প্রবন্ধ: প্রাচীন মল্লভূমে প্রচলিত মুদ্রার ইতিবৃত্ত – মধুসূদন দরিপা

প্রাচীন মল্লভূমে প্রচলিত মুদ্রার ইতিবৃত্ত
মধুসূদন দরিপা

‘ নিউমিসম‍্যাটিক ‘ (Numismatic ) শব্দটি প্রাচীন গ্রীক শব্দ numisma. থেকে উদ্ভূত । অর্থ মুদ্রা সম্বন্ধীয় । ধাতব মুদ্রা তৈরি হয়েছে ২৭০০ বছর আগে পূর্ব মধ‍্য এশিয়ার ইউরোপ সংলগ্ন লিডিয়া নগরে । আর কাগজী মুদ্রার প্রচলন হয়েছে চীনে ১৩০০ বছর আগে কুবলাই খাঁর আমলে ।
গান্ধাররাই সর্বপ্রথম ভারতে ধাতু মুদ্রা হিসাবে ব‍্যবহার করেছিল । অদ্ভুত আকৃতির লম্বা ধরণের এক প্রকার বক্র ভঙ্গিমা যুক্ত রৌপ্য মুদ্রা, যার ইংরাজি প্রতিশব্দ বেন্টাবার কয়েন । ১ঐ ইঞ্চি থেকে ১.৭৫ ইঞ্চি লম্বা এবং ০.০৪ ইঞ্চি চওড়া, ওজন ১৫০ থেকে ১৮০ গ্রেন । সেই রৌপ‍্য মুদ্রাগুলি সম্ভবত ভারতের ষোড়শ জনপদ বা মহাজনপদ নামক ক্ষুদ্র ও বৃহৎ স্বয়ংশাসিত রাজ‍্যগুলি থেকে প্রচলিত হয়েছিল।


প্রাচীন ভারতবর্ষে স্বর্ণ, রৌপ‍্য ও তাম্র –এই তিন প্রকার ধাতু নির্মিত মুদ্রা প্রচলিত ছিল । ফা-হিয়েন কর্তৃক ভারতবর্ষ পরিভ্রমণের কাল ৩৯৯-৪১৩ খ্রিস্টাব্দ । উড্ডীয়ান, গান্ধারপ্রদেশ অতিক্রম করে তিনি নগরহার রাজ‍্যের সীমান্তবর্তী নগর হিলোতে পৌঁছান । সেখানে একটি বিহারে বুদ্ধদেবের মস্তক অস্থি স্বর্ণ ও রত্নমণ্ডিত অবস্থায় সংরক্ষিত ছিল । ফা-হিয়েনের বর্ণনায় জানা যায় যে, নগরহারের রাজা বুদ্ধের এই পূতাস্থি যাতে কোনভাবে চুরি না যায়, সেজন‍্য নগরীর আটজন সম্ভ্রান্ত নাগরিককে সেই বিহারদ্বার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন এবং এঁদের প্রত‍্যেককেই একটি করে মোহর (স্বর্ণমুদ্রা) দিয়েছিলেন । এঁরা প্রতিদিন সন্ধ‍্যাকালে বিহারদ্বার রুদ্ধ করে তার ওপর নিজ নিজ মোহরের ছাপ দিয়ে যেতেন এবং পরদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ছাপগুলি অটুট আছে কিনা দেখে তারপর বিহারদ্বার খুলতেন ।
মুদ্রাতত্ত্ববিদরা বর্তমান ভারতের জনসমাজের পূর্বপুরুষ হিসেবে যৌধেয় জাতির উল্লেখ করেছেন । পুরাণমতে এরা যুধিষ্ঠির তনয় যোধনের বংশধর । যৌধেয়দের মধ‍্যে প্রচলিত মুদ্রাগুলি ছিল মূলত তামার তৈরি । কিছু কিছু রূপার মুদ্রাও পাওয়া গেছে এই সময়ের । এইসব মুদ্রায় অধিকাংশে যুদ্ধের চিত্র আঁকা থাকত ।
বঙ্গদেশের মল্লভূম রাজ‍্যে ৬৯৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ১৩০০ বছরের রাজত্বকালে সর্বমোট ৬১ জন মল্লরাজা রাজত্ব করেছেন । ইংরেজ আমলের পূর্ব পর্যন্ত সারা দেশে প্রচলিত সোনা, রূপা ও তামা –এই তিন প্রকার মুদ্রা মল্লভূম রাজ‍্যেও প্রচলিত ছিল । প্রাচীন ভারতের প্রস্তরে উৎকীর্ণ লিপি এবং পুঁথির লেখা থেকে জানা যায় যে, ‘কার্ষাপণ ‘ নামে এক ধরণের মুদ্রার প্রচলন সেকালে ছিল । ‘কার্ষাপণ ‘ শব্দটি এসেছে ‘কর্ষ ‘ শব্দ থেকে । এক কর্ষ = ৮০ রতি বা ১৪৬.৪ গ্রেন । স্বর্ণ কার্ষাপণকে বলা হত ‘ সুবর্ণ ‘ বা ‘ নিষ্ক ‘ (মোহর) । রূপার কার্ষাপণকে ‘ পুরাণ ‘ বা ‘ ধরণ ‘এবং তামার কার্ষাপণ-এর নাম ছিল ‘পণ ‘ । রতি হল রক্তকুঁচ ফল । কুঁচ ফলের বৈজ্ঞানিক নাম অ্যব্রাস প্রিকেটোরিয়াস । লাল কালো একটি রতির ওজন প্রায় ১.৮৩ গ্রেন । ৫ রতি = ১ মাষক । ৮০ রতি বা ১৬ মাষক = ১ কার্ষাপণ । রূপার ওজনের বেলায় নির্দিষ্ট ছিল ২ রতি =১ মাষক । ৩২ রতি = ১৬ মাষক = ১ কার্ষাপণ । তাম্রমুদ্রার মূল্য অনুসারে চারভাগে বিভক্ত ছিল –মাষক, অর্ধ মাষক, পাদমাষক (কাকনী ) এবং অষ্টভাগমাষক (অর্ধ কাকনী ) । সম্ভবত মহাযান লিপির ‘ কাকনিকা ‘ থেকে কৌটিল‍্যের পাদমাষ বা কাকনী নামটি এসেছে । মতান্তরে, সমুদ্রগুপ্ত তাঁর প্রবর্তিত মুদ্রায় ‘ কাক ‘ নামটি উৎকীর্ণ ক‍রেছিলেন ।
কিন্তু খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে কুষাণ রাজবংশের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে স্বর্ণমুদ্রার ব‍্যবহার অত‍্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । কণিষ্ক ও তার পরবর্তী রাজাদের মুদ্রায় নানান দেবদেবীর নাম উৎকীর্ণ করা হয়েছিল । এছাড়া শাক‍্যমুনি বুদ্ধদেবের প্রতিকৃতিও আঁকা হত । মূলত ব্রাহ্মী লিপিতে মুদ্রাগুলি খোদিত হত ।


বাঁকুড়া জেলার ডিহর, পুষ্করণা, গোবিন্দপুর ও জিওড়দা এই চারটি অঞ্চলে মৌর্য, শুঙ্গ ও কুষাণ যুগের প্রাচীন ছাপযুক্ত মুদ্রা পাওয়া গেছে । কুষাণ ও কুষাণ পরবর্তী যুগের পুরী-কুষাণ মুদ্রা পাওয়া গেছে এই জেলার চিদা, রাওতড়া, তিলাবনী, সারাংগড়, ব্রাহ্মণডিহা, হাড়মাসড়া, সুলগী, জোড়দা, কদমদেওলী, তুলসীপুর, সরাগডিহি ও কুমারডাঙ্গা –এই বারোটি অঞ্চলে । এগুলি মূলত খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে দ্বিতীয় শতাব্দী এবং প্রাক গুপ্ত যুগের মধ‍্যবর্তী সময়ের । চৌকো ও গোল আকারের এইসব মুদ্রায় রেলিংয়ের মধ‍্যে গাছ, পর্বত, নদী, সূর্য, অর্ধচন্দ্র, জ‍্যামিতিক চিহ্ন, হস্তী, ত্রিশূল, স্বস্তিক, শিববাহন বৃষ, চক্র, চাপকান জাতীয় পোষাক ও পায়ে নাগরা বুট জুতা প‍রিহিত দণ্ডায়মান মূর্তি ইত্যাদি চিত্র অঙ্কিত আছে। কিছু কিছু মুদ্রায় হরপ্পা সভ‍্যতায় প্রথম প্রাপ্ত ক্রশ বা যুক্ত চিহ্ন দেখতে পাওয়া গেছে ।


কুষাণযুগে শ্রাবস্তী, বারাণসী ও বৈশালী থেকে বণিকগণ উড়িষ্যা, বিহারের ছোটনাগপুর এবং প্রাচীন তাম্রলিপ্তে বাণিজ্য পরিচালনা করেছিল । উড়িষ্যার তোসালী তাম্রলিপ্তের মতো পূর্ব ভারতের বিখ্যাত বাণিজ‍্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল । কুষাণ যুগে উত্তরপ্রদেশের সাথে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার বাণিজ্যিক সম্পর্ক দৃঢ় হয় । পুরী-কুষাণ মুদ্রাগুলি উড়িষ্যা থেকে ব্রাহ্মণদের মাধ‍্যমে মল্লভূম রাজ‍্যে ছড়িয়ে পড়েছিল । এছাড়াও বাণিজ্যের মাধ‍্যমে তীর্থযাত্রী, মন্দির সংগঠক এবং সেনাদলও এই মুদ্রা বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল ।


খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের শেষদিক থেকে শুরু ক‍রে তৃতীয় শতকের শুরু অবধি অন্ধ্রপ্রদেশের সাতবাহন রাজারা দাক্ষিণাত‍্যের অধিকাংশ স্থানেই তাদের প্রভূত্ব কায়েম করেছিলেন । তামা, সীসা ইত‍্যাদির দ্বারা নির্মিত ঐসব রাজাদের বেশ কিছু মুদ্রা পাওয়া গেছে । এরা বিদিশা অঞ্চলে পাঞ্চমার্ক মুদ্রা চালু করলেও অন‍্যত্র ছাঁচে ঢালা (Dai cast) মুদ্রার প্রচলন করেন । সাতবাহন রাজাদের মুদ্রার সোজাদিকে প্রতীক চিহ্ন স্বরূপ পাহাড়, গাছ, পশুপাখি এবং অন‍্যান‍্য প্রতিক‌তি উৎকীর্ণ করা হত । মুদ্রার উল্টোদিকে উজ্জয়িনীর প্রতীক চিহ্ন ব‍্যবহৃত হত । কিছু মুদ্রায় হাতি ও সিংহের প্রতিকৃতি থাকত ।


গুপ্ত রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজাদের অন‍্যতম সমুদ্রগুপ্ত খ্রিস্টিয় ৩৩৫-৩৭৫ সাল অবধি রাজত্ব করেন । তাঁর প্রবর্তিত মুদ্রায় রাজার দণ্ডায়মান প্রতিকৃতি এবং পিছনে সিংহাসনে উপবিষ্টা লক্ষ্মী দেবীর প্রতিকৃতি বিদ‍্যমান । দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (খ্রিস্টিয় ৩৭৬-৪১৪) প্রবর্তিত মুদ্রায় ধনুর্বানধারী সিংহশিকারী, অশ্বারোহী, ছত্র ও শায়িত প্রতিকৃতি দেখা যায় । প্রথম কুমারগুপ্ত (খ্রিস্টিয় ৪১৪-৪৫৫) প্রবর্তিত মুদ্রায় অশ্বমেধ, কার্তিকেয়, বীণাবাদক, তরোয়ালধারী, হস্তী আরোহী, সিংহ-ব‍্যাঘ্র-গণ্ডার শিকারীর প্রতিকৃতি উল্লেখযোগ্য ।
বঙ্গদেশে আবিষ্কৃত কুষাণ-গুপ্ত যুগের মুদ্রাগুলি লাঞ্ছনযুক্ত (পাঞ্চমার্ক) রৌপ‍্যমুদ্রা । প্রাপ্ত তাম্র ফলকলিপিতে জানা যায় যে, গুপ্তরাজাদের স্বর্ণমুদ্রাকে দিনার ও রৌপ‍্যমুদ্রাকে রূপক বলা হত । ১৬ রূপক = ১ দিনার । গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের (৬০০-৬২৫ খ্রিঃ) আমলে প্রাপ্ত একটি স্বর্ণমুদ্রার সামনের দিকে বৃষোপরি শিব এবং বিপরীতে পদ্মাসনা দেবী ও দেবীর দু’দিকে দুটি হস্তী কিংবা অর্ধচন্দ্র দেখতে পাওয়া যায় ।


আদি মল্ল (৬৯৪-৭০০ খ্রিঃ) থেকে অনন্ত মল্ল ( ১০০৭-১০১৫ খ্রিঃ) –এই সময়কালে রাজত্বকারী মল্লভূমের ঊনিশজন রাজা ছিলেন । বঙ্গদেশে সেই সময় শাসক ছিলেন খড়্গবংশ, রাতবংশ, চন্দ্রবংশ ও পাল বংশের রাজারা । উল্লেখযোগ্য রাজারা হলেন গোপাল (৭৫০ খ্রিঃ), ধর্মপাল (৭৭০ খ্রিঃ), দেবপাল (৮০৫ খ্রিঃ), নারায়ণপাল (৮৫৪ খ্রিঃ), রাজ‍্যপাল (৯০৮ খ্রিঃ), গোপাল (২য়) (৯৪০ খ্রিঃ), বিগ্রহপাল (৯৬০ খ্রিঃ) এবং মহীপাল (৯৮৮ খ্রিঃ) ।
এই সময়কালে প্রবর্তিত অধিকাংশ মুদ্রা আজও অনাবিষ্কৃত । অনুমান করা যেতে পারে যে, যুগপৎ কড়ি ও পুরনো মুদ্রা চলতি মুদ্রার সঙ্গে চালু থাকার জন‍্য সমকালীন রাজারা নতুন ক‍রে আর মুদ্রা প্রবর্তনের ব‍্যাপারে আগ্রহ দেখাননি । সেসময় কড়িকে বলা হত কপর্দক, রৌপ‍্য কার্ষাপণকে পুরাণ । জমির রাজস্ব নির্ধারিত হত কপর্দক পুরাণোতে । ৮০ কড়ি =১ পণ অর্থাৎ ১ তাম্র কার্ষাপণ । এবং ১৬ পণ অর্থাৎ ১২৮০ কড়ি = ১ পুরাণ বা ১ রৌপ‍্য কার্ষাপণ এমত হিসাব প্রচলিত ছিল ।
পাল রাজাদের ৪০০ বছরের রাজত্বকালে পাহাড়পুরে তিনটি তাম্রমুদ্রা পাওয়া গেছে – যার এক পিঠে একটি বৃষ ও অপর পিঠে তিনটি মাছ উৎকীর্ণ । এছাড়া ‘ শ্রীবিগ্র ‘ নামে কতকগুলি রৌপ‍্য ও তাম্র মুদ্রা পাওয়া গেছে । অনুমান করা হয় এগুলি বিগ্রহপাল (৩য়) (১০৫৪-১০৭১ খ্রিঃ) কর্তৃক প্রবর্তিত । পালযুগের লিপিতে ‘দ্রুম্ম’ নামক মুদ্রার উল্লেখ আছে । সেই কারণে ঐ মুদ্রাগুলি ‘ বিগ্রহদুম্ম ‘ নামে অভিহিত হয় ।
সেনবংশ (১০৯৫-১২২৫ খ্রিঃ) রাজত্বকালে মল্লভূমে রাজত্ব করেন ১০ জন মল্লরাজা । রূপ (ঝাপ) মল্ল থেকে শুরু করে গোবিন্দমল্ল । এই সময়কালেও বাংলার কোন রাজা কর্তৃক প্রবর্তিত মুদ্রার সন্ধান পাওয়া যায় না । তবে ঐ সময় কড়ির চল ছিল । ঐতিহাসিক মিনহাদ-উদ্দীন-সিরাজ বঙ্গদেশে এসেছিলেন মুসলিম বিজয়ের প্রাক্কালে ১২০৩ থেকে ১২০৫ খ্রিস্টাব্দের মধ‍্যে । তাঁর গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে গৌড়ের রাজা লক্ষ্মণসেনের লক্ষাধিক কড়ি দান করার কথা ।
মধ‍্যযুগের শুরুতে উত্তরভারতে কলচুরি, গাহড়য়াল, কাহসান ইত‍্যাদি রাজারা মুদ্রা প্রবর্তন করেছিলেন । এদের মধ‍্যে দাহলের কলচুরি রাজাদের অন‍্যতম গাঙ্গেয়দেব বিক্রমাদিত্য (১০১৫-১০৪১ খ্রিঃ) গুপ্ত রাজাদের নকশা অনুকরণ করে উপবিষ্টা লক্ষ্মীদেবীর প্রতিকৃতি যুক্ত স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন । চোল রাজাদের মুদ্রায় মাছ, ধনুক ও ব‍্যাঘ্রের প্রতীক চিহ্ন লক্ষ্য করা যায় ।
১১৯২ খ্রিস্টাব্দে তরাওরীর দ্বিতীয় যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে মুহম্মদ ঘোরী সর্বপ্রথম আর্যাবর্তে মুসলিম রাজ‍্য প্রতিষ্ঠা করেন । তার মাত্র কয়েক বছর পর গর্মসীরের অধিবাসী অসমসাহসী ভাগ‍্যান্বেষী ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী অতর্কিতভাবে পূর্বভারতে অভিযান চালিয়ে প্রথমে দক্ষিণ বিহার এবং পরে পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গের অনেকাংশ জয় করে মুসলিম অধিকার স্থাপন করেন ।
মুসলমান যুগে প্রত‍্যেক স্বাধীন সুলতানই নিজ নিজ নামে মুদ্রা অঙ্কিত করতেন । বস্তুত সেটাই ছিল তখন স্বাধীনতার প্রতীক । বাংলার মুসলমান সুলতানেরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেই নিজের নামে মুদ্রা বের করতেন । এইসব মুদ্রায় তারিখ থাকত । পরবর্তীতে দিল্লী সরকারের অন্তর্গত হলে বঙ্গদেশে দিল্লীর সুলতানের মূদ্রাই চলত ।
খিলজী বংশের সুলতান আলাউদ্দীন-মুহম্মদ-শাহ খিলজী (১২৯৪-১৩১৬ খ্রিঃ) মিশ্র ধাতুর মুদ্রা প্রবর্তন করেন এবং তাতে সর্বপ্রথম হিজরী সন উৎকীর্ণ করেন । হিজরী ও খ্রিস্টিয় অব্দ গণনার মধ‍্যে পার্থক্য প্রায় ৮০০ বছরের । যথা, ১২৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২১ নভেম্বর ৬৯৪ হিজরী সনের শুরু । এই সময়কালে মল্লভূমের রাজা ছিলেন পৃথ্বি মল্ল ( ১২৯৫-১৩১৯ খ্রিঃ ) ।
দিল্লীর সুলতানদের মুদ্রা প্রস্তুতকরণে গুরুত্বপূর্ণ যুগ আরম্ভ হয় প্রকৃতপক্ষে মুহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে (১৩২৫-১৩৫১ খ্রিঃ) । এই সময়কালে মল্লভূমে রাজত্ব করেছেন তপ মল্ল, দীনবন্ধু মল্ল ও কিনু (কানু) মল্ল । মুহম্মদ প্রচলিত ১৭৫ গ্রেন ওজনের স্বর্ণ-রৌপ‍্য মুদ্রার পরিবর্তে ২০২ গ্রেন ও ১৪৪ গ্রেন ওজনের স্বর্ণ দিনার এবং ১৪৪ গ্রেন ওজনের রৌপ‍্য অদলি চালু করেন । অতঃপর তিনি তামা ও পেতলের রৌপ‍্য ও মিশ্র মুদ্রা প্রচলনের চেষ্টা করলে দ্রুত জাল মুদ্রায় দেশ ছেয়ে যায় । দিল্লীর ঘরে ঘরে জাল মুদ্রার কারখানা তৈরি হয় । ১৩৩১-১৩৩২ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ বাজার থেকে তামা-পেতলের মুদ্রা তুলে নেন ।
পরবর্তীকালে যখন দিল্লীর তুর্কী সুলতানী ক্ষমতা দ্রুত অস্তাচলগামী, তখনও দিল্লীর সার্বভৌমত্ব স্বীকার না করে বঙ্গদেশের সুলতানরা দিল্লী সুলতানদের অনুরূপ প্রায় ১৬৬ গ্রেন ওজনের মুদ্রার প্রবর্তন করেন । খিলজী সম্রাট আলাউদ্দিনের মতো বঙ্গদেশের সুলতান সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহও (১৩৪৩-১৩৫৭ খ্রিঃ) তাঁর প্রবর্তিত মুদ্রায় নিজকে দ্বিতীয় আলেকজান্ডার হিসেবে বর্ণনা করেন । এই সময় মল্লভূমে রাজত্ব করেন কিনু (কানু) মল্ল (১৩৪৫-১৩৫৮ খ্রিঃ) । বঙ্গদেশের আরেক স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৮ খ্রিঃ) তাঁর প্রবর্তিত মুদ্রায় নিজকে কারু (অর্থাৎ কামরূপ), কামতা, উড়িষ‍্যা ও জাজ নগরের বিজয়ী বলে বর্ণনা করেন । এই বিজয়কে স্মরণ রাখার জন‍্য তিনি কিছু মুদ্রা বঙ্গদেশে প্রচলন করেন । সেই সময় মল্লভূমের রাজা ছিলেন চন্দ্র মল্ল ( ১৪৬০-১৫০১ খ্রিঃ) এবং বীর মল্ল ( ১৫০১-১৫৫৪ খ্রিঃ) ।
বঙ্গদেশের প্রতাপশালী হিন্দু জমিদার রাজা গণেশের পুত্র (ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত) জালালুদ্দিনের নামাঙ্কিত হিজরী ৮১৮ ও ৮১৯ সনের তারিখযুক্ত কিছু মুদ্রা পাওয়া যায় । রাজা গণেশ তাঁর রৌপ‍্য মুদ্রাগুলি পাণ্ডুনগর (পাণ্ডুয়া), সুবর্ণগ্রাম (সোনার গাঁ) এবং চাটিগ্রামের (ঢট্টগ্রামের) টাকশাল থেকে তৈরি করাতেন । তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেই দনুজমর্দন দেব উপাধি গ্রহণ করে মুদ্রা প্রস্তুত করেন । এই সময় মল্লের রাজা ছিলেন হাম্বীর মল্ল দেব (১৫৬৫-১৬২০ খ্রিঃ ) ।
সপ্তদশ শতকের পর থেকে মুঘল সম্রাটদের মুদ্রাই বঙ্গদেশে প্রচলিত ছিল । রৌপ‍্যমুদ্রার নাম ছিল ‘টঙ্ক ‘ –এই শব্দ থেকেই টাকা শব্দের উৎপত্তি । প্রতি টঙ্কতে (চীনদেশীয় ১/১২ আউন্স) রূপা থাকত । অষ্টাদশ শতাব্দীতে চার পাঁচ হাজার (কারো মতে আড়াই হাজার) কড়ি এক টাকার সমান ছিল । ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ( ১৫২৬-১৫৩০ খ্রিঃ) এবং তাঁর পুত্র হুমায়ুন ( ১৫৩০-১৫৪০ এবং ১৫৫৫-১৫৫৬ খ্রিঃ ) তাঁদের মুদ্রা প্রস্তুতকরণ পদ্ধতিতে মধ‍্য এশিয়ার ধারা অনুসরণ করেন । তাঁদের রৌপ‍্যমুদ্রাগুলি শাহরুখি অথবা দিরহাম নামে পরিচিত ছিল । সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিঃ ) শূরী রাজবংশের শ্রেষ্ঠ শাসক শের শাহ (১৫৩৯-১৫৪৫ খ্রিঃ)-এর মুদ্রা প্রস্তুতির কলাকৌশল গ্রহণ করেছিলেন । শের শাহ প্রবর্তিত স্বর্ণ ও রৌপ‍্য মুদ্রার ওজন ছিল যথাক্রমে ১৭৪ গ্রেন ও ৩৩০ গ্রেন । তাঁর আমলে ১/২, ১/৪, ১/৮ ও ১/১৬ অংশের মুদ্রা প্রবর্তিত হয় । রূপা ও তামার মুদ্রার নাম ছিল যথাক্রমে রুপিয়া ও দাম ( প্রাচীন নাম দাম্রি) । শের শাহের তামার মুদ্রার অনুরূপ মুঘলদের ‘দাম’ তামার মুদ্রার ওজন ৩২০ গ্রেন থেকে ৩৪০ গ্রেন হত । ঐ মুদ্রাগুলিকে সাধারণত ফানুস (তামা) অথবা সিক্কা ফানুস (তামার মুদ্রা) নামে অভিহিত করা হত । ১/২ দামকে নিককি, ১/৪ দামকে দ্রাম্রা এবং ১/৬ দামকে দামরি বলা হত । তামার দাম বেড়ে যাওয়ায় ঔরঙ্গজেবের আমলে ২২০ গ্রেন ওজনের ‘ দাম ‘ অথবা ‘ ফালুঙ্গ ‘ মুদ্রা নির্মাণ শুরু হয় ।
মুঘল সম্রাটদের আমলে বঙ্গদেশে সর্বমোট ৩৯ জন শাসক (১৫৭৫-১৭১৬ খ্রিঃ) রাজত্ব করেছেন এবং ১৭১৭-১৭৬৫ –এই সময়কালে মুর্শিদাবাদের নবাব ছিলেন ৮ জন । এই সমকালে মল্লভূমে রাজা ছিলেন –হাম্বীর মল্র দেব থেকে চৈতন‍্য সিংহ দেব –মোট আটজন মল্লরাজা ।
১৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে মুদ্রা তৈরি করার অনুমতি লাভ করে । তারা প্রথমে দক্ষিণ ভারতীয় ধরণের সোনার ব‍রাহ ( প‍্যাগোদা) মুদ্রা এবং ইউরোপীয় ধরণের রুপি ও তামার মুদ্রা প্রচলন করে । ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের পরে বঙ্গ-বিহার-উড়িষ‍্যার দেওয়ানী লাভ করবার পরই মুদ্রা তৈরির একচেটিয়া অধিকার লাভ করে । যদিও তারা মুঘল মুদ্রার অনুকরণ এবং পুরাতন মুদ্রার ব‍্যবহার বজায় রাখল । কিন্তু ব‍্যবসার প্রয়োজনে নকল মুঘল মুদ্রাও তৈরি করত । ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস স্থির করেন অতঃপর দ্বিতীয় শাহ আলমের রাজত্বকালের মধ‍্যে একটি মাত্র তারিখ মুদ্রাতে উৎকীর্ণ করা হবে । অর্থাৎ একটি বিশেষ কাল পর্যন্ত মুদ্রার তারিখ অপরিবর্তিত থাকবে । ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিস ঘোষণা ক‍রেন, মুদ্রার অঙ্গহানি হলেও তা পরিত‍্যক্ত হবে না । কিন্তু ওজনের মাধ‍্যমে তার মূল‍্যমান স্থির করা হবে । ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে ইঙ্গ-ভারতীয় মুদ্রা একমাত্র বৈধ মুদ্রা বলে স্থির হয় এবং রৌপ‍্য মুদ্রা এক নির্দিষ্ট ওজন মানে উপনীত হয় । ৬৪ তামার পয়সা অথবা ১৬ আনা এক রৌপ‍্য টাকার সমতুল‍্য বলে গণ‍্য হল । ঐ একই সময়ে ১, ১/২, ১/১২ মূল‍্যের তামার পয়সা চালু হল । ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাজা চতুর্থ উইলিয়ামের মস্তক চিত্রিত সর্বভারতীয় স্তরে রূপার এক টাকা মূল‍্যের রৌপ‍্য মুদ্রা চালু হয় । পরিবর্তে পূর্বের সব মুদ্রা বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয় । এই সমকালে মল্লভূমে রাজত্ব ক‍রেছেন মাধব সিংহ দেব ( ১৮০১-১৮০৯ খ্রিঃ)ও গোপাল সিংহ দেব (২য়) ( ১৮০৯-১৮৭৬ খ্রিঃ)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৩৯-১৯৪৫ খ্রিঃ) রূপার দাম চড়া হবার কারণে বিশুদ্ধ রূপার মুদ্রার পরিবর্তে সঙ্কর ধাতুর মিশ্রণ ঘটিয়ে এক টাকার মুদ্রা তৈরি করে চালু করা হয় এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে সস্তা ধাতু নিকেল মুদ্রা তৈরির জন‍্য ব‍্যবহৃত হতে লাগল । সঙ্গে সঙ্গে কাগজের টাকাও মুদ্রিত হয়ে চালু হল ভারতে । পরাধীন ভারতে মল্লভূমের শেষ রাজা ছিলেন কালীপদ সিংহ ঠাকুর (১৯৩০-১৯৮৩ খ্রিঃ) ।

তথ্য ঋণ :

১। বাংলাদেশের ইতিহাস : রমেশচন্দ্র মজুমদার
২। মুদ্রা ও মানব সভ‍্যতা : মদনমোহন সাহা
৩। সুবর্ণরেখা হইতে ময়ূরাক্ষী : মাণিকলাল সিংহ
৪। ঐতিহাসিক প্রবন্ধ সংকলন : চন্দন কুমার ভট্টাচার্য
৫। বিদেশীদের চোখে ভারতবর্ষ (ফা-হিয়েন) : শ্রীকৃষ্ণচৈতন‍্য মুখোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *