ভালোবাসার বাগান
শিখা কর্মকার
নিজের ব্যাগ-বাক্স গুছিয়ে কার্টে ভরে সবে আটলান্টা হার্টসফিল্ড এয়ারপোর্টের দরজা দিয়ে বাইরে বেরোতে যাবে রিমি, হঠাত পিছুডাক। কেউ পরিষ্কার বাংলায় হেঁকে বলছে , “শুনছেন”?
অবাক রিমি পিছু ফিরে দ্যাখে, একজন সৌম্যদর্শন স্যুটবুট পরিহিত ভদ্রলোক হনহন করে এগিয়ে আসছে তার দিকে। সে খুব কাছে এসে বলল, “আমি খুব দুঃখিত আপনাকে বিরক্ত করার জন্য, কিন্তু উপায়হীন “। বিব্রত ও শঙ্কিত মুখে যুবকটি বলে চলে, “আসলে আমি এইমাত্র লক্ষ্য করলাম যে আমার ওয়ালেটটি মিসপ্লেস করে ফেলেছি। ওটা ছাড়া ট্যাক্সি নিতে পারবোনা । আপনাকে বাঙালি দেখে ডেকে ফেললাম। যদি পারেন, প্লীজ একটু হেল্প করে দিন। একটা কিছু উপায়… “।
“আমি কি করতে পারি বলুন”? রিমি জিজ্ঞেস করে।
রিমির মনে পড়ে যায় আজকাল নানারকম কায়দাকানুন করে, অনেকেই জনসাধারণকে বিপদে ফেলছে। এইতো কদিন আগেই খবরে শুনেছে যে বাজার করে এক ইয়ং মহিলা ফিরছিল তার গাড়িতে । পারকিং লটে এক বৃদ্ধ বললেন, “ আমার গাড়ির ট্রাঙ্কটা খুলে দেবে? আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিনা, তাই খুলতে পারছিনা”। সে উপকার করতে গিয়ে যেমনি চাবি ঘুরিয়ে গাড়ির ট্রাঙ্ক খুলেছে, সেই ভদ্রলোক তাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ভরে কিডন্যাপ করে কোথাও নিয়ে গিয়ে গিয়ে গাড়িশুদ্ধ বিক্রি করে দিয়েছে। তার সঙ্গে আরও লোকজন ছিল। কিছুদিনে পরে খবরে বলে, “মৃতদেহটির ময়না তদন্তে জানা গেছে, ধর্ষণের পরে যুবতীকে খুন করা হয়েছে”। এমন ধরণের কত যে চক্রান্ত চলছে। কখনো পঞ্চাশটি গাড়ি একসঙ্গে চুরি হচ্ছে, কখনো বাচ্চাসহ গাড়ি চুরি হয়ে যাচ্ছে । তার ভাবনায় বাধা পড়ল, রিমি বাস্তবে ফিরে এল, যখন সেই ভদ্রলোক বললেন,
“আমি জানতে চাইছিলাম যদি আমাকে কিছু ক্যাশ ধার দিতে পারেন তাহলে আমি হোটেলে যেতে পারি আজকের রাতটার মত । কাল ব্যাঙ্কে কথা বলে আপনার টাকা ফেরত দিয়ে দেব। আপনি যদি কন্ট্যাক্ট নাম্বার দেন, তাহলে আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসব। এত রাতে অফিস, ব্যাঙ্ক কিছুই খোলা নেই। কি যে করি, মাথায় কিছু আসছেনা”।
রিমি বুঝতে পারছেনা তার কি করা উচিত। সে ভাবতে ভাবতেই দেখা হল এয়ারপোর্টের সিকিউরিটির হেড মিঃ ব্রাউনের সঙ্গে। রিমি একই কোর্টে বহুবার টেনিস খেলেছে তাঁর সাথে, তারা পরস্পরকে চেনে জানে একযুগের মত । তিনি এসে ভদ্রলোককে বললেন,
“কি ব্যাপার কান্ত, চোখ-মুখ এমন শুকনো কেন? কি হয়েছে?” সেই ভদ্রলোক সিকিউরিটি অফিসারকে একই কথা বললেন। তিনি এয়ারপোর্টের ব্যাঙ্কের দিকে চেয়ে দেখলেন, শাটার বন্ধ। রাত দুটো দশ তখন, কি আর খোলা থাকবে। এটিএম মেশিন খারাপ হয়েছে। সেও বন্ধ। সবই বন্ধ । অন্য লোকজনও কেউ কোথাও নেই। মিঃ ব্রাউন পকেট হাতড়ে বার করে আনলেন,পাঁচ ডলার । তিনি বললেন, “ কান্ত, এক সেকেন্ড ওয়েট করো , তোমার জন্য আমার ক্রেডিট কার্ড থেকে তুলে দিচ্ছি দুশ ডলার, তুমি যেদিন বাড়ি ফিরবে, সেদিনে দুশডলার আমার অফিসে দিয়ে যেও ।“
তিনি কথা বলতে বলতেই ইন্টারকমে মেসেজ ভেসে এল, “মিঃ ব্রাউন, প্লীজ কাম টু দ্য মেইন অফিস, ইমিডিয়েটলি, দিশ ইজ আর্জেন্ট । মিঃ ব্রাউন, দিস ইজ আর্জেন্ট, ওভার” । শুনেই তিনি ডলার তোলার কথা ভুলে দৌড়লেন সিঁড়ির দিকে বেল্ট থেকে গান বার করতে করতে। বাকি তিনজন সিকিউরিটিও দৌড়ল তার পিছু পিছু।
রিমি ব্যাগে খুঁজে পেতে একশ ডলার পেল। বলল, “আমার কাছে আর ক্যাশ নেই, আপাতত এইটুকু রাখুন। আর আমার সঙ্গে আসুন। কোন হোটেলে উঠেছেন জানালে আমি নামিয়ে দেব। তারপর কাল সবকিছু খুললে আপনি ব্যবস্থা করে নেবেন”।
“আমি উঠেছি ফোর সীজনস হোটেল, আটলান্টা” । সে বলতেই রিমি তার লাগেজের দিকে লক্ষ্য করল। নজরে পড়ল, খুব দামী ব্যাগ, পোশাকআসাকও দামী। সে ভাবল, হয়ত ইনি সত্যিই বিপদে পড়ে সাহায্য খুঁজছিলেন । আর মিঃ ব্রাউন যখন চেনেন, বা কান্ত বলে সম্বোধন করলেন, তার মানে এনাকে রাইড দেওয়া যেতেই পারে।
“আসুন, আমার সঙ্গে । পারকিং লটে গাড়ি আছে” ।
রিমি যখন চালাতে থাকে গাড়ি হোটেলের দিকে, ভদ্রলোক তখন জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনার বাড়ির পথেই কি হোটেলটি পড়ছে” ?
“না, একটু দূরে। আধঘণ্টা দূরে। সে কিছু না। আপনি নিরাপদে পৌঁছে যান, রেস্ট নিন রাত্তিরে, কাল দেখা যাবে। কিন্তু হোটেলে যাবেন কি করে ? আইডি, ক্রেডিট কার্ড ও ক্যাশ তো ওয়ালেটে” ।
“সে অসুবিধে হবেনা। মালিক ও ম্যানেজার দুইই আমার বন্ধু” ।
“খুব ভালো । কিন্তু শুনেছি এসব বিখ্যাত হোটেলে গেস্টদের জন্য শাটল পাঠিয়ে দেয় এয়ারপোর্টে” ।
“হুম, প্রতিবারই দেয়। এবারে শুনলাম একটি শাটল গেছে নর্থ এয়ারপোর্টে এক ফিল্মস্টারকে আনতে। আর দুটিকে সারভিসে দিয়েছে। ম্যানেজার অফার করেছিল যে সে আসবে ট্যাক্সি নিয়ে তো আমিই বলেছিলাম, আসার দরকার হবেনা। এত দেরিতে নামছি, আমি বরং একটা রাইড নিয়ে নেব। কে জানতো এমন ফ্যাসাদে পড়ব । প্লেন থেকে নামার লাস্ট মোমেন্ট পর্যন্ত চেক করেছি সঙ্গে ছিল, তারপরে যে কি হল, মাথায় আসছেনা”।
“কালকে কল করে দেখবেন, হয়ত পেয়ে যাবেন । বলা তো যায়না” ।
তিনি চুপ করে রইলেন। নামার সময় ভদ্রলোক বারবার ধন্যবাদ জানালেন। বললেন,
“এমন অসময়ে এতবড় উপকার করলেন, নইলে কি যে করতাম। কি বলে যে ধন্যবাদ দিই”। তিনি স্যুটকেশ খুলে তার একটি কার্ডও দিলেন, বললেন, “প্লীজ যোগাযোগ করবেন, আমি তাহলে ধার শোধ করতে পারবো” ।
রিমি গুডনাইট জানিয়ে তার পার্সে কার্ড রেখে ড্রাইভ শুরু করল। বাড়ি ফিরতে প্রায় একঘণ্টা দেরি হয়ে যাবে। কাল সকালেই আবার অতবড়ো এক প্রেজেন্টেশন আছে । আটশ থেকে হাজার খানেক প্রিন্সিপ্যাল, কলেজের প্রেসিডেন্ট বা আরও উঁচুদরের লোকজন আসবে। কিন্তু আজ রাত্তিরে ঘুম একটু না হলেই নয় । সে যখন বিছানায় গেল, তখন প্রায় ভোর চারটে। বাগানে পাখি ডাকতে শুরু করেছে। তবু ফোনে অ্যালারম দিয়ে সে শুয়ে পড়ল ।
জর্জিয়ার সব চাইতে বড় গার্ডেনে বিশাল মেলা আজ । স্প্রীং ফেয়ার চলছে। অনেকদিন বাগানটি বন্ধ ছিল। এখন তারা খুলছে । এমন এমন প্ল্যান করছে যাতে শুধু প্রকৃতিকে যারা ভালোবাসে তারাই নয়, আরও অনেকেই যাতে আসে। এজন্যই তারা আয়োজন করেছে নানা রকমের একজিবিশনের, কম্পিটিশনের যেমন জর্জিয়া হুইল অফ ফরচুন, কায়াক ও ক্যানু রেস, হর্সরেশ, ডগ শো, একাডেমিক প্রেজেন্টশন, ফ্লাউয়ার শো, সেভ দ্য ওয়ার্ল্ড ইত্যাদি ইত্যাদি । বাইরে কার্নিভ্যালের মত বসেছে বিশাল চড়ক, ৭০ ফুটের বিশাল বালিশ ঝাঁপানোর জন্য, মুন-ওয়াক ড্রাগন বাচ্চাদের জন্য, এক, গাছের ডাল থেকে আরেক গাছের ডালে টারজানের মত যাতায়াতের অ্যাডভেঞ্চার (হারনেশ আর সুপারভাইসর থাকবে সঙ্গে)। একটা হলে আরটস এন্ড ক্র্যাফট শো চলছে। এত লোকজন এসেছে যে আর গাড়ি পার্ক করার জায়গা নেই। লোকে দূরে মাঠে গাড়ি রেখে চার পাঁচ ব্লক মানে প্রায় এক মাইল হেঁটে হেঁটে আসছে। রিমির স্কুলের প্রেজেন্টেশনের দিন আজ । তার স্কুল থেকে চারজন টিচার এসেছেন। তাঁরা সবাই Environmental Issuর ব্যাপারে পাওয়ার-পয়েন্ট বা মুভি দেখিয়ে বক্তৃতা দেবেন। একজন খুব নার্ভাস হয়ে প্রায় নেতিয়ে পড়েছে । রিমি সাহস দেবার জন্য হেসে জিজ্ঞেস করে,
“ কি ব্যাপার মিস মলি, কেমন আছেন ?
তিনি মিনমিন করে বললেন, “খুব নার্ভাস লাগছে আজ । ভয় করছে”।
তার কাঁধে হাত রেখে রিমি বলল, “ ভয়ের কি আছে” ? তুমি এত ভালো পড়াও যে স্টুডেন্টদের মা বাবারাও বসে পড়ে তোমার ক্লাসে, কত নাম করে আমার অফিসে এসে, তোমার চিন্তা কিসের”?
মিস মলি বললেন, “যদি উল্টোপাল্টা করে স্কুলের নাম ডুবিয়ে দিই? যদি কথা না বেরোয় ? যদি সব ভুলে যাই, তাহলে কি হবে ?”
রিমি হেসে বলে, “আজ পাঁচ বছর ধরে ক্লাসে পড়ানো দেখছি তোমার । কতবার না বলেই অবজারভ করেহি তোমাকে । কোনদিন একচুল ভুল হয়নি। আজও হবেনা। আর হলেও জানছে কে? তোমার লেখাটি তো কেউ দ্যাখেনি, তারা বুঝতে পারবেনা তুমি যদি একটু আধটু স্কিপ করেও ফ্যালো । প্লাস সবকিছুই তো প্রায় লেখা আছে পাউয়ার-পয়েন্টে, তুমি সেফ। এক্কেবারে ভাববেনা”।
মিস মলি আবেগে অভিভুত হয়ে জড়িয়ে ধরেন রিমিকে । বলেন, “ইউ আর দ্য বেস্ট প্রিন্সিপ্যাল এভার। আই এম সো প্রাউড অফ ইউ, আই ফীল সো লাকি টু হ্যাভ ইউ অ্যাজ মাই সুপারভাইসর”। বলতে বলতেই তাদের ডাক এল। সবার সাথে রিমিও গেল স্টেজে। পরপর চারজনের প্রেজেন্টশন হলে পরে দর্শকেরা করতালিতে ভরে দিল প্রেক্ষাগৃহ । সবশেষে রিমি তাদের প্রাপ্য সার্টিফিকেট, টিশার্ট, গার্ডেনের ফ্রি এডমিশন ফর দ্য ফ্যামিলি এসব টোটব্যাগে ভরে সব টিচারদের দিল। তখন বেলা দেড়টা । তারা তাদের নিজেদের লোকজনের সঙ্গে বাগান ঘুরতে চলে গেলে সে সোজা চলে এল ক্যাফেটেরিয়ায়।
“ ফ্রেশ অ্যাভাকাডো স্যান্ডউইচ, হট-সস অ্যান্ড আদার কন্ডিমেন্টস ইন শেপারেট কন্টেইনার, স্পাইশি ফ্রাই, ভেজি স্যুপ, লেমোনেড । লেটার অন স্পাইসি টি , এন্ড এ স্লাইস অফ চীজকেক উইথ হুইপিং ক্রীম”। এসব অর্ডার দিয়ে রিমি বসল গিয়ে বাইরে, লেকের বুকে ঝুলন্ত এক ডেকে । সেখানে বসেই সে খাবে তার লাঞ্চ। একটু রেস্ট নিয়ে ভাববে কি করা যায় । যাবার জায়গা এখানে প্রচুর, কিন্তু হাতে ততটা সময় নেই, তারপরে ক্লান্তিও এসে পড়ে হুটহাট করে । আপাতত বড় কাজটি সারা হয়ে গেছে বলে স্ট্রেস নেই আর । তার মন এখন ফুরফুরে হালকা।
এখানে এলে রিমি ভুলে যায় তার রাজ্যের কাজ, হাজার ব্যস্ততা, তার সারাদিনের দৌড়ঝাঁপ । এখানের পরিবেশ বড় শান্ত করে দেয় তাকে। গত তিনদিন ধরে যে এত ছুটোছুটি গেছে, গতকাল ভোর চারটেয় বাড়ি ফিরে মাত্র তিনঘন্টা ঘুম দিয়ে আজ সকাল থেকে সারাক্ষণ ব্যস্ত থেকেছে, তা মনেই পড়েনা।
সে জলে ফুটে থাকা ফুলের প্রতিবিম্ব দ্যাখে একমনে। দ্যাখে পাশে খেলতে থাকা দুই বছরের বাচ্চার অনাবিল হাসিমুখ। সে এসেছে তার দিদার সাথে। দুজনে ট্রেন নিয়ে খেলছে। দিদার হাসিটিও স্নেহসুখে স্বর্গীয় ।
“বসতে পারি”? এয়ারপোর্টে দেখা হওয়া সেই ভদ্রলোক । হাতে লাঞ্চের ট্রে, নিখুঁত দাঁত বেয়ে ঝরে পড়া উজ্জ্বল হাসি। ঝকঝকে দামী স্যুট। ষ্টেজের আইডি-ট্যাগ তখনো কলারে আটকানো ।
“আরে আপনি! এখানে? বসুন, বসুন”। রিমি সাদরে আমন্ত্রন জানায়। মনে মনে ভাবে সে, এনাকেই কি চাইছিলাম আজ খুব? ইনি আসাতেই মনে হল দিনটি সার্থক হল । এত ভালো কেন লাগছে আমার ? অথচ আমি চিনিনা এনাকে, পুরো নাম পর্যন্ত জানিনা।
“আমি ক্যাফেটেরিয়ার ভেতরেই বসেছিলাম। তারপর আপনাকে দেখলাম অর্ডার দিয়ে পরে প্রকৃতির কোলে এসে বসলেন । চারদিকে এত ফুটে থাকা ফুলের মত বাঁধাকপি, ঝলমলে বেরি, এতসুন্দর গন্ধ ইস্টার লিলির… আর ভেতরে থাকতে ইচ্ছে হলনা। ভাবলাম, একা বোকার চেয়ে বরং … অবশ্য এতে আপনার আপত্তি না থাকলে তবেই”।
“আরে না না, আপত্তি কেন হবে, ভালোই হল , আপনি এলেন”।
সেই টেবিলেই আরও তিনটে চেয়ার শূন্য ছিল। তার একটা টেনে তিনি বসলেন।
রিমি একঝলক তাকাল ট্রেতে রাখা খাবারের দিকে। বলল, “এখানের ফ্রায়েড চিকেন কিন্তু বিখ্যাত”।
তিনি হেসে বললেন, “জানি। কিন্তু আমি নিরিমিষ খাবার পছন্দ করি” ।
রিমি কিছু বলার আগেই তারও ট্রে দিয়ে গেল জ্যাকি নামের একজন ওয়েট্রেশ।
“আপনিও” ?
রিমি হেসে বলে, “হুম, নিরিমিষ খেয়ে যদি উপকার করা যায় পরিবেশের, যদি জল কম খরচ হয়, যদি গ্রীন হাউস গ্যাস কম হয়, নিজেরও স্বাস্থ্য ভালো থাকে, আরও কত কি লাভ হয়, তাহলে নয় কেন?”
তিনি বললেন, “একদম তাই। আমি আগে মীটইটার ছিলাম, গত দশবছর হল ছেড়ে দিয়েছি”।
“ভালো করেছেন। নিরিমিষেও কত যে চয়েস থাকে, অনেকেই জানেনা”। বলেই রিমি পিঠোপিঠি জিজ্ঞেস করল।
“তো এখানে কি মনে করে এসেছেন? বেড়াতে “?
“পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কে একটা লেকচার দিতে এসেছি। সেটা শেষ হতে লাঞ্চ খেতে এলাম।“
“আপনি কাজে এসেছেন? আপনি কি প্রফেসর”?
“নাহ। আগে ছিলাম, সেই প্রস্তরযুগে, এখন আর প্রফেসর নই”।
“তাহলে”?
“সে কাজ থেকে পদোন্নতি করে কলেজের ডিন, সেখান থেকে প্রেসিডেন্ট হবার জন্য অফার-লেটারও পেয়েছিলাম। তাও ছেড়ে দিয়েছি”।
রিমি হাঁ হয়ে যায় শুনে। “সে কি? তাহলে আপনার কাজ কি এখন”?
“আমি রিটায়ার্ড মানুষ । কাজ তেমন কিছু করিনা আজকাল। তবে নিমন্ত্রিত হলে লেকচার দিই, অন্য সময়ে পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে রিসার্চ করি। সিনেমা করি, মাঝে মাঝে ডুব দিই, তখন বই পড়ি, গান শুনি, সময় কেটে যায় “।
“সত্যি”?
“হুম, একেবারে সত্যি” ।
“ঈশ, কি মজা। আপনাকে কিন্তু বেশ হিংসে হচ্ছে আমার । ইচ্ছেমত কেউ কিছু করতে পারে নাকি আজকাল? একটা চাকরি ছেড়ে স্বাবলম্বী হওয়া, সেকি কম কথা। আমি তো ভাবতেই পারছিনা। আহা, আমিও যদি পারতাম”!
“তাহলে কি করতেন ? সেই সময়, সুযোগ ও ম্যাটেরিয়াল পেলে”?
“সারাদিনরাত বই পড়তাম । লিখতাম, ছবি আঁকতাম । সাফারিতে যেতাম, সমুদ্রের তলায় কোরাল রিফে রঙিন মাছেদের সাথে সাঁতার কাটতাম । পাহাড়ে উঠতাম, দেখতাম পৃথিবীটাকে”।
“কেন নয় ? সবই করতে পারেন। সেরকম প্ল্যান করে কাজ করলেই হয়। সে যাই হোক, আপনি কি করেন”?
“আমিও এডুকেটর, এসেছিলাম প্রেজেন্টশনের ব্যাপারে। আমার স্কুলের চারজন টিচারকে নিয়ে। পরিবেশ পরিমন্ডল সংরক্ষণের ব্যাপারে তারাও বললেন, গাইলেন, কবিতা পড়লেন, ছবি দেখালেন”।
“তাই মনে হল যে প্রেক্ষাগৃহে আপনাকে এক ঝলক দেখলাম। তারপরে ভাবলাম, হয়ত আমার মাথা খারাপ হয়েছে, তাই সব জায়গায় আপনাকে দেখছি”। বলেই তিনি হো হো করে হাসতে থাকলেন।
রিমিও হাসল প্রাণখুলে। এনার কথাবার্তা যতটা না মজাদার, কথা বলার ভঙ্গীতেই তার হাসি পাচ্ছে।
“সব জায়গায় মানে? ঈশ্বর নাকি? আর কোথায় দেখলেন আমাকে”?
“হলের ভেতরে প্রতিটি টেবিলে আপনার ছবি দেখলাম । তারপর স্বপ্নে। এখানে খেতে এসে”।
রিমির শিরদাঁড়া বেয়ে এক চিনচিনে স্রোত বয়ে যায় । স্বপ্নে? তার মানে তিনিও রিমিকে স্বপ্নে দেখেছেন যেভাবে রিমি তাঁকে দেখেছে। যেভাবে ঘুম থেকে উঠে অবধি সারাক্ষণ তাঁর কথা মনে পড়েছে । যেভাবে প্রতিটি নিঃশ্বাসে তিনি ভরে দিয়েছেন রিমির দিন। জেনে খুব ভালো লাগল রিমির, কিন্তু কেমন এক ভয়ও ছুঁয়ে গেল। রিমির মনে পড়ে গেল তার স্বপ্নের কথা ।
রিমি, রিমি, রিমি…বলে কেউ একটানা ডেকে চলেছে। সে ঘুমের ঘোরে শোনে তার নাম। বুঝতে পারেনা কে ডাকছে। অথচ সেই ডাকের কি এক অমোঘ আকর্ষণ যা তাকে সব ক্লান্তি সরিয়ে জাগিয়ে তুলে ফেলে দিচ্ছে আরেক নেশার মধ্যে। দুকান বালিশে চাপা দিয়ে সে আরেকটু শুয়ে থাকার চেষ্টা করে, কিন্তু সে ডাক বন্ধ হচ্ছেনা। শেষপর্যন্ত সে আর শুয়ে থাকতে পারলনা।
সে উঠে তার পরীর ডানার মত ধবধবে সাদা সিফনের গাউনের উপরে পরে ফেলে তুলতুলে নরম রোব। দরজায় টুকটুক আওয়াজ। সে দরজা খুলতেই দ্যাখে কালকের ভদ্রলোক । তার দুহাত ভরা স্থলপদ্মে। হাসিতে ঝলমল করছে মুখ ।
“আপনি? এখানে? কি করছেন”?
“তুমি আসতে বললে আমি আসবোনা, তাই কি হয়”? বলে তিনি চেয়ারে বসে সঙ্গে আনা একটি ছোট্ট প্যাকেট খুললেন।
রিমি ভাবার চেষ্টা করে সে কেন তাকে আসতে বলবে ? তিনি তো অচেনা অজানা এক ভদ্রলোক । বিপদে পড়েছিলেন মাঝরাত্তিরে তাই সে একটু সাহায্য করেছে, আর তো কিছুনা। এর বেশি তার ব্রেন কাজ করেনা। আর কিচ্ছু মনে পড়েনা । ইতিমধ্যে তিনি ভেলভেটের বাক্স খুলে একটি ছোট্ট সরু কাঠির মত কি বার করলেন। তার একপ্রান্তে নক্ষত্রের মত এক হীরে, অন্যদিকে কমেটের মত কিছু ঝুরি। সেগুলি হয়ত সোনার, রুপোর, প্ল্যাটিনামের; বললেন,
“ছোটবেলা থেকে চেয়ে গেছ প্রতিদিন, সেই সোনার কাঠি । যার জাদুস্পর্শে ঘুম ভাঙ্গে একশবছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা এক রাজ্যের, রাজকন্যার, পশুপাখির । এই নাও, ধর, হারিয়ে ফেলোনা যেন”।
বলে রিমির ডানহাতের তালুটি ধরে তিনি সেই সোনার কাঠি খুব যত্ন করে ভরে দিলেন। রিমির সেদিকে খেয়াল নেই। সে তখন ভদ্রলোকের হাতের স্পর্শে গলে যাচ্ছে । তার সর্বাঙ্গ তখন বাতাসের মত স্বচ্ছ আর হালকা। সে পরী হয়ে উড়ে যাচ্ছে । এক অচেনা সুখ প্রতি পরমাণুতে রিনরিন করে বেজে চলেছে। সে কথা বলতে ভুলে গেছে।
“আরে, কি হল, অজ্ঞান হয়ে গেলেন? ঈশ, এমন হবে কে জানতো । দাঁড়ান, জল নিয়ে আসি, তাতে যদি জ্ঞান ফেরে…
সেটুকু শুনতে পায় রিমি সুখের প্লাবনে হারিয়ে যেতে যেতে । তারপরে তার আর কিছু মনে নেই”। তারপর অ্যালারম বাজতেই হুড়মুড় করে উঠে বসে। বুঝতে পারে এটা নিছকই এক স্বপ্ন। সে নিজের স্বপ্নের কথা কিছু না বলে ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে,
“তো কি দেখলেন আপনার স্বপ্নে? বলা যাবে?”
তিনি হেসে, মাথা নেড়ে না বললেন। তারপরে কথা ঘোরানোর জন্য বললেন,
“দেখছেন, আপনাকে আমার নাম বলা হয়নি। আলাপ হল, অথচ পরিচিতি পর্যন্ত দিইনি। আমার নাম সূর্যকান্ত। বন্ধুরা সুরিয়া নামে ডাকে। কেউ কেউ কান্ত বলে । সারাক্ষণ বই মুখে থাকতে ভালোবাসি, সেরকম প্ল্যান আছে বাকি জীবনটাও সেভাবেই কাটানোর ”।
রিমি ফ্রাইগুলি ক্যাচাপে ডুবিয়ে খেতে খেতে আগ্রহের সাথে শোনে ।
“আমি প্রতিবছর এখানে ইনভাইটেড গেস্ট হয়ে আসি, অন্যবার সময় কম থাকে বলে জায়গাটা ঘুরে দেখা হয়নি । এবার প্ল্যান করেছি ঘুরে দেখব। কাজ সেরে সাততাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেই বা কি করবো, সেইতো বই, নইলে গান, নইলে মুভি”।
“কেন, বাড়ির লোকেরা রাগ করেনা? আপনার মিসেস”?
“মিসেস? বাড়ির লোক ? আমার কেউ নেই এখানে। ভাই আর মা এসেছিল বিয়ের কথা বলে বলে মাথা খারাপ করে সবে গতমাসে চলে গেল দেশে। এখন আমি থাকি আর আমার রোবট ছায়া। এবার আপনার কথা বলুন”।
“তার আগে বলুন আপনি কি করে জানলেন যে আমি বাঙালি? প্লেনে তো কারো সাথে কথা বলিনি আমি । ব্যাগেও নাম ছিলনা। তাহলে”?
“আপনি নিউইয়র্কের এয়ারপোর্টে যেখানে বসে গল্প করছিলেন মাসীমার সাথে, তার খুব কাছেই বসেছিলাম আমি । হয়ত দেখেননি নজর করে। আপনাদের প্রায় সব গল্পই কানে এসেছিল তখন। মাসিমা বড় মজার কথা বলেন। সে যাই হোক, খুব আপন মনে হচ্ছিল আপনাদেরকে, তাই আটলান্টায় বিপদে পড়েই মনে হল আপনাকে জিজ্ঞেস করলে হয়ত ফেরাবেননা”।
“আচ্ছা। বুঝলাম। আমি রিমি। হাইস্কুলের প্রিন্সিপ্যালের কাজ করছি গত পাঁচ বছর হল । কবিতা বা বাগান পেলে ভুলে যাই নিজের কথা, পৃথিবীর কথা, সব দায়িত্ব । মা, বাবা, ভাই, বোন, দিদি, জামাইবাবু সবাই আছে ইন্ডিয়াতে । এখানে ওই মাসি থাকে নিউইয়র্কে । আর আমি থাকি আটলান্টায়” ।
“আপনিও কি চীজকেক আর চা নেবেন নাকি কী-লাইম পাই , সঙ্গে কফি”? জ্যাকি এসে জিজ্ঞেস করে।
“দুটোই টেম্পটিং। আপনি কোনটা সাজেষ্ট করেন”? তিনি জ্যাকিকেই জিজ্ঞেস করেন।
“দুটোই দুজনে এক স্লাইস করে নিন। সঙ্গে স্পাইসি টি”।
“ তাই হোক” । এসে গেল কেক এবং পাই। কেকের ওপরে হুইপিং ক্রীমের ওপরে চেরি, চকলেটের শেভিং, ওয়ালনাটের টুকরো ।
“আমার এত মিস্টি খাওয়া উচিত নয় কিন্তু দুটোই এমন লোভনীয় যে না বলতে পারছিনা”। রিমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ।
“খাবেননা কেন? বলে টেস্ট করে বললেন, “এসব না খেয়ে রেখে দিলে আক্ষেপ করবেন, লোভ থেকে যাবে, এতই স্বাদু। তার চেয়ে আসুন, খেয়ে নি। পরে ফলাফলের কথা ভাবা যাবে।“
“কাজ হল, খাওয়াদাওয়া হল, এবার কি করবেন, বাড়ি ফিরে যাবেন এখুনি ”? সুরিয়া জিজ্ঞেস করে রিমিকে।
“আমি এখানে এলে এমনিতে সারাদিনটাই থেকে যাই । এত দেখার জায়গা আছে, চারদিক জুড়ে এমন ফুল ফুটেছে তার উপরে এতগুলি ইভেন্ট প্লাস আর্টস এন্ড ক্র্যাফটসের মেলা বসেছে, সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে, কি করে আর ঘরে ফিরি, আপনিই বলুন “।
“সেই তো । আমিও তো বহুবার নাম শুনেছি এই গার্ডেনের এই ইভেন্ট ভালো, সেই ইভেন্ট ভালো কিন্তু কলেজের ডিন ছিলাম যখন, তখন সময় কোথায় নিঃশ্বাস নেবার । ক্যালেন্ডারে টুডু লিস্ট বানিয়ে তার পিছনে ছোটা । এখন আমি আমার সময়মত কাজ করি। আমারও ইচ্ছে আছে রথ দেখা হলে কলা বেচবো । তা আপনি প্রথমে কোথায় যাবার কথা ভাবছেন”?
“এখন তো স্প্রিং, তাই এসময়ে অ্যাজেলিয়া ফুল দেখবো । লেকের ধারে ধারে কত রকমের যে ফুল ফোটে সে বলে বোঝানো যাবেনা । চলুন, আগে সেসব দেখে আসি”।
বাগান একটাই হলেও তার কিছু জায়গা বেশ দূরে দূরে। সেখানে বাগানের ট্রলিতে, সাটলে বা নিজের গাড়িতে করে যেতে হয়।
“এখানে কি করে এলেন? কে রাইড দিল”? রিমি ড্রাইভ করতে করতে জিজ্ঞেস করে।
“গার্ডেনের সাটল গিয়ে আমার মত দশজনকে নিয়ে এসেছে হোটেল থেকে, একসাথে। ওরাই সকালে খোঁজখবর নিয়ে এয়ারপোর্টে ফোন করে আমার ওয়ালেটের খোঁজ করে। মিঃ ব্রাউন চারদিক তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাননি। কোন এক ইয়ং মহিলা নাকি তা খুঁজে পেয়ে লস্ট-এন্ড-ফাউন্ডের অফিসে গিয়ে দিয়ে এসেছেন। আশ্চর্য লাগল এইদেখে যে ভেতরের একটি ডলারও খোয়া যায়নি । শুধু সব ক্রেডিট কার্ড ক্যান্সেল করে দিয়েছি তাই সেগুলি আবার ডাকে নতুন নাম্বার দিয়ে পাঠাবে । বাই দ্য ওয়ে, এখন প্লীজ আমাকে ধার শোধ করতে দিন। আপনি মাঝরাত্তিরে অচেনা-অজানা একজনকে রাইড দিয়েছেন। কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেবো, তা জানিনা” ।
“সে তো আমি বা অন্য কেউ বিপদে পড়লে আপনিও নিশ্চয়ই সাহায্য করতেন । এটা এমন কিছু বড় কথা নয় । পরে না হয় করবেন ধার শোধ । এখন তো আপনার ক্রেডিট কার্ড চলবেনা। কখন যে ক্যাশ দরকার হবে, তা কি বলা যায়” ?
“সে আমার হয়ে যাবে। এখন আছি তো রিসর্টেই। চারবেলা খাবার, থাকা, বেড়াতে যাওয়া …সব কিছুই তো ওঁরা করছেন। তিনদিন থেকেই চলে যাবো । আমার আবার আলাদা খরচ কিসের”?
“তবুও রাখুন, বলা তো যায়না । পরে কোনদিন ফেরত দেবেন। এ তো আর পালিয়ে যাচ্ছেনা”।
আলাপ-আলোচনা করতে করতে দুজনে পৌঁছে গেল লেকের কাছে। আজ অনেক লোকজন এসেছে তাদের পুরো পরিবারকে নিয়ে । শিশুদের কোলে বসে বা ষ্ট্রলার ঠেলে ঠেলে দূরে নিয়ে যাবার আনন্দ, ছোটদের প্রজাপতিদের পিছনে ধাওয়া করা, উড়ে বেড়ানো মথ, ভ্রমরদের গুঞ্জন, কিশোরীদের ছোটাছুটি সব মিলিয়ে এ যেন অপূর্ব এক আনন্দনিকেতন। খানিকক্ষণ দুজনের মুখেই কথা নেই। অবাক হয়ে দেখছে তারা নীল পাখিদের ঝুপ করে জলে ডুবে চোখের মত সুন্দর রুপালি মাছ নিয়ে বাসার দিকে চলে যাওয়া । কোথায় যে তাদের শিশুগুলি এক পৃথিবী খিধে নিয়ে মায়ের ফিরে আসার পথের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছে কে জানে।
“আমি আগে এজেলিয়া দেখেছি, কিন্তু এত রঙের, আর এমন সুন্দর, আর এমন কোটি কোটি ফুলেদের একসঙ্গে ফুটে ওঠা দেখিনি” । সুরিয়া বিস্মিত লেকের রূপে ।
খুব ধীরে ধীরে হাঁটে দুজনে । দ্যাখে বাঁধের বাধা না মেনে জলের উচ্ছসিত ছুটে চলা। জলের ধারে ধারে ছোট মাছদের ছোটার প্রতিযোগিতা, ব্যাঙের পরিবারের শান্ত হয়ে ভাসন্ত পাতায় বসে থাকা। এইসবের মধ্যেখানে এক মা এসে রিমিকে জিজ্ঞেস করে, ”উজ ইউ প্লীজ টেক এ ফটো অফ আউয়ার ফ্যামলি”?
রিমি হ্যাঁ বলতেই রিমির হাতে ক্যামেরা দিয়ে তিনি হুইশল দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার স্বামী, ও পনেরোটি বিভিন্ন বয়সের বাচ্চা এসে লাইন দিয়ে দাঁড়াল । কি নম্র, ভদ্র, ও সুন্দর তারা, হেয়ার-জেল দিয়ে আঁচড়ানো চুল, একটিও নড়েনি, তারা ঘণ্টা খানেক ধরে লাফিয়ে, ঝাঁপিয়ে, ছুটে একাকার করলেও। তারা খুব সুন্দর পোষাক পরে আছে এবং দিব্যি কথা শুনছে । রিমি তাদেরকে নানাভাবে এদিকে ওদিকে বসিয়ে অন্তত পক্ষে পনের-ষোলটি ছবি তুলে দিল। সে যখন ছবি তুলছে, সুরিয়া তখন রিমির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে ভাবছিল,
“কি মিষ্টি মেয়ে এই রিমি, একে দেখলে মনেই হয়না সে একটা হাইস্কুলের প্রিন্সিপ্যাল; দুহাজার স্টুডেন্টের ভবিষ্যতের, ও তিনশ জন স্টাফ মেম্বারের রুটিরুজির দায়িত্ব তার কাঁধের উপর। কি সহজেই কাছে গিয়ে কথা বলা যায় । এতটুকু অহংকার নেই, আর কথার মধ্যে কি যে মাধুর্য । এ যুগে না চিনেজেনে একটা মানুষকে দুম করে একশ ডলার দিয়ে দিল, তাকে মাঝরাতে একলা গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়ে এল হোটেলে । এমন নিঃস্বার্থপর মানুষ আমি শেষ কবে দেখেছি? আমাকেই কেউ মাঝরাতে জিজ্ঞেস করলে আমি হয়ত রিমির মত এমন করে এগিয়ে আসতামনা। মা বাবা সম্বন্ধ করে বিয়ে দিতে চেয়েছিল, আমি মত দিইনি। বাবা কত দুঃখ পেয়েছিল। তবু মত দিতে পারিনি। মনে দুঃখ নিয়ে বাবা শেষ পর্যন্ত চলেই গেল তবু হ্যাঁ বলতে পারিনি। তবে কি রিমির মত কারোকে খুঁজে পাবো বলে অপেক্ষায় ছিলাম? কিন্তু কি জানি, রিমির হয়ত বয়ফ্রেন্ড থেকে থাকবে। হয়ত বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে কিম্বা বিয়ে করতে চায়না। সবে তো আলাপ, কি করে এসব কথা জিজ্ঞেস করবো “?
সে ভাবনায় এমন মগ্ন হয়ে গেছে যে লক্ষ্য করেনি ছবি তোলা হতে সেই পরিবার চলে গেছে। রিমি কাছেই একটা ইজিচেয়ারে বসে দেখছে আকাশের উজ্জ্বল নীলের তলায় আগুন রঙের এজেলিয়া, লাল কচি পাতায় ভরে থাকা সূক্ষ্ম জাপানীজ মেপলের বন, সবে কুঁড়ি আসা কত যে নাম না জানা ফুলের গাছ। একসময় কাছের চ্যাপেল থেকে ভেসে এল সুমধুর অর্গানের আওয়াজ। তাতে সম্বিত ফিরল সুরিয়ার। সে রিমির কাছে গিয়ে বলল, “ফুল দেখে এমন মুগ্ধ হয়ে গেছি ভুলেই গেছি বাকি সব কিছুর কথা”।
রিমি বলল, “এখানে সারাদিন বসেও আমার খেদ মেটেনা। তাই প্রতিবছরই আসি। এখন স্প্রিংব্রেক চলছে স্কুলে, তাই দুদিন কাটিয়েও যেতে পারব”।
“আপনিও কি রিসর্টে আছেন এখন”?
“হ্যাঁ, সবাই আছেন যারা যারা লেকচারে যোগদান করেছিলেন। এই বাগানের মালিক বা লোকজন সেদিকে কিপ্টে নয় । ভালোই আদরযত্ন করে। তাই এত গেস্ট আসে। তারাও সাহায্য করে যতটা পারে। কাছেই চ্যাপেল, দেখতে যাবেন আপনি”?
দুজনেই ফুলে ভরা লেকের পাড়ে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেল পাহাড়ের মত একটু উঁচু জায়গায় অরগ্যানের সুরমাখা চ্যাপেলে। এখানে ফুল একটু কম, তার বদলে নতুন ও ঘন সবুজের চাদর বিছানো আছে সবদিকে । যেদিকেই সুরিয়া তাকায়, তার মন আরাম পায়, স্নিগ্ধতা পায় দৃষ্টি । চ্যাপেলের একটা দিকে বিশাল বিশাল বোল্ডার, তাদের পাশ হয়ে ছুটে চলেছে জলের উচ্ছ্বসিত ধারা। সেখানে জলপান করতে এসেছে জলফড়িঙেরা, এসেছে লাল টুকটুকে কার্ডিনাল, পাশে ডালে বিশ্রাম নিচ্ছে কিছু প্রজাপতি। মানুষজন দেখেও কেউ উড়ে যাচ্ছেনা । জায়গাটাতে জলের কুলুকুলু শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। ওরা ছাড়া এখন এখানে কেউ নেই। আছে শুধু ধ্যান করার মত শান্ত এক পরিবেশ ।
“আপনি আগে এখানে এসেছেন”? সুরিয়া জিজ্ঞস করে।
“হ্যাঁ, এসেছি বহুবার, কিন্তু যতবার আসি বাগানের, জলের, চ্যাপেলের পিছনে অরণ্যের রূপ বদলে যায় । মনে হয় নতুন কিছু দেখছি। স্নিগ্ধতায় ভেসে যাই ।মনের ভেতরের চাপ চলে যায় এখানে এলে”।
সুরিয়ার দুচোখে বিস্ময় ঝরে পড়ে । সে ভাবে, “পৃথিবীতে এত মধুর জায়গা আছে যা না দেখলে বিশ্বাস করতামনা। দুঃখ হচ্ছে বেলা ফুরিয়ে আসছে বলে । কষ্ট হচ্ছে একটু পরেই সন্ধের অন্ধকারে সব ঢেকে যাবে, আর মনের কথা মনে রেখে, আমাদেরকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে হবে বলে “।
রিমি গিয়ে ঝরনার কাছে বসে। সুরিয়া চারদিকটা দ্যাখে। তারপরে দরজা খুলে চ্যাপেলের ভেতরে ঢুকে পড়ে । নিরাভরণ ভেতরটি, শুধু সার দিয়ে কিছু বেঞ্চ রাখা আছে । আছে কিছু পুরনো কালের ছবি, আর একটি ময়লা রঙের কাঠের পোডিয়াম । চ্যাপেলের চারদিকে আছে কারুকার্যভরা রঙিন কাঁচের জানালা। সে জানালায় রোদ এসে পড়েছে, আর রংগুলি সেই আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে । সে বাইরে বেরিয়ে এসে দ্যাখে রিমির খুব কাছে কয়েকটা পাখি এসে বসেছে। সবাই খুব শান্ত, নীরব। সুরিয়ার মনে হয় এমন স্বর্গীয় দৃশ্য সে আগে কখনো দ্যাখেনি। জায়গাটাতে তেমন কিছু নেই, অথচ কি এক অপূর্ব সুষমা । একঝাঁক কুচি কুচি হলুদ পাখি এল জলপান করতে। তারা যেমন নীরবে এসেছিল, সেভাবেই উড়ে গেল। এই জায়গাটি কি সুন্দর নাকি রিমির সান্নিধ্য এটিকে আরও অপরূপ করে তুলেছে, তাই নিয়ে সে ভেবে চলেছিল।
রিমির হাতে বাগানের স্ক্যাজুয়েল। সে পড়ে বলে, “আর একঘণ্টা পরে প্রজাপতির বাগান বন্ধ হয়ে যাবে । এ বাগানে যারা আসে, কেউ এটি মিস করেনা। আমি সেখানে যাবো ঠিক করেছি, আপনিও কি যাবার কথা ভাবছেন?”
সুরিয়া মাথা নাড়ে । লেক থেকে সেখানে যেতে যেতেই দশ মিনিট লেগে যায় । সেখানে গাড়ি পার্ক করে তারা ভেতরে আসে। তখন রিমির ফোন বেজে ওঠে । সে সুরিয়াকে বলে, “আপনি ভেতরে গিয়ে দেখুন। আমি কথা বলে আসছি”।
সুরিয়া ভেতরে গিয়ে দ্যাখে কত রাজ্যের ককুন বা ক্র্যাসিলিস রাখা আছে শোকেসে। রূপালী, সোনালী, বাদামী, সবুজ, আর ধুসর রঙের। দুয়েকটা ককুন কেটে বেরিয়ে আসছে ব্র্যান্ড নিউ প্রজাপতি, নড়বড়ে পায়ে হাঁটছে, নেড়ে নেড়ে শুকিয়ে নিচ্ছে পাখাগুলি। সেটুকু দেখতে দেখতেই রিমি ফিরে এসে বলল,
“একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে আমার স্কুলে। আমাকে এখনই গিয়ে কিছু লোকজনের সাথে কথা বলতে হবে। তাই চলে যাচ্ছি । আপনি বাগানের রাইড নিয়ে রিসর্টে ফিরে যাবেন । খুব দুঃখিত আর থাকতে পারছিনা বলে“ । বলেই রিমি গম্ভীর, থমথমে মুখ করে চলে গেল ।
সে বেরিয়ে যেতেই সুরিয়ারও আর একা একা কিছু দেখতে ইচ্ছে করছিলনা। প্রজাপতির বাগানে এসেও সে রাইড নিয়ে চলে গেল রিসর্টে, নিজের রুমে। সেদিনকার মত সেও স্থগিত রাখল তার বেড়ানো । গত তিনচারদিন ধরে তেমন বিশ্রাম নেওয়া হয়নি, আজও সেই সকাল সাতটা থেকে চলছে এতসব কার্যকলাপ । যে কেউ হয়রান তো হবেই। বিশেষ করে পাশে তেমন বন্ধু যদি না থাকে যার মুখ দেখলে সব ক্লান্তি উড়ে যায় ।
পরের দিন সকালে পিয়ানোর রিংটোন বাজল সুরিয়ার ফোনে । রিমির আনন্দিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো । “আপনি এখন কোথায় আছেন”?
সুরিয়া উত্তর দেয়, “এই পৃথিবীতে, স্বর্গে যাইনি এখনও ”।
“ ধ্যাৎ, অমন কথা বলতে নেই, লোকেশনটা জানাবেনতো “ ।
“কেন, তা দিয়ে কি হবে”?
“কি আর হবে, কিছু হবেনা। আপনাকে বলতে হবেনা। আজ সারাদিন আপনাকে কিছুই বলতে হবেনা”। বলে সে কেটে দেয় ফোন । সুরিয়ার মজা লাগে, সে হেসে গড়াতে গড়াতে কল-ব্যাক করে। একবার, দুবার, তিনবার, চারবার, পাঁচবারের পরে রিমি তা ধরে।
“এখন আবার আমাকে ফোন করা কেন? কি দরকার”?
“ সরি ম্যাডাম, খুউউউব বড় একটা ভুল হয়ে গেছে, একটু মজা করছিলাম তো আবার ফোঁস করে উঠে লাইন কেটে দিলেন। এমন করলে চলে? রাগ করে কে কবে নোবেল প্রাইজ পেয়েছে শুনি? সে যাই হোক, এখন বড় লেকে এসে এদের কায়াকের প্রতিযোগিতা দেখছি। কায়াকের দুই মুখে ড্রাগনের, বাঘের, সিংহের মূর্তি জুড়েছে, তারপর রেস চলছে। এত সকালেই বেশ ভিড় হয়ে গেছে। আপনি আসবেননা? ওহ মনে পড়ল, কালকে কি হয়েছিল? অমন হুড়মুড়িয়ে চলে গেলেন।”
“ও, সেই ব্যাপার, দুজন ইয়ংম্যান আমাদের স্কুলের ক্লাসরুমের জানালা ভেঙ্গে দশটি কম্পিউটার, আট জোড়া ওয়াকি-টকি, আর এক ব্যাগ স্কুল সাপ্লাই চুরি করেছিল। কম্পিউটারে চিপ ছিল,সেই সুত্র ধরে কালকেই পুলিশ তাদের ধরেছে। সব পাওয়া গেছে, শুধু একটি কম্পিউটার বাদে। সেটাও পাবে বলে আশা করছেন ওঁরা যেহেতু কালপ্রিটদের ধরা গেছে। বীচে এখন যাবনা কেননা আমি যেতে যেতে রেস শেষ হয়ে যাবে। তাই ওখানে আর না গিয়ে আমি চলে যাচ্ছি প্রজাপতির বাগানে, আপনার সময় বা ইচ্ছে হলে আসুন। রাখছি”।
“বাব্বা, কি রাগ। এখনো ফুঁসছেন ? আপনি বললে আমি কি না গিয়ে থাকতে পারি? নাকি আমার ভালো লাগবে অন্য জায়গায় একা একা ঘুরতে। এই রেসটা শেষ হলেই আসছি”।
কথা শেষে সে লক্ষ্য করে ওধার থেকে কেউ কথা বলছেনা। হয়ত ‘রাখছি’ বলেই রেখে দিয়েছে। সুরিয়া মনে মনে একচোট হেসে নিল। বোঝা যাচ্ছে প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম হুট করে রেগেও যায় । রেসের শেষ না দেখেই সে চলে যায় বাগানের দিকে। কাল থেকে তার ভেতরজুড়ে কি যে এক নতুন ছটফটানি শুরু হয়েছে, তা কিছুতেই কমছেনা। তার সঙ্গে দিবাস্বপ্ন। রিমিকে ভুল করে বলে ফেললে সে হয়ত ফাজলামি হচ্ছে বলে পিটুনি দেবে। তার থেকে সবকিছু এখন না বলাই ভালো ।
প্রজাপতির বাগানের ভেতরে গিয়ে সুরিয়া দ্যাখে সেটি শীততাপনিয়ন্ত্রিত একটি বিশাল কাঁচের গ্লোব । আলো আসছে অনাবিল কিন্তু ভেতরের হাওয়াটি বেশ উষ্ণ । প্লাস সেখানে দুটি বিরাট সাইজের ফ্যানও লাগানো আছে । সে ভেতরে আসা মাত্র বেশ কিছু প্রজাপতি বেরিয়ে এল পাশের ঝোপ থেকে । তাদের নানা রং, নানা সাইজ, এমনকি ওড়ার ঢংও আলাদা । কেউ বসছে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া পাকা কলার স্লাইসের উপর, কেউ আনারসের পিসের ওপর, কেউ বা পাতার উপর আবার কেউ কেউ মাটিতেই বসে পড়ছে । চারদিক নানা রকমের সৌখীন গাছে ভরা, সেসব গাছে ফুলও
ফুটেছে । বেশ কিছু পাতাবাহারও আছে । কিছু প্রজাপতি ফুলে বসে সেগুলির মধুপান করছে, কিছু চলে গেছে গ্লোবের একেবারে সাইডে বা উপরে। যাতে তারা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে । সুরিয়া এদিকে ওদিকে তাকিয়ে খোঁজে রিমিকে, কিন্তু দেখতে পায়না। কিছু লোকজন চলে গেলে ভিড় কমে এলে সে দ্যাখে রিমি ভিডিও করছে দুটি ম্যাককাউয়ের। কি অপূর্ব নীল আর লাল রঙের পালক যে ওদের । কি সুন্দর আদর করছে পরস্পর পরস্পরকে । রিমিকে ডাকতে গিয়েও সে ডাকলনা। বরং জুম দিয়ে ম্যাককাউদের ছবি তুলে নিল দূর থেকেই। রিমিরও । রিমির ফটো তোলা শেষ হলে সে তাকে দেখে এদিকে এসে বলল, “এসে গেছেন?”
“যা ক্রোধান্বিত হলেন তখন, না এসে উপায় আছে । ভয় হচ্ছে, যদি আবার মা কালীর মত খাঁড়া বার করেন…” রিমি হেসে কুটিপাটি তখন।
বলে,
“ ওমা, রাগলাম কখন? আমি তো খুব খুশী স্কুলের প্রায় সবকিছু পাওয়া গেছে বলে”।
সুরিয়া মুগ্ধ হয়ে দ্যাখে তার উচ্ছল হাসি। সেও আনন্দিত হয় । চারদিকে উড়ন্ত প্রজাপতিদের দিকে তাকাতে তাকাতে রিমি অন্যমনস্ক ভাবে রেলিঙ্গে হাত রাখে, একটা প্রজাপতি এসে বসে তার তালুর উল্টোদিকে ।
“নড়বেননা একেবারে”। বলে সুরিয়া প্রজাপতির ছবি নেয়।
“নড়লেও উড়ে যাবেনা । দেখবেন তিলে তিলে একেবারে হাতের আঙ্গুলে এসে উঠেছে” । সুরিয়ার চোখ কপালে উঠল । দেখল রিমি ঠিক বলেছে। অনেক বাচ্চা বা বড়রা প্রজাপতিদের কাছে তর্জনী নিয়ে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালে প্রজাপতিগুলি প্রথমে পা দিয়ে, ও এন্টেনা দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে যাকে পছন্দ তার হাতে গিয়ে উঠছে ।
সুরিয়া বলে উঠল, “ বাহ, বেশ তো, এত ফ্রেন্ডলী বাটারফ্লাই আগে দেখিনিতো । বাই দ্য ওয়ে রিমি, আপনার হাতে যেটা উঠেছে সেটা মনে হচ্ছে পুরুষ প্রজাপতি হবে। আপনাকে দেখেই তার খুব ভালো লেগে গেছে। এত সুন্দর হলে ভালো না লেগে উপায় আছে ? তার উপর কিন্তু আমার ভীষণ হিংসে হচ্ছে। সে এইমাত্র দেখল আপনাকে আর দুম করে আপনার গায়ে উঠে পড়ল, আর আমি আজ তিনদিন ধরে দেখছি, ছোঁয়া তো দুরের কথা, আজ সকালবেলাতেই দাবড়ানি খেলাম প্লাস দু দুবার ফোন কাটলেন”।
রিমি তার রসিকতায় হেসে অস্থির। সুরিয়া প্রজাপতি ও রিমির ছবি নিল বেশ কয়েকটা । দেখতে দেখতে আরও দুটো প্রজাপতি এসে রিমির অন্য হাতে বসল, কিন্তু সুরিয়া আঙ্গুল বাড়িয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করা সত্ত্বেও একটিও এলনা তার হাতে। ওরা হাঁটতে হাঁটতে গ্লোবের ঝর্ণাটির সামনে দাঁড়াল । সেখানে জল ঝরছে অবিরত। অনেক জলজ গুল্ম, শ্যাওলা, রঙ্গিন মাছ, চার জোড়া কচ্ছপ, কিছু ভাসমান পাতা, সব কিছু মিলিয়ে বেশ একটা আলাদা দৃশ্য তৈরি করেছে। সেখানেও ঝর্ণার জল পেরিয়ে উড়ে যাচ্ছে কিছু সাদা ও স্বচ্ছ প্রজাপতি । কিছু কালো ও হলুদ প্রজাপতি বিশাল বিশাল কচুপাতার মত দেখতে পাতার আড়ালে বিশ্রাম নিচ্ছে। ওরা দুজনে অনেকক্ষণ থাকল সেখানে। ইচ্ছেমত অনেক ফটো তুলল।
সেই বাগান থেকে বেরিয়ে একটা ক্যাফেটেরিয়ায় বসল দুজনে। সেখানে বেশ ভিড় আজও । তাদেরকে খাবার সারভ করতে বেশ দেরি হবে জেনে সুরিয়া লাইনে দাঁড়িয়েই ফোনে জিজ্ঞেস করল,” কি ফ্লেভরের আইসক্রিম পছন্দ, চকলেট না ভ্যানিলা”? রিমি উত্তর দিল, “ মিন্ট”।
নিজের জন্য পিক্যান স্যান্ডিস, আর রিমির জন্য মিন্ট আইসক্রিম এনে দুজনে বসল একটু নির্জন বেঞ্চে। এখানেও লেক, তবে ছোট, নির্জন এক লেক। অন্যটার মত ফুলে ভরা নয় তাই লোকজন নেই তত।
“ আমার আরও তিনদিন ছুটি, কিন্তু কাজ পড়ে গেল বলে চলে যেতে হবে আজই”। আইসক্রীম খেতে খেতে রিমি জানাল।
ধ্বক করে উঠল সুরিয়ার বুক। ম্লান মুখে সে জিজ্ঞেস করল, “আপনার সঙ্গে আর দেখা হবে কি আমার “?
“কি জানি। আপনি তো অন্য ষ্টেটে কাজ করেন। আমি এখানে, কি করে আর দেখা হবে”?
“ তা হোক । কিন্তু আমি খুব চাই যে আমাদের দেখা হোক, কথা হোক, পরস্পরকে চিনি জানি। একটা সুবিধে আছে আমার । আমার রিসার্চের বেশির ভাগ কাজই হয় ইন্টারনেটে, পৃথিবীর যে কোন জায়গা থেকে আমি কাজ করতে পারি। আপনি চাইলে আমার অফিস সুদ্ধ এখানে চলে আসতে পারি সেই আলাদিনের জিনের মত”।
“কি করেন আপনি? বললেন যে রিটায়ার্ড” ।
“আমি রিটায়ার্ড কলেজ থেকে কিন্তু আমি এখনো একজন এডুকেটর। আগে কাজের ব্যস্ততায় নিজের দিকে লক্ষ্য রাখার সময় পেতামনা। মায়ের সঙ্গেও কথা বলতে পারতামনা। ঘুমও হতনা নানা ঝামেলায়। খাওয়া দাওয়া নামমাত্র। সারাক্ষণ সে কি প্রেসার। আমার ডাক্তার স্ট্রেস বেড়ে যাচ্ছে বলে খুব করে বকা দিতেন। আমারও ডিনের পদে থাকতে বা প্রেসিডেন্ট হতে ইচ্ছে করেনি। ব্যক্তিগত ইচ্ছে ছিল সারাজীবন ধরে রিসার্চ করার। তাই সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে এখন রিসার্চ করি”।
“এতে চলে ? এমন এক্সপেনসিভ হোটেলে ওঠেন আপনি । একরাতেই তো পাঁচশো ডলার লাগে সেখানে, তাই না”?
“আরে সেসব কিছু না। এইসব হোটেল ফাইভস্টার কিন্তু সেগুলি আমার ছোটবেলার বন্ধুর হোটেল । সেখানে না উঠলে রাগ করে। তাই আসার আর যাবার দিনটি থাকি। অন্যসময় তো অন্য জায়গায়। সে যাই হোক, ডিন থাকাকালীন যে টাকা রোজগার করেছি, তার কিচ্ছু খরচ হয়নি, তাই তা দিয়ে দুটো কম্পিউটার স্কুল খুলেছি। টিচার আছে, তারাই সব দেখাশোনা করে। সব মিলিয়ে দিব্যি চলে যায় । একটা বিশাল মাঠ কিনেছি, সেখানে আমার ইচ্ছে আছে প্ল্যান করে কিছু বানাবো ভবিষ্যতের জন্য । আমার ঘরে যেই আসুক লক্ষ্মী হয়ে, তাকে না খাইয়ে মারবনা কথা দিয়েছি মাকে”।
রিমির মুখ লাল হল এক সেকেন্ডের জন্য । সে তবু বলল, “ আমি কি সেকথা বলেছি? বলেছি কি যে আপনার সাধ্য নেই? শুধু জানতে চাইছি কি নিয়ে রিসার্চ করেন? যেটা নিয়ে এখানে লেকচার দিলেন সেটাই কি আপনার রিসার্চের বিষয়বস্তু”?
“হ্যাঁ, একদম তাই। পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে আমি রিসার্চ করছি । আমি খুব ছোট থেকেই এ ব্যাপারে আগ্রহী। কিন্তু শুধু দেখছি পৃথিবী-মায়ের শরীর দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তার হাসি উবে যাচ্ছে । প্রিয় সন্তানদের সে হারাচ্ছে। এখন তো চারদিকে দাবানল, টর্নেডো, বন্যা, ভুমিকম্প, কি না হচ্ছে। গ্লেসিয়ার গলে মিশছে সমুদ্রে। পৃথিবীজুড়ে আবহাওয়া কতভাবে বদলাচ্ছে”। সে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, “ জানেন, অনেকেই দেখি বেঁচে থাকার জন্য শুধু নয়, লোভে পড়ে নানা ভাবে অনেক সময় জেনেশুনে অন্যের ক্ষতিও করে বা পরিবেশের ক্ষতি করে ফেলে। আমি চাইছিলাম এমন কিছু করব যাতে শুধু আমি নই, সঙ্গে বাঁচে আরও অনেকেই। বিশেষ করে গাছপালা , জীবজন্তু, বিহঙ্গ, পতঙ্গ, ঘাস মাটি। এই স্বপ্ন নিয়েই এ পথে পা বাড়িয়েছি । মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীই যদি রক্ষা করতে না পারলাম আমরা, তাহলে কি এসে যায় কার ব্যাঙ্কে কত টাকা জমা আছে তার হিসেবে”।
রিমি চুপ করে শোনে, তারপরে সেও যেন এক ঘোরের মধ্যে থেকে বলে ওঠে , “আমিও এমন কিছু করতে চাই। জীবন দিয়েও যদি এমন কিছু করার সুযোগ পেতাম, তাই করতাম। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলে কি আর বাকি থাকবে বলুন। সেইজন্যই শুধুমাত্র বিয়ের জন্য বিয়ে করতে চাইনি। চাইছিলাম এমন কারো সঙ্গে দেখা হোক যে এসব ইস্যু সিরিয়াসলি নেবে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে এসব কাজ করবে। জেনে খুব ভালো লাগল যে আপনি এসব নিয়ে ভাবেন। কিছু করার চেষ্টা করছেন”।
“মায়ের সঙ্গে কথা হলেই মায়ের মুখে সারাক্ষণ ওই প্রশ্ন। কবে বিয়ে করছিস বড়খোকা , কবে বৌমা দেখব । মাকে বলতে পারিনা জীবনটা ছেলেখেলা নয় যে আজ বিয়ে করব, কালকে দেখব দুজনের ইচ্ছে, আদর্শ, প্রেরণা, ভালোবাসা সব একেবারে বিপরীত । তখন সব কাজ বন্ধ করে দুজনেই কষ্ট পাবো, হা হুতাশ করব,সে হতে দিতে পারিনা”।
সুরিয়া তাকিয়ে দেখে, রিমির দুচোখ জলে ভরা ।
“মায়ের কথা বলতে বলতে, আপনার মন খারাপ হবে এমন কিছু বলে ফেললাম নাকি? তাহলে সরি বলছি, সঙ্গে এই দেখুন, নাক কুঁচকেছি, কান মলছি”।
রিমি আবার হেসে ফেলে, “আপনাকে নাক কুঁচকে, কান মলতে হবে কেন? আপনি কিছুই তেমন বলেননি। আমার এখন একা একা বাড়ি ফিরতে খুব কষ্ট হবে, সেই কথা ভেবে মনখারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে এই দিনটা যেন শেষ না হয়। খুব মিস করব আপনাকে”।
সুরিয়া রিমির দুহাত নিজের হাতে নিয়ে বলে, “কখন যে আপনাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি বুঝতে পারিনি। সারাক্ষণ আপনার মুখ মনের মধ্যে ভাসছে। যেদিকে তাকাচ্ছি, শুধু আপনাকেই দেখছি। কি হবে আমাদের” ? আপনাদের বাড়িতে মত হবে আমার মত এক রিটায়ার্ডকে ঘরের মানুষ করে নিতে? সুরিয়া শুধোয় ।
“সেসব কিছু সমস্যা হবেনা মনে হয়। কিন্তু আমরা যদি স্থির করি যে ভবিষ্যতে একসাথে থাকবো , তাহলে থাকবো কোথায় ? এখন আমি তো থাকি ফ্ল্যাটে। সেখানে দুজনের কুলোবেনা । আপনার হোমঅফিস লাগবে। ততখানি স্কয়ার ফুট জায়গা নেই”।
“সে না হয় একটা বাড়ি কিনে নেব। কত আর দাম হবে। সাতশো হাজার থেকে মিলিয়ন, তার বেশি তো নয় । আমাদের দুজনের দুটো হোম-অফিস আর একটা গ্র্যান্ড কিচেন ওতেই হয়ে যাবে। হবেনা, বলুন” ?
রিমি এত বাজে প্ল্যানের কথা শুনে আবার হেসে ফেলে বলে, “ একটা বাজে প্ল্যানের প্রাসাদ হবে দুজনের জন্য । কিন্তু তার পরে ক্ষুদকুঁড়ো জুটবে তো “?
এবার সুরিয়া হাসতে হাসতে বলে, “ম্যাডাম, সেটুকু না থাকলে আপনাকে আমার জীবনে আমন্ত্রন করার সাহস পাই? বাপরে বাপ, আগেভাগেই কুটুর কুটুর করে সব জেনে নেওয়া। পড়াশুনা জানা বিটিছেল্যার জ্বালা অনেক । আমাদের গাঁয়েঘরে সব বলে, কথাট মিথ্যা লয় ।“
রিমি ভ্রু কোঁচকায় । “জেনে রাখাই ভালো শুধু কল্পনা না করে। গত দুদিন যে কত কল্পনা, কত দিবাস্বপ্ন চলছে তার নেই ঠিক” ।
“আপনিও দেখছেন? যাক বাবা, বুকে সাহস ফিরে এল। আমি ভাবলাম হয়ত এসব সে আমার একার রোগ” ।
দুজনেই হাসতে থাকে। আর সে সময়েই ফোনে মেসেজ এল তাদের লাঞ্চ রেডি। তারা তখন লক্ষ্য করল যে দুটি আইসক্রিমই গলে জল হয়ে কোণের মধ্যে টলমল করছে। সুরিয়া তার আইসক্রীম মিল্কসেকের মত ঢকঢক করে খেয়ে নিল। রিমি ফেলে দিল তার ভিজে যাওয়া কোণ ও গলে যাওয়া আইসক্রিম ।
লাঞ্চ খেয়ে দুজনে আর্টস এন্ড ক্র্যাফট ফেয়ারে গেল। সেখানে কাচের গুঁড়ো দিয়ে বানানো ল্যান্ডস্কেপ, সুতলি দিয়ে বানানো নাচতে থাকা বাঁদর, রেনডিয়ারের শিংএর ভেতর কুঁদে বানানো খুদে রেনডিয়ারের সংসারের ছবি, ক্যানভাসে আঁকা উড়ে যাওয়া হাঁস, সেরামিকের থালা, শুকিয়ে যাওয়া কুমড়োর খোসাতে আঁকা আর্ট দেখে মুগ্ধ হল দুজনে। আরও অনেক কিছু ছিল যেমন পোশাক, ব্ল্যাঙ্কেট, কুইল্ট, মধু, গয়না, কিন্তু সেসব তাদের তেমন আকৃষ্ট করেনি । রিমি কিনল চারটি বার্ডহাউস তার ইয়ার্ডের পাখিদের জন্য। সুরিয়া কিনল একটি বার্ডফিডার ও একটি উইন্ডচাইম। দুজনে মিলেই সবকিছু পছন্দ করে নিল। ঘুরতে ঘুরতে দেখতে দেখতে পড়ে এল বেলা।
যাবার সময় এসে গেল। মুখ নিচু করে রিমি জিজ্ঞেস করে,
“আবার কখন দেখা হবে আমাদের”?
“ কি জানি। এমন হুট করে হবে কিনা। তবে পরেরবারের ভিসিটের ব্যাপারটা আমরাই ঠিক করবো । আমি তো ফ্লেক্সিবল, আসতেই পারি, কিন্তু আপনার কাজের চাপ কমলে বা ছুটি নিলে তবেই । আপনাকে মাঝেমধ্যে কল করলে মাইন্ড করবেন?” সুরিয়া জিজ্ঞেস করে ।
“খুব মাইন্ড করব । প্রতিদিন কল করলে মাইন্ড করবনা”।
এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল দুজনের মাঝে। খানিকক্ষণ পরে সুরিয়া বলল,
“জানি, আপনি পাখি ভালোবাসেন, বাসা কিনলেন তাদের থাকার জন্য কিন্তু , ফিডার না দিলে তারা খাবে কি? তাই এটা কিনলাম। আর এই উইন্ডচাইমটি। বাতাস আর গাছের আনন্দ যখন মিলেমিশে যাবে তখন বেজে উঠবে উইন্ডচাইম, হয়তো আপনার মনে পড়বে তখন আমার কথা । এদুটি আপনার জন্যে, আশা করি মাইন্ড করবেননা” ।
সুরিয়া সব যত্ন করে রেখে দিল গাড়ির ট্রাঙ্কে। সন্ধে হয়ে যাবার আগে রিমি বেরিয়ে পড়তে চায়। বনের পথে রাত্রিবেলায় যেতে যেতে যাতে কোন পশুকে ধাক্কা না দিয়ে ফেলে সেই কারণে । বাড়ি পৌঁছতে তবু রাত হয়ে যাবে তার। সুরিয়া দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে তার দুহাত। রিমি ধরা গলায় বলে, “আমিও ফোন করবো। প্রতিদিন আপনার সাথে কথা বলতে চাই। প্রতিদিন”।
“তখন কিন্তু আর আপনি বলা চলবেনা। একেবারেই না। কেমন”? বলতে বলতেই সুরিয়ার দুচোখ বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে । সে যেতে দিতে চায়না রিমিকে, তবু যেতে দিতে হয়। একে একে মেলার সব ভেন্ডাররা চলে যায় তাদের পশরা নিয়ে । চলে যায় সব অতিথিরা বাগান শূন্য করে । সুরিয়া মাকে ফোন করে সেই রাতে, বলে,
“মা, তোমার ঘরের লক্ষ্মী চেয়েছিলে। মনে আছে ? কত রাগ করলে গতবারে যাবার সময় ? তোমাকে জানাচ্ছি যে সবে একজনের সাথে আলাপ হয়েছে। তার লক্ষ্মীর মত গুণ আছে, সরস্বতীর মত বিদ্যাও আছে কিন্তু সে লক্ষ্মীও নয়, সরস্বতীও নয়, সে একেবারে দুর্গা । দশহাতে কাজ করতে পারে, খুব তেজ আছে তার, সেসব টের পেয়েছি। জানো মা, মেয়েটি বড্ড ভালো । তার অন্তরটি খুব সুন্দর। বিয়ে করব তাকেই, মনস্থ করেছি, তুমি এসে ঘর সামলিও তার সাথে সাথে”।
মায়ের উত্তর ভেসে আসে, “আমি প্রতিদিন মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা করে যাচ্ছি তোর আর ছোটখোকার মঙ্গলের জন্য । তুই যখন দেখেশুনে আনছিস ঘরে, সব ভালোই হবে। মা এতদিনে মুখ তুলে চাইল তাহলে। তুই নিজের খাওয়াদাওয়ার দিকে নজর রাখিস, কাজ কাজ করে সব ভুলে যাসনা যেন” । ঈথারে তরঙ্গ তুলে তারা কথা বলেই যায়, নতুন আশা নিয়ে । রাত নামে আটলান্টা শহরে, রাত নামে গ্রামেগঞ্জে, খেলার মাঠে, লেকে, অন্ধকার হাইওয়েতে। বাগানের আলো নিভে যেতেই ঘুমিয়ে পড়ে হাজার হাজার ফুল, গাছপালা, পাখির দল। কাল হয়ত শুরু হবে আবার অন্য এক ভালোবাসার কাহিনী । অন্য কোথাও, অন্য দুজন মানুষের মধ্যে। আকাশ, বাতাস, ঘাস, মাটি, জল খুব খুশী হবে। সে কথা কেউ জানুক না জানুক এই বাগানটি জানে।