ছুঁয়ে থাকলেই ঘর
সৌমী আচার্য্য
ভবেশ জানে আজ বাড়ি ফেরার পর আবারো নিঝুম হয়ে থাকা মেয়ে মানুষটা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকবে।ওদের ইঁটের পাকাঘরের একটাতে ঢাঁই হয়ে থাকা জামাকাপড়ের পাশে স্তূপের মতো গুটিয়ে থাকবে একটা বুড়ি শরীর।ময়লা চাদরে ছিটিয়ে থাকবে মুড়ি।তবু রাগ উঠে আসবেনা শরীর গলা চোখ বেয়ে।উল্টে কান্না ঝাঁপিয়ে নামবে।
-আরেএএ শালা,ব্যাটা হয়ে কাঁদে।মেয়েছেলের মতো মরাকান্না।পাড়ার মদ্যে ওর একমাত্তর পাকাবাড়ি তবু গা দিয়ে দুঃখের বোঁটকা গন্দ।
অনেকেই এমন কথার বিষে ভেতরটা জ্বালিয়ে দিতে চায় কিন্তু ভবেশ শুক্লার চুপ করে থাকার ভেতর সমুদ্রের আওয়াজ শুনতে পায়।সেই যে বিয়ের পর প্রথম গিয়েছিল বাসে করে।সমুদ্র দেখে ওর হাতটা চেপে ধরেছিল,পাড়ে বসে অবাক চোখে কেবল দেখে গেছে বিপুল জলরাশি।
-সমুদদুরে এতো আওয়াজ কেন বলোতো!ভীষণ কান্না চেপে রেখেছে বলে।
ভবেশ আজ হেঁটে যায় সেই কান্নার পথ ধরে।মেয়েটা হারিয়ে গিয়েছে গহীন কষ্টের ভিতর।ভবেশ নিজের সাথে কথা বলে।
ও ভবেশ,আজ কাজ থাক,যাও ট্রেনে চেপে যাও।একবার ঘুরে এসো।
ভবেশ এমন তালকানা হলে চলেনা।অন্তত একটাও যদি পাও।যাও।যাও।
পারেনা।কোনো একটার কাছেও পৌঁছাতে পারেনা।রোজ হাফবেলা ছুটি চেয়ে নেয় সমীর সমাদ্দারের কাছে।সেও চিৎকার করে চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে।তবু ভবেশকে কাজ থেকে তাড়িয়ে দিতে পারেনা।অসুরের মতো শক্তি আর নলেনগুড়ের মতো নরম মন এমন কর্মচারী পাওয়া দুষ্কর।হাফবেলায় তিনদিনের মাল কাটিং করে।ঝড়ের বেগে গেঞ্জির পরত হাতের টানে ফেলতে থাকে।তারপর ঘচঘচ কাঁচি চালায়।উড়ে আসা গেঞ্জি কাপড়ের গুঁড়োয় ওর মাথা ঢেকে থাকে।আশেপাশে কারা যেন বিড়ি খায়।তেতো ঝিমঝিম আবেশে জিভের ভেতরটা টানে।তবু অন্য মন হলে চলেনা।আজ একবার সোদপুর যেতেই হবে।বেলাবেলি বেরোলে সন্ধ্যের ভেতর বাড়ি।ঠিক শুনেছিল গলা নামিয়ে লোকটা বলেছিল।
-সোদপুরে কেউ কোন রাস্তা দেখাতে পারল না এদিকে কোলকাতায় যাবার মুরোদ আমার নেই।আপনি দেখুন।যা লাগে দশ বিশ আপনাকে দেব।
একথা ভবেশের আগে মনে ছিলনা।কাল রাতে শুক্লা একটা দানাও মুখে তোলেনি।কোলবালিশটা শক্ত করে বুকে চেপে খুব ঘৃণা নিয়ে বলেছে,’ছোটলোক’।সেই থেকে মাথার ভেতরটা জ্বলছিল।পাশের ঘরে গিয়ে রাতের ওষুধ মুখে দিতেই বুড়ি মায়ের অবশ শরীর থেকে নোনাজল ঝপঝপ করে বেরিয়ে এল।সব পরিস্কার করে ঘরে আসতেই কোনো কারণ ছাড়াই মনে এল তিন নম্বর সোদপুরেই গিয়েছিল।সেবার আর শুক্লা কথা বাড়ায়নি।প্রথমবার অনেক সাধ্য সাধনা করতে হয়েছিল।
-বোঝার চেষ্টা কর।এ সুযোগ বারবার আসবে না।এই টিনের একটা ঘুপচি ঘর,মায়ের অসুখ,নুন আনতে পান্তা ফুরোয় এসব ঠিক হয়ে যাবে।রাজি হয়ে যা।
খানিকক্ষণ কথা বলেনি শুক্লা।এইট পাশ করেই পালিয়েছিল ভবেশের সাথে।কাকা কাকির সংসারে এঁটোকাঠার মতো বাঁচার চেয়ে সেই ভালো মনে হয়েছিল তার।একটা ঘরের নীচে তোষোকে শাশুড়ি আর চোকিতে তারা।তবু ভালো।পায়া গুলো আওয়াজ করেনা।সোয়াবিন,ডিম অথবা ভোলা মাছেই সুগন্ধ ওঠে ওদের জীবনে।এ কোন উৎপাত?এতো জটিলতা বোঝেনা শুক্লা।নিজের বলতে কিছুই তো তার নেই।তাহলে শুধুমুধু ঝামেলা কেন?
-আমি কি কিছু চেয়েছি কখনো।শুধু একটু শান্তি চেয়েছি।তুমি কি তাও কেড়ে নেবে?
-ঐ দেখ কি বলে!তা কেন?
-এ কি পাপ নয়?
-আমি জানিনা পাপ কাকে বলে।শুধু জানি বাঁচার সুযোগ সবাই পায়না।কেউ কেউ পায়।আমরা পাচ্ছি।এতে যখন কোনো ক্ষতিই নেই তখন পিছিয়ে আসা বোকামি।দেখ শুক্লা আমি যতই খাটি যতই ঘাম ঝরাই ঐ সমাদ্দারের পো একটা পয়সা বেশি ঠ্যাকাবেনা বুঝিসনা।
খুব কষ্ট পেলে হাজার গরীবের চোখের নীচেও নীল কালির পোঁচ পড়ে যায়।তবে পঁইপঁই করে নির্দেশ ছিল।’অসম্ভব কিছুতেই টেনশান করা যাবেনা।’বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নেড়েছিল।যেদিন টাকা গুলো ঘরে এল গুনে গুনে চল্লিশ হাজার।শুক্লা আছাড়ি পিছাড়ি কেঁদেছিল।পরদিন খগেন মিস্ত্রী দাঁতে দেশলাই কাঠি গুঁজে হাত নেড়ে বলে দিল,’বৌমা তোমার ঐ বাইরে গিয়ে হাগা মোতা আর করতে লাগব না।সব এক ছাদের ভিত্রে করতে পারবা।’মিতালী ফার্মেসীতে ভবেশ মাকে দেখিয়ে এনেছিল দুদিন পর আর তার পরের রবিবার খাসির মাংস।ঝাল ঝাল করে রেঁধেও শুক্লা কিছুতেই খেতে পারল না।গাল ভর্তি বমি নিয়ে সেই যে উঠে গেল আর রান্নাঘর মুখো হল না।দেখতে দেখতে পাঁচ বছর কেটে গেল।জীবন আসলে ক্যালেণ্ডারে বইছে।ভবেশ থমকে আছে।বৌটা খায়,কথা বলে,হাসে সব যেন পুতুলের মতো।প্রাণহীন।
মফস্বলে রাত বড্ড ঝিম ধরে থাকে।তার উপর ঠান্ডাটাও বেড়েছে।কুন্ডলী পাকানো কুয়াশা ধীরে ধীরে গিলে নিচ্ছে রাস্তা।শরীর জাগেনা শুক্লার।বৃথা সুর তোলার চেষ্টায় তানপুরায় হাত বোলায় ভবেশ।উঠে বসে হাত পা বুকে টেনে চেপে ধরে শুক্লা।
-আর কেউ আসবেনা কখনো,তাহলে কেন?কেন বৃথা গা বেয়ে উঠছো।
-আমার তোকে পাওয়ার ইচ্ছা জাগতে পারেনা?
-না,পারেনা।কেউ এলে তাকে বিক্রি করে তবে না তোমার লাভ।এবার কেউ এলে পাকা ঘরে রঙ হত।তোমার মায়ের পড়ে যাওয়া শরীরের আরো ভালো চিকিৎসা হত।আর আমার কি হত?আবার নতুন করে সব শূন্য।
মা!মায়ের কথা তুলে খোটা দিলে বুকে বড়ো বাজে।ছবির মত দুলে ওঠে।উঁচু পাহাড়ের মতো ভাত খাচ্ছে বাবা।পাশে ডাল তরকারি আর মাছ।হুঙ্কারে চেয়ে নিত আরো কিছুটা ডাল,ভাত।ভবেশ টিপটিপে চোখে উবু হয়ে বসে দেখত।মা কোনো কোনো দিন বলত,’ছেলেটার জন্য একটুই ভাত ডাল রেখেছি।ওটুকু না খেলে ও যে মরে যাবে।’বাবা পাতে মুখ কুলকুচির জল উগরে দিত।পাতের কোণায় মাছের ছালে চোখ দিয়ে বসে থাকত ভবেশ।বুঝত ওটুকুও জুটবে না।মা চিঁড়ে গুড় দিয়ে বেশ করে মেখে দিত।ভবেশ জানতো মা জল ছাড়া কিছুই খাবেনা।তাই জোর করে খাইয়ে দিত নিজের হাতে।সন্ধ্যেয় পাগলাহাটির এঁদো পুকুর থেকে গুগুলি তুলে আনতো।ওগুলো সেদ্ধ করে শুকনোলঙ্কা পোড়া দিয়ে মেখে মা আর ভবেশ হাপুস হুপুস খেত।বাবা আসার আগেই মা ঘুম পাড়িয়ে দিত ভবেশকে।একেকদিন ঘুম ভাঙলেও চোখ বন্ধ করে রাখত হাত চেপে।চিৎকার, ব্যথা আর অশ্লীল শব্দ শুনতে চাইত না।ভবেশের শরীর অত কম খেয়েও ঠিক ফুলেফেঁপে উঠল।মাটিকাটা,বস্তায় মাল ভরা,লরি থেকে মাল খালাস যখন যা পেয়েছে সব করেছে ভবেশ।মায়ের জন্য।বাবাকে কাঁঠাল গাছে ঝুলতে দেখে ওর কোনো বিকার হয়নি।পাওনাদারেরা চড়াও হয়েছিল বাড়িতে।মা কিন্তু শোকটা নিতে পারলো না।না খেতে খেতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তবু স্বামীর ঝুলে থাকা বিকৃত শরীর মাকে তাড়া করত।দেখতে দেখতে মায়ের মাথায় রক্ত জমাট বাঁধতেই শরীর পড়ে গেল।জটিল রোগ।কঠিন নাম।চিকিৎসায় অনেক টাকা।তখনি হঠাৎ সুযোগটা এল।ভবেশ ভেবেছিল সে আর শুক্লা চেষ্টা করলে সহজেই সব সমস্যা মিটে যাবে কিন্তু কপাল ফাটা হলে সব সুখ ঐ ফাটা দিয়েই বেরিয়ে যায়।তিন নম্বরটা সোদপুরে চলে যাবার একমাসের মধ্যেই পেটে ব্যথা শুরু হল শুক্লার।ব্যথার দমকে বেঁকে যেতে লাগল।ডাক্তার দেখে গম্ভীর মুখে যা বলল তাতে পায়ের নীচের মাটিটাই সরে গেল ভবেশের।তিনদিন নার্সিংহোমে ছিল শুক্লা।ফিরল মরা হয়ে।আগে যাও বা কথা বলত হাসত খেত সব যেন চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল।অন্ধকারে বসে বিড়ি ধরায় ভবেশ।বুকের ভেতরটা খালি লাগে।সে তো চেয়েছিল ভালো হতে।নিজের অজান্তে সেও কি বাবার মতো পিশাচ হয়ে গেল!জমাট অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে দুটো হাত,আর্তনাদের মতো কথা বলে।
-অন্তত একটা বাচ্চা আমাকে এনে দাও।চারটে বাচ্চা বিক্রি করে দিলে।দ্বিতীয় বার যমজের একটাকেও রাখতে দিলেনা।বলেছিলে এবারেরটা আমার হবে কিন্তু আর তো কেউ আসবেনা।আমার একটাকে অন্তত এনে দাও।তোমার দুটি পায়ে পড়ি।
ভবেশ হাতদুটো ধরে কেঁদে ওঠে।দুজনা দুজনকে জড়িয়ে থাকে খানিকক্ষণ।সব আশা ভরসা শেষে নিঃস্ব দুটো মানুষ হিসেব কষতে বসে কি ঠিক আর কি ভুল?ভোররাতে দুজনা আঁকড়ে ঘুমায় বুড়ি শরীর।স্বর্গীয় আলো খেলা করে সেই শরীর জুড়ে।