ধারাবাহিক উপন্যাস: দ্বিতীয় পৃথিবী (৩য় পর্ব) – অনিরুদ্ধ সুব্রত


দ্বিতীয় পৃথিবী – ৩য় পর্ব
অনিরুদ্ধ সুব্রত

সুমিতের ঘুম ভাঙে পরদিন সকালে তীব্র একটা আওয়াজে। আর ঘুম ভাঙার পর সে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে বুঝতে পারে যে, এটা বাপ্পাদিত্য চ্যাটার্জির এন্ডফিল্ড মোটরবাইকের হর্ণের তীব্র শব্দ।
বিছানায় উঠে বসে সুমিত । এতক্ষণে সে বুঝতে পারে যে, সে ছিল এক ঘন স্বপ্নের মধ্যে । মুখোমুখি অমৃতা অধীর হয়ে শুনছিল, সুমিতের নতুন লেখা দীর্ঘ কবিতা– ‘নক্ষত্র সঙ্গম’।

সুমিত জানে এই পৃথিবীতে যত মানুষ কবিতা লেখে, তত মানুষ হয়তো সাগ্রহে কারও লেখা শোনেনা বা পড়েও না। অথচ গত দুই বছরে অমৃতা সুমিতের অনেক অনেক অধীর হয়ে লেখা শুনেছে, পড়েছে এবং সমানে প্রতিক্রিয়া দিয়ে গেছে। তবু মুখোমুখি বসে সুমিত অমৃতাকে কবিতা শোনাতে পেরেছে খুবই সামান্য সময়, মাত্র হাতে গোনা কয়েক বারমাত্র। কখনও হয়তো লেখার পর পাঠিয়ে দিয়েছে ইমেলে, হয়তোবা কখনো সুযোগ হলে ফোন করে পড়ে শুনিয়েছে। অমৃতা এতো মনোযোগ দিয়ে শুনেছে ,পড়েছে সেই সব, যে শুনিয়ে পড়িয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়েছে কবি সুমিত।
এমন করে এর আগে কেউ তো জানতে চায়নি। অমৃতার প্রতিক্রিয়া, বিশ্লেষণ শুনতে শুনতে সুমিত আশ্চর্য হয়ে থেকেছে অনেকক্ষণ।
কাল রাতের গভীর ক্লান্তির ঘুমের মধ্যে সেই তৃপ্তি যেন অনন্য মাত্রায় পৌঁছেছিল। নন্দন চত্বরে বাংলা অ্যাকাডেমির সামনে ছোটো কাঠের বেঞ্চে মুখোমুখি সুমিত আর অমৃতা। ঝকঝকে নরম আলোর এক গোধূলি বিকেল। সুমিত তার নতুন লেখা দীর্ঘ কবিতা পড়ে শোনাচ্ছে অমৃতাকে। কবিতাপ্লুত অমৃতা শুনেছে। এ এক স্বতন্ত্র শিহরণ, সুমিতের কাছে চরম সুখেরও ।

চোখ কচলে ঘুমের রেশ কাটতে না কাটতে সুমিত দেখে খাটের পাশের ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রণিতা । মুখে কী যেন একটা ক্রীম লাগাতে লাগাতে কথা বলছে সে,
“— মেয়ে এখনও উঠলো না, ওকে ডেকে দিও। ওর কিন্তু এডুকেশনের টিউশন আছে ন’টায়।
— আচ্ছা
— আর মনে আছে তো— আলু সেদ্ধ ভাত নামিয়ে নিও। ফ্রিজে ডাল আছে, সঙ্গে ডিম ভেজে নেবে। মেয়ে ম্যাগি করে খেয়ে চলে যাবে।
আর…”

সুমিত হুঁ হুঁ করে কথায় সায় দিচ্ছিল। রণিতা ব্যস্ত বলে যাচ্ছিল। ঠিক তক্ষুনি আবার বাপ্পাদিত্যর বাইকের হর্ণ দুই বার হুউইস্যালের মতো বাজল।
রণিতা একবার একটু দরজার দিকে এগিয়ে হাত দেখাল,
–” জাস্ট দু’মিনিট বাপ্পা দা !”
বলেই আবার ঘরে এলো। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় মুখের শেষ টান গুলো দেখে নিল দ্রুত। কাঁধ ব্যাগ, মোবাইল, পার্স নিল তুলে। নিজের ছোটো কসমেটিক্স এর কমপ্যাক্ট পাউচটা কাঁধ ব্যাগের চেন খুলে ঢোকালো। একবার ঘরের এদিক ওদিকটা তাকাল।
রণিতার এই চরম ব্যাস্ততার মুহূর্তটা সুমিত ঘুম ভাঙা চোখে যেন শিশুর মতো দেখছিল। আর মনে ভাবছিল,
” ফেড ব্লু রঙের জিন্স এর উপর ডিপ ব্লু কুর্তিতে চল্লিশ ছুঁই ছুঁই ফর্সা রণিতাকে দেখাচ্ছে বেশ । তাছাড়া আলাদা একটা স্মার্টনেস ফুটে উঠেছে তার আদব কায়দা আর অফিসিয়াল ব্যাস্ততার ভঙ্গিমায়। রণিতাকে ঠিক বয়সে এমন ভাবে সেজে উঠাবার সহায়তা স্বামী হিসেবে করতে পারে নি সুমিত। সেদিনের অপূর্ণ স্বাচ্ছন্দ্য, স্বাধীনতা, সখ, সাধ সবই মুখ বন্ধ খামে ছিল আটকে। অথচ সুমিতের দীর্ঘ ব্যর্থতা অতিক্রম করে আজ যখন রণিতা নিজের লড়াই দিয়ে ফিরিয়ে এনেছে বিগত অপূর্ণতার খানিকটা, তখন তার স্বতন্ত্র একটা ব্যক্তিত্বময় লাবন্য আছে। আছে তার উজ্জ্বলতার কিছুটা বিচ্ছুরণ। সুমিতের ভালো লাগে সেই আলো। কিন্তু সেই আলোর মধ্যে যে রোগা একটা আগুন আছে, তাতে তার হল্কার আন্দাজ লাগে সুমিতের গায়ে।”

এরমধ্যে হঠাৎ করে করে ঐ বাইকের হর্ণ। শুনে সুমিত রণিতাকে বলে, “— বাপ্পাদিত্য বাবুকে ভিতরে এসে না হয় একটু বসতে বলতে পারতে ?”
রণিতা আশ্চর্য হয় সুমিতের কথায়,
” তোমার কি মাথার ঠিক আছে ? জানো লোকটা কে ? কোম্পানির টপ টুয়েন্টিফাইভ মেম্বার ! মাসে কয়েক লাখ ভাউচার, কত ইনসেনটিভ। তাছাড়া ওরা প্রফুল্লনগরের বনেদি বড়লোক। ওকে এখানে এই জায়গায় ডেকে ঢোকানো একটা বিশ্রী ব্যাপার। আমাদের ঘর দরজার যা অগোছালো অবস্থা !”

দরজা থেকে দু’পা বেরিয়ে তিন পা আবার পিছিয়ে এলো রণিতা,
” শোনো যেটা বলছিলাম, ঘরে সবজি নেই। পারলে, যদি মোড়ের দিকে যাও.. । আর একটু কাটা মাছ ?
— আচ্ছা, দেখব ।
— টাকা আছে ?
— হুম
— ‘হুম’ মানে তো…। মাসের কুড়ি তারিখ ওভার, জানি তো…
—- না, ঠিক আছে। আমি এনে রাখব।
— যাগ্গে, ঐ যে তাকের উপর ফটোফ্রেমের নীচে,
পাঁচশ টাকার একটা নোট চাপা দেওয়া আছে। আমি বেরচ্ছি…”

সুমিত ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে তাকিয়ে থাকে ফাঁকা দরজার দিকে। তখনও সে বিছানায় জবুথবু বসে। ফাঁকা দরজা দিয়ে শুধু ছোট্ট বারান্দার সামান্য অংশ টুকুই দেখা যায়। কিন্তু বাপ্পাদিত্যর দাপিয়ে ওঠা এন্ডফিল্ড-বাইকের গুব গুব শব্দটা সুমিতের কানে বেশ জোরে জোরে প্রতিধ্বনি তুলে, ক্রমশ দূর থেকে দূরে চলে যায়। সুমিত বিছানায় বসে যেন দেখতে পায় রণিতা দূরন্ত বাইকে চড়ে মুহূর্তে হারিয়ে গেল গলি থেকে বড়ো রাস্তায়। ছোটোবেলায় একবার ছোট্ট একটা খাঁচায় সুমিত একটা লাল ঠোঁট টিয়া পাখি এনে পুষে ছিল। হঠাৎ করেই একদিন ভেজানো ছোলা দিতে গিয়ে সুমিত অসাবধানে খাঁচার দরজা খুলে রেখেছিল। সেই ফাঁকা পেয়ে পাখিটা হঠাৎ ফুরুৎ।
সুমিত যতদূর দেখা যায় অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। তারপর নিজে নিজেই বলেছিল,
” আর কখনো পাখি পুষব না। পোষা মানে তো পরাধীনতা। যা পাখি তোরও তো স্বাধীন হয়ে বাঁচতে ভালো লাগে। স্বাধীনতা প্রত্যেকের নিজস্ব। “
আজকে আবার সেই পাখির স্মৃতিটা হঠাৎ করেই সুমিতের মনে এসে, ফের উড়ে গেল।

বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ঘরে ঢুকতেই সুমিতের মনে হলো, রাত থেকে মোবাইলটা সুইচ অফ। সারারাত চার্য হয়েছে কিন্তু সকালের ব্যস্ত পরিস্থিতির মাঝে মোবাইল অন করার কথা মাথায় ছিল না। দ্রুত অন করে। সুমিত মেয়েকে ডেকে দেয়। রণিতা চা করে রেখে গেছে। সামান্য গরম করে এক কাপে ঢেলে নিয়ে ঘরে আসে। খুলে দেয় পূবের জানলা। বিস্কুট চিবিয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে নেট অন করে মোবাইলের। চমকে ওঠে, নোটিফিকেশনে ঝুলছে অমৃতার এক গুচ্ছ টেক্সট।

কয়েকটা মেসেজের উত্তর লিখল সুমিত। সেন্ড করল কিন্তু অমৃতাকে অফ দেখাল। সুমিত জানে অমৃতা এখন কলেজের পথে। একটা ফোন করার প্রয়োজন ছিল, ডিটেল তো মেসেজে সম্ভব হয় না। বিকেলে সুযোগ বুঝে ফোন করবে অমৃতাকে ভাবল।
ইতিমধ্যে ঋ ঘুম থেকে উঠে সুমিতের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে,
” এডুকেশন স্যার আজকে পড়াবেন না, ফোন করে বললেন। সন্ধেবেলায় অনলাইনে ক্লাস করবেন।
— আচ্ছা ! বেশ ! তাহলে তো আজ বাবা, মেয়ে দুজনেরই ছুটি ! আহা কী আনন্দ !
— মা বাড়িতে থাকলে নতুন কিছু একটা রান্না করা যেত। তাই না বাবা ?
— না পাগলি, তোকে আর রান্না করতে হবে না। তুই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নে, চল রাস্তা দিয়ে খানিকটা বেড়িয়ে আসি দুজনে। তারপর ভাবব।
— কিন্তু…
— আচ্ছা যাবি না, তাহলে থাক। বল কী খাবি ?
— না , বাবা চলো হাঁটতে যাবো, আমি আসছি। “

ঘরে তালা ঝুলিয়ে বাপ বেটি বেরিয়ে পড়ে। সুমিত মেয়েকে বলে,
–” শোন, সকালে কোনো রান্না নয় ঋ, মোড়ের দোকান থেকে কেক আর চা । তারপর হেঁটে বাজার হয়ে ফিরব। আজ আমি নিজে হাতে তোকে চিকেন রান্না করে খাওয়াব।”

বাবার কথা শুনে ঋ ভীষণ খুশি। কতদিন সে এভাবে বাবার সঙ্গে যেন মেশে নি। আজ বাবা যেন প্রকৃতই বন্ধু। ঋ মনে মনে ভাবে, উপযুক্ত সুযোগ পেলেই সে নিজের মনের সমস্যাটা বাবাকে বলবে। মাকে বললে, না শুনেই হয়তো চিৎকার করে উঠত। বাবা তো তেমন না, বাবাকেই সাহস করে সব বলা যায়।
তাছাড়া নীলের ব্যাপারটায় তার নিজের নেওয়া সিদ্ধান্তটা যে সত্যিই ঠিক, এটা বাবা সুস্পষ্ট না করলে ঋ মনে শান্ত হতে পারছে না। কারণ ব্যাপারটা যে অনেক দিনের তা বাবার অজানা নয়। মাও জানে। আর সমস্যাটাও সেখানে।
এতদিনে ঋ নীলের মানসিকতার আসল পরিচয় পেয়েছে। একটা ভরসা গড়ে উঠতে যে দীর্ঘ লালিত বিশ্বাস লাগে, ঋ তিল তিল করে তা সঞ্চয় করছিল এতো দিন। অথচ সে যে এতখানি মিথ্যে দিয়ে ধ্বংস হবে ঋ কখনও তা ভাবেনি। বুকের মধ্যে তার সদ্য তরুণী মন ভেঙে খানখান । তবু একটা ব্যক্তিত্বের চেতনায় সে আজ শক্তি কুড়োচ্ছে নতুন করে ভাবার। আর বাবার সমর্থনে দৃঢ় হবে সেই শক্তির জোর।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে, মোড়ের ফাস্টফুডের দোকান থেকে সুমিত আর ঋ চা কেক ইত্যাদি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। শিব মন্দিরের গলিটা ছাড়িয়ে বাঁ দিকে কিছুটা হেঁটে গেলেই মুখার্জিদের বড়ো দিঘি। এখন অবশ্য দিঘিটা আর মুখার্জিদের মালিকানার নেই। তবু নামটা রয়ে গেছে মুখার্জিদেরই নামে।

দিঘির পার বরাবর সুন্দর ছোটো ছোটো ছাঁটা গাছ। গাছের নীচটা সবুজ ঘাস বিছানো। নিয়মিত দেখভাল হয় বলেই জায়গাটা খুব পরিচ্ছন্ন। দিঘির পাড়ে একটু দূরে দূরে বসবার জন্য কাঠের বেশ কিছু বেঞ্চ আছে। সকাল বিকেলে হাঁটতে আসা লোকজনের বসার উদ্দেশ্যে এগুলো তৈরি করা নয়। তৈরি করা হয়েছে পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে মাছ ধরতে আসা লোকেদের জন্য। তবু সুযোগ পেলে পথ চলতি অনেকেই বসে বেঞ্চ গুলোতে। বসে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি দিঘিতে বড় বড় মাছের উপস্থিতি উপভোগ করাও যায়।

সুমিত হাঁটতে হাঁটতে ঋকে বলে “চল না, একটু বসি মা।”
একটা ঝাটালো বকুল গাছের পাশের বেঞ্চে পাশাপাশি বাবা মেয়ে বসে। সুমিত আঙুল দিয়ে ঋকে দেখায় দিঘির জলে কিলবিল করে বেড়ানো এক ঝাঁক ছোটো মাছ। ঋ সেদিকে না তাকিয়ে বাবার মুখে তাকায়,
“—- বুঝতে পেরেছি, বল্ কাল কী বলতে চেয়েছিলি ?”
ঋ একবার বাবার মুখে একবার মাটির দিকে বার কয়েক তাকায়। প্রথমে তার ঠোঁট দুটো একটু কম্পিত দেখায়। তারপর দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে নিজেকে দৃঢ় করে। শেষে মুখ খোলে,
” — নীলের সঙ্গে আমি আর ফ্রেন্ডশিপে থাকতে চাই না বাবা।
—- আচ্ছা, ঠিক আছে, তোর নিশ্চয়ই তেমন কিছু মনে হয়েছে, তাই এই রকম ভেবেছিস।
—- হ্যাঁ বাবা, আজ আমার লজ্জা করছে না তোমাকে বলতে।
—- আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তো তোর বন্ধুর মতো তাই না ?
—- এতো দিন ওর সম্পর্কে আমার একটা ভালো ধারণা ছিল, কিন্তু…
—- মানুষকে সবসময় ঠিক চেনা যায়, এমন কি হয় ! সে ঠিক আছে, তুই যখন ভেবেছিস নিশ্চই তার সম্পর্কে সব খোঁজ খবর নিয়ে তারপর।
—- হ্যাঁ, আগে অন্য কেউ ওর সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করলে বিশ্বাস করিনি। কিন্তু যখন ওর আচরণ নিজে চোখে দেখলাম, তখন নিজের চোখকে তো আর অবিশ্বাস করতে পারিনা।
—- ওকে জিজ্ঞাসা করিসনি কিছু ?
—- প্রশ্ন করলে ও যা ক্যাজুয়াল ভাব দেখায় বা যা এক্সকিউজ দেখায় তাতে ওর প্রতি আরও নেগেটিভ ধারনা সৃষ্টি হয়। আর একটা বড় কথা…
—- কী কথা , বল ঋ ?
—- তিন বছর ওর আমার বন্ধুত্ব, কিন্তু ও আজকাল এই ফ্রেন্ডশিপটাকে আলাদা কোনো ইম্পর্টেন্স দিতেই নারাজ। কথায় কথায় আমাকে হার্ট করে, এক বিন্দুও অনুতপ্ত হয় না। বাজে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, শুনেছি সুযোগ পেলে নেশাও করে আজকাল। সুতরাং এরপর…
—- একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস ঋ
—- বলো বাবা, পরস্পরের চিন্তা ভাবনার প্রতি শ্রদ্ধা না থাকলে কোনো সম্পর্ক সত্যিকার সম্পর্ক হয়ে ওঠে ?
—- ওঠে না মা, সত্যি কথা
—- ও উঁচু ক্লাসে পড়ে, ভালো ছাত্র, বিভিন্ন সময়ে পড়াশোনায় আমাকে হেল্প করেছে। তার জন্য ওর মনটা ভালো বলেই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আমার।
কিন্তু ইদানিং একটা অহংকার ও কথায় কথায় প্রকাশ করে। কিন্তু সে অহংকার আমি কেন দেখব বলো বাবা ?
—- না, সম্পর্ক তো মনের, সেখানে অহংকার এলে সম্পর্ক বাইরে চলে আসে, মনে থাকে না।
—- তাছাড়া ওর রুচি আর মানসিকতার অবনতি আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।
—- কেন, মানবি ঋ। রুচি মানসিকতা এগুলো তো মানুষের প্রকৃত অস্তিত্ব মা।”

সুমিত ভাবে, সামনে মেয়ের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা, ওর মনটা এখন এই সব মানসিক চাপ নিলে তাতে ওর পড়াশোনার ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। কিন্তু সমস্যা তো সমস্যাই, তাকে চাপা না দিয়ে সহজ করে দেওয়াই ভালো। বেঞ্চ ছেড়ে উঠতে উদ্যত হয় সুমিত,
” দেখ ঋ জীবন একটা দীর্ঘ পথ। এখানে বিচিত্র অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ প্রতিদিন শিক্ষা নিচ্ছে। কোনো বাজে অভিজ্ঞতা যেমন কেউই প্রত্যাশা করে না, তেমনি কোনো দুর্ঘটনাকে মনে রেখে তার তিক্ততার রেশ বয়ে বেড়ানো ভবিষ্যতের জন্য এতটুকু ভালো নয়। তোর মূল্যবান সময়টা সামনে, বরং ঈশ্বরকে থ্যাংস জানা। তিনি তোকে মানুষ চিনবার শক্তি দিয়েছেন। এখনও বহু মানুষের সঙ্গে তোর দেখা হওয়া বাকি। চল ঋ আজ উঠি।”

মেয়েকে নিয়ে সুমিত বাজার ঘুরে বাড়িতে ফেরে। তারপর দুপুরে জমিয়ে চিকেন রান্না করে সুমিত। ঋ এটা ওটা গুছিয়ে দেয়। বলে,
” বাবা, আজ যেন আমাদের পিকনিক,তাই না ?” সুমিত হেসে সহমত হয়। কিন্তু গ্যাস ওভেনে টগবগ করে ফোটা মাংসের দিকে তাকিয়ে সুমিতের মনেও কেমন একটা অসহায়তা টগবগ করে সেদ্ধ করে তোলে তাকে। হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়। মনে মনে ভাবে সুমিত,
” মেয়েটা অনেক বড় হয়েছে, ওর ও তো বাইরে বেড়ানোর সখ হয়। মাঝে মাঝে হৈচৈ করে ঘুরতে যাওয়া অথবা বাইরে খেতে যাওয়া এখনকার দিনে সাধারণ ব্যাপার। অথচ সতেরো আঠারো বছরের মেয়েটাকে সেটুকু সুযোগ আর দিতে পেরেছি কবে !”
মনে ভীষণ ব্যর্থ বোধ হয় সুমিতের। চোখ দুটো ভিজে আসে হঠাৎই। স্বাভাবিক হতে মেয়েকে বলে,
“যা ঋ, স্নান সেরে নে। তারপর দুজনে বসে বেশ গরম গরম খেয়ে নেব।”

দুপুরে খাবার পর ঋ শোবার খাটের উপর কম্বলে পা ঢুকিয়ে হাতে নোটস এর খাতা নিয়ে পড়তে বসে। সুমিত বিছানায় যায় না। খানিক পায়চারি করে ঘরে এসে একটা পাতলা সোয়েটার গায়ে চড়িয়ে নেয়। তারপর মুখে একটু সপ্ট ক্রীম লাগিয়ে গলায় মাফলার পেঁচিয়ে বারান্দায় আসে। ঋ ঘর থেকে দেখে,
” বাবা কোথাও বেরচ্ছ ?
—- তুই পড়তে থাক, পাশের বাড়িতে জেঠিমা আছেন তো।
—- না না, আমার কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু তুমি কোথায় যাবে ?
—- কাছারিপাড়ায়, আমার স্যার অতীনবাবুর বাড়িতে। একটা বই দিয়ে চলে আসব। কোনো প্রয়োজন হলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করবি আমাকে।
—- আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি এসো।”
বারান্দা থেকে সাইকেলটা বের করে দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে পড়ে সুমিত।

অতীন ঘোষ, সুমিতের ছাত্রজীবনের প্রিয় অঙ্কের স্যার। পলাশপুর কাছারিপাড়ার মূল রাস্তার পাশেই বাড়ি। স্যার রিটায়ার করেছেন অনেক দিন। সেই সেভেন এইট নাইন টেন ক্লাস গুলোতে সুমিত ঝড়ের বেগে অঙ্ক করত ক্লাসে। স্যার বলতেন সুমিত জিনিয়াস। মাধ্যমিকে সুমিত অঙ্কে আটানব্বই পেলে স্যার প্রথমে বলেছিলেন, ” তোর সঙ্গে কথা বলব না, একশোতে একশো হলো না কেন ।” সুমিত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর স্যার নিজেই জড়িয়ে ধরেছিলেন । পরে একদিন একটা ইংরেজি ভার্সনের হায়ার ম্যাথমেটিক্স বই সুমিতকে ডেকে হাতে তুলে দিয়ে বলে ছিলেন,
” জীবনটা অঙ্কের মতো সুমিত, তুমি ভালো অঙ্ক শিখবে। এটা নাও রেফারেন্স হিসেবে পাশে রাখবে, প্রাকটিস করবে।”

সেদিন হয়তো স্যারের আশীর্বাদের মতো সুমিত বইটা হাতে নিয়েছিল। কিন্তু স্যারের কথা সে রাখতে পারে নি। বরং ক্লাস ইলেভেন থেকে বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক, অজিত স্যারের ফ্যান হয়ে উঠেছিল দিন দিন। তারপর ধীরে ধীরে কবিতার নেশা তাকে কোথায় যে নিয়ে গিয়েছিল, আজও তার পরের হদিস সে দিতে পারে না। উচ্চমাধ্যমিকে অঙ্কে সুমিতের দিন দিন অবনতি অতীনস্যার মেনে নেননি। কথা বলতেন না সুমিতের সঙ্গে। সুমিতও লজ্জায় স্যারের সামনে আসত না। তারপর কেটে গেছে অনেক বছর।

সম্প্রতি সুমিতের ফেসবুক প্রোফাইল দেখে স্যার ইনবক্সে সুমিতের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই এর একটা কপি চেয়েছেন। আজ যখন সুমিত বৃদ্ধ অতীনস্যারের হাতে নিজের প্রথম কবিতার বই তুলে দিল, স্যার দ্বিতীয় বারের জন্য আবার জড়িয়ে ধরলেন সুমিতকে। এই আপ্লুত স্যারকে দেখে সুমিতের চোখে ব্যর্থ আনন্দের অন্য এক জলধারা। স্যার ঘর থেকে একশো টাকা এনে সুমিতকে নিতে বললেন। সুমিত জানাল সে কিছুতেই টাকা নেবে না। এটা সে স্যারকে শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে দেবে। স্যার তখন টাকাটা মুড়িয়ে সুমিতের পকেটে দিয়ে বললেন,
“— বাড়িতে দাদুভাই মানে তোমার মেয়ের জন্য একটা চকলেট নিয়ে যাবে তাই দিলাম, মনে করো। তোমাকে আমি সেরা অঙ্কের মানুষ করতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু তুমি আমাদের গর্ব সুমিত। আমি নিয়মিত ফেসবুকে তোমার লেখা গুলো পড়ি। যে লেখা গুলো কোনো গভীর সাধনা ছাড়া সম্ভব হতে পারে না। ঈশ্বর তোমার দীর্ঘ জীবন দিন।”

পলাশপুরের এই কাছারিপাড়াতে এলেই অনেক অনেক কথা সুমিতের মনকে জাদুঘরের সারি সারি ফসিলের কাঁচ বাক্সের সামনে নিয়ে ফেলে।
অতীন স্যারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সুমিতের সাইকেলের প্যাডেল থেকে পা ফসকে যায় অমিত্রসূধন চক্রবর্তীর বিশাল বাড়িটার সামনে। দেখলে এখনও একটা শতাব্দী অতীত স্কুলবাড়ি মনে হয়। বাড়িটার মালিক বদল হলেও, রং চং বদলালেও এখনও পথচলতি মানুষ ঐ অমিত্রসূধনের নামেই বলেন। পলাশপুর এলাকায় এক সময় অমিত্রসূধন চক্রবর্তীকে কে না চিনত। শুধু প্রফুল্লনগর কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন বলেই নয়, এই অঞ্চলের শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে অমিত্রসূধনের বিশিষ্ট সম্মান তখন মানুষের মুখে মুখে। যে কোনো সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক শুভ কাজে অমিত্রসূধনের উপস্থিতি ছিল স্বতন্ত্র সম্মানের।

সুমিত নেমে পড়ে সাইকেল থেকে। বাড়িটার কাছে গিয়ে স্ট্যান্ড দিয়ে সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে রেলিং এর পাশের ধূসর রোয়াকে বসে। মনে পড়ে তিরিশ বছরের কিছু বেশি আগের কথা। সে বছর স্কুলের বাৎসরিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি অমিত্রসূধন বাবু। সুমিত তখন সদ্য ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র। বিগত মাধ্যমিকের কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের পুরস্কার প্রদানের তালিকা ধরে ধরে রঙিন কাগজে মোড়া বই দেওয়া হচ্ছে প্রধান অতিথির হাত দিয়ে। সুমিত তালিকায় এক নম্বরে। মঞ্চে উঠে অমিত্রসূধনবাবুর হাত থেকে পুরস্কার নিয়ে প্রণাম করল তাকে। পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন অঙ্কের স্যার অতীনবাবু।
হাতে পুরস্কার নিয়ে অমিত্রসূধন বাবুকে প্রণাম করতেই, অতীন স্যার বললেন, ” জানেন তো অমিত্রসূধন বাবু, এই ছেলেটি এবার মাধ্যমিকে অঙ্কে আটানব্বই পেয়েছে। ওর নাম সুমিত । অন্য বিষয়েও দারুণ নম্বর।”
অতীন স্যারের কথা শুনে অমিত্রসূধনবাবু সুমিতের হাতটা টেনে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন বাড়ির ঠিকানা। জানতে চাইলেন, বাবা কী করেন। তারপর নিজের বাড়ির ঠিকানা বুঝিয়ে দিয়ে বললেন,
” আগামী রবিবার, সকাল এগারোটা নাগাদ আমার কাছারিপাড়ার বাড়িতে একবার এসো। তোমার সঙ্গে আমার জরুরি দরকার আছে।”
পাশে দাঁড়িয়ে অতীন স্যার বললেন,
” কী যে বলেন অমিত্রসূধনবাবু, আপনি হলেন এই পলাশপুরের অভিভাবক। শিক্ষা সংস্কৃতিতে আপনার অবদান পলাশপুরের কোনায় কোনায়। আপনি ডেকেছেন আর সুমিত যাবে না ? অবশ্যই যাবে।”
এরপর অতীন স্যার সুমিতের পিঠে একটা স্নেহের হাত রেখে বললেন, ” অমিত্রবাবুর কথাটা মনে রেখে রবিবার যেও সুমিত।” সুমিত মাথা কাত করে সম্মতি জানিয়ে পুরস্কার হাতে মঞ্চ থেকে নামে।

আজ থেকে তিরিশ বছর আগের কথা। সুমিত মাত্র সতেরো বছরের ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র। রোগা পিলপিলে, শ্যামবর্ণ, নরম ভীতুর ডিম। নির্দিষ্ট রবিবার সকাল এগারোটায় সাইকেল চড়ে সোজা অমিত্রসূধন চক্রবর্তীর বাড়ির এই গেটে। সামনে কাউকে না দেখে সাইকেলের বেল বাজালো ক্রিং ক্রিং। শব্দ শুনে একজন কেউ এসে বলল, গেট ঠেলে ভিতরে আসতে। তারপর নীচ থেকে চিৎকার করে জানান দিল,
“কে যেন এসেছে দেখুন”।
দোতলার বারান্দায় ঝুঁকে দেখলেন অমিত্রসূধন । সুমিত কাচুমাচু মুখ। অমিত্রবাবু চিনতে পারলেন। উপর থেকে চেঁচালেন,
” ডান দিকে সিঁড়ি আছে দেখো। উঠে এসো উপরে। চিন্তা নেই সোজা চলে এসো । “
সুমিত ভিতরে গেটের কাছে সাইকেল টা স্ট্যান্ড করে রেখে ধীরে ধীরে একতলার বারান্দা হয়ে সিঁড়ি, সিঁড়ি বেয়ে সোজা দোতলায়। অমিত্রসূধন বাবু বারান্দাতেই ছিলেন। সুমিত কাছে পৌঁছতেই বললেন,
” রিটায়ার করেছি অনেক দিন বাবু। শরীরে জোর কম। উপরেই থাকি বেশি। চলো ও ঘরে গিয়ে বসি।”
সুমিত ভয়ে ভয়ে ঘরটায় ঢুকলো। ঢুকেই যেন তাজ্জব,
“একটা মানুষের বাড়িতে এতো বড়ো বইয়ের ঘর থাকে !”

যেদিকে তাকায় সুমিত সেদিকেই বই। চারদিকে বাদামী রঙের সার সার আলমারি। প্রতি আলমারি ভর্তি বই। ঘরের মেঝেতে শতরঞ্চির মতো মোটা কার্পেট পাতা। তার উপর লম্বা কাঠের টেবিল। টেবিলের দুপাশে অনেক গুলো চেয়ার। পুরো আস্তো একখানা লাইব্রেরি। সুমিত দেখতে দেখতে যেন চোখ ফেরাতে পারছে না। এমন একটা বইয়ের খনি যেন সে সন্ধান করেছে কতদিন।
সাধারণ ছাপোষা ঘরের ছেলে সে। সিলেবাসের লেখা পড়া দিয়ে জীবীকা জয় ছাড়া সেখানে বাড়িতে বইএর আলমারি আশ্চর্য বিলাসিতা। অথচ যত বড় হচ্ছে সুমিত তত যেন কত অজানারে জানতে তার আগ্রহ। কিন্তু নিজের পারিবারিক গণ্ডীতে সে অসম্ভব। অথচ ঘটনাক্রমে আজ অমিত্রসূধন বাবু যেন তেমনই এক পাহাড়ের সামনে এনে দাড় করিয়ে দিলেন তাকে।

” —–আমাকে ডাকলে কেন দাদু ? কী বলবে ?”
একটি কিশোরী মেয়ের কন্ঠস্বর। হঠাৎ শুনতে পায় সুমিত। শুনে সুমিত ঘাড় ফিরিয়ে দেখে অমিত্রসূধন বাবু লাইব্রেরি ঘরের দরজার কাছের চেয়ারটাতে বসে, আর একটি ফ্রকপরা একটি মেয়ে তার সামনে। অমিত্রবাবু সুমিতকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
” এই যে বাবু এদিকে এসো। শোনো, এই আমার নাতনি অমৃতা। ক্লাস নাইনে পড়ছে। ও একটু অঙ্কে গোলমেলে বুঝলে তো। তুমি বাপু সপ্তাহে অন্তত একটা দিন, মানে এই রবিবার করে ওকে যদি ঘন্টা খানেক অঙ্কটা দেখে দিয়ে যাও, তো খুব ভালো হয়। পারবে নিশ্চয়ই ? না কোরো না কিন্তু বাবা।”

সুমিত অমৃতার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। অমিত্রসূধন বাবুর কথায় ঘাড় কাত করে সম্মতি জানিয়ে ফের লাইব্রেরি ঘরের বইয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সে।
কিন্তু তার কানে আসে অমৃতার কন্ঠ। হঠাৎ যেন বেশ কর্কশ লাগে সুমিতের কানে,
” আমি নিচে গেলাম দাদু, আজ থেকে তো নয় , আগামী রবিবার থেকে অঙ্ক করব। এখন আমি আসছি।”

হঠাৎ সুমিতের মোবাইল বেজে ওঠে। সড়াৎ করে তিরিশ বছর নিচে এসে পড়ে সুমিত রায়।
” আরে ! ঋ ফোন করছে ?
— হ্যাঁ ঋ কী হয়েছে ?
— তুমি কোথায় ? বাড়ি এসো বাবা। মা ফিরছে।
— আচ্ছা, আমি এক্ষুনি আসছি।”
মেয়েকে দেখে রাখার দায়িত্বশীল বাবা, আবার আজকে ঝাড় খাবে নির্ঘাত। মনে মনে চিন্তা করে সুমিত।” ইস্ অতীন স্যারকে বইটা দিতে এসে এতো দেরি ! “
সুমিত ভাবতেও পারেনি কাছারি পাড়ার মোড়ে এইভাবে অমৃতাদের পুরনো বাড়ির সামনে হঠাৎ স্মৃতি আক্রান্ত হয়ে পড়বে সে। তাড়াতাড়ি সাইকেল টেনে প্যাডেলে পা চালায় জোরে।

বিজনেস প্রোগ্রাম শেষে বাপ্পাদিত্যর বাইকেই বাড়ি ফেরে রণিতা। দরজায় এসে ঋকে ডাকতেই ঋ পড়া ছেড়ে উঠে এসে দরজা খুলে দেয়। রণিতা রীতিমতো ক্লান্ত, তাতে দুহাতে বেশ কিছু প্যাকেট। ঋ মায়ের হাতের থেকে প্যাকেট গুলো ধরে নামাতে থাকে। রণিতা ঋ কে জিজ্ঞাসা করে,
” তোর বাবা ?
— বাবা একটু বেরিয়েছে, বলল এক্ষুনি চলে আসবে।
— ও ! আমি যে বলে গেলাম, বাড়িতে থাকতে। তোকে একা বাড়িতে রেখে গেলই বা কেন ? বাড়িতে একদম ভালো লাগে না তাই না ?
তাহলে থাকতেই তো পারে অন্য কোথাও গিয়ে।
আমি তো বলে গেলাম বার বার । কোনো দায়িত্ব বোধ নেই লোকটার !
— বাবার স্যারকে একটা বই…
—- নে, বাবার হয়ে তোকে আর সাফাই গাইতে হবে না। এগুলো ধর।”

মা ফিরতেই ঋ ঘরে গিয়ে টুক করে বাবাকে ফোন করে দেয়। সুমিত ব্যস্ত হয়ে বাড়ি ফিরতে থাকে। রণিতা হাতের জিনিসপত্র গুলো পর পর নামিয়ে রেখে ঋ কে বলে,
” দ্যাখ এর মধ্যে সব আছে। খাবার গুলো জাস্ট গরম করে নিলে হয়ে যাবে। আমি একটু ফ্রেশ হয়ে নিই। সারাদিন ভীষণ ধকল গেছে।”
“খাবার গুলো” — শুনে ঋ আবাক হয়। এগিয়ে প্লাস্টিক প্যাকেট থেকে পার্সেল গুলো একে একে বের করে খুলে দেখতে থাকে। একটায় পোলাও, একটাতে মাটন, চাটনি, দু-তিন রকম মিষ্টি। তেমনি তার উচ্চ গ্রামের গন্ধ। ঋ বলে,
” তুমি এতো সব খাবার আনবে বলে গেলে না কেন মা ? বাবা তাহলে তো …”

বাথরুম থেকে ঋ এর কথা শুনতে শুনতে বেরয় রণিতা । একটু উত্তেজিত লাগে তাকে,
” কেন, আমি বলে গেছি শুধু ভাত করে রেখে দিতে । তাছাড়া আমার যে এতটা বিকেল গড়িয়ে যাবে সেটা ভাবিনি। প্রোগ্রাম শেষ হতে একটু বেশি দেরি হলো তাই।”
ঋ বলল, ” শুধু ভাত ফোটালে হতো ? আমরা দুপুরে কী খেতাম তাহলে। বাবা চিকেন রান্না করল নিজে হাতে। কী দারুণ খেতে হয়েছে জানো। তোমার জন্য আলাদা করে তুলে রেখেছি, দেখবে ?”
রণিতা কে চরম হতাশ দেখালো। মুডটা হঠাৎ করে বড্ড খিচড়ে গেল। দুম করে একটা চেয়ার টেনে বসলো।
বাড়িতে তেমন কোনো ভালো খাবার নেই, রণিতা সেটা খুব জানত। রান্না রেডি হতেই সে আলাদা করে সুমিত আর ঋ এর জন্য মাটন, পোলাও, মিষ্টি সব পার্সেল ফয়েলে তুলে রেখেছিল। ইচ্ছেও ছিল একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে দুপুরের পরপরই ঘরে এসে খাবার গুলো ওদের সামনে পরিবেশন করে দেবে। বিজনেস প্রোগ্রাম এর বিভিন্ন আলোচনায় তার বাড়ি ফিরতে খানিকটা দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু সুমিত যে সংসারে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠে মেয়েকে চিকেন রান্না করে খাওয়াবে, রণিতার ধারণায় তা ছিল না।
বরং যথাসময়ে খাবার গুলো নিয়ে এসে ঋ আর সুমিতকে খাওয়াতে পারলে একটা ক্রেডিট তৈরি হতো তার। যেটা এই মুহূর্তে পুরো গুরুত্বহীন হয়ে গেল ঐ সুমিতের জন্য। “কেন আজকেই তার এতো বাবাগিরি জেগে উঠলো ! কতদিন তো বাজারেই যাওয়ার কথা মনে পড়ে না। বাড়িতে না থাকলে মেয়ে বৌ তারা কী খেলো, না খেলো কতটুকু খেয়াল করে সুমিত ?”

সারাদিনের বিজনেস প্রোগ্রামে ক্লান্ত রণিতা। চেয়ার ছেড়ে টেবিলের খাবার গুলো প্লাস্টিক ঢাকনায় ঢেকে রেখে ঘরে গিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। টেবিলের অন্যপাশে দুতিনটি না খোলা গিফট বক্স পড়ে রইল। ঋ খাবার গুলো দেখে আর ঐ বাক্স গুলোতে হাত দেয় নি।
ঋর এখন প্রায় আঠারো বছর হতে চলল । সংসারের কী পরিস্থিতি সে বোঝে। বোঝে বাবার অসহায়তা, মায়ের পরিশ্রম, আর একটা চেষ্টা। তবু কোথায় যেন বাবার প্রতি তার একটা গোপন মাতৃস্নেহ । মা বড্ড দেরি করে খাবার গুলো এনেছে । অথচ বাবার উপর উত্তেজনা দেখাচ্ছে। এটা ঋ পছন্দ করেছে না। ভালো খাবার তার কি ভালো লাগে না ! তবু অনেক লোভনীয় বস্তুর প্রয়োজনীয়তা কখনও কখনও ফুরিয়ে যায়।

সারাদিনের ক্লান্তি নিয়েও বাড়ি ফিরে রণিতা কেন যেন বড্ড হতাশ। সুমিতকে সে অলস আর খানিকটা উদাসীন বলেই জেনেছে। স্ত্রী, মেয়ের প্রতি তার দায়িত্ব পালন বড্ড মধ্য মানের। আজ বাড়ি থেকে বেরনোর সময় রণিতার মনে মনে ইচ্ছে ছিল, ঘরে ফেরার সময় সে নিশ্চিত কিছু ভালো খাবার নিয়ে ফিরবে। মেয়ে এবং সুমিতকে সেই খাবার খেতে দেওয়ার মধ্যে তার একটা গোপন আনন্দ থাকবে। সেই মতো তাদের বিজনেস প্রোগ্রামে যখন রান্না হয়ে গেল তখন বাপ্পাদিত্য রণিতাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল , ” তোমার বাড়ির জন্য পার্সেল গুলো গুছিয়ে নাও রণিতা।”

রণিতা এতো দিনে লক্ষ্য করে দেখেছে, “বাপ্পাদা সেই প্রথম দিন থেকে আমার সব ব্যাপারে ভীষণ কেয়ার নেয়। আমার পারিবারিক পরিস্থিতি মনোযোগ দিয়ে একদিন মাত্র শুনেছে। অথচ প্রতিটা ক্ষেত্রে আমাকে কিছু মনে করিয়ে দিতে হয়নি। সব সময় খেয়াল রেখেছে— কীভাবে আমি কত দ্রুততার সাথে এই বিজনেসে একজন সফল মানুষ হতে পারি। অতবড় একজন বিজনেস টপার, ব্যক্তিগত জীবনে বড়লোক, গাড়ি বাড়ি, উঁচু মানের জীবনযাপন তবু লোকটা আমাকে আলাদা ভালবাসে। ” স্বতঃস্ফূর্ত ‘ভালবাসে’ কথাটা নিজের মনে বলে ফেলে রণিতা যেন হঠাৎ নিজে নিজেই নিজের কাছে থমকে যায়। অনেকক্ষণ আর কোনো কথা ভাবতে পারে না, চুপ করে শুয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে রণিতার মনে ঠোকরায় এক কাঠঠোকরা পাখি,
” মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে সুমিতের কবিতায় আর মায়াভরা চোখে পাগল হয়েছিলাম। বান্ধবী সুনন্দা একদিন একটা পত্রিকার পাতা খুলে সুমিতের কবিতা দেখিয়ে বলেছিল, ছেলেটাকে ওর খুব ভালো লাগে। কবিতা পড়ে মনে মনে হিংসে হয়েছিল সুনন্দার উপর।
তারপর মাঝে মাঝেই সুনন্দার মুখে সুমিতের প্রশংসা শুনতে শুনতে একটা জেদ চেপে গিয়েছিল মনে— সুমতকে জয় করব আমিই, সুনন্দা নয়। একদিন সত্যি হলো সেই জয়, পেলাম সুমিতকে। কিন্তু সুমিত আমাকে নিয়ে ফেলল একটা কঠিন অন্ধকারে। ওর পরিবারের কথা ভাবলে আমার এখনও ঘেন্না হয়। কখনও আমাকে ওরা মানুষ বলে মনে করেনি। আর সুমিত দিন দিন জবুথবু হয়ে গেছে। রণিতা কী চায়, কী ভালোবাসে, কী পেলে সে সুখী হয়— সুমিত একটা দিনের জন্যেও সে কথা ভাবতে চেষ্টা করে নি। একটা ভালো চাকরি কি ও চেষ্টা করলে পেত না ? বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি ও। টিউশনিটাও মন দিয়ে করবে না। শুধু এক অসুখ ঐ কবিতা আর কবিতা। কী দিয়েছে ওর কবিতা ওকে ? “

ভাবতে ভাবতে মনে মনে উত্তেজিত হয়ে পড়ে রণিতা। উঠে বসে বিছানায়। চোখ যায় সামনের ড্রেসিংটেবিলে । আয়নায় নিজের ছবি দেখে রণিতা । এখন তাকে এলোমেলো দেখাচ্ছে বড্ড। হাত দিয়ে নিজের এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করতে করতে রণিতার হঠাৎ বাপ্পাদিত্যর কথা মনে পড়ে যায়।
আজ সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে রণিতা যখন বাপ্পাদিত্যর বাইকে উঠতে যাচ্ছিল, তখন খানিকটা চমকে দিয়েই বাপ্পাদিত্য বলেছিল,
“— আজ কিন্তু তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে রণিতা !”
প্রতি উত্তরে সঙ্গে সঙ্গে রণিতা বলে ফেলেছিল,
” কেন, অন্য দিন কি আমাকে ভালো দেখায় না ?”
কথাটা বলে ফেলে রণিতা নিজেই যেন একটু অপ্রস্তুত বোধ করেছিল। তার পর বাপ্পাদিত্যর বাইকে উঠে ওর কাঁধে হাত রেখে রণিতা স্বাভাবিক করে নিতে বাপ্পাদিত্যকে বলেছিল,
” থ্যাংস বাপ্পাদা আজকের কমেন্টের জন্য।”
বাপ্পাদিত্য ধীরে ধীরে বাইকের গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল।

সাইকেল থেকে নেমে সুমিত দরজায় নক করে। ঋ উঠে এসে দরজা খুলে দিয়ে ঘরে চলে যায়। সুমিত ঘরের নির্দিষ্ট জায়গায় সাইকেলটা রেখে নিজের ঘরের দিকে ফিরতেই টেবিলে চোখ যায় তার ঢাকা জিনিস গুলোতে তার নজর পড়ল না। দেখল কতগুলো গিফট বক্স টেবিলে। এগিয়ে একটা বক্স হাতে নিলো,
” বাঃ ! এটা তো ঘড়ি মনে হচ্ছে। বেশ দামি । বাঃ! গোল্ডেন । এটা কি প্রাইজ পেলে ?”
বিছানা থেকে সুমিতের কথা সুস্পষ্ট কানে গেল রণিতার । এতক্ষণ বাড়ি ফিরে আজকের বিজনেস প্রোগ্রামে তার পাওয়া প্রাইজ, গিফট নিয়ে একটি কথাও সে শেয়ার করতে পারেনি এখনও। ঋ যেন এতটুকু উৎসাহ দেখাল না। তাছাড়া এতো ভালো খাবার গুলো এনে রণিতা ঋকে উৎসাহিত হতেও দেখেনি।
তবু গিফট নিয়ে সুমিতের প্রশ্ন শুনে রণিতা বিছানা ছেড়ে উঠে এলো।
সুমিতের হাতে নতুন সোনাটা কোম্পানির একটা আকর্ষণীয় গোল্ডেন কালারের লেডিজ ঘড়ি। সুমিত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে সেটা। রণিতা সামনে যেতেই সুমিত বলল,
” খুব সুন্দর প্রাইজ পেয়েছ। এটা তোমার অনেক দিনের সখ ছিল। কতদিন ভেবেছি, পরে ভুলে গেছি, কেনা হয়নি আর।
—- যাক মনে আছে তাহলে।
—- কিনব কিনব ভেবেছি, আজ না কাল করে হয়নি। তা বলে মনে ছিল না তা নয়।
তবে আজকে যখন প্রাইজ হিসেবে পেয়েছ, তখন এর মূল্য কিন্তু অনেক বেশি রণিতা।
—- কিন্তু ওটা প্রাইজ না। প্রাইজ এই দুটো, একটা প্রেশারকুকার আর এইটা একটা টি-সেট।
—- তাহলে ঘড়িটা ?
—- ঘড়িটা বাপ্পাদা পার্সোনালি আমাকে গিফট করেছেন।

(এরপর আগামী পর্বে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *