সমুদ্র সৈকতে
জয়ন্ত বাগচী
দলে দলে মানুষ সার বেঁধে চলেছে । আবার দলে দলে মানুষ ফিরেও চলেছে । দেশ বিদেশের মানুষ কেমন একটা ঘোর লাগা ভাব নিয়ে আসছে যাচ্ছে । এ এক মহা মিলন ক্ষেত্র । কেউ আসে ধর্মের লোভে আবার কেউ আসে রোজগারের লোভে । কেউ ঈশ্বরের নাম গান করতে করতে একটা ঘোরের মধ্যে বিরাজ করছে আর একদল সেই সুযোগে তাদের জিনিষপত্র হাতিয়ে নিচ্ছে । এভাবেই চলছে তীর্থক্ষেত্রের মহিমা ।
ছিপ ছিপে বৃষ্টির মধ্যে ছোট ছোট ত্রিপলের ছাউনিতে খড়ের ওপর বসে শুয়ে আছে বহু মানুষ । শীতের দাপটে শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে তবুও এক অদ্ভুত প্রশান্তি চোখে মুখে । কেন এসেছে জানতে চাইলে বলে , প্রত্যেকবার আসি তাই এবারো এসেছি ।
— কিন্তু কেন বার বার আসেন ?
–তা জানি নে বাবু । তবে সকলেই আসে আমিও আসি । কেউ বলে ,বাপ ঠাকুরদা আসতো ,তাই আমরাও আসি বাবু । এযে মহা তীর্থ ।এখানে একবার ডুব দিতে পারলেই সব পাপ দূর হয়ে যায় । কপিল মুনি তো আর যে সে মুনি নয় ………বলতে বলতেই দুই হাত জোড়া করে ভক্তিভরে প্রণাম করে । সেই প্রসন্ন মনে নমস্কারের বহর দেখলেই বোঝা যায় কি অপার ভক্তি নিয়ে এরা ছুটে এসেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ।এমন সব অদ্ভুত উত্তর এদের মুখে !
সাগর দ্বীপ । ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একেবারে প্রান্ত সীমায় এক ছোট্ট দ্বীপ ।যেখানে বঙ্গোপসাগরের লোনা জলের তরঙ্গ প্রতি নিয়ত ধৌত করে চলেছে দ্বীপটাকে । হয়তো আগামী দিনে তাকে গ্রাস করে নেবে এই ক্ষুধার্ত সাগর । সেখানেই প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে আসছে পৌষ মাসের মকর সংক্রান্তির দিনে । চাকুরীর স্বার্থে আমাকেও যেতে হয়েছিল সেই পুণ্য ভূমিতে । নিজের কৌতূহলেই সাগর মেলায় এমনি কত না মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি । তবে এটাও ঠিক , সে যদি ঘুরিয়ে জানতে চাইত আপনি কেন এসেছেন, এ প্রশ্নের উত্তর আমিও দিতে পারতাম না । সত্যিই তো কেন এসেছি ? পুণ্য সঞ্চয় করতে ? নাকি চাকুরীর তাগিদে ? কিন্তু তা তো নয় ! তবে ? এই তবেটাই হচ্ছে একটা অদৃশ্য আকর্ষণ ।
ভোর থেকে স্নান পর্ব শুরু হয়েছে । মকর সংক্রান্তির এই স্নানে নাকি সব পাপ দূর হয়ে যায় । এই ভাবনা দূর দূরান্ত থেকে মানুষকে টেনে আনে ।যে যেমন ভাবে পারছে স্নানের পুণ্যটুকু সঞ্চয় করে নিচ্ছে । আমার ক্যামেরায় কত না ছবি বন্দী হচ্ছে প্রতিদিন । গোটা ভারতটাই যেন এখানে উঠে এসেছে । কত রকমের মানুষ আর তাদের স্নানের ভঙ্গিমাও ততোধিক বিচিত্র ।
তবে এখানে অবাঙ্গালীদের ভিড়টাই বেশি । বিশাল বেলাভূমিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমুদ্র স্নান করছে । । হঠাৎ এক মহিলা সামনে এসে বলেন– চিনতে পারছো ?
অবাঙালী স্টাইলে শাড়ী পরিহিত এক মাঝ বয়েসী মহিলা । ভালো করে তাকিয়ে দেখেই চমকে উঠি ! হঠাৎ করেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে , কুন্তী না ? তুমি………
— যাক চিনতে পেরেছ তাহলে ?
—-তুমি !! মানে তোমাকে চিনতে পারবো না এটা কি হয় ? কি আশ্চর্য ! এত বছর বাদে এমন জায়গায় তুমি …তোমাকে দেখবো এটা ভাবতেই পারছি না ! সংক্রান্তির ভোরে সাগর থেকে ছুটে আসা বাতাস মুহূর্তে আমাকে টেনে নিয়ে গেল কয়েক যুগের ওপারে । তখন ক্লাস টেন এ পড়ি । স্কুলেরই শিক্ষক নরহরি বাবুর কাছে ইংরাজি বাংলা পড়তাম । আরো বেশ কয়েকজন পড়তো বিভিন্ন ক্লাসের । একদিন নরহরি বাবু বললেন ,জতু এই অঙ্কটা একে একটু বুঝিয়ে দে তো । একটা সমাধানের অঙ্ক । সেই থেকে পরিচয় । সকলের সামনে নাম জিজ্ঞেস করতে না পারলেও দেখলাম খাতার উপর লেখা আছে কুন্তলিনী । অদ্ভুত নাম । তারপর থেকে মাঝে মাঝেই নানা ছুতোয় আমার কাছ থেকে অঙ্ক বুঝে নেয় এটা বুঝতে পারতাম । পনেরো বছর বয়েসে অমন একটা মেয়ের সান্নিধ্য আমকে যেন কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল । মনের কল্পনাগুলো ডানা মেলে উড়ে যেতে থাকলো মাইলের পর মাইল। কি সুন্দরটাই না লাগতো তাকে।
স্কুলের সরস্বতী পুজোর দিন প্রথম তাকে নিয়ে ঘুরলাম । সে দিনটা মনে পড়লে আজো শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে । বাসন্তী শাড়িতে সেদিন তাকে সরস্বতী প্রতিমার মতোই মনে হচ্ছিল । ভয়ার্ত স্বরে বলেছিল বেশি দূরে কোথাও যাবো না ,যদি কেউ দেখে ফেলে ! টুকরো টুকরো ঘটনার মধ্যে দিয়েই একদিন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে গেলাম । নরহরি বাবুর বাড়ীতেও পড়তে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল । রেজাল্ট হাতে নিয়ে প্রথম যে মুখটা মনে পড়েছিল ,সে হল কুন্তলিনী । আমি ছোট করে ডাকতাম কুন্তি ।
কুন্তী দূরেই চলে গেল । আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেলাম ব্যাঙ্গালোর ।মাঝে ছুটিতে এসে শুনেছিলাম ওর বাবা রেলের চাকুরীতে বদলী হয়ে গিয়েছেন বিলাসপুর । সেই যে চলে গেল আর দেখা হয়নি । মাঝ থেকে চলে গিয়েছে ছাব্বিশটা বছর । তবু আজ সেই সেদিনের কুন্তির বয়স প্রকৃতি তার চলমান নিয়মে বাড়িয়ে দিলেও আমার স্মৃতির এলবাম থেকে মুছে যেতে পারেনি ।
ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর একটা কোম্পানির চাকুরীর ইন্টারভিউ দিতে যেতে হয়েছিল বিলাসপুর । চিঠিতে বিলাসপুর নামটা দেখেই মনে পড়েছিল কুন্তির কথা । ততদিনে প্রায় ছ’বছর অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে ।ঠিকানাটাও জানিনা ।বিলাসপুরে নেমে রাস্তার প্রতিটা মহিলার মুখ ভালো করে দেখেছিলাম ,যদি কুন্তীর দেখা পাই । সেটা বাস্তবে মেলেনি । এভাবেই আস্তে আস্তে কুন্তী চরিত্র আমার মনের থেকে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল । আজ ,আজ এতদিন পরে সেই কুন্তী আমার সামনে দাঁড়িয়ে । কিন্তু তার পোশাক এমন কেন ?
–কি গো কি ভাবছ? ভাবনার ঘোর কাটিয়ে তার মুখের দিকে তাকাতেই আবার বলে , কি ভাবছ ?
ভাবছি তো অনেক কিছুই কিন্তু তার আগে বল তুমি এখানে ?
— আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন তো মোরাদাবাদের । ওরা এসেছেন স্নান করতে । ঐ তো সব স্নান করছে । তোমায় দূর থেকে দেখেই চিনতে পারলাম । তাই আর থাকতে না পেরে চলে এলাম । তুমি সেই একই রকম আছো জতুদা । শুধু চুলটা একটু পাতলা হয়েছে ।
— কিন্তু তোমার এই বেশ কেন কুন্তি ?
— স্বামী মারা গেছেন তিন বছর হল । কেমন আছ তুমি ? বিয়ে করেছ?
— এই তো যেমন দেখছ ……এই আর কি !
— ছেলে মেয়ে ?
\ — এক ছেলে । তোমার ?
— দুই মেয়ে ।
— কই তারা ?
— তারা আসেনি । এই হুজুগে তারা নেই ।
ভোরের সূর্য আকাশ লাল করে রাঙিয়ে দিয়েছে । কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে উড়ছে কুন্তীর কালো চুল । প্রকৃতি তার বিশাল ক্যানভাসে মেলে ধরেছে এক নারী মূর্তিকে যাকে নিয়ে এক সময় অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম । যে ছিল আমার প্রথম জীবনের প্রথম ভালোবাসা । প্রথম ভালোবাসায় নাকি অভিশাপ থাকে ।কে জানে ,হয়তো তাই !
—কুন্তী তোমায় বোধহয় ডাকছেন । ওই দ্যাখো ।
— হ্যাঁ আমার শ্বাশুড়ি । আমি যাই । একটা কথা……।।
— হ্যাঁ ,বল । থামলে কেন ?
দিগন্ত বিস্তৃত উত্তাল সফেন বারিরাশির দিকে মুখ ফিরিয়ে অত্যন্ত নিচু স্বরে বলে , আমার কথা তোমার আজো কি মনে পড়ে জতুদা ? সেই দিনগুলোর কথা ? নরহরি স্যারের বাড়িতে অংক বলে দেওয়া , সরস্বতী পুজোর দিনের কথা ?
কণ্ঠস্বর বুজে আসে কুন্তীর । কথা শেষ করতে পারে না । শ্বেত শুভ্র আঁচল তুলে দুচোখ ঢেকে নেয় ।
বাইরের ধেয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাস আর মনের ভিতর উথাল পাথাল ঝড়ে আমি তখন এক পাল ছেঁড়া নৌকার মতো ভাসতে শুরু করেছি । আমি কি করে বোঝাব সেদিনের সেই পত্রহীন বৃক্ষ আজ এই মুহূর্তে নতুন পুষ্পে পল্লবিত । কোন কথাই যে মুখে আসছে না । কোন রকমে বললাম , তুমি যেমন ভুলতে পারোনি , আমি ও তাই । কি অদ্ভুত অবস্থায় তোমার সঙ্গে দেখা হল আর মনটাও খারাপ হয়ে গেল তোমার এই অবস্থা দেখে !
ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এনে উত্তর দিলো , কি আর হবে বল । বাবার বদলী ,তোমার পড়তে চলে যাওয়া সব কিছু ঘটনাই আমাদের দূরে সরিয়ে দিলো । তোমাকে ভালবাসি এটা নিজের বুকের মধ্যেই পুষে রেখেছি বাইরের দুনিয়াকে সেটা কোনদিনই জানাতে পারিনি ।এ জন্মে তো হল না , দেখি , যদি পরের জন্মে হয় । তুমি ভালো থেকো জতুদা …….. চলি । বলতে বলতে এগিয়ে গেল সেই দলের মধ্যে । চারিদিকে তখন স্নানরত সাধু সন্তদের জয়ধ্বনি উঠছে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে …সাগর মহারাজ বাবা কপিল মুনিকা জয় ………
ভাল লাগল।