি করা সম্ভভপর হয় ; নতুবা গার্হস্থ্য অকল্যাণের আকর হয়ে ওঠে। সংসারে সেই মঙ্গলের প্রতিষ্ঠা করতে হলেই স্বার্থবৃত্তিসকল সম্পূর্ণ পরাহত হয় এবং যথার্থ মিলনের ধর্ম যে কিরূপ নির্মল আত্মবিসর্জনের উপরে স্থাপিত তা আমরা বুঝতে পারি। যখন তা সম্পূর্ণ বুঝি তখনই যিনি অদ্বৈতম্ সেই ঐক্যরূপী পরমাত্মার সঙ্গে সর্বপ্রকার বাধাহীন প্রেমের মিলন সম্ভবপর হয়।আরম্ভে সত্যের পরিচয় , মধ্যে মঙ্গলের পরিচয়, পরিণামে আনন্দের পরিচয়।
এইজন্যে আমাদের ধ্যানের মন্ত্র শান্তম্ শিবম্ অদ্বৈতম্। প্রার্থনার মন্ত্র অসতো মা সদ্ গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময় , মৃত্যোর্মামৃতং গময়। অসত্য হতে সত্যে, পাপ হতে পুণ্যে এবং আসক্তি হতে প্রেমে নিয়ে যাও। তবেই হে প্রকাশ , তুমি আমার প্রকাশ হবে ; তবেই হে রুদ্র , আমার জীবনে তুমি প্রসন্ন হয়ে উঠবে।

2 thoughts on “মুক্তগদ্যঃ রবি কথা – ভূমিকা গোস্বামী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *