ছোটগল্পঃ রবীন্দ্রনাথের বাবা স্বপ্ন দেখেছিলেন – সন্তোষ কুমার শীল (বাংলাদেশ)

রবীন্দ্রনাথের বাবা স্বপ্ন দেখেছিলেন
সন্তোষ কুমার শীল

ছুটির দিনের সকাল বেলাটা আমার দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী পড়ে কাটে। আজও যথারীতি পৃষ্ঠাটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করেছি। একহাতে চায়ের কাপ আর হাতে কিছু বেলফুল নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মনীষা বলে- শুনেছো, রবীন্দ্রনাথের বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে?
হঠাৎ মনেহল হাতে ধরা পৃষ্ঠাটা আগাগোড়া শাদা আর বেলফুলগুলো গন্ধহীন, কাগজের ফুলের মত।
চারদিক যখন এত স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, ব্লাড সুগারের মহোৎসব তখন ষাটোর্ধ বৃদ্ধের হার্ট অ্যাটাক হওয়া বিচিত্র নয় বরং স্বাভাবিকই। কিন্তু তিনি তো সবেমাত্র প্রিয়তমা স্ত্রী আর আত্মজের কাছ থেকে ফিরে এলেন! দীর্ঘদিন নিঃসঙ্গ থাকার ফলে যদি হৃদপিন্ডের কাঠামো বা পলেস্তারা খসে গিয়েও থাকে অদর্শন-বিরহের পর স্ত্রী-পুত্রের মুখ দেখে তো হৃদপিন্ড, ফুসফুস, কিডনীর পুনর্যৌবন আসা উচিৎ! তাহলে হার্ট অ্যাটাকের মত উল্টো ঘটনা ঘটল কেন!
আমার অপরাধবোধ ছিল অন্য কারণে- দু’তিন দিন হয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের বাবা দেশে ফিরে এসেছেন। কোথায় আমি গিয়ে তার খবরাখবর নেব! তার পরিবর্তে তিনি আমাকে দেখা করার জন্য বারবার খবর পাঠিয়েছেন। ঠিক কি কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি নিজের কাছেই তার ব্যাখ্যা নেই।
বান্ধবহীন রাজধানী শহরে আমরা একই পাড়ায় দুই যুগের বেশি বাস করেছি। দুঃখ-সুখে একে অপরের সাহায্য, পরামর্শ এবং বন্ধুত্বের উষ্ণতা পেয়েছি। এটাই বা কম কীসে! আশির দশকের শেষ দিকে তার সাথে আমার প্রথম আলাপ।বেশ কিছু দিন ধরে দেখতাম একটা সংবাদপত্র হাতে প্রতি শুক্রবার বিকেলে পার্কের নির্দিষ্ট বেঞ্চিতে বসে নিবিষ্ট মনে সন্ধ্যা অবধি পড়তেন। তারপর একা একা ফিরে যেতেন। ইচ্ছে থাকলেও আলাপ করার সুযোগ হয়নি। হঠাৎ একদিন সুযোগটা এসে যায়।
কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং চলছিল। একজন বক্তার দারুণ বিশ্লেষণমূলক সম্মোহনী বক্তব্য চলছে। লক্ষ্য করে দেখি পার্কের সেই সংবাদপত্র পাঠক। আমি মুগ্ধ, বিস্মিত, নির্বাক হয়ে তার কথা শুনছিলাম। পাশে এসে বসতেই হাত বাড়িয়ে দেন- গুড ইভনিং কমরেড!
-গুড ইভনিং। আপনি চমৎকার বক্তব্য দিয়েছেন!
-এটা আমার একান্ত নিজস্ব মতামত। মূলতঃ সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আমরা খুব কম চিন্তা করি বলে হয় রাশিয়া নয়তো চীনের দিক মুখ ফিরিয়ে থাকি। কিন্তু আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতে আর্থিক সমবন্টনের সময়োপযোগী কোন বৈপ্লবিক মতবাদ উদ্ভাবন করতে হবে। ধর্মান্ধতা দূরীকরণের নতুন কোন তত্ত্ব না হলে 1947 সাল থেকে শুরু করে একাত্তর পর্যন্ত যে উগ্র সাম্প্রদায়িক হানাহানি হয়েছে যে কোন মুহুর্তে তার পুনরাবির্ভাব অসম্ভব নয়। আর অসম্ভব নয়ই বা বলছি কেন, এখনও নিয়মিত চলছে তো!
-বেশ তো, তাহলে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু হোক।
-এবার থেকে পার্কে দু’জনকে আর একা একা বিকেল কাটাতে হবেনা, কি বলুন?
বুঝলাম আমার উপস্থিতি প্রতিদিনিই সে লক্ষ্য করেছে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও সৌজন্যতার সীমা লঙ্ঘন করে আলাপ করতে আসেনি। লোকটা সম্পর্কে এটাই আমার প্রথম বিস্ময়।তাই পরবর্তীতে সংযমের রাশ কখনো আলগা হতে দিইনি।

রাজধানীর একটা বিখ্যাত কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেও সাহিত্যে তার অবাধ বিচরণ। মাঝে মাঝে কবিতাও লিখতেন। সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে অনবদ্য প্রবন্ধ লেখেন। পত্র-পত্রিকার সম্পাদক তার দরজায় অপেক্ষমান থাকে একটা নিবন্ধের জন্য। তার স্বদেশ ভাবনাও অত্যন্ত সূক্ষ্ম। আশির দশকে সংবিধানের মূল চার নীতির পরিবর্তন এবং প্রেসিডেন্সিয়াল শাসন ব্যবস্থা চালু করার অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকে খুব দুশ্চিন্তায় ভুগতে দেখেছি। সেদিন তিনি সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করেছিলেন- আমাদের দেশে প্রেসিডেন্সিয়াল শাসন ব্যবস্থা অচল। তাও না হয় মেনে নেয়া যেতো। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার মত অতি প্রয়োজনীয় উপাদান বাদ দিয়ে রাষ্ট্রধর্মের মত একটা অলীক বিষয় ঠাঁই দিয়ে ধর্মান্ধ দানবের ঘুম ভাঙ্গানোর রাষ্ট্রীয় প্রয়াস শুরু হল। একটা রাষ্ট্র যদি অতীতের ভুল শোধরানোর চেষ্টা না করে তবে তা পতনের দিকে এগিয়ে যাবে। তাতে রাজনৈতিক দলগত কিছু অন্যায় সুবিধা ভোগ করা যেতে পারে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে তা একটি অন্তঃসারশূন্য আদর্শহীন রাষ্ট্রে পর্যবসিত হয়। উনিশশো’ সাতচল্লিশ সাল থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত যে ধর্মান্ধগোষ্ঠী সক্রিয় ছিল তাদেরকে উস্কে দেবার নামান্তর রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠা করা। ক্ষমতার পরিবর্তনে এটার অতি অবশ্যই পরিবর্তন হবে। আমরা তো আর আমেরিকার ডুপ্লিকেট নয়। সামনে দুর্দিন আসছে। আমি তা যেন দেখতে পাচ্ছি।
-আমি ইচ্ছে করেই রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখি। তবে আপনার ভবিষ্যত বাণীর সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। এমনি একটা শঙ্কা আমাকেও বিষাদগ্রস্ত করে তুলেছে।

-কি হল তোমার চা টা খেয়ে তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়ো! একা মানুষ কি অবস্থায় আছে কে জানে!- মনীষা শঙ্কিত গলায় তাড়া দেয়।
-আমার যেন মন কেমন করছে। তুমিও যাবে নাকি সাথে?
-বেশ তো! তোমার চা খাবার মধ্যে চেঞ্জ করে আসি।

রবীন্দ্রনাথের বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করে যখন একটু অবসর মেলে তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। ডাক্তার জানিয়েছে- বাহাত্তর ঘন্টা না যাওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবেনা। মনীষাকে বাড়ি পাঠিয়ে পরিচিত ডাক্তারের ইচ্ছেয় করোনারি কেয়ার ইউনিটে একটা চেয়ার পেতে বসি। রোগীর স্যালাইন চলছে। নৈঃশব্দের মধ্যে নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা যায়। রবীন্দ্রনাথের বাবার মুখখানা নির্বিকার, ভাবলেশহীন। মনেহয় শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। শুধু নাসারন্ধ্রে ঢুকানো ফুডপাইপটা বড় বিসদৃশ লাগছে। আজ মৃত্যুর ঢেউয়ে দোদুল্যমান লোকটা কি ভীষণ নিঃসঙ্গ! অথচ একদিন তার পরিবার-পরিজন নিয়ে কি প্রচন্ড আবেগ ছিল!
বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ এক সন্ধ্যায় আমার বাড়ি এসে বলে- কাল ভোরে গাঁয়ের বাড়ি যাচ্ছি। আটটায় তৈরি থেকো। তুমি, আমি আর কমরেড হাবীব মিলে যাচ্ছি। আটটা তিরিশে আমাদের বাস ছাড়বে।
-বাস কেন? চলুন আমার গাড়িতে যাই।
-তুমি তো জানো, ভোলার পুরোটাই দ্বীপাঞ্চল। বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি যাবেনা। তাছাড়া তুমি তো আমাদের দর্শন জানই- মেহনতি মানুষ জিন্দাবাদ, ধনিকতন্ত্র মুর্দাবাদ। রসিকতার ছলে চূড়ান্ত সত্যটা বলে মিষ্টি হেসে বেরিয়ে যান।

গিয়ে দেখি বাড়িতে উপচে পড়া ভিড়। রান্নাবান্না চলছে বিশাল আয়োজনে। নিমেষ ফেলতেই দিনটা ফুরিয়ে গেল। সন্ধ্যেবেলা হাবীবদা, আমি আর স্বপরিবারে রবীন্দ্রনাথের বাবা উঠোনে চাঁদের আলোয় বসি। দিনের হৈচৈ, আনন্দ-আয়োজন, ভোজ উৎসবের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন- আগামীকাল ছেলেটা প্রথম স্কুলে যাবে। তাই একটু আনুষ্ঠানিকতা আর কি! সত্যি বলতে, সমাজ তো মায়ের মতই! মাতৃস্তন্যের মত এই সমাজের রস পান করেই তো জন্ম থেকে বেড়ে উঠেছি। আজ কলেজে অধ্যাপনা করছি। সমাজের কাছে নিজেকে সব সময়ই ঋণী মনেহয়। তাই সবাই মিলে পংক্তিভোজের এই দীন আয়োজনটুকু বেশ উপভোগ্য লাগে। আর আপনাদের নিয়ে এসেছি এই জন্য যে, গুণীজনের কাছ থেকে আমার ছেলে একটা সুন্দর নাম পাব। যে নামের যোগ্য হয়ে ও গড়ে উঠবে আর সত্যিকারের মানুষ হবার আয়োজন চলতে থাকবে সারা জীবন।
-আজ নামকরণ হবে কেন? এতদিনেই তো হয়ে যাবার কথা!- হাবীবদা বলে।
-এতদিন ওর ডাকনাম ছিল ‘লুথার’। কিন্তু শিক্ষায়তনে ছেলে কোন নতুন নামে পরিচিত হোক- এই আমার ইচ্ছে।
-আপিনি তো কমরেড। ওর নাম হোক তাহলে ‘লেনিন’।
-নামটা আমিও যে ভাবিনি তা নয়। কিন্তু প্রথমত ওটা বাংলা নাম নয়। আর এমন তো হতে পারে বড় হয়ে সে রাজনীতি পছন্দ করবে না, নেতৃত্বে অনীহা পোষণ করবে। তখন লেনিন নামটার অসম্মান হবে!
-তাহলে ওর নাম হোক ‘রবীন্দ্রনাথ’।
আনন্দের আতিশয্যে আমায় জড়িয়ে ধরেন রবীন্দ্রনাথের বাবা। তার চোখে অনাগতকালের স্বপ্ন-কল্পনা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। ধরা গরায় বলে- ইচ্ছে থাকলেও অত বড় দেবতুল্য মানুষটার নামে নাম রাখাটা স্পর্ধার কাজ হবে ভেবে সাহস পাইনি। আজ তোমার মাথায় দোষ চাপিয়েই না হয় নামটা রাখলাম।

বিশ শতক পর্যন্ত পুরোপুরি চিঠির যুগ ছিল। রবীন্দ্রনাথের বাবাকে দেখেছি শিশু রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে দারুণ সব চিঠি লিখতেন। আমাকে দেখিয়ে বলতেন- দেখো, নেহরুর পরে দ্বিতীয় ‘গ্লিম্পস অফ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রী’ বইখানা হবে আমার।
-আপনি রবীন্দ্রনাথ আর ওর মাকে এখানে নিয়ে আসেন না কেন?
-আমি গাঁয়ের মাটি মেখে বড় হয়েছি । আমার পূর্ব পুরুষরাও তাই।যদি রবীন্দ্রনাথকে শহরে নিয়ে আসি গাঁয়ের প্রতি ওর মমত্ববোধ কমে যাবে । আমার অন্তর বরং স্নেহ-বুভূক্ষু থাক। রবীন্দ্রনাথ চৌদ্দপুরুষের স্পর্শ পাওয়া ধুলোমাটি মেখে বড় হোক ।
দ্বিতীয়বার রবীন্দ্রনাথকে দেখতে যাই যেদিন সে সারা দেশের মধ্যে বেশি নম্বর পেয়ে প্রাথমিকে ট্যালেন্টপুল স্কলারশীপ পায় । আবার উৎসব, আবার সমবেত লোকজনের হৈ-হুল্লোড় ।
তার বছর দুই পর, রবীন্দ্রনাথ তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে । এক গভীর রাতে রবীন্দ্রনাথের বাবা আসেন আমার বাড়িতে । তার চোখ-মুখে ভীষণ অস্থিরতা, বিপর্যস্ত চেহারা । বলেন, প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে আমার চৌদ্দপুরুষের জন্ম ভিটেয় ধর্মীয় সংখ্যালঘু বলে উগ্র ধর্মান্ধগোষ্ঠীরা আগুন লাগিয়েছে। সারা দ্বীপ জুড়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন গণহত্যা হয়েছিল তেমনি হচ্ছে। পার্থক্য হল- এবার আর হানাদার বাহিনী নয়, হত্যা এবং লুন্ঠনকারীরা এদেশেরই সম্মানিত নাগরিক আর তাদের হিংস্র শিকার ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী!
আমার ভাষা হারিয়ে গিয়েছিল। একটা স্বাধীন দেশে এমন হওয়া সম্ভব কিনা ভাবছিলাম। আমরা কি তবে আবার শ্বাপদ-সঙ্কুল আরণ্যক যুগে ফিরে চলছি? সেই রাতেই রবীন্দ্রনাথের বাবার সাথে তার প্রিয় গাঁয়ে গিয়ে পরিবারবর্গ নিয়ে আসি। কিন্তু গ্রামে নারী লুন্ঠনের বিভিষীকা, হত্যা-অগ্নি সংযোগের বীভৎস চিত্র দেখে রবীন্দ্রনাথের বাবা যেন কেমন হয়ে যান। শিশু রবীন্দ্রনাথের চোখেও দেখেছি ভীষণ আতঙ্ক। পড়াশোনায় মন নেই, ঠিকমত খাবার-দাবার খায়না, বিষণ্ন-মলিন মুখে সারাদিন বসে থাকে।
তারপর যা ঘটে তা আমাকে স্তব্ধ করে দেয়। একদিন খুব ভোরে কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলে দেখি রবীন্দ্রনাথের বাবা দাঁড়িয়ে, হাতে একটা নোটবুক। আমার হাতে দিয়ে বলেন- বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার পূজারীর মৃত্যু হয়েছে। এটা ভাল লাগলে তুমি রেখে দাও, নয়তো ফেলে দিও। আর এই ধর্মীয় বৈষম্যপূর্ণ পরিবেশে শঙ্কিত মানসিকতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বড় হবে, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসে ধর্মীয় সম্প্রদায় তুলে ইতর মুখের গালাগাল শুনে জীবন-যাপন করবে- একজন পিতা হয়ে এটা আমি চাইনা। তুমি তো আমাদের দ্বীপের অবস্থা দেখেছো! আজ না হয় প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে, কালও কি পারবে? তারচেয়ে ওর মাকে নিয়ে পশ্চিম বাংলায় পাঠিয়ে দিই।
সেই মুহুর্তে কিছু বলার ভাষা ছিলনা। আর গভীরতম সঙ্কটে তুচ্ছ উপদেশে খুব একটা লাভ হয়না। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের বাবার মত উচ্চ শিক্ষিত এবং প্রাজ্ঞ ব্যক্তিকে।
কিছুদিন পালিয়ে বেড়িয়েছি যাতে রবীন্দ্রনাথের বাবার সাথে দেখা হয়ে না যায়। বেশ কিছুদিন পরে এক সন্ধ্যায় তার বাসায় যাই। ভেজানো দরজা ঠেলে অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করতে যেন একটা অপরিচিত কন্ঠস্বর বলে ওঠে- আজ তো শুক্রবার, পার্কে যাওনি?
নিজের হাতে আলো জ্বেলে দেখি- কঙ্কালসার একটা লোক বিছানায় পড়ে আছে। চিনতে কষ্ট হয় তিনি রবীন্দ্রনাথের বাবা। চোখ দু’টো কোটরে ঢুকে গেছে। গলার স্বর পর্যন্ত অন্য রকম। কপালে হাত দিয়ে দেখি প্রচন্ড জ্বর। সারাদিন অভূক্ত। প্রিয়তম স্ত্রী আর আত্মজকে প্রবাসে পাঠিয়ে তিনি যেন স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করে নিয়েছেন। তাই স্পর্ধিত যৌবন অন্তর্হিত হয়ে নিমেষে বার্ধক্য নেমে এসেছে।
সুস্থ হয়ে উঠলে একদিন খুব সঙ্কোচের সাথে বলি- আপনার দেশপ্রেম, আগামীদিনের বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা, ধর্মান্ধতা থেকে প্রগতির দিকে ক্রমোত্তরণের স্বপ্ন নিয়ে লেখা বহুমূল্যবান প্রবন্ধগুলো আমি পড়েছি। তারপরও আপনার শারীরিক অবস্থার প্রেক্ষিতে বলছি, আপনি স্ত্রী-পুত্রের কাছে চলে যান।
-সুহৃদ হসেবে আমিও হয়তো কাছের মানুষকে এই পরামর্শই দিতাম। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখেছো? এই দেশ মাতৃকার স্তন্যে, পুর্বপুরুষদের স্বপ্নে এখানকার ধুলিকাদায় এ পর্যন্ত বেড়ে উঠেছি। স্ত্রী-সন্তান এসেছে তো ভরা যৌবনে! কিন্তু তার আগেও তো নিজেকে শূন্য মনেহয়নি! এখানকার জল-বাতাস-মাটি আমার পঞ্চভৌতিক সুন্দর অবয়বটাকে লালন-পালন করেছে। এই জন্মভূমি ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারবনা। আমি অনেক ভেবেছি। এই মাটির গভীরে আমার সত্ত্বার শিকড় প্রোথিত হয়ে আছে। এর একটা ছিঁড়ে গেলেও আমি বাঁচতে পারবনা। তার চেয়ে স্ত্রী-পুত্রের শূন্যতা নিয়েই কাটিয়ে দিই জীবনটা। রবীন্দ্রনাথের জীবন না হয় অন্য মাটিতে বেড়ে উঠুক। এই জন্মভূমি ছেড়ে আমার মুক্তি চাইনা।
মৃদু হেসে ডাক্তার বলেন- সিসিইউতে রাত্রি যাপনের নিয়ম নেই। আমি তো রয়েইছি! আপনি বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম করুন। কাল সকালে আবার দেখা হবে।
আসার সময় রোগীর কাছে সেলফোনসহ যা কিছু ছিল আমার কাছে দিয়ে দেন।

খেতে বসলে মনীষা বলে- তুমি রবীন্দ্রনাথের কাছে একটা ফোন করে জানাও। তোমার শরীরও তো বেশি ভাল নেই। একা আর কত সামলাবে!
-আগে ওঁর জ্ঞান ফিরুক। তারপর দু’জনে মিলে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। তুমি তো জানো, রবীন্দ্রনাথের বাবা সাধারণের থেকে অনেক বেশি সেন্সেটিভ। যদি কিছু মনে করেন!
-এতে মনে করার কি আছে! বৃদ্ধ বাবার অসুস্থতার খবর ছেলে বা তার মাকে জানানোই তো উচিৎ! বরং না জানালে তারা তোমাকে দোষ দিতে পারে। ধরো যদি কিছু হয়ে ….! কথাটা অসমাপ্ত রেখে মনীষা আগের কথায় ফিরে আসে- তুমি একটা ফোন করো। না হয় আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিও যে, আমার কথায় ফোনটা তুমি করেছো।
-আমিও তোমার কথায় একমত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বাবা যে ক’দিন আগে স্ত্রী-পুত্রের কাছ থেকে এলেন তারপর কিন্তু আমাদের সাথে যোগাযোগ করেননি! আর আসার পরেই হার্ট অ্যাটাক! আমি বিষয়টার মধ্যে কেমন যেন একটা যোগসূত্র খুঁজে পাই! তাই বলছিলাম আর কি!

  • সে যাই হোক, তোমার কর্তব্য তুমি করো।আগে তাদের জানাও। তারপর যা হবার হবে।
    অগত্যা সেলফোনটা হাতে নিতেই হয়।
    ফোনে রিং হচ্ছে আর আমার মনে ভেসে উঠেছে লজ্জায় জড়সড়, শান্তশিষ্ট সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া রবীন্দ্রনাথের ছবি। মেয়েলি গলায় মিষ্টি করে কথা বলে। হঠাৎ স্বপ্নের জাল ছিন্ন করে বাজখাঁই গলায় কেউ বলে ওঠে- “হ্যালো, রবাদা বোলজি।”
    আমার হৃদপিন্ড ধড়াস্ করে ওঠে, গলা শুকিয়ে যায়। তোতলাতে তোতলাতে কোনমতে বলি- রবীন্দ্রনাথ আছে? তার সাথে একটু জরুরি কথা ছিল।
    -বোলজি। তুমি গে বোলজো?
    -আমি রবীন্দ্রনাথের বাবার বন্ধু, অমিতাভ বাগচী বলছিলাম।
    -ও অমিদাব গাগু? বলো গি গবর?
    ফাঁকে ফোনটা নামিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিই- আমি ভুল শুনছি না তো! কথাগুলো অস্বাভাবিক শুনাচ্ছে কেন? আবার কানে তুলে বলি- তুমিই রবীন্দ্রনাথ! কেমন আছো বাবা?
    -ওই চোলজে। বলো গি বোলবে?
    -তোমার বাবা গতকাল থেকে খুব অসুস্থ। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে রেখেছি।
    মুখের কথা টেনে নিয়ে বলে- আছজা। তাকে বোলো আমার চীফ মিনিস্টারের প্রোগ্রাম আছে। এগন যেতে পারবনা।
    -তাকে বলার অবস্থায় নেই। খুব.., কথা শেষ না হতেই ফোন কেটে দেবার শব্দ পাই। আমার আগের ভাবনার সাথে সমর্থনসূচক আর একটি ইতিবাচক দিক যোগ হয়। তবু মনীষার দিকে চেয়ে হাসার চেষ্টা করি- আসবে বোধহয়।
    -আমি বলছিলাম না! তুমি মিছেমিছি আকাশ -পাতাল ভেবে মরো। বাবার অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে একমাত্র সন্তান কি না এসে পারে! যাক, ভালোই হল। কবে আসবে বলেছে?
    -এক দেশ থেকে আর এক দেশে আসতে গেলে গুছগাছ আছেনা? সপ্তাহখানেক লেগে যাবে বোধহয়।
    স্বস্তির একটা মৃদু হাসি ছড়িয়ে পড়ে মনীষার ঠোঁটে যা দেখে দুশ্চিন্তার মধ্যেও একটা চুম্বনের ইচ্ছে জাগে। আর ভিতরের সমস্ত উদ্বেগ-উৎকন্ঠা চাপা দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করি।
    রবীন্দ্রনাথের বাবার জ্ঞান ফিরেছে। শারদ প্রভাতের মিষ্টি সোনালি রোদের মত এক টুকরা শান্ত আবেশ জড়ানো তার মুখে। আমাকে দেখে ক্লান্ত স্বরে বলে- বেঁচে যাব বোধহয় এবারের মত, কি বলো?
    -আপনাকে মরতে দিলে তো! আমি রবীন্দ্রনাথকেও ফোন করেছি। সে এলো বলে।
    -কি বললে তুমি!
    খুব উত্তেজিত আর অস্বাভাবিক মনেহচ্ছে রবীন্দ্রনাথের বাবাকে। আমি ছুটে গিয়ে ডাক্তার ডেকে আনার আগেই অ্যাকিউট ব্রেইন স্ট্রোক।
    এবার নিরুপায় হয়ে ফোনের পর ফোন করতে থাকি রবীন্দ্রনাথ আর তার মাকে। এক সময় এসেও যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আসেনা, যে নামটি স্বপ্নদর্শী বন্ধুরা মিলে রেখেছিলাম সে নামটিও মুছে গেছে। আর নামের মালিক মরে গিয়ে সেখানে জন্ম নিয়েছে প্রচন্ড শক্তিশালী উদ্বাস্তু নেতা ‘রবাদা’। তার চোখ দু’টো টকটকে লাল, মাথায় বাবরি দোলানো চুল, ইয়া বড় গোঁফ, কপালে একটা গভীর কাটা দাগ। কবজিতে মোটা একটা রূপোর চেইন আর দু’টো তামা অথবা অষ্টধাতুর চুড়ি হবে। হাত নাড়ালে ঠনঠন শব্দ হয়। হাঁটতে-বসতে-কথা বলতে সব সময় একটা অস্থির ভাব, যেন ঘোরের মধ্যে আছে। নিকষ কালো সানগ্লাসটা খুললে ভয়ে বুকটা হিম হয়ে আসে।
    ঠিক তার উল্টো অবস্থা রবীন্দ্রনাথের মায়ের। যৌবনে তাকে দেখেছি সুচিত্রা সেনের মত। বরং সুচিত্রা সেনের অবয়বে একটু রুক্ষতা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু তিনি ছিলেন আরো কোমল আরও সুন্দর। সেই নারী যিনি রবীন্দ্রনাথকে আগলে রাখতে জীবনের মধুবসন্তে স্বামী সঙ্গহীন কাটিয়েছেন। স্বামী-স্ত্রীর মান-অভিমান, প্রেম-ভালবাসা, আদর-সোহাগ, খুনসুটি সবকিছু নিষ্ঠুরভাবে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। শুধু কি তাই! দ্বিতীয় সন্তান পর্যন্ত নেননি! সারা জীবন শরীরকে কঠোর শাসনে বেঁধে অভুক্ত রেখেছেন, একমাত্র রবীন্দ্রনাথের দিকে চেয়ে। সেই রবীন্দ্রনাথের এ কী হাল!
    মা কিন্তু ছেলের এই বিপর্যয়ে দোষী করেননা ছেলেকে। তিনি বরং রবীন্দ্রনাথের পক্ষ নিয়েই কথা বলেন- কৈশোর থেকে পিতার আদর-স্নেহ-শাসন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ওখানে গিয়ে বাঙ্গাল, উদ্বাস্তু বলে সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধবের কাছে কম অপমান সইতে হয়নি। এসব থেকে মুক্তি পেতেই সে ক্ষমতাবান হতে চেয়েছে। নিজের সামনে সবার ভীরু দৃষ্টি কামনা করেছে। কিন্তু দুষ্ট রাজনীতির কাছে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়ে ক্ষমতার ঝুলি বাহক হয়েছে। বাঘ হতে আর পারলনা, বাঘের ল্যাজ হয়েছে। কাঙ্ক্ষিত ক্ষমতার মালিক হতে গিয়ে ভৃত্যের ক্ষমতা পেয়েছে। এলাকার ওর নামে সবাই ভয় পায়। আর ভয় পাইয়ে যে কাজ করাতে হয় ও তা-ই করে। তার মধ্যে ভোট আদায় করা প্রধান কাজ। আরো কিছু আছে যা আমি জানতে পারিনি। ওর চ্যালা-চামুন্ডারাও ওর মত সবাই উদ্বাস্তু। ওরা চেয়েছে ওখানকার সবাই ওদের ভয় পাক। কিন্তু বড় হওয়া, মানুষ হওয়া কাকে বলে তা এ জীবনে জানতে পারলনা, যে স্বপ্ন রবীন্দ্রনাথের বাবা সারা জীবন দেখেছিলেন।
    স্বপ্ন- হৃদপিন্ড নিংড়ানো স্বপ্ন বুকে নিয়ে পাষাণ বেঁধে রবীন্দ্রনাথের বাবা পুত্রকে প্রবাসে পাঠিয়েছিলেন। আজ আর সেই স্বপ্নের উন্মত্ততা নেই। সব স্বপ্ন, জীবন-যৌবন, স্থির, শান্ত হয়ে গেছে। দু’দিন যেতেই রবা ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর তাকে যেতে বলে ফোনের পর ফোন আসতে থাকে। অবশেষে সে নিজেই যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। যাবার আগে হাসপাতালে বাবার মুখের দিকে নির্ণিমেষে বিপন্ন, অসহায় চোখে চেয়ে ধীরে ধীরে বেড়িয়ে যায়। আমি আর তার মা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাই। আর এমন একটা দৃশ্য চোখে পড়ে যা আমার কল্পনাতেও ছিল না- মাকে জড়িয়ে ধরে রবীন্দ্রনাথ পাগলের মত হাউমাউ করে কাঁদছে। পাথরের বুকে কি জলের ধারা বয়! আমি স্বপ্ন দেখছি না তো!

বিমানটা দূর আকাশে মিলিয়ে যাবার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বৌদি হাসপাতালে ফিরে আসেন। তার দিকে তাকাতে সাহস হয় না। যেন একটা বোবা কান্নার পাহাড় জমে আছে।
রবীন্দ্রনাথের বাবা নির্বিকার, অচেতন। তিনি জানতেও পারেননি তার আত্মজ, যাকে গোটা জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য উৎসর্গ করেছিলেন, যাকে ঘিরে পৃথিবীর মধুরতম স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে এসেছিল।

One thought on “ছোটগল্পঃ রবীন্দ্রনাথের বাবা স্বপ্ন দেখেছিলেন – সন্তোষ কুমার শীল (বাংলাদেশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *