শবরী কথা
রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী
শবরীর নাম শোনেননি, এমন পাঠক খুব কম বলে বিশ্বাস। ছোট বেলায় শুনেছি নামটা। শবরীর কুটীর ছিল পঞ্চবটী বনের অন্তরালে সূর্যের আলো আর বিশাল বিশাল গাছের আলো আঁধারীর মধ্যে।
হিন্দীতে নাভাজি তাঁর কথা লিখেছেন:-
“বনমে রহত নাব শবরী কহত সব।
চহতি টহল সাধূ তন ন্যূনতাই হৈ।।
রজনীকে শেষ ঋষি আশ্রম প্রবেশ করি।
লকরীন বোঝ ধরি আবে মন ভাই হৈ।।…..”
পঞ্চবটী বনের সাধুদের পরস্পরের আলোচনা শুনে শুনে মর্যাদা পুরুষ শ্রীরামের প্রতি তাঁর অন্তরে শ্রীরাম ভক্তির সঞ্চার হয়। সারাক্ষণ শ্রীরাম কথা ও অন্যান্য ভগবৎ আলোচনা শোনার আগ্রহে সাধু মুনিদের তাঁর সেবা করার ইচ্ছে প্রবল থেকে প্রবলতর হতে লাগলো। তাই, প্রতি রাত্রে সবার অলক্ষ্যে বনজঙ্গল থেকে আহরণ করা শুকনো কাঠ তাঁদের আশ্রমে রেখে আসতেন। এছাড়া, তিনি মুনি সাধুদের যাতায়াতের পথ সকাল হবার আগেই নিজের হাতে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখতেন।
আবার অন্য দিকে বনেজঙ্গলে বিভিন্ন ফলের গাছে যা যা ফল পেতেন সেগুলো সংগ্রহ করে আগে নিজে মুখে দিয়ে চেখে দেখতেন, ফলটা সুস্বাদু কিনা। যদি সুস্বাদু হয়, সেই ফলটা আধ-খাওয়া অবস্থায় রেখে দিতেন। যদি কখনও শ্রীরামজীর দেখা মেলে তাহলে সেই সুস্বাদু ফল তাঁকে খাওয়াবেন। তাঁর এই ভাবনার পেছনে ছিল সরল হৃদয় এক ভক্তের বাঞ্ছা, প্রভুকে নিজের জানা শ্রেষ্ঠ খাদ্য দেয়া। হ্যাঁ, আচার নিষ্ঠা কিছুই তাঁর জানা ছিল না। তাঁর বিশ্বাস ছিল একদিন না একদিন তাঁর বাঞ্ছিত প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের দেখা মিলবেই। হঠাৎ করে দেখা হলে তাঁকে বসিয়ে রেখে কোথায় আর যাবেন এমন সুস্বাদু ফল আনতে ? তাই ভাল যা যা ফলমূল পেতেন এক একেকটা করে সেই ফলগুলোর স্বাদুতা নিজে একটু নমুনা হিসেবে খেয়ে দেখতেন। পছন্দের হলে সেসব একটা ঝুড়িতে রেখে দিতেন। বলা তো যায় না, কবে কখন তাঁর প্রভু এসে পড়বেন ! তাঁর ঝুটা বা এঁটো কিছু কাউকে দেয়া যায় না, সে সব ভাবনা তাঁর মাথায় ই আসতো না। শ্রীরাম একদিন না একদিন আসবেন, তা তাঁর বিশ্বাস ছিল।
এদিকে তপোবনের সাধুরা প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই তাঁদের আশ্রমে প্রচুর শুকনো কাঠের যোগান দেখে বিস্মিত হতেন। তাঁরা বিস্মিত হতেন যখন প্রতি প্রত্যুষে নদীতে স্নান করার পথ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন দেখে। এসব কে বিনা পারিশ্রমিকে রোজ রোজ করে যায়, তা তাঁরা বুঝতে পারতেন না।
তাই, একদিন রাত্রে সবাই ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করতে লাগলেন। রাতশেষে দেখলেন, চণ্ডাল কন্যা শবরী মাথায় বোঝাই শুকনো কাঠ নিয়ে আশ্রমের আসছেন। সবাই মিলে তাঁকে চেপে ধরলেন, কেন সে প্রতিদিন এরকম বেগার খেটে কাঠ আনেন আর তাঁদের যাতায়াতের পথ মার্জিত করে রাখেন ? শবরী কিছু বলার আগেই সাধুদের মধ্যে একজন, সম্ভবত তাঁর নাম ছিল মাতঙ্গ বা মতঙ্গ ঋষি, বুঝলেন যে শবরী ভক্তিমতী আর সেজন্যই সাধুদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি তাঁর সেবা ভাবের জন্য খুশী হয়ে তাঁকে শ্রীরাম নাম মন্ত্র দিয়ে দীক্ষিত করলেন।
তা’ দেখে অন্য সাধুরা তাঁকে নীচ জাতির মেয়েকে দীক্ষা দেবার অপরাধে একঘরে করে দিলেন। তিনি বুঝলেন তাঁর আর বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই। তাই তিনি শবরীকে বললেন – মা শবরী, এই জীবনে আমার আর শ্রীরাম দর্শন হবার নয়। তুমি কিন্তু প্রভুর আসার জন্য অপেক্ষা করো।”
একান্ত হরিভক্ত সাধু মতঙ্গ ঋষির প্রয়াণে অন্য সাধুরা শবরীকে বিভিন্ন ভাবে উত্যক্ত করতে উঠেপড়ে লাগলো। তাঁরা একমাত্র নদীতে এক ঘাটে শবরীকে স্নান করতে দিলনা। কয়েক দিনের মধ্যে সেই নদীর জল দূষিত হয়ে সাধুদের কেন, সকলের স্নানের অযোগ্য হয়ে পড়ল।
এরকম দিনে শ্রীরামচন্দ্র অনুজ শ্রীলক্ষণকে নিয়ে বনেজঙ্গলে সীতা মাতাকে খুঁজতে খুঁজতে শবরীদের বনে এসে উপনীত হলেন। আর শ্রীরাম ভক্ত শবরী অহরহঃ শ্রীরাম চিন্তনে থাকতে পছন্দ করেন। তিনি শ্রীরামকে শয়নে স্বপনে শ্রীরামকে স্মরণ করতেন। একথা জানতেন মর্যাদা পুরুষ অন্তর্যামী শ্রীরামচন্দ্র। তাই দুই ভাই এলেন শবরীর ই কুটিরের দরজায়। ভক্তের ভগবান তিনি। শবরী হঠাৎ শুনতে পেলেন তাঁর দরজায় তাঁর প্রভু শ্রীরাম এসে তাঁকেই ডাকছেন।
নাভাউজীর বর্ণনা শ্রীকৃষ্ণদাস বাবাজীর ভাষায় :-
“অমৃত নিন্দিত বাণী ভুবন মোহন ধ্বনি
আর তাহে স্নেহের সহিত।
শবরীর কর্ণে আসি প্রবেশিল সুধারাশি
কর্ণ পাতি রহে চমকিত।।
চারিদিক্ পানে চায় উন্মত্ত পাগলী প্রায়
স্তম্ভ যেন দাণ্ডায়া রহিল।
হেনকালে দয়াময় স্নেহে নেত্রে ধারা বয়
তথা আসি উপনীত হৈল।।……”
শ্রীরামচন্দ্রকে পেয়ে আনন্দে ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে কেঁদে ভাসান শবরী।অনেকক্ষণ শ্রীরাম-লক্ষণকে স্বাগত সম্ভাষণের ভাষা খুঁজে পাননা। এত আনন্দ ! বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লাগলো। তা’ দেখে অনিন্দ্য সুন্দর মুখ মণ্ডলে হাসি লগ্ন রেখেই শ্রীরাম অনুজ লক্ষণকে নিয়ে শবরীর কুটিরের দাওয়ায় বসে পড়লেন। শবরী ধাতস্থ হতেই নিজের ঘরের অভ্যন্তরে ঢুকে সহজ সরল ভক্তিতে তাড়াতাড়ি নিয়ে এলেন এতদিনের সঞ্চিত করে রাখা শুকনো আর তাঁর উচ্ছিষ্ট ফল। দু ভাই তা’ অমৃতের মত গ্রহণ করলেন। শবরী দুটি মাটির পাত্রে শুদ্ধ জল এনে দিলেন। তাও তাঁরা গ্রহণ করলেন। ভগবান জানেন, এ জগতের যা কিছু সবই তাঁর। তাই কোনো বাছবিচারের প্রয়োজন নেই। বরং, ভক্তিকে আগে প্রাধান্য দেবেন। ভগবান শ্রীরাম ও শ্রী রামানুজের এধরণের কৃপা পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করলেন শবরী তাই তিনি ভক্তিতে কাঁদেন, আহ্লাদে কাঁদেন, তাঁর যেন কোনো সম্বিৎ
রইলো না। শবরীর সাধনার, অপেক্ষার সাফল্য দেখে যে কোনো ভক্ত উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হতে পারেন।
দিব্যতনু দুই ভাই একসময় নদীর কাছে গিয়ে ঐ আশ্রমের সাধুদের কাছে জানতে চাইলেন নদীর ঐ ঘাটের জল দূষিত হল কী করে ? উপস্থিত আশ্রমিকরা বললেন এক সময় চণ্ডাল কন্যা শবরীও একই ঘাটে স্নান করতে আসতো। তবে এখন শবরীকে এই ঘাটে আসতে দেয়া হয় না। তা’ তাঁদের কাছে জেনে শ্রীরাম বললেন – …..শবরীর পদতল। জলে স্পর্শ কৈলে জল হইবে নির্মল।।….”
তখন আশ্রমের সাধুরা স্তুতি নতি করে জলে নামিয়ে দিলে, নদীর জল আবার আগের মত শুদ্ধ হয়ে গেল।
এরপর শ্রীরামচন্দ্র শবরীকে নবধা ভক্তির কথা বললেন :-
১. সাধু সৎসঙ্গ, ২.ভগবানের লীলাকীর্তনে অনুরাগ, ৩. অহঙ্কার শূণ্য হয়ে গুরুর পাদপদ্ম সেবা, ৪. ভগবানের গুণকীর্তন, ৫.ভগবানের নাম জপ ও তাঁর প্রতি অটুট বিশ্বাস, ৬. ইন্দ্রিয় সংযম ও সচ্চরিত্র থাকা, ৭. সমস্ত জগতকে ভগবানময় দেখা, ৮.যথালাভে পরিতুষ্ট থেকে সরলতা ও নিষ্কপট ব্যবহার আর ৯. ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রেখে , পরদোষ না দেখে সব সময় সুখে দুঃখে অবিচল থাকা।
শ্রীরাম এরপর শবরীর কাছে মা সীতা দেবীর কোন সন্ধান পাওয়া যায় কিনা জানতে চাইলেন। মহানুভব অন্তর্যামী ঈশ্বরের অজানা কিছু থাকার কথা নয় জেনেও প্রভুর লৌকিক প্রশ্নের উত্তর দিলেন – হে রঘুনাথ, তুমি পম্পা সরোবরের কাছে গেলে সুগ্রীবের সঙ্গে মিলন হবে। তিনিই সব রকমের সহযোগিতা করতে তোমার সঙ্গে থাকবেন। তবে হে ধীরমতি প্রভু, তুমি আমায় জিজ্ঞেস করছ !
“পম্পা সরহি জাহু রঘুরাই।
তহঁ হোইহি সুগ্রীব মিতাঈ।।
সো সব কহিহি দেব রঘুবীরা।
জানতহুঁ পূছহু মতিধীরা।।”
সাধক কবি তুলসীদাস শবরী প্রসঙ্গে লিখেছেন:-
“অধম তে অধম অধম অতি নারী।
তিন্ হ মহঁ মৈঁ মতিমন্দ অঘারী।।
কহ রঘুপতি সুনু ভামিনী বাতা।
মানউঁ এক ভগতি কর নাতা।।”
যে অধম থেকেও অধম নারী, সেই অধমেরও অতি অধম, হে পাপনাশন রঘুপতি ঈশ্বর আমার ! আর তার উপরেও আমি অতিশয় মন্দবুদ্ধি। শ্রীরাম বললেন – হে ভামিনী, আমার কথা শোন, আমি তো শুধু ভক্তির সম্বন্ধই স্বীকার করি।”
“জাতি পাঁতি কুল ধর্ম বড়াঈ।
ধন বল পরিজন গুণ চতুরাঈ।।
ভগতি হীন নর সোহই কৈসা।
বিনু জল বারিদ দেখিঅ জৈসা।।”
জাতি, শ্রেণী, কুল, ধর্ম, মান, ধন, শক্তি, কুটুম্ব, গুণ আর বিচক্ষণতা এই সব কিছু থাকলেও ভক্তিহীন মানুষ কেমন? না জলহারা মেঘ যেমন তেমনই।
প্রকৃত ভক্ত ঈশ্বরের কাছে কিছুই চাননা। শুধু তাঁকে চান। শবরী শুধু তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে ঈশ্বরের দর্শন চেয়েছেন। ধন্য শবরী।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রায়ই বলতেন :-
“চণ্ডালোহ পি দ্বিজ শ্রেষ্ঠঃ (মুনি শ্রেষ্ঠো) হরিভক্তিপরায়ণঃ।
হরিভক্তিবিহীনশ্চ দ্বিজোহ পি শ্বপচাধমঃ।।”
অর্থাৎ চণ্ডালও যদি হরিনাম করে আর কোন ব্রাহ্মণ যদি হরিনাম না করে, তাহলে চণ্ডালই শ্রেষ্ঠ।
শ্রীমদ্ভাগবতে প্রহ্লাদের বলেন :-
“যেষাং সংস্মরণাৎ পুংসা সদ্যঃ শুধ্যন্তি বৈ গৃহাঃ।
কিং পুনর্দ্দর্শনস্পর্শপাদশৌচাসনাদিভিঃ।।”
অর্থাৎ, যাঁদের স্মরণমাত্র ই মানুষের গৃহ সদ্য পবিত্র হয়। তাঁদের দর্শন স্পর্শন পাদ প্রক্ষালন ও আসনদান দিয়ে কীযে হয় তা আর কী বলবো !
এহেন ভক্তিমতী শবরী চণ্ডাল হলেও সকলের নমস্যা। আমরাও শবরীর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাই।
ঋণ স্বীকার : নাভাউজী রচিত ও শ্রীমৎ কৃষ্ণদাস বাবাজী অনূদিত শ্রীশ্রী ভক্তমাল গ্রন্থ, বসুমতী কর্পোরেশন কর্তৃক প্রকাশিত, ষষ্ঠ সং, ১৪০৫ এবং তুলসীদাস রচিত রামচরিত মানস, গোরক্ষপুর (গীতা ) প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত।