গল্পঃ মা – দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

মা
দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

আজকাল ছবিগুলো আর দেখাই হয় না। পুরনো ছবিগুলো। স্মৃতির ঝাপটা তখন বুকের পাঁজরে। কেনই বা খুঁচিয়ে ঘা করা !যে যার জায়গায় থাক। পড়ন্ত বিকেলে শেষ আলো মেখে ঘরে ঢুকলেই একটা অন্ধকার যেন গিলতে আসে।নি:সঙ্গতার অন্ধকার। জ্বলে থাকা আলো কেমন যেন কৃত্রিম মনে হয়।তাই সারা গায়ে মেখে দিনের প্রতীক্ষায় থাকি।এ যাপনে স্মৃতি ঘাঁটতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু বার বার রক্তাক্ত হতে হতে মনে হয় দূরের আকাশের তারা গোনা অনেক শ্রেয় ও প্রেয়।
গঙ্গার ঘাটে পাগলটা বাঁশি বাজায় রোজ রাতে। ঢেউয়ের সঙ্গত বড়ো মায়াবী করে তোলে সে সুর।এক একদিন চুপচাপ বিছানা ছেড়ে উঠে ওর কাছে গিয়ে বসি। আমাকে হাত নেড়ে কাছে ডাকে ও। হয়তো ভাবে ওর ভালো শ্রোতা। আসলে ওর সুরের মায়ায় আমার সময় কাটে। নদীর জলে আলোর ঝিকিমিকি কেমন অবশ করে রাখে অনুভব। কখন যে ওর পাশেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি জানি না। সকালে ঘাটে আসা মানুষের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গলে সামনের দোকান থেকে চা বিস্কুট কিনে এনে পাগলটাকে দিই। চা খেতে খেতে ওর মুচকি হাসি বড়ো পবিত্র লাগে। সেখানে অভিজ্ঞ চোখ কোন অবিশ্বাস খুঁজে পায় না।রাত বন্ধু আমার একসময় উঠে যায় ওর মাধুকরীতে। আমিও উঠে পড়ি। চম্পার কাজে আসার সময় হয়।
চম্পা আমার দেখভাল করে । আমার এই পালিত্য সময়ের একান্ত আপনজন।রান্না করা,বাসন মাজা ,ঘর ঝাঁট –সব চম্পা করে আমার স্বঘোষিত অভিভাবক হয়ে। মেয়েটা বড়ো দুঃখী ! ভালোবেসে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে বিয়ে করেছিল একবুক আশা নিয়ে ঘর বাঁধবে বলে ।এক বছরের মাথায় অন্য মেয়ের সাথে পালায় ওর বর। পেটে তখন ছ মাসের বাচ্চা। আত্মহত্যা করতে ট্রেন লাইনে ঝাঁপালে এক নিত্যযাত্রী ওকে জড়িয়ে ধরে বাঁচায়।ওর দুঃখের কাহিনী শুনে বনানী দিদিমণি ওকে বাড়িতে নিয়ে যায়। মেয়েদের স্কুলের অঙ্কের প্রাক্তন শিক্ষিকা। একমাত্র ছেলে সত্তরোর্ধ্ব মাকে একা ফেলে বউ নিয়ে কলকাতার ফ্ল্যাটে। বড়ো বাড়িতে দিদি একা। চম্পার বাচ্ছা দিদির আশ্রয়েই হল।দিদি চম্পাকে মেয়ের মতোই দেখতে থাকলেন। চম্পার ছেলে ওনার নাতির জায়গা নিল অচিরেই। চম্পাও যেন নতুন মা পেল।দিদির সংসার আবার সুজলাং সুফলাং প্রাত্যহিকীর যাপনে।
বনানীদি আমার দোকানেই মুদির মাল নিতেন। ভালো সখ্যতা ছিল। চম্পার ছেলে সঙ্গে এলে চকোলেট দিতাম। দিদি মানা করতেন। অনেক সময় পয়সাও দিতে চাইতেন। কষ্ট লাগতো খুব। হয়তো আমার চোখের দিকে তাকিয়ে সব বুঝতেন উনি। আমার চোখের অসহায়তা হয়তো ধরা পড়েছিল ওনার চোখে। আস্তে আস্তে জেনেছিলেন আমার সব কথা।সব থেকেও যে কিছুই নেই আমার।সারাটা জীবন যাদের দায় দায়িত্ব পালনেই কাটালাম একদিন তারাই অক্লেশে ফেলে রেখে পালালো। সংস্কৃতির ধ্বজাধারী ছেলে মাকে নিয়ে চলে গেল ওর নিউ আলিপুরের আলিসান ফ্ল্যাটে। মস্ত বেসরকারি কোম্পানীর অফিসার।এ বাড়িতে আর নাকি থাকা যায় না।গরীব বাবার দাম তার কাছে আর কিই বা তখন! উন্নতির ঝাঁ চকচকে রাস্তা ওর সামনে।বিয়ে করল। এসেছিল বলতে। যেতে পারিনি। গরীব বাবা সেখানেও তো বেমানান হতে পারে।নাতির বয়স এখন পাঁচ বছর। বউ এখন ছেলের বড়ো ফ্ল্যাটে নাতির দেখভাল করে।বেবিসিটার ! হায় রে জীবন !বুঝতে পারি সব।বউকে আর ফিরতে বলিনি কখনো। আসলে আমাকে একা ফেলে যখন চলে গেছে , তখন এটা আমার কাছে পরিস্কার সেভাবে ভালোবাসার বাঁধনই ছিল না কোনদিন। থাকলে……!
একদিন বনানীদি দোকানে থাকাকালীন মাথা ঘুরে পড়ে যাই।ডালের টিনে মাথা কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। চিৎকার চেঁচামেচিতে লোক জড়ো হয়। সামনের নার্সিং হোমে নিয়ে যায় সকলে। টানা দশ দিন থাকার পর সুস্থ হয়ে ফেরা।বনানীদি এই দশদিন ছায়ার মতো ছিলেন। এরমধ্যে বয়সে ছোট বলে আমাকে ভাই ডাকতেও শুরু করেছেন। আমার দেখভালের ভার নিজের কাঁধেই স্বেচ্ছায় তুলে নিলেন উনি। সঙ্গে এলো চম্পা। জীবনযুদ্ধে লড়তে থাকা এক মা !কখন যে ও আমার মেয়ে হয়ে উঠলো আমার কাছে, তা নিজেও জানি না।একাই দু বাড়ি সামলায়।শরীর আর সামাল দিচ্ছে না বলে অবশেষে একদিন দোকান বিক্রি করে দিলাম।যা টাকা পাওয়া গেল তা পোষ্ট অফিসে রাখা হল।বনানীদির সাহচর্যে সব হয়ে গেল সহজভাবেই। চম্পা এখন বাস্তবিক দু বুড়ো বুড়ির অভিভাবক একাই। চম্পা খুব বিশ্বাসী। আসলে কষ্টে পুড়ে ও এখন খাঁটি সোনা। চম্পাকে তাই চোখ বুজে ভরসা করা যায়।
তিরিশের চম্পার এক পুরুষ সঙ্গীর প্রয়োজন।কদিনই বা ঘর করেছে মেয়েটা! বনানীদি ও আমার অবর্তমানে ওর কি হবে? তাছাড়া শরীরেরও একটা দাবি আছে। চম্পা শুনেই আগুনচোখ।আর ও জীবনে নয়। কেঁদে ভাসায় মেয়েটা তখন।আমরাও আর বলি না কিছু ওকে।থাক ওর নিজের মতো করে। ছেলেকে বড়ো করাই এখন ওর তপস্যা যেন !ও এখানে জিততে মরিয়া। হয়তো কারো কাছে কিছু প্রমাণ করার দায় রয়ে গেছে ওর। চম্পার ছেলে এখন স্কুলে ভর্তি হয়েছে।ওর পড়াশোনার দায়িত্ব বনানীদি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। মাঝে মাঝে ওর ছেলে এ বাড়িতেও আসে। চকোলেট এখন আর দেওয়া হয় না। চকোলেট কেনার পয়সা দিতে গেলে চম্পা রাগ করে।ও ছেলেকে কষ্টের মধ্যেই মানুষ করতে চায়। এরমধ্যে আমার বাড়ি ও সব টাকা পয়সা আমি ওর নামেই করে দিয়েছি। আমার মৃত্যুর পর ওই সব পাবে। শুধু বনানীদি জানেন । হয়তো ওনারও একই ইচ্ছা ! জিজ্ঞাসা করিনি কখনো। চম্পা জানে না এসব।ও নিজেকে আশ্রিতাই ভাবে শুধু।সব জানলে যদি প্রলোভনে গা ভাসিয়ে দেয় । যদি সব পেয়েছির আনন্দে মাথা ঘুরে যায়। হাজার হোক মানুষ ত ! যদি ছেলেটাকে পুড়িয়ে সোনা বানাতে না পারে ওর মতো করে।কিছু চাহিদা অপূর্ণই রাখা প্রয়োজন জীবনে। প্রাচুর্যের যাপনে বড়ো হয়ে হয়তো ওর ছেলে মাকে একা ফেলে চলে যাবে কোথাও কোন সঙ্গীর হাত ধরে !আর সারা জীবন বিধবার মতো কাটানো মা শেষ বয়সে নিঃসঙ্গতার গুহায় প্রতিদিন মরবে একাকীত্বের ছোবলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *