লিয়াকত চাচা
দীপক মান্না
‘লিয়াকত চাচা বাড়ি আছো নাকি?’ পরিমল সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়ায়। তারপর হুমড়ি খাওয়া খড়ের ঘরের সামনে এসে হাঁক দিতে লাগল। কিছুক্ষণ পর ঘরের ভিতর থেকে এক হাত ঘোমটা দেওয়া এক মাঝ বয়সী মহিলা বেরিয়ে আসে।
‘কারে চাই?’
‘বলছিলাম কি লিয়াকত চাচা বাড়ি আছে?’
‘হ্যাঁ, আসে, ঘরের ভিতর শুইয়া আসে।’
‘আপনি?’
‘আমি উনার ইস্ত্রি।’
লিয়াকত চাচা যে বাড়ি আছে এই জেনে পরিমল মনে মনে বেশ খুশি হয়। এমন লোকের দর্শন পাওয়া সাপের পাঁচ পা দেখার সমান। তার ওপর আবার শীতকালে। খুব ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে একবার এসেছিল। সে শুনেছে লিয়াকত চাচার মতো নলেন গুড় এই নদীয়া জেলায় আর কেউ বানাতে পারে না। ওনার গুড়ের নাকি বিরাট নামডাক। বহু দূর থেকে মানুষ গুড়ের খোঁজে মৌমাছির মত ছুটে আসে। মিষ্টি গন্ধে ঘর নাকি ম ম করে। সেই গন্ধে পরিমলেরও তাই তার কাছে ছুটে আসা। তাছাড়া প্রায় একমাস হতে চলল তার কাকা লন্ডন থেকে উড়ে এসেছে। আর কদিন পরেই ফিরে যাবে। তাই প্রবাসী কাকার হাতে যাবার আগে কয়েকটা মুচি তুলে দিতে চায়। এদেশে আসার সময় তার কাকা অফিস কলিগদের কথা দিয়েছে যে এবার দেশ থেকে ফিরে এসে নলেন গুড়ের পিঠে খাওয়াবে। ওখানে নাকি তেমন একটা পাওয়া যায় না। তাই ভাল গুড় দিতে না পারলে মান সম্মান থাকে না।
‘চাচাকে একটু বাইরে ডাকবেন?’
‘সে বিছানা থিকে নামতি পারবেক লাই, সে যে আর ভালো করি খাড়া হতি পারে না।’ – স্ত্রীটি বলে। দুজনের কথাবার্তা শুনে লিয়াকত চাচা ভিতর থেকে বলে উঠল – ‘কে? কে ডাকছে?’ তার স্ত্রী বলে – ‘এক ভদ্দর নোক তুমার সাথে দেখা করতি চায়।’ লিয়াকত বলে – ‘উনারে ভিতরে পাঠাও।’
লিয়াকতের স্ত্রী পরিমলকে ভিতরে যেতে বলে। পরিমল পাশের একটা খেজুর গাছে সাইকেলটা ঠেকিয়ে ঘরের ভিতর ঢোকে। ঘরের ভিতরটা আবছা অন্ধকার। কাঁচা মেঝে। দরিদ্রের ছাপ ঘরের ভিতরটা মেঘলা আকাশের মতো করে রেখেছে। তারই মাঝে একটা চৌকিতে লিয়াকত চাচা কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে। পরিমলকে দেখে সোজা হয়ে বসতে গেল। বসতে যাওয়ার সময় তার মুখে শারীরিক ব্যথার একটা যন্ত্রণাদায়ক ছাপ ফুটে ওঠে। পরিমল তাকে বসতে সাহায্য করে। সে পরিমলকে পাশে রাখা একটা মোড়া টেনে বসতে বলল। প্রায় সত্তর বছর বয়সী চাচা পরিমলকে জিজ্ঞেস করে – ‘তুমার ঘর কুথা।’
‘আজ্ঞে, চাপড়ায়।’
‘আমারে কি দরকার, বাছা?’
‘আসলে চাচা, আমি ভালো নলেন গুড়ের খোঁজে তোমার কাছে এসেছিলাম।’
‘তা আমার কাছে ক্যান?’ বাজারে তো অনেক গুড়ের দুকান আসে।’
‘ওগুলো কি গুড় চাচা! সব ভেজাল দেওয়া। চিনির ডেলা। ওই গুড়ে না আছে গন্ধ না আছে স্বাদ। আমি জানি যে তোমার মতো গুড় এই জেলায় আর কেউ বানাতে পারে না।’ চাচা পরিমলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ধিরে ধিরে মুচকি হাসে। তারপর বলে –
‘দুনিয়াটাই যে ভেজাল হয়ে গেছে বাপ। চিনি মেশানো গুড় খেয়েই জিবের স্বাদ মিটাইতেছে।’ পরিমল সে কথায় সায় দিয়ে বলে – ‘তাইতো চাচা তোমার কাছে ছুটে এসেছি। আমার কাকা লন্ডনে থাকে। ছুটি পেয়ে দু মাসের জন্য আমাদের এখানে এসেছে। তাকে তোমার গুড়ের কথা বলেছি। সামনে সপ্তাহে সে ফিরে যাবে, লন্ডন, নাম শুনেছ?’ চাচা মাথা নেড়ে বলে – ‘না বাপ, আমি এই গেরামের বাইরেই পা দেই নাই।’ –
‘তার হাত দিয়ে তোমার গুড় পাঠাব।’ চাচা মাথা নিচু করে বসে থাকে। কোন কথার উত্তর দিচ্ছে না দেখে পরিমল বলে ওঠে – ‘ও চাচা! কিছু বলছ না যে!’ চাচা ধিরে ধিরে মাথা তুলে বলে – ‘কিন্তু বাপ আমি যে আর গুড় তৈরি করি না। গত বছরই শেষবার করিছি তারপর থিকে সব ছেড়ি দেছি। খেজুর গাছ থিকে পড়ি গিয়া মাজার হাড় ভেঙি যায়। তা প্রায় মাস তিনেক হইল। তারপর থিকে আর ভালভাবে হাঁটতি পারি না যে। ডাক্তার দেখে বলে – অনেক ট্যাকা খরচ। কুথায় পাব! তাই সেই থিকে এই ভাবে শুইয়া ভুগতেছি। কোনোমতে লাঠির উপর ভর দিইয়া দুই-চার পা হাঁটি। তুই এক কাজ কর বাপ, আমি একজনের ঠিকানা দিতেছি, সেইখানেতে যাও। ও ভালোই গুড় বানাতে পারে।’ চাচার শারীরিক অক্ষমতার কথা ভেবে পরিমল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলে- ‘কিন্তু চাচা, আমি যে কাকাকে কথা দিয়েছিলাম। এবার ফিরে গেলে আর হয়তো তার এ দেশে আসা হবে না। কাকা আমার পিতার তুল্য। ছোটবেলায় বাবা মারা যাবার পর এই কাকাই আমাদের দেখাশোনা করে বড় করেছে। তার হাতেই আমরা মানুষ। খাওয়া, লেখাপড়া, চাকরি সবই এই কাকার জন্য। আমার বড় সাধ ছিল তোমার হাতের তৈরি নলেন গুড় শেষ বারের মতো তার হাতে তুলে দেব। কিন্তু কি আর করা যাবে। আমার দুর্ভাগ্য।’ পরিমলের কথা শুনে লিয়াকত চাচার মনটা কেমন যেন ভারাক্রান্ত হয়। এতক্ষণ সে এক মনে তার কথা শুনছিল। চাচার মুখে তার কষ্টের কথা শুনে পরিমলের মুখে হতাশার ছাপ ফুটে ওঠে। সে বলে- ‘আচ্ছা, চাচা আসি তাহলে।’ এই বলে উঠে চৌকাঠ পেরোতে যাবে এমন সময় লিয়াকত চাচা পিছন থেকে ডাক দেয় – ‘ও বাপ, শোন হেথায়।’ পরিমল পিছন ফিরে তাকায়। চাচা বলে – ‘তোর কথা শুইনা মনটা কেমন যেন করত্যাছে। এত আশা কইরা এলি। এক কাজ কর পরশুদিন আসিস, দেখি তোর কাকার জন্য কিছু করতি পারি কিনা।’ পরিমলের মুখে হঠাৎ বেদনা-মিশ্রিত হাসি ফুটে উঠল। সে বলে- ‘তুমি পারবে তো চাচা?’ – ‘তুই এত আসা নিইয়া এয়েছিস যখন দেখি একটি বার চেষ্টা কইরা, পারি কিনা।’ এই বলে চাচা বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিল। পরিমলও খুশি মনে বাড়ির দিকে রহনা দিল।
এতক্ষণ দরজার পাশ থেকে দুজনার কথা শুনছিল লিয়াকত চাচার স্ত্রী। পরিমল চলে যাবার পর ঘরে ঢুকে স্বামীর কাছে গিয়ে বলে – ‘তুমি আবার এই সব করতি যাবে? সরিলের এই হাল, ঠিক করি দাঁড়াতি পার না। তার উপর এই খাটুনি তুমার সইবে?’ চাচা বলে – ‘কি করমু বল! ছেলিটা বড় মুখ কইরা এসিছে। বাপ মরা ছেলি। কাকারে নিজের বাপের সমান দেখে। তুই এক কাজ কর, তোর ভাইরে কাল একটু আসতি বলিস।’ এই বলে চাচা লম্বা একটা হাই তুলে চোখ বুজল। তার স্ত্রী কাঁথাটা পায়ের কাছ থেকে টেনে গায়ের ওপর দিল।
পরদিন সকাল হতেই চাচার সালা মনসুর এসে হাজির। চাচা তখন দাওয়ায় বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে মুড়ি চেবাচ্ছিল। মনসুর চাচার মুড়ির থালা থেকে এক মুঠো মুড়ি মুখে তুলে বলে – ‘কি জামাই, আমারে হঠাৎ ডাক করাইলে যে!’ চাচা বলে – হ্যাঁ শোন, এত দিন ধইরা যে জন্য তুই আমার পিসন পিসন ঘুরতিস এবার আমি তোরে সেই জিনিসটা দিমু।’ মনসুর উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করে –
‘কি জিনিস গো জামাই?’
‘ওরে সালা! এমন ভান কোরতাছস যেন কিছুই বুঝতে পারো নাই। গুড় তৈরি করার সময় বার বার আমারে কি শুধাইতিস! মনি পড়ে?’ মনসুর বিস্ময় মিশ্রিত আনন্দে বলে ওঠে – ‘তার মানে! তুমি আমারে তুমার গুড় তইরির ফর্মুলা শিখাবে!’ – ‘হ্যাঁরে সালা।’ – মনসুর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে – ‘হে আল্লা, আজ কার মুখ দেইখা উইঠাছিলাম।’ এই বলে চাচার পায়ে পেন্নাম ঠোকে। চাচা বলে – ‘অনেক দিন ধইরা ভাবতিছিলাম, আর কদিনই বা বাঁচব, কত মানুষ আমার তৈরি গুড় খাইয়া শান্তি পায়। আমি চইলা গেলে কে আর তাদের খাঁটি গুড় দেবে। চারিদিকা শুধুই ভেজাল। তোর মাগ আইসা কতবার আমারে কইছে – ‘ও জামাই বাবাজীবন, তোমার সালারে তোমার মতো গুড় করাটা শিইখা দিও। ওর তো আর কোন মুরোদ নাই।’ তখন তোরে শিখাই নাই। কারণ আমার তোদের উপর ভরসা ছিল না। তোরা পাঁচকান করা মানুষ। ভাল জিনিসের কদর তোরা বুঝিস কুথা। তাছাড়া, এ জীবনে ভাল মানুষ পেলাম কইরে, যারে শিইখা যামু। ভাল মানুষ না হইলে ভাল জিনিস হয় নারে শালা। এ গুন আমারে আল্লা দিইছে। তারে আমি এতদিন নিজের বুকের মধ্যি যত্ন কইরা রেখেছি।’ মনসুর বলে – ‘তা আমারে এখন হঠাৎ শিখাবে ক্যান?’ – ভাবলাম তুই আর পাঁচজনের মত না। তোর পরীক্ষা শেষ হইয়া গেছে, তাই তোরে এবার শেখামু।’ – ‘কিন্তু জামাইবাবু, তুমি কি আর পারবে ইসব করতে!’- মনসুর বলে। – ‘পারতে হবে রে, কাল একটা ছেলি এসি ছিল। তার বড় সাধ আমার হাতের গুড় তার কাকারে দেয়। ওই গুড় ননডন যাবে।’ – মনসুর অবাক হয়ে বলে – ‘বল কি জামাই তোমার গুড় ননডন যাবে।’ চাচা পা দুটো লম্বা করতে করতে বলে – ‘হ্যাঁ রে হ্যাঁ।’ কিন্তু তোরে আমার অনিক কাজ করি দিতে হবে।’ – ‘সে তুমি যাই বল জামাই, আমি তুমার সব কাজ করি দিতে রাজি আছি। এখন আমারে কি করতে হবে বল।’– মনসুর বলে। চাচার স্ত্রী ওদের দুজনার কথার ফাঁকে আরও কিছুটা মুড়ি থালায় করে তেল দিয়ে মেখে মনসুরের হাতে দিয়ে যায় সঙ্গে বেশ কয়েকটা কাঁচা লঙ্কা। চাচা স্ত্রীকে একটু চায়ের ফরমাইশও করে। তারপর সালার উদ্দেশে বলে – ‘তুই তো সব জানোস, আমার দ্বারা দৌড়ঝাঁপ করা আর একিবারে সম্ভব লয়। তাই যা যা জোগাড় করার তোরেই সব করতি হবে। আমি শুধু তোর পাশে বইস্যা শিখাইমু।’ মনসুর – ‘বলে সে তো নয় হইল জামাই, কিন্তু রস কোথা থিকে পাবে! সব গাছ তো সেলিমকে জমায় দিয়েছ’। চাচা বলে – ‘তুই তারে গিয়া আমার কথা কইবি, বলবি আমি কইছি, একদিনের রস আমারে দিতে। আমি তারে যা দাম হয় তাই দিমু। সে আমার কথা ফেলতি পারবেক নাই, সে যে আমারে বেশ মান্যি করে।’ ‘ঠিক আছে, তাই হবে জামাই’- এই বলে মনসুর চাচার পায়ে একটা পেন্নাম ঠুকে বাড়ির দিকে রহনা হল। বাড়ি ফেরার পথে একবার সেলিমের ঘর হয়ে যায়। চাচার কথা সেলিমকে বলাতে সেলিমও রাজি হয়ে যায়।
দুপুরের পর মনসুর ঘাড়ে করে জ্বালানির জন্য কাঠ এনে উঠোনে ফেলে। ইট সাজিয়ে উনুন তৈরি করল। লিয়াকত চাচা দাওয়ায় বসে তদারকি করতে থাকে। তার স্ত্রী আগে থেকেই গুড় তৈরির সরঞ্জাম যেমন – ঠাপা, বিজকাঠি, নারকেল মালা, মাটির পাত্র, গুড় ঢালার পরিষ্কার কাপড় প্রভৃতি। এই সব জোগাড় করতে করতে বেলা গড়িয়ে গেল। চাচার স্ত্রী ভাইকে সকালেই বলে রেখেছিল যে আজকের দুপুরের খাবারটা সে এখানেই খাবে। তাই সে হাতমুখ ধুয়ে চাচার সাথে খাওয়া দাওয়া সেরে দুজনে বিছানায় বিশ্রাম নিতে গেল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর মনসুর বলে – ‘জামাই আমি তবে যাই, গাছের কপাল গুইলা চেঁচে দিইয়া নালি, ভাঁড় নাগগে আসি।’ চাচা বলে দেয় – ‘ভোর থাকতি বাগানে চলি যাস, আর ভালো কইরা নজর রাখিস, রস যেন চুরি না হয় আর মনে রাখিস আমার কিন্তু জিরেন কাঠির রস চাই। সকালে যখন আসবি ভালো কইরা গুড়টা ছেঁকে নিতে ভুইলা যাস না যেন। একটা মৌমাছি যেন পড়ি না থাকে।’ মনসুর মাথা নেড়ে রহনা দেয়।
কথামতো পরদিন সকাল হতেই মনসুর সাইকেল নিয়ে হাজির। তাতে বেশ শক্ত করে রসের হাঁড়িগুলো বাঁধা। লিয়াকত চাচা ঢাকনা খুলে রসটা দেখে নেয় ঠিক আছে কিনা। মনসুর উনুনের উপর রস জ্বাল দেওয়ার জন্য ঠাপা পাতলো। তারপর একটা একটা করে হাঁড়ি উপুড় করে সমস্ত রস ঢেলে ফেলে। লিয়াকত চাচা একটা মোড়ার ওপর লাঠিতে ভোর দিয়ে বসে। চাচার স্ত্রী কাঠের জ্বাল দিতে লাগল। সেও এই ব্যাপারে যথেষ্টই অভিজ্ঞ কারণ দীর্ঘদিন যাবৎ কারণ সে শুধুই চাচার জীবন সঙ্গীই নয়, গুড় তৈরির কাজে প্রথম থেকেই সঙ্গ দেয়। কোন ফুটে কতটা জ্বাল দিতে হবে সে তার ভালোই জানা। কিছুক্ষণের মধ্যেই রস ফুটতে শুরু করল। বিজকাঠি দিয়ে প্রথমে চাচা পরে শালা নাড়তে লাগল। লিয়াকত চাচা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে ফুটন্ত গুড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে মনসুরকে বোঝাতে লাগল- কিভাবে নাড়তে হয়, কিভাবে রসের ময়লা তুলে ফেলতে হয়, কখন কতটা জ্বাল দিতে হবে, কোনটা মুসুরি ফুট, কোনটা কদম ফুট কোনটা গুটি ফুট ইত্যাদি। মনসুর গুরুমন্ত্রের মতো সেই সব শুনছে। লিয়াকত চাচা বলে – ‘বুঝলি শালা! ভাল গুড় তৈরি করতি আর একটা জিনিস লাগে, আর তা হইল মন। মন তোর যত সুন্দর হইবে, গুড় ততই সুন্দর হইবে। ভালো মানুষ না হইলে ভালো কাম করা যায় না। মানুষকে ঠকিয়ে দুটো পইসা হয়তো পাবি কিন্তু মান পাবি না।’ মনসুর, চাচার কথার তালে তালে মাথা নাড়তে থাকে। ক্রমশ, চারিদিক গুড়ের গন্ধে ম ম করতে লাগল আর সেই গন্ধেই বোধহয় পরিমলও এসে হাজির। চাচার স্ত্রী পরিমলকে বসার জন্য একটা পিঁড়ে এনে দেয়। কিন্তু সে তাতে না বসেই ঘুরে ঘুরে গুড়ের গন্ধ উপভোগ করতে লাগল। এতক্ষণ কোমর ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে থেকে চাচাও একটু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সে দাওয়ার ওপর পা ঝুলিয়ে বসে। পরিমল কাছে এসে বলে – ‘চাচা, তোমায় কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো বুঝতে পারছিনা। আমার জন্য কত কষ্টই না করলে।’ চাচা বলে – ‘কষ্ট হইলেও এর মধ্যি অনিক আনন্দ আছে রে বাপ।’ আমার জন্য কারোর যদি এতটুকু উপকার হয় তাতি আমার পরানটা শান্তি পায়। আল্লার দোয়ায় আমার গুড়ের কেউ কোনদিন বদনাম করিনি।’ চাচা দাওয়ায় বিছানো মাদুরে গা এলিয়ে দিতে দিতে বলে –‘তার দোয়ায় দুবেলা দু মুঠো জোগাড় হইয়া যায়, শুধু এই যন্ত্রণাটা আল্লা কেন যে আমার শরীলে দিল কে জানে! হইতো কুনো পাপের ফল।’
চাচার স্ত্রী এতক্ষণ গুড়ের মুচিগুলো গুছিয়ে গুছিয়ে জড় করছিল তারপর একটা ব্যাগে করে এনে পরিমলের হাতে দেয়। চাচা বলে – ‘যা বাছা, এ গুড় খাইয়া দেখিবি, এমন স্বাদ আগে কুনো দিন পাস নাই।’ পরিমল বলে – ‘সে তো জানি চাচা, তাইতো তোমার কাছে আসা।’ পরিমল গুড়ের ব্যাগটা সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে রেখে চাচার পাশে এসে বসে, তারপর বলে – ‘তুমি তো আমার জন্য এত পরিশ্রম করলে, অসুস্থ হয়েও আমার মান বাঁচালে তুমি বয়েসে আমার থেকে অনেক বড়, তাই ধন্যবাদ জানিয়ে তোমাকে ছোটো করব না তোমায়। এখন তোমার গুড়ের দাম কত বল।’ চাচা পরিমলের পিঠে হাত রেখে বলে –‘তুই বাছা বড় ভাল ভালো, তোর যা মন চায় তাই দে।’ পরিমল পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করে চাচার হাতে দিয়ে ধিরে ধিরে বলে – চাচা, এইটা রাখো। – চাচা বলে – ‘কি এইটা?’ –‘এটা তোমার গুড়ের দাম।’ –পরিমল বলে। চাচা বিস্মিত হয়ে বলে –‘কিন্তু এত টাকা কেনে! আমার গুড়ের দাম তো এত না।’ পরিমল বলে – ‘কাল কাকার কাছে তোমার অসুস্থতার কথা বলেছিলাম। তোমার মতো একজন সৎ মানুষ আমাদের এত কাছে থাকে ভাবতেই অবাক লাগে। তুমি তো আমাদেরই আপনজন। তোমার হাতের গুড় খাবার জন্য আমরা পথ চেয়ে বসে থাকি। তুমি সুস্থ হয়ে না উঠলে আমরা ওই গুড় আর কোথায় পাব? তাই তুমি যাতে চিকিৎসা করে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো তাই কাকা তোমাকে দশ হাজার টাকা দিয়েছে। চাচা বিস্ময়ে, আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়ে। তার দুই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে আসে। পরিমলের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে – আল্লা যেন তোকে সারা জীবন সুখী রাখে। চাচার স্ত্রী আর মনসুরও তাদের মাঝে এসে দাঁড়ায়। তাদেরও দুচোখ জলে ভরে ওঠে। চাচা অতি কষ্টে আকাশের দিকে দুহাত তুলে চোখ বুজে আল্লাকে ডাকতে ডাকতে বলল-‘হে আল্লা, তুমি করুণাময়, এই বাছারে আজীবন সুখ দিও।’ পরিমল ততক্ষণে সাইকেলের প্যাটেলে পা দিয়ে, বেলের কিড়িং কিড়িং শব্দ তুলে গুড়ের গন্ধে ভাসতে ভাসতে বাড়ির দিকে রহনা দেয়।
খুব মানবিক একটা লেখা। নলেন গুড়ের গন্ধে ভরপুর। শুভেচ্ছা।
খুব সুন্দর একটা গল্প পড়লাম । আজকাল আর এমন মানবিকতা খুব একটা দেখা যায় না……সম্পর্কগুলো বড্ড মেকি হয়ে গেছে। ভালো লাগলো ।
সুন্দর গল্প। সত্যি, ভাল মনের মানুষ না হলে কোন ভাল কাজ হয় না।