দাদাকে প্রণাম
সাবিত্রী কাহালী
গত বছর ১০১তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা, শুভকামনা ও প্রণাম জানাতে গিয়েছিলাম দাদার বরানগরের বাড়িতে। আমার ছেলে ও আমি যাই। আর আমার ভাইঝি ভূমিকা তার মেয়ে ও নাতনি সহ এসেছিল। আমরা”করোনা”নামের মহামারী র জন্য যথেষ্ট আতঙ্কিত ছিলাম! তাই ভিড় বাড়াইনি। আমরা নীচতলায়”জগদ্ধাত্রী মায়ের”পূজোর ঘরে বসে অপেক্ষা করি দাদার জন্য।খবর পেতেই তিনি দোতলা থেকে নেমে আসেন। প্রথমেই বলেন তোদের আসতে কোনো কষ্ট হয়নি তো? বললাম না না কিসের কষ্ট? আজ একটা বিশেষ দিনে তোমার কাছে এসেছি। অনেক আনন্দ নিয়ে।
আমাদের সবার উপস্থিতি তাঁকে কতটা আনন্দ দিয়েছিলো তা দাদার চোখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছিল।
বললেন আয় আয় কাছে এসে বোস। আমরা সবাই দাদার কাছে বসে নানা ধরনের কথা বলি। দাদা ও বড় বৌদি পাশাপাশি চেয়ারে বসে ছিলেন হর-গৌরীর মতো। শ্বেতশুভ্র সিঁথিতে টকটকে লাল সিঁদুর প’রে!
আমরা সবাই সমবেত কন্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন করি। দাদাও আমাদের সাথেই গলা মিলিয়ে গান করেন টেবিলে তাল ঠুকে। আবার জানতে চান, বললেন, “-এটা কোন রাগ?” সঠিক উত্তর দিতে খুশি হন!
সেদিন আমাদের সবার উপস্থিতি আনন্দ মেলার সমান ছিল! অনাবিল আনন্দ আর প্রশান্তির রেশ নিয়ে বাড়িতে ফিরেছিলাম!
সেদিন কিন্তু মনের আনাচে কানাচে একবার এর জন্য ভাবিনি তিনি ১০২তম জন্মদিন এ আমাদের সামনে বসে প্রণাম নেবেন না! মাঝে মাঝে ই বিস্মরণ ঘটে যায়, তিনি এখন না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন! অবসরে যখন গীতার সারাংশ বোধগম্য হয়না তখন ভাবি-দাদার কাছে জেনে নিতে হবে এর অর্থ গুলো। মুহূর্তে সেই ঘোর কেটে যায়! কোথায় পাবো দাদাকে? আর তো দাদা অনেক ধৈর্য ধরে সরল ভাবে বুঝিয়ে দিতে পারবেন না!!
তারপর বিষন্নতা র পালা! তখুনি দুই চোখের জল কোন বাধানিষেধ মানেনা। গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। তিনি নিরোগ দেহে, কথা বলতে বলতে যেন হেঁটে হেঁটে উর্ধ্ব লোকে চলে গেলেন!
বয়সের ভার তাঁকে জব্দ করতে পারেনি।দুই তুড়িতে রোগ ব্যাধি দূর করে দিয়েছেন। কোনো দিন তাঁর মুখে শুনিনি যে,”আমার শরীর ভালো নেই”।কেমন আছ দাদা? সাথে সাথেই “আমি ভালো আছি”! তোরা সবাই ভাল থাকিস। অনেক দিন খুকুর কোনো খবর পাইনা।ও কেমন আছে? আমাকে সবার খবর জানাস”।
শততম জন্মদিন পালন করা হয়েছিল”বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলন”এ। সেখানে আমরা ভাই-বোন মেয়ে জামাই সবাই জন্মদিন উপলক্ষে একত্রিত হয়েছিলাম। আমাদের কাছে সেই দিনটি উৎসবের দিন ছিল। সেখানে আমরা সবাই গান, কবিতা পাঠ করে দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে পেরে নিজেদের ধন্য ও গর্বিত মনে করেছি। অনুষ্ঠান শেষে জানতে পারলাম যে আমার দাদাকে”রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়” থেকে সম্বর্ধনা প্রদান করবেন সেখানকার কবি, সাহিত্যিক ও গুণীজন।
যারা সদস্য তারা যেতে পারবেন। দাদার কথায় ঐ দিন আমার রাঙাদি আমি, আমার ছেলে সদস্য হয়ে যাই কোন রকম দ্বিধা না করে। অবশ্যই দাদার খুব ইচ্ছে ছিল আমরা তাঁর সাথে পৈত্রিক জন্ম স্থান দেখে আসি। দাদার অনুমতি পেয়ে নির্দিষ্ট সময়ে আমরা যাবার দিন ঠিক করি। দাদার জন্য আমরা বাংলাদেশে যেতে পেরেছিলাম তা না হলে কখনোই সম্ভব হতো না। এটা আমাদের বড় সফলতা। সারা জীবন মনে রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা! নির্দিষ্ট দিনে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে আবার রাজশাহী”পরিচয় সংষ্কৃতি সংসদ”এর তরফ থেকে দাদাকে”আজীবন সম্মাননা”প্রদান করবেন সেখানকার গুণী ও বিদগ্ধ জন।
অনেক শুভেচ্ছা, শুভকামনা ও ধন্যবাদ জানিয়েছেন আমাদের সবাইকে ওখানকার মানুষ। অনেক আদর ও খাতির করেছেন। সভা সমাবেশ শেষে আমাদের সবাইকে নিয়ে উৎসাহী কেউ কেউ যারা সেখানে দ্রষ্টব্য স্থান দেখতে চান তারা ঘুরে আসতে পারি এমনটা বলেন আমরা তাদের সঙ্গে গাড়ি করে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ি। আমাদের সাথে দাদা ও ভাইপো (শঙ্খ) থাকায় নির্ভয়ে ঘুরে বেড়িয়ে এসেছিলাম। আর ছিল আমার ছেলে। রাঙ্গা পিশী ও আমাকে সামলে রেখেছে সর্বদা।
১০২ তম জন্মদিন পালন হচ্ছে! কিন্তু বড় ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আছি! শূন্যতা পূরণ হবার নয়! তবুও সবটা মেনে নিতে হয় প্রকৃতির নিয়মে। সর্ব শেষে আবারও ১০২তম জন্মদিনে গভীর শ্রদ্ধা ও প্রনাম করলাম আমার বড় দাদাকে।
তিনি আমাদের মাঝে আছেন, ছিলেন, থাকবেন!!