আমার বাবা -শ্রী পূর্ণেন্দু প্রসাদ ভট্টাচার্য্য
ভূমিকা গোস্বামী
আজ বাবার একশো দুই তম জন্মদিন।গত বছর বাবার কাছে গিয়েছি। আমার পিশি, মেয়ে নাতনি আমার ভাই , ভাইয়ের বৌ, ভাইপো সবাই মিলে বাবার জন্মদিনে আনন্দ করেছি। বাবা একাই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসেছিলেন। সুস্থ নীরোগ। প্রখর স্মৃতি। তিনি গান করেছেন। গান শুনেছেন। কথা গান গল্পে মুখর ছিল সেই সন্ধ্যে।
গত জুন তিনি তাঁর নশ্বর শরীর ত্যাগ করে অমৃতলোকে যাত্রা করেছেন।
বাবাকে নিয়ে লিখতে বসে কত কত স্মৃতির ভিড় যে একসাথে চলে আসছে ! কাকে প্রাধান্য দিই বলো ! ছোট বেলার দিনগুলো দিয়েই শুরু করি –
যতটুকু মনে পড়ে আমি মাঝে মাঝেই আমার মাকে অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন করতাম। মার কাছে সেগুলোর উত্তর ছিল না। ছেলেভুলানো উত্তর দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করতেন । আমি নাছোড়। মা বলতেন – তোর বাবা জানে। বাবা অফিস থেকে এলে জেনে নিস।
বাবার কাছে স-ব প্রশ্নের উত্তর ছিল। সারাজীবন এটা কী…. সেটা কী….বলে জ্বালিয়েছি। ধৈর্য্য ধরে সব প্রশ্নের সমাধান করতেন।
সেই ছোট্ট বয়স থেকে ধীরে ধীরে বাবা আমার বন্ধু হয়ে উঠলেন। তাঁর একাধারে ঐশ্বর্য ও মাধুর্যের আলো দেখতে দেখতে মুগ্ধ হতে হতে বড় হলাম।
অফিস থেকে ফিরে বিকেলে ছাদে ইজি চেয়ারে বসে গান করতেন। আমি পায়ের কাছে বসে বাবার সাথে গান করতাম। তখন আমরা পালপাড়া ফাঁড়ি বাসস্ট্যান্ডের কাছে চারতলায় একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতাম। সেখানে আমাদের দুটো ঘর বারান্দা সংলগ্ন বিশাল ছাদ ছিল। আমার জন্ম থেকে চোদ্দ বছর ওই বাড়িতেই থেকেছি। পরে বাবা অক্ষয় কুমার মুখার্জী রোডে বাড়ি করলেন। সেই সময় বাবার পাশে থেকেছি। গরমের ছুটি ছিল। বাবার অফিসে যাবার সময় আমাকে রেখে যেতেন । আমি সারাদিন মিস্ত্রি দের কাজের তদারকি করতাম। সমস্ত বিষয়ে আমার সাথে আলোচনা করতেন। ১৯৭১সালের উল্টোরথের দিন আমরা নতুন বাড়িতে চলে এলাম।
বাবাকে কখনও টেবিল চেয়ারে লেখাপড়া করতে দেখিনি। বুকে বালিস নিয়ে উপুর হয়ে শুয়ে লিখতেন। এভাবেই সাহিত্য মেলার কাজ, এটটার পর একটা কবিতার বই , শ্রীঅরবিন্দের সাবিত্রীর অনুবাদ লিখে যেতেন। আমি কখনো বাবার পিঠে বসে বাবার পৈতে নিয়ে ঘোড়া ঘোড়া খেলতাম , কখনো বাবার চুল আমার ফিতে দিয়ে বেঁধে দিতাম। বাবার তখন জাগতিক কোন হুঁশ থাকতো না। জানতেই পারতেন না। পরে আয়না দিয়ে দেখে হাসতেন।
ইংরেজী টেন্স কত সহজে সুর করে নামতার মতো শিখিয়ে দিতেন।
বিভিন্ন রাগের ওপরে বাবার লেখা শ্রীঅরবিন্দ ও শ্রীমাকে নিয়ে লেখা গান শেখাতেন। আমি খুব ছোট বয়স থেকেই বাবার সাথে এই সব আসরে গাইতাম। ২০১৯-এও গিয়েছি। করোনা সিনেরিওতে কোথাও আর যাওয়া হয় নি।
বাবা যখন সভাপতির ভাষণ দিতেন, প্রতিটি শব্দ মনের মধ্যে বসে যেত। বাড়ি ফিরে মাকে সেসব বলতাম। মা হাসতে হাসতে বলতেন — শ্রুতিধর!
বাবার বলা প্রতিটি ভাষণ আজও আমার মনের মণিকোঠায় সযত্নে লালিত।
বাবা আমাকে সাজাতে পছন্দ করতেন। জ্ঞান হয়েই দেখছি আমার হাতে মোটা বালা, কানে দুল, গলায় সোনার চেন । আমি স্কুলে যেতাম বা যেকোন খানে সেগুলো খোলা হত না। একবার পুজোয় বাবা আমার জন্য লাল রংয়ের সুন্দর চামড়ার স্যান্ডেল , রূপোর নূপুর নিয়ে এলেন। নিজে আমাকে আলতা , নূপুর , লাল স্যান্ডেল পরিয়ে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
একবার আমার মাথা ন্যাড়া করা হয়েছিল ,তাতে নাকি আরো ভাল চুল হবে । তখন আমি নার্সারিতে পড়ি। সেটা বাবা-ই করেছিলেন। এলোমেলো চুল দেখলেই তেল দিয়ে নিজেই বেঁধে দিতেন।
ফাইভে সারদায় ভর্তি হলাম। বাবা ‘আই এস আই ‘তে চাকরি করতেন। স্কুল ছুটির পর বি টি রোডে এসে দাঁড়াতাম। বাবার অফিসের সাহায্যকারী কাকু আমাকে বাবার কাছে নিয়ে যেতেন। বাবার সাথে সুরধুনীতে গানের স্কুলে যেতাম। আমি ভেতরে গান শিখছি। বাবা বাইরে বসে গানের খাতায় স্বরলিপি লিখছেন।
আমার বিয়ের পরে এক একদিন দুপুরে অফিসের টিফিন টাইমে – চলে আসতেন।
বলতাম – বাইরে এত রোদ , এখন কেন এলে বাবা।
বলতেন-” আমার অফিসের এক কলিগ বলল – ‘পূর্ণেন্দুদা, মেয়ে কেমন আছে ?’
ভাল আছে ,বলেই , মনে হল, কতদিন তো তোকে দেখিনি। তাই চলে এলাম। “
একটু পরেই আবার চলে যেতেন।
তখন তো ফোন ছিল না। মনে হলেই ছুটে আসতেন। একদিন বললেন – “ভূমি, গান কর।” আমার তখন বছর দুয়েক বিয়ে হয়েছে। বললাম -“আমি তো আর গান শিখি না বাবা।”
-” তাতে কী ! তেরো বছর তো গান শিখেছিস। গান কর। ভুল হলে ইনি ঠিক করে দেবেন।” আমার ঘরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাঁধানো ছবি দেখিয়ে বললেন।
সেই বিশ্বাসে আজও গাই। জানি, ভুল হলে তিনি গৃহশিক্ষকের মতো সংশোধন করে দেবেন।
একবার বললেন -” গীতার দ্বাদশ অধ্যায় – ভক্তিযোগটা মুখস্থ করে ফেল তো ! একজায়গায় প্রতিযোগিতা আছে। আমি তোর নাম দিয়েছি।”
আমি তো রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। কিছুতেই সাহস পাচ্ছি না। কাঁদ কাঁদ হয়ে বললাম – “এ আমি পারবো না বাবা। সংসার সামলিয়ে …..”
বাবা বললেন – “আরে ! মাত্র কুড়িটা শ্লোক! একদিনে দুটো করে শ্লোক মুখস্থ করতে পারবি না! ঠিক হয়ে যাবে। “
সংস্কৃত উচ্চারণ ঠিক করে দিলেন। ড় ঢ় এর , স শ ষ এর ন ণ এর উচ্চারণ।
বাবা, আমার চেয়েও আমাকে বেশী জানতেন ! সত্যিই আমি দ্বাদশ অধ্যায়-ভক্তিযোগ সুরে মুখস্থ করে ফেললাম। তবে প্রতিযোগিতাটা শেষ পর্যন্ত হয় নি। কারণ আমার ছাড়া আর কোন নাম জমাই পড়ে নি।
আমার কিন্তু গীতার প্রতি আকর্ষণ দিন দিন বাড়তে লাগলো। একদিন বাবার ইচ্ছায় একটি অধ্যায় মুখস্থ করেছি। এখন গীতাকারের ইচ্ছায় ও কৃপায় আঠারোটি অধ্যায় …..
প্রতিটি শ্লোকে সঠিক জীবন যাপনের ফরমুলা খুঁজে পেলাম। নেশা বাড়তে লাগলো। এখনও সেই নেশায় বুঁদ হয়ে আছি।
বাবার কথা বললে শেষ হবে না। আমার প্রতিটি ওঠাপড়ায় বাবাকে পেয়েছি। তাঁর উপদেশ , নির্দেশ আমার চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে চিরদিন। আমার সন্তানদেরও বন্ধু হয়ে, গুরু হয়ে পথ দেখিয়েছেন তিনি চিরকাল।
সশ্রদ্ধ প্রণাম। আজ আরো অনেক কিছু জানলাম।
সুন্দর স্মৃতিচারণ।
২১শে ফেব্রুয়ারি শ্রীমার জন্মদিনে মহামিলন মঠের ছবি।
ভীষণ ভালো লাগল পড়ে।
আমার বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই 🙏
আপনার বর্ণনায় উজ্বল মহাজীবনস্মৃতি। শুভেচ্ছাজানাই।
অনেক ধন্যবাদ ……
বরাবরের মতই খুব সুন্দর স্মৃতিচারণ। পড়তে পড়তে আমার বাবার কথা মনে পড়ে গেল। খুব ভালো লাগল।