ভানুসিংহ বন্দিছে
রাধাকৃষ্ণ (রাধু) গোস্বামী
কিশোর বয়সেই আমাদের প্রিয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি টান লক্ষ্য করা গেছে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি টান, স্নেহ, সখ্যতা, ভক্তি, ভালোবাসা, আত্ননিবেদনের ভাব অনেকেরই ছিল আর আছেও। এই বিষয়ে ভুরি ভুরি আলোচনা যুগে যুগে হয়েছে এবং হয়ও। বর্তমান লেখায় সে সম্পর্কে কোন আলোচনা করার স্পর্ধা করে সাধারণ পাঠকদের বিরক্ত বা বেশি পুলকিত করার ইচ্ছে নেই। তবে শ্রীকৃষ্ণের স্বভাব নিয়ে অনেক কথার মধ্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরচিত শ্রীশ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের একটি শ্লোক স্মরণ করা যেতে পারে।
” প্রভু কহে কৃষ্ণের এক স্বভাব বিলক্ষণ।
স্ব মাধুর্যে করে সদা সর্ব আকর্ষণ।।” (চৈ.চ. মধ্য, নবম পরিচ্ছেদ)
অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের মাধুর্য অন্য সকলকেই আকর্ষণ করে থাকেন, এমনকি নিজেকেও।
কাজেই বিশ্বকবির শ্রীকৃষ্ণের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল বা তিনিই তাঁকে আকর্ষণ করতেন, একথা বলা যায়। কৈশোরকালে কবি বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জয়দেব প্রমুখ শ্রীকৃষ্ণের উপর যাঁরা গান কবিতা রচনা করেছিলেন পড়ে নিজে মুগ্ধ হয়েছেন। মুগ্ধ হয়েছেন শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির প্রতি। এই মুগ্ধতা চলেছে তাঁর সারাজীবন, তাই মাঝেমাঝেই তাঁর বিভিন্ন লেখায় ‘ বাঁশি ‘ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। বাল্য বয়স থেকে বাংলার প্রথম শামুকের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়েছিলেন যিনি সেই শ্রীগৌরাঙ্গ বা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রতিও তিনি ছিলেন যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। হয়তো বলা যায় শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু তাঁর বিভিন্ন প্রেরণার অন্যতম প্রেরণাও ছিলেন।
আমরা বরং বিশ্বকবির কিশোর বয়সের ‘ ভানুসিংহের পদাবলী ‘ নিয়ে দু’একটা কথা বলে নিই। পদাবলীর যে ভাষাকে ব্রজবুলি বলা হয় তাতে তাঁর বাল্য বয়সেই কৌতূহল জন্মেছিল। শব্দতত্বের প্রতি তাঁর স্বাভাবিক ঔসুক্যে তিনি টিকায় দেয়া শব্দার্থগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করে নিজের স্বাধীন বিবেচনায় অর্থাদি একটি বাঁধনো খাতায় অভ্যাসবশত, লিখে রাখতেন। খাতাটি অজস্র শব্দে ভ’রে উঠেছিল। কিছুদিন পর সেই খাতাটি এক তৎকালীন বিখ্যাত কাব্যবিশারদ বিদ্যাপতির টিকা সহ সংস্করণে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু, কবি আর খাতাটি ফেরৎ পাননি। তা সত্বেও অমর কবি ‘ ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী ‘ র কবিতাগুলো লিখে ফেলে বাড়ির সকলকে চমৎকৃত করে দেন। আর তাতে যেন বেশি করে কবির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে।
বাল্যকালের বছর চৌদ্দ-পনেরোয় রচনা হলেও কুড়িটি ও সঙ্গে দু’টি সংযোজন নিয়ে বাইশটি পদাবলীতে ‘ ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী ‘পরিব্যাপ্ত। তবে, তা মুদ্রিত হয়েছে অনেক বছর পরে ১৯৪০ সালে। কাজেই, এটা স্বাভাবিক যে, দীর্ঘদিন পড়ে থাকা পদাবলীগুলি মাঝে মাঝেই পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের সুযোগ পেয়ে আরও পরিণত কাব্যফসলের রূপ নিয়েছে। আমরা পেয়েছি উন্নত , রুচিসম্মত ও পরিণত পদাবলী।
কিশোর কবি খেলার চ্ছলে একটি স্লেটের উপর পদাবলী লেখার অভ্যাস করতে গিয়ে লিখে ফেলেছিলেন :-
“গহন কুসুমকুঞ্জ মাঝে
মৃদুল মধুর বংশী বাজে।”
ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীর ১নং গানটি শুরু হয়েছে :-
“বসন্ত আওল রে…..” দিয়ে।
বসন্তের আগমনে বিশ্বপ্রকৃতি যেন নিজের রূপকে ফুটিয়ে তুলতে চায়। মধুকর গুণগুণ করে কানের পাশ দিয়ে গেয়ে যায়। আম গাছ গুলি সেজে ওঠে মঞ্জরীর মত হাজার হাজার মুকুলে। গাছের ডাল পাতারা যেন মুকুলের ভারে হয়ে যায় অবনত। তবু মন উদাস হতে থাকে। হাজারো মুকুলের ক’টাই বা থাকবে শেষ পর্যন্ত ! বাজতে থাকে হাহাকারের সুর, বিরহের সুর। সে সুরে সুর মিলিয়ে গেয়ে ওঠে মিলনোৎসুক কোকিলরা। চলে কোকিলের কোলাহল, চলে অহরহঃ কোকিলকুলের কান্না।
যেন বিরহিনী শ্রীমতী রাধার কথাই বলে :-
” …বসন্তভূষণভূষিত ত্রিভুবন
কহিছে, দুখিনী রাধা
কঁহি রে সো প্রিয়, কঁহি সো প্রিয়তম,
হৃদি বসন্ত সো মাধা ?…….”
কঠিন হৃদয় অত্যাচারী দুর্মতি রাজা কংসের হয়ে ক্রুর নন অক্রুর এসে দাদা বলরাম সহ শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে চলে গেলেন রাজধানী মথুরায়। কিন্তু প্রিয়তম কানাইয়ের আর তো ফেরার লক্ষণ নেই। অজস্র সখীদের ও শ্রীমতীর হৃদয় বসন্ত মাধব ফিরে এলো না বৃন্দাবনে। অজস্র সখীদের মধ্যমণি শ্রীমতী রাধা তা’ সইবেন কী করে ! তিনি তো পাগলিনীপ্রায় !
কিশোর কবি, ভবিষ্যতের বিশ্বজয়ী কবি ততদিনে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর পূর্বজ পদাবলী রচয়িতাদেরর বিশেষ করে বিদ্যাপতির রচনা আস্বাদন করে ফেলেছেন। তাঁদের ভাষার মাধুর্যের, ছন্দ প্রয়োগে আর অলঙ্কার নির্বাচনে মুগ্ধ হতেন।
‘ সখি, কি পুছসি অনুভব মোয় ‘ (বিদ্যাপতি)।
২নং পদাবলী গানে একমাত্র নিরাশা:-
“……কুঞ্জ কুঞ্জ ফেরনু সখি শ্যামচন্দ্র নাহি রে।….”
সারারাত বিরহিনী কুসুমহার বহন করে করে ক্লান্ত, অবসন্ন তার আর বহন করার সামর্থ্য নেই। হৃদয়ে রয়েছে বিরহজ্বালা। শ্যামহীন কুঞ্জ যেন তা আরও বাড়িয়ে দেয়। কবি লেখেন :-
“……… ভানু গায় শূণ্যকুঞ্জ শ্যামচন্দ্র নাহি রে!”
তবুও সখিরা সান্ত্বনা দেবার প্রয়াসে থাকে :-
” ……চল সখি গৃহ চল, মুঞ্চ নয়ন জল,
চল সখি চল গৃহ কাজে।…..”
তবুও শ্রীমতীর ক্ষীণ আশা, যদি শ্যাম আসে তার মোহন বাঁশিটি সঙ্গে লয়ে ! তাই হৃদয় বলে :-
“…..তৃষিত প্রাণ মম দিবস যামিনী
শ্যামল দরশন আশে
আকুল জীবন তেহ ন মানে,
অহরহ জ্বলত হুতাশে।…..” (৩)
ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীতে আবার দেখি , বিরহনী আশায় আশায় মুগ্ধ হয়েও কেমন হতাশ হয়ে পড় :-
“…..মুগধ মৃগীসম চমকি উঠ ই কভু
পরিহরি সব গৃহকাজে
চাহি শূন্য-পর কহে করুণ স্বর —
বাজে রে বাঁশরি বাজে।…..”
ভাবেন, কানহাইয়া যেন নিষ্ঠুর ! তিনি সে সব ভেবে আকুল :-
” নিঠুর শ্যামরে, কৈসন অব তুঁহু
রহ ই দূর মথুরায় —
রয়ন নিদারুণ কৈসন যাপসি,
কৈস দিবস তব যায়। “
তিনি উৎকন্ঠিতাও :-
“…..কৈস মিটাওসি প্রেমপিপাসা,
কঁহা বাজাওসি বাঁশি ?..…”
এছাড়া সঙ্গে থাকে কিঞ্চিৎ সন্দেহও:-
“…..পীতবাস তুঁহু কথি রে ছোড়লি,
কথি সো বঙ্কিম হাসি ?
কনকহার অব পহিরলি কন্ঠে,
কথি ফেকলি বনমালা ?
হৃদিকমলাসন শূন্য করলি রে,
কনকাসন কর আলা !…..” (৪)
শ্যাম যে এখন রাজবেশধারী । কন্ঠে তাঁর বনমালার পরিবর্তে দুলছে কনকহার। আবার যেন আশার রেশ মৃদু কম্পন এনে দেয় ,
তাই সহচরীদের প্রতি নির্দেশ দেন :-
“….সহচরি সব, নাচ নাচ
মিলন গীতি গাও রে।
চঞ্চল মঞ্জীর রাব
কুঞ্জগগন ছাও রে ।……”
প্রিয়তম আসবেন। তিনি আসার আগেই সব কাজ সেরে রাখতে হবে।সুন্দর করে সাজসজ্জা করতে হবে। নতুন করে আবার কুঞ্জ সাজিয়ে রাখতে হবে। তিনি এসে যেন দেখেন সব ঠিকঠাক আছে। আরে সখি, তিনি যে কোনো সময় চলে আসতে পারেন।
স্বয়ং কবি ভানুসিংহও তৃষিত নয়নে শ্রীমতী রাধিকার প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণের আগমন পথ কুঞ্জ পথের দিকে চেয়ে আছেন। যেন তাঁরও মনে হয় তিনি আসছেন :- “…….মৃদুল গমন শ্যাম আওয়ে
মৃদুল গান গাহিয়া।” (৫)
এরকম দৃশ্য দেখতে ভক্তের ভাল লাগে, ভালো লাগে ভানুসিংহেরও।
বৃন্দাবনের কুসুম বিছানো পথে প্রাণধন শ্রীকৃষ্ণের আগমন দেখতে কোন্ ভক্তের না ভাল লাগে ? সেখানে শ্রীমতী রাধা আর তাঁর সখীরা তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকবেন, এতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে ? বিশেষ করে মুখে তাঁর গুণগুণ গান, তাতে রাধা নাম অবিরাম। তা আন্দাজ করে যেন বলতে চান :- ” বধুঁয়া, হিয়া’পর আওরে,
মিঠি মিঠি হাসয়ি , মৃদু মধু ভাষয়ি
হমার মুখ’ পর চাও রে !”
চিরন্তন নায়ক নায়িকার পুনর্মিলন হলে এই জগৎ চরাচর পুলকিত হয়ে উঠবে। এই জগৎতো চিরকাল শ্রীরাধারমণের মিলনসুখে সুখী দেখে সুখী হতে চায় :- “.. হরখে পুলকিত জগতচরাচর
দুঁহুক প্রেমরস ভোর ।” (৬)
এই জগতের অজস্র ভক্ত জনেরা তাঁদের প্রেমের ঠাকুর ঠাকুরাণীর অনন্ত অচ্ছেদ্য মিলনের দর্শন আকাঙ্ক্ষায় সদা উৎসুক। বিরহিনী মিলন
সুখে বিভোর হয়ে থাকতে চান। হতে পারে বিরহের শোকে যমুনার জল ও স্তম্ভিত হয়ে গেছে। তবু শ্যাম স্মৃতিতে হৃদয় ভরপুর হয়ে আছে। তাইতো শ্রীমতী রাধা জানান :- “শুন সখি, বাজত বাঁশি
গভীর রজনী , উজল কুঞ্জপথ,
চন্দ্রম ডারত হাসি। ….”
তবুও তিনি উদাস হয়ে যান যখন দক্ষিণ বাতাসে আসে নিয়ে সুবাস কুসুমের। মনে হয় শ্যাম আছেন কাছাকাছি। কেননা তিনি তো এই এসে পড়লেন বলে :- ” ……শুনত শুনত তব মোহন বাঁশি
জপত জপত তব নামে,
সাধ ভ ইল ময় দেহ ডুবায়ব
চাঁদ উজল যমুনামে ! …..” (৭)
বিরহিনী রাধারাণী ব্যাকুলতা যেন বাড়তেই থাকে। তৃষিত আঁখি দুটি মেলে তাকিয়ে থাকেন। এর মধ্যে তাঁর মনে হল :-
” গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে
মৃদুল মধুর বংশি বাজে,
বিসরি ত্রাস-লোকলাজে
সজনি, আও আও লো।……”
ভানুসিংহ শ্রীমতীর বিরহ বেদনায় হন ব্যথিতও। তিনি যেন শুনতে পান রাধারাণীর আকুল হয়ে সখীদের ডেকে ডেকে বলছেন, তাঁরা শ্রীগোবিন্দের দর্শন পাবেন :- “……আও আও সজনিবৃন্দ,
হেরব সখি শ্রীগোবিন্দ,
শ্যামকো পদারবিন্দ
ভানুসিংহ বন্দিছে।।” (৮)
একি ভ্রম ? বিরহিনী শুনতে পান যেন প্রিয়তম এসেছেন। হঠাৎই তাঁর মনে হল কুঞ্জে এসে হাজির তাঁর প্রিয়তম :-
“…….সহসা রাধা চাহল সচকিত,
দূরে খেপল মালা,
কহল – সজনি শুন, বাঁশরি বাজে,
কুঞ্জে আওল কালা। ……” (৯)
বিলাপ করেন। আবার তিনি বাজান না মোহন বাঁশি। কত আশা, কত সুখ, কত প্রেম ! সব মনে পড়ে :-
” বজাও রে মোহন বাঁশি।
সারা দিবসক বিরহদহনদুখ,
মরমক তিয়াষ নাশি।
রিঝমনভেদন বাঁশরিবাদন
কঁহা শিখলি রে কান ? ….”
তিনি তো ভুলতে পারেন না যে এক সময় রাধা রাধাময় ছিলেন এই কানহাইয়া। তাই আজও মনের সাধ :-
“……সাধ যায়, ইহ চন্দ্রমকিরণে
কুসুমিত কুঞ্জবিতানে
বসন্তবায়ে প্রাণ মিশায়ব
বাঁশিক সুমধুর গানে।
প্রাণ ভৈবে মঝু বেণু গীতময়,
রাধাময় তব বেণু । …”
কবি নিজের উচ্ছ্বাস আর চেপে রাখতে পারেন না। বিগলিত হয়ে তিনি গেয়ে ওঠেন :-
জয় জয় মাধব, জয় জয় রাধা,
চরণে প্রণমে ভানু। ” (১০)
ভানুসিংহ মানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তা আমরা সবাই জানি । তিনি নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম ভাবনা বা বিশ্বাসের প্রতি কখনোই পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করেন নি। কোনো বিশ্বাসের প্রতি বিরূপতাও প্রকাশ করেন নি। তবুও শ্রীকৃষ্ণের ও শ্রীমতী রাধারাণীর দিব্যপ্রেমের অনুভবে তিনি এতই উৎসাহিত যে কবি স্বাভাবিক ভাবেই ভক্তি নত মস্তকে প্রণাম না জানিয়ে পারলেন না। নিজের অজান্তে প্রায় বাধ্য হয়েই জয়ধ্বনি দিয়েছেন, যা বহুদিনের সাধকদের কাছেও বিস্ময় হয়ে উঠতে পারে।
বিরহিনী রাধারাণীর মিলনাকাঙ্খা যেন কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বাধা না হয়ে দাঁড়ায় ! তবুও নিশ্চিত হবার কোন উপায় নেই, তাই জেগে রয় শঙ্কা। এ শঙ্কা নিয়ত চলে অভিসারের। তবে আজ চলছে অনুকূল পরিবেশ :-
” আজু সখি, মুহু মুহু
গাহে পিক কুহু কুহু,
কুঞ্জবনে দুঁহু দুঁহু
দোঁহার পানে চায়।
যবনমদবিলসিত
পুলকে দিয়া উলসিত,
অবশ তনু অলসিত
মূরছি জনু যায়।……”
আজ কেমন যেন উল্লাসের পরিবেশ সমগ্ৰ প্রকৃতিতে। কুঞ্জবনে রাধাকৃষ্ণের অনুপস্থিতিতে পাখিরা পর্যন্ত বিস্মিত হয়ে মুখ চাওয়াচায়ি
করছে। আকাশে মধুর চাঁদের প্রাণ পাগলকরা জ্যোস্নার বিস্তার। সম্ভাব্য আনন্দে দেহমন যেন উন্মুখ হয়ে উঠেছে। তাই অপেক্ষমানা শ্রীমতী একাকিনী চোখভরা জল নিয়ে বসে থাকেন আর :-
“…..ঝর ই শিরে ফুলদল,
যমুনা বহে কলকল,
হাসে শশী ঢলঢল —
ভানু মরি যায়।” (১১)
শ্রীমতী তো আবার শ্যামের প্রতি, তার দিব্যপ্রেমের প্রতি ঋণের স্বীকার করেন। আহা, তাঁর প্রিয়তম শ্যাম ঘুমিয়ে আছেন। তাই তিনি স্বপ্ন দেখেন :-
“……নীদ-মেঘ’পর স্বপনবিজলিসম
রাধা বিলসত হাসি !
শ্যাম, শ্যাম মম, কৈসে শোধব
তুঁহুক প্রেম ঋণরাশি ।…..”
শ্রীমতী রাধার আক্ষেপ এই রাত তো একসময় ফুরিয়ে যাবে । তাই , চাঁদকে অনুরোধ করেন আরও শীতল জোসনাধারা দিয়ে শ্যমের নিদ্রা দীর্ঘস্থায়ী করতে। আকাশের তারারা যেন তড়িঘড়ি পালিয়ে না যায়। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে সূর্য আবার উঠে পড়ে। সে এলেই শ্যাম উঠে চলে যাবে :-
” …….নিরদয় রবি, অব কাহ তু আওলি,
জ্বাললি বিরহক আগি।…….”
স্বপ্ন কি কখনো কথা শোনে ? স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে আবার তো বিরহের আগুনে পোড়া শুরু হয়ে যাবে। এখানে কবি ভানুসিংহ ও শ্রীমতীর প্রতি সমব্যথী :-
“…….ভানু কহত — অব রবি অতি নিষ্ঠুর
নলিন-মিলন অভিলাষে
কত নরনারীক মিলন টুটাওত,
ডারত বিরহুতাশে। ” (১২)
সত্যিতো আর মিলন হয় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও অভিসার হতে পারে। তবু শঙ্কা, শঙ্কা থাকে অভিসারে, নিয়ত অভিসারের। শ্রীকৃষ্ণ প্রেমের জন্য অভিসার চলেছে অনন্তকাল থেকে। তার আর শেষ নেই। শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়া কি সহজ নাকি ! শ্রীমতীতো তাঁর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে রয়েছেন ই। তবু তাঁদের অনন্তলীলার মাঝখানে লীলা চ্ছলে শ্রীমতীর বিরহকাতরতা। মথুরাবাসী শ্রীকৃষ্ণ কি আর ফিরবেন ? তবুও রাধা অভিসারে যাবেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা ভাবলে হবে না। আসুক না বাধা :- “সজনি গো,
শাঙন গগনে ঘোর ঘনঘটা,
নিশীথ যামিনী রে।
কুঞ্জ পথে , সখি, কৈসে যাওব
অবলা কামিনী রে।……..” (১৩)
ভানুসিংহ যেন এক নতুন মাত্রায় নিয়ে গেলেন অভিসারকে। বিরহিনী জানেন শূন্য কুঞ্জ, কানহাইয়া শ্যাম সেখানেতো নয়ই ,বৃন্দাবনেও নয়, তিনি এখন মথুরাবাসী। অভিসার কিসের জন্য ? এযেন কল্পনার মধ্যে কল্পনা। অভিসার শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে। তবুও থাকে উৎকণ্ঠা। প্রিয়জনের জন্য সব সময়ই থাকে উৎকণ্ঠা :- ” বাদরবরঘন নীরদ গরজন
বিজুলী চমকন ঘোর,
উপেখ ই কৈছে আও তু কুঞ্জে
নিতি নিতি, মাধব মোর।……” (১৪)
এবার যেন প্রিয়তমের প্রেমে গদ্ গদ্ প্রিয়তমা প্রেমিকা শ্রীরাধা। তাঁর মনে হয় এতদিনে শ্যাম তাঁকে আদরে আদরে ভরিয়ে তুলছেন। একথা ভাবনায় ভাবতা তিনি স্বগতোক্তি করেন :- ” মাধব, না কহ আদরবাণী,
না কর প্রেমক নাম।
জানয়ি মুঝকো অবলা সরলা
ছলনা না কর শ্যাম। ……”
অথচ, কতবার যে তিনি অভিমান করেছেন ! হয়তো বা অনেক কেটু ইঙ্গিত করে ফেলেছেন। সে জন্য তাঁর মনে রয়েছে অপরাধবোধ। আজ যেন তিনি মার্জনা চাইছেন। স্বীকারোক্তি করছেন যে কখনো আর নির্দয় বাক্যবাণে প্রিয়তমকে ব্যথা দেবেন না। তিনি তাই তাঁর প্রিয়তমকে বলেন :-
“……মাধব, কাহ তু মলিন করলি মুখ,
ক্ষমহ গো কুবচন মোর।
নিয়ত বাতি অব কবহুঁ ন বোলব,
তুঁহু মম প্রাণক প্রাণ।……” (১৫)
শ্রীমতী রাধারাণী স্বপ্নের মধ্যেই নাহয়, মিলন দেখে খুশি থাকতে চান।স্বপ্ন ! সে তো স্বপ্নময় জগতে সত্য। মনে পড়ে :-
“……হাসয়ি হাসয়ি নিকটে আসয়ি
বহুত প্রবোধ দেল,
হাসয়ি হাসয়ি পলটায় চাহয়ি
দূর দূর চলি গেল।……….”
আবেগ ভেজা কন্ঠে তিনি স্বপ্ন ছেড়ে আরও বলেন :-
“…….অব সো মথুরা পুরক পন্থমে,
ইঁহ যব রোয়ত রাধা,
মরমে কি লাগল তিলভর বেদন,
চরণে কি তিলভর বাধা ?…..”
কবি ভানুসিংহ বলেন :- ” ……হাসিবার তর সঙ্গ মিলে বহু,
কাঁদিবার কো নাই। ” (১৬)
বিরহিনী শ্রীমতী রাধারাণী দিন দিন তাঁর সাধের কানু অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের মথুরা থেকে ফিরে আসার স্বপ্ন দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে যেন সন্দেহ প্রকাশ করে পরম অভিমানে বলে ফেলেন :- ” বার বার সখি, বারণ করনু,
না যাও মথুরামে।……….”
তিনি আবার প্রশ্ন করেন :- “….বোল ত সজনি, মথুরাধিপতি
সো কি হমারই শ্যাম ?……….”
তিনি আরও জানান :- “….নব নগরে সখি নবীন নাগর
উপজল নব নব রঙ্গ।……..” (১৭)
শ্রীমতী অভিমান করে বলেন :- “…..ফুকারবে যব রাধা রাধা
মুরলি উরধ শ্বাসে,
যব সব গোপিনী আসবে ছুটই,
যব হম আসব না,
যব সব গোপিনী জাগবে চমকই,
যব হম জাগব না,
তব কি কুঞ্জপথ হমারি আশে
হেরবে আকুল শ্যাম ?………” (১৮)
আঃ, অনেক হয়েছে। আর যে পারা যায় না। এ জ্বালা বিরহের জ্বালা। তাতে দগ্ধ হয়ে শ্রীমতী যেন বাধ্য হয়েই বলেন :-
” মরণ রে,
তুঁহু মম শ্যামসমান।….”
আবার, বারবার তিনি শ্যামবিরহে কাতর হয়ে পড়েন। তিনি বলেন :-
“….মরণ রে,
শ্যাম তোঁহার ই নাম !.……” (১৯)
সহ্য হয় না আর বিরহ জ্বালা। মরণ পর্যন্ত কামনা করে করে আক্ষেপে অভিমানে তিনি বলেন :-
“…..বাঁশরিধ্বনি তুহ অমিয় গরল রে,
হৃদয় বিদারয়ি হৃদয় হরল রে, ………” (২০)
কবি ভানুসিংহ ঠাকুরের মনে হয়েছিল এই কুড়িটি পদাবলীতে শ্রীমতী রাধারাণীর শোকগাথা, বিরহব্যথা, অভিমান, মিলনের আকাঙ্খা ও স্বপ্ন দেখার কথা শেষ করা হয়ে ওঠেনি। তিনি জানতেন শ্রীকৃষ্ণকথা এবং শ্রীমতীর ব্যাকুলতার কোন শেষ হয় না। তবু, তিনি চিঠিলেখার শেষে ‘পুনশ্চ ‘ লেখার মত ঢংএ আবার দু’টি সংযোজন করেছেন।
(১) এ কবি ভানুসিংহ শ্রীমতী রাধার বয়ানে বলেছেন:-
“…..সকল তয়াগব লভিতে শ্যামক
একঠো আদর বাণী।…….”
শ্যাম তাঁর, যেন শুধুই তাঁর। তিনি গাইলেন :-
“……সখিলো —
বৃন্দাবনকো দুরুজন মানুখ
পিরীত নাহিক জানে,
বৃথাই নিন্দা কাহ রটায়ত
হমার শ্যামক নামে ?…..”
(২) এ কবি শ্রীমতীর দুঃখে সমব্যথী হয়ে পড়েন। তিনি তাই শ্রীকৃষ্ণকে অনুরোধ করেন তিনি যেন শ্রীমতীকে আর দুঃখ না দেন। শ্রীমতী কেঁদে কেঁদে বলেছেন :- “…..জনম অভাগী, উপেখিতা হম,
বহুত নাহি করি আশ, —
দূর থাকি হম রূপ হেরাইব,
দূরে শুন ইব বাঁশি।……”
ভানুসিংহ যেন শ্রীকৃষ্ণকে অনুরোধ করে বলেন :-
“….ভানু সিংহ ভনয়ে, শুন কালা
দুখিনী অবলা বালা —
উপেখার অতি তিখিনী বাণে
না দিহ না দিহ জ্বালা।”
কৈশোর থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করে রচিত ‘ ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী ‘ বৈষ্ণব কবিদের কাছে আজও পরম বিস্ময়। কবির ভাবনা অনুসরণ করে আবার (৮) ক্রমিক সংখ্যার পদাবলীর শেষ দুটি স্তবক উল্লেখ করে আমরাও নত হয়ে শুনি :-
“…..দেখ সজনি, শ্যামরায়
নয়নে প্রেম উথল যায়,
মধুর বদন অমৃতসদন
চন্দ্রমায় নিন্দিছে।
আও আও সজনিবৃন্দ,
হেরব সখি শ্রীগোবিন্দ,
শ্যামকো পদারবিন্দ
ভানুসিংহ বন্দিছে।।”