সুধা চলে গেছে
মীরা মুখোপাধ্যায়
খোলা জানালা দিয়ে হাওয়া ঢুকছিলো বলেই
হয়তো আমার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখি
সুধা ঘরে নেই। কিছু না ভেবেই পাশ ফিরে আবার চোখ বুজলাম, কিন্তু না, বেশ কিছুসময় পার হয়ে
গেল তবু সুধার কোন সাড়া পেলাম না। অগত্যা
উঠলাম। ঘরের বাইরে, বাথরুমে ,ছাদে কোথাও সে
নেই। গেল কোথায় !
এই শহরে আমরা এসেছি মাত্র তিন মাস। কারো সাথেই সেভাবে জানাশোনা হয়নি যে এতো ভোরে
সুধা আমাকে না জানিয়ে সেখানে যাবে। ছোট্ট বাসা, এককামরারই বলা চলে। কোনোরকম একটু
রান্নার ব্যবস্থা আর একফালি টয়লেট। বাড়িওয়ালা
থাকে অন্য জায়গায়, একতলাটা ভাড়া দেওয়া আছে গোডাউন হিসাবে। এখান আসার আগে সাত
মাস ছিলাম পার্কসার্কাসের এক বস্তিতে,খুব বাজে
পরিবেশ। অনেক খোঁজ খবর করে অবশেষে এই
ঘরটা পাওয়া গেছে ভাড়াও তো মাস মাইনের হাফ।
তবে শান্তিতে থাকা যাবে বলে পুষিয়ে যাচ্ছে আর
সুধা এরকম নিরিবিলিই তো থাকতে চেয়েছিল।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম আটটার
দিকে চলেছে কাঁটা।এবার তো খোঁজ নিতে হয়।কিন্তু কোথায় খোঁজ নেবো ! দোকানে ও যায়না
বলতে গেলে একটু লুকিয়েই থাকে সেই সুধা আজ
আমাকে না বলে ভোরবেলা গেল কোথায় ! সার্টটা
গায়ে গলিয়ে দরজা টেনে নিচে নামলাম, ঠান্ডা
পড়ে গেছে। আশ্বিনের শেষ।যাদবপুরের এদিকটা
বেশ ফাঁকা ফাঁকা এখনো। এদিক ওদিকে খানিক
হেঁটে আবার ফিরে এলাম ঘরে। আজ রবিবার তাই
কাজে যেতে হবেনা। মাথার ভিতরটা কেমন খালি
খালি লাগছে । সুধার জন্য যতটা না কষ্ট হচ্ছে তার
চেয়ে বেশি লাগছে ভয়। অন্য কেউ হলে সে নির্ঘাত
পুলিশের কাছে যেত কিন্তু আমি তা পারবো না।
আমার এই না পারার কারন হলো সুধা আমার বৌ
নয়। আমরা মিথ্যে স্বামী স্ত্রীর পরিচয়ে বাস করি।
বছর তিনেক আগে আমি যে কোম্পানিতে কাজ করি তারা যশিডিতে একটা ব্রাঞ্চ খুলেছিল
আর আমাকে দেখাশোনা করতে কলকাতা থেকে
সেখানে পাঠায়। আমার তিনকূলে কেউ না থাকায়
আমার কোনো আপত্তিও ছিলনা। থাকতাম মেসে,
সেখানকার পাট তুলে চলে গেলাম যশিডি। ওখানে
একটা ঘর ভাড়া নিলাম, একা মানুষ এক একদিন
দুটো ফুটিয়ে নিতাম আর মাঝে মধ্যেই কুলিলাইনে
টাকা দিয়ে খাওয়ার ঝামেলা মেটাতাম। আমার ঠিক পাশেই ভাড়া ছিলো সুধা আর তার খ্যাপাটে
স্বামী পরিতোষ। পরিতোষ ছিল কাঠের মিস্তিরি।
আস্তে আস্তে সুধা আমার সাথে আলাপ করে এটা
ওটা রান্না করে দিয়ে যেতো। গল্পগুজব করতো।
ওর স্বামী পরিতোষ খুব একটা আলাপী ছিলো না
তবে দেখা হলে হাসতো। সুধাকে তখন আমি বৌদি
বলতাম, বেশ ছিলাম কিন্তু ভাগ্যের ফের! জড়িয়ে
পড়লাম সুধার সাথে।
যশিডি থেকে আমার কলকাতা ফেরার সময়
সময় সুধা বললো সেও আমার সাথে চলে আসবে।
আমি বললাম কিন্তু তোমার স্বামী?
কিচ্ছু বলবেনা ও
কিন্তু ও তো পুলিশের কাছে যাবে…..
ছাই যাবে
আমি প্রথম প্রথম সুধাকে কাটাতে চেয়েছিলাম কিন্তু ও মরিয়া।
তারপর আমরা কলকাতায় এলাম। মিথ্যে পরিচয়
নিয়ে ঘর বাঁধলাম। প্রথম দিকে বেশ ভয়ে ভয়ে
কাটাতাম কিজানি পরিতোষ যদি খুঁজতে খুঁজতে
কোনদিন……
কিন্তু না সে আসেনি
এই বাসায় আসার মাসখানেক পরে সুধা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। আগের মতো হাসতো
না, গল্প করতো না। নতুন পাতা সংসার সাজানোর
দিকেও তেমন মনোযোগ ছিলোনা।কেমন যেন সব
ছাড়াছাড়া।
সারাটাদিন আজ এভাবেই কাটলো আমার।রাতে টের পেলাম খুব খিদে পেয়েছে। অনেকদিন
রান্নাঘরের সাথে সম্পর্ক নেই, খুঁজেপেতে কৌটোতে
কটা মুড়ি পেলাম।সারাদিন পর তাই খেলাম। জল খেতে গিয়ে গ্লাসের নিচে একটুকরো কাগজ ভাঁজ
করে রাখা, জল খাওয়া বন্ধ রেখে কাগজটা ভাঁজ
খুলে দেখলাম। সুধার লেখা ‘ কদিন ধরেই খুব কষ্ট
হচ্ছে পরিতোষের জন্যে ওর কাছে চলে গেলাম।’
আমি জলটা শেষ করলাম একচুমুকে। ঘরের
বাইরে এসে দাঁড়ালাম, রাস্তায় লোক কমে আসছে,
স্ট্রিটল্যাম্পের হলুদ আলোয় শহরটা কেমন যেন
ভুতুড়ে লাগছে। কাগজের টুকরোটা নষ্ট করে দেব
কিনা ভাবলাম,সুধার শেষ স্মৃতি। বুক খালি করে
একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়লো, কিজানি তাতে কষ্ট না
মুক্তি কিসের আভাস !