রৈবতক-কথা
সংগ্রামী লাহিড়ী
“তোমায় আজ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।” রেবা মনে করাল। “ব্লাডওয়ার্ক, রুটিন এন্ডোস্কোপি, ইসিজি। সবইএকসঙ্গে হয়ে যাবে।”
“জাহান্নমে যাও তুমি।” মনে মনে ব’লে শুভ পাশবালিশ নিয়ে পাশ ফিরল। মুখে বলার সাহস নেই।
আজকাল কেমন একটা ক্ষীণ সন্দেহ হয়, রেবা কি মনের কথাও জেনে ফেলছে? হতেই পারে। গুণে ঘাট নেই।
নিজের স্বাস্থ্য,ভালোমন্দের ব্যাপারে রেবা দুশো ভাগ সজাগ। নিয়ম করে হেলথ চেক-আপ, মেনটেনান্স, কোনোটাই বাদ দেয় না। রুটিন মেনে নিজেকে রিচার্জ করে নেয়। প্রাণশক্তিতে সদাই ভরপুর।
প্রত্যেক মাসে রেবার জন্যে একটা করে রোবোপ্যাচ আসে। আরো বেশি বুদ্ধি, বিবেচনা, অ্যানালিসিসপাওয়ার ভ’রে দেওয়া থাকে, ভুলত্রুটিও শুধরে দেওয়া থাকে। নিয়ম করে সেগুলো লাগিয়ে নেয় রেবা। কেজানে, রোবোপ্যাচের মধ্যে হয়তো বামনের কথা বুঝে নেবার ক্ষমতাও আস্তে আস্তে ভ’রে দিচ্ছে! রোবো কর্পোরেশনগুলো যা ইচ্ছে তাই করতে পারে, এমনই লম্বা হাত ওদের। এই একুশশো সালের পৃথিবীতে ওরাই প্রভু।
ভাবনায় ছেদ পড়ল। রেবার কাংস্য কণ্ঠ আবার বেজে উঠেছে।
“কথা কানে গেলনা? গ্যারাজে গাড়ি রেডি। তোমায় নিয়ে যাবে। ওঠো দেখি, আমি তোমার ব্রাশ-পেস্ট, কফি, ব্রেকফাস্ট – সব অ্যাসেম্বলি লাইনে চাপিয়ে দিয়েছি।”
এইবার টনক নড়েছে। তড়াক করে শুভ উঠে পড়ে।
অ্যাসেম্বলি লাইন? বাপরে! সে অতিমারাত্মক বস্তু।
ঘুম থেকে উঠে বিশেষ প্রাতঃকালীন চেয়ারে তুমি বসবে। প্রথমেই তোমার দাঁত লক্ষ্য করে নাচতে নাচতে আসবে পেস্ট ভর্তি ব্রাশ। আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত কায়দায় বত্রিশপাটির ওপর নাচন কোঁদন চালাবে। পুরোটা সময় তুমি হাঁ করে থাকবে। মুখ বোজা চলবে না, তাহলেই ধমক!
তারপর আসবে অটোমেটিক জলের ফোয়ারা। বিশুদ্ধ, জীবাণুমুক্ত জলেপরিষ্কার করে মুখ ধুয়ে দেবে।
এরপর পরই কফি। তার সঙ্গে ভিটামিন-ভরা ডিম, প্রোটিন পাঁউরুটি, মিনারেলস মাখন।
কোনো কিছুর একচুল এদিক ওদিক হবে না।
ঠিক সময়ে চেয়ারে হাজিরা দিতেই হবে। রেবার কড়া নির্দেশ।
অকথ্য একটা গালি বেরোচ্ছিল মুখ দিয়ে। আটকাতে গিয়ে নিরুপায় হয়ে নিজের মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরে শুভ।
রেবার ভুরু কুঁচকে গেছে। “হাইতুলছ? তারমানে অক্সিজেনের অভাব। আচ্ছা, বলেদিচ্ছি, একবার অক্সিজেন লেভেলটাও মেপে নিক।”
বাধ্য ছেলের মত তৈরী হয়ে নিল শুভ। শনিবারের ছুটির দিনটা গোল্লায় গেল। আরো একটু বিছানায় গড়ানো যেত। যদিও রেবা সেটা মোটেই পছন্দ করে না, চেয়েচিন্তে সপ্তাহান্তের এটুকু সুবিধে সে আদায় করেছে।
গ্যারাজে গাড়ি রেডি। টেসলা কোম্পানির সেলফ ড্রাইভিং কার, নিজেই চলে। গাড়িতে শুধু উঠে বসার অপেক্ষা।
টেসলা ঐতিহাসিক কোম্পানি। একশো বছরেরও আগে, দুহাজার সালের প্রথম দিকেই তৈরী করেছিল ব্যাটারিতে চলা গাড়ি। সে কবেকার কথা! তখনই সে গাড়ি সামান্য বুদ্ধিমান, নিজেনিজেই একটু আধটু আগুপিছু করতে পারে। রাস্তায় ক্রুজ কন্ট্রোলে চলতে চলতে নিজেই স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নেয়। গাড়ির মিউজিয়ামে সেরকম গাড়ি কয়েকটা রাখা আছে। শুভ দেখেছে।
এখনকার গাড়ির সঙ্গে অবশ্য তার তুলনাই হয় না।
ভাবতে ভাবতেই শুভ গ্যারাজে। ধাতব কণ্ঠে গাড়ি সুপ্রভাত জানাল। অন্যমনস্ক শুভ ফিরিয়ে দিল সুপ্রভাত। উঠে বসেছে গাড়িতে। আরামদায়ক সিট। শুভর ক্যালেন্ডার ভরে দেওয়া আছে গাড়ির মেমোরিতে।গাড়ি খুব ভালোই জানে কখন কোথায় যেতে হবে।
বাইরে ঝকঝকে একটা দিন। নীল আকাশ। বাতাসে টান ধরছে, শীত এল বলে। ধুত্তেরি, এমন একটা দিন কিনা ডাক্তারের চেম্বারে কাটবে?
মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি। ফোন করেছে পৃথাকে। ছোট্ট বয়েস থেকে গলায় গলায় বন্ধু তারা।
“কী করছিস রে?”
“গান শুনছি।” খুশিখুশি গলা। পেছন থেকে গানের আওয়াজও আসছে।
কান খাড়া করে একটু শোনার চেষ্টা করে শুভ। এই মেয়েটা বরাবর আদ্যিকালের পুরোনো পুরোনো গান শোনে। সেই একশো বছর, দেড়শো বছর আগের সব গান। আর্কাইভ থেকে ডাউনলোড করে নেয়। কে এক সলিল চৌধুরীর গানের বিরাট ভক্ত। দারুণ ট্যালেন্টেড কম্পোজার, সময়ের থেকে অনেক এগিয়েছিলেন। আঁতলামি যত!
কিন্তু সক্কাল সক্কাল গান শুনছে মেয়েটা, পারমিশন দিল কে? ওর বাড়ির রবিজেঠুতো আরও কড়া! বয়েস হয়েছে অনেক, প্রাচীন পন্থী। হাতের তেলোর ওপরে রাখে পৃথাকে। সাত সকালে গান শুনতে দেবেই না!
“রবিজেঠু কই?”
“আর বলিস না, সে এক কাণ্ড!” খুশিতে ফুটছে পৃথা।
এত খুশি কীসেররে বাবা! শুভ হকচকিয়ে গেছে।
“রবি জেঠু বেশ বুড়ো, বয়েস হয়েছে অনেক, সেতো জানিসই।” পৃথা কলকলিয়ে উঠেছে।
“হুঁ, শুনেছিতো। সেই প্রথমদিকের প্রোডাকশন ব্যাচ। রোবট কারখানাগুলো তখন সবে চালু হচ্ছে।”
“হ্যাঁরে, তখনই তো বাবা কিনে আনল। আমাদের বলল জেঠু বলে ডাকতে।”
“তোর ইতিহাসের পাঁচালি রাখ দেখি? ঝেড়ে কাশ। কী হয়েছে রবিজেঠুর?”
“আরে গত কালই একটা নতুন রোবোপ্যাচ রিলিজ করলনা? সব্বার জন্যে? কী নাকি এক খুঁত রয়ে গেছে অনেকদিন ধরে, ওই প্যাচ দিয়ে মেরামত হবে।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার বাড়ির রেবাও তো নিল দেখলাম।”
“রবিজেঠুর বয়েস হয়েছে তো অনেক, ওই রোবোপ্যাচ মনে হয় রবিজেঠুর ওপর ঠিকঠাক কাজ করেনি, মানে কম্প্যাটিবল নয়। প্যাচ নেওয়ার পরপরই দেখছি কেমন যেন উল্টোপাল্টা, নিজের মনেই কীসব যেন বলছে।”
“বলিস কীরে?” শুভ হাঁ। “কী হবে তাহলে?”
“আমিও প্রথমটা ঘাবড়ে গেলাম, বুঝলি? কী করি? এমার্জেন্সি ডাকব? রোবো কারখানার হসপিটালে নিয়ে যাব?”
“তাছাড়া আর উপায় কী?”
“কিন্তু ভেবে দেখ, রবিজেঠু হসপিটালে গেলে ফেরার চান্স কম। ওর ওয়ারান্টি অনেক দিন হল ফুরিয়ে গেছে। আমাকে রিপ্লেসমেন্ট দিয়ে দেবে, তোর ওই রেবার মত কাউকে!”
“তাতো ঠিকই!”
“তাই সাত পাঁচ ভেবে ঠিক করলাম, ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখা যাক। প্যাচ নেওয়ার পর রবিজেঠু আর আগের রবিজেঠু নেই। মনে মনে জটায়ুর স্টাইলে বললাম, ‘আপনাকেতো কাল্টিভেট করতে হচ্ছে মোয়াই!'”
“জটায়ু? সে আবার কে?” শুভ অথৈ জলে।
“উফ, শুভ, জ্ঞানগম্যি এত কম কেন তোর? এই তো মোটে দেড়শো বছর আগের কথা। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার সিনেমা। ওই ডায়লগটা লোকের মুখে মুখে ফিরত।”
শুভ চুপ। হবেও বা। সত্যিই তার অত পুরোনো জিনিসপত্র জানা নেই। পৃথাই জানে ওসব, চর্চা করে।
“শোন তারপর কী হল। আমায় বলছে, ‘শুক্কুর বারের রাত, চল একটু স্পেশ্যাল ডিনার বানানো যাক। মোগলাই পরোটা আর ঝাল ঝাল কষা মাংস হলে কেমন হয়?’ আমিতো এক কথায় রাজি। ছোটবেলায় আমার মায়ের হাতে কত খেয়েছি! মাঝে মাঝেই তো ডিনারে থাকত ওই দুটো আইটেম।”
“রবিজেঠু সত্যি রাঁধল?”
“হ্যাঁরে, একদম মায়ের হাতের রান্না। বলল, মা নাকি ওকে রেসিপি শিখিয়ে দিয়েছিল।”
“তাহলে এতদিন করেনি কেন? অ্যাঁ?” শুভ তেড়েফুঁড়ে উঠেছে।
“আহা, ওদের তো রোবো কম্যান্ড হেডকোয়ার্টারের কথা শুনে চলতে হয়। ওই যেমন তোর বাড়ির রেবা। এত কার্ব খেতে কখনোই অ্যালাও করবে না।”
রেবার কথা উঠতেই দাঁত কিড়মিড় করে শুভ, “রাক্ষুসি একটা!”
পৃথা কান দেয়না, বলে চলে, “রবিজেঠু কী বলল জানিস? নতুন রোবো প্যাচটা নেওয়ার পরই ও নাকি বুঝে গেছে রোবোকম্যান্ডকে কেমন করে বাইপাস করতে হয়।”
“বলিস কী রে?” শুভর চোখ এবার ছানাবড়া।
“হ্যাঁরে। আজ ছুটির দিনে আমি আর রবিজেঠু প্ল্যান করেছি, একটু সমুদ্রের ধারে ঘুরতে যাব। বোর্ডওয়াক ধরে হাঁটব, পা ভেজাব জলে। রাস্তার ধারের দোকান থেকে ফাস্টফুড খাব। যা প্রাণ চায় তাই করব। সেই ছেলেবেলায় বাবা-মা রসঙ্গে বিচে যাওয়ার মত।”
পৃথার গলাটা কি একটু ভেঙে আসে? শুভ, পৃথা, ওদের কারোরই মা-বাবা ওদের সঙ্গে থাকেন না।
পৃথিবী শুধুই যুবক-যুবতীদের জন্যে। মঙ্গল গ্রহে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্যে আলাদা কলোনি। রিটায়ার করে সবাইকে সেখানেই যেতে হয়। কী যেন তার নাম, হ্যাঁ, বানপ্রস্থ-নগর।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ।
“আমায় তোদের সঙ্গে নিবি?” খুব আস্তে বলে শুভ, যেন শুনতে না পাওয়ার মত করে।
“হ্যাঁ অ্যাঁঅ্যাঁঅ্যাঁ…” পৃথা খুব রাজি।
“কিন্তু আমার গাড়ি যে যাচ্ছে ডাক্তারের চেম্বারে, অন্য কোথাও যাবেই না! বললেও যাবে না। ক্যালেন্ডারে যা প্রোগ্রাম করা আছে, তাই!”
“দাঁড়া না, বাবারও বাবা আছে। রবিজেঠু ঠিক বাতলে দেবে কীকরে গাড়ির প্রোগ্রামকে বাইপাস করতে হয়। প্যাচ নিয়েছে না? এখন আমার রবিজেঠু সব জানে।” খুশিতে ফুটছে পৃথা।
“জেঠুউউউ…” ডাকছে গলা ছেড়ে।
“এই যে, যাই মামণি…” দূর থেকে ভেসে আসে আওয়াজ। ধাতব গলায় যেন প্রাণের স্পর্শ।
কী বলল? মামণি! শুভর চোখ ভিজে আসে। মনে পড়েছে, ওটা পৃথার ছোট্ট বেলার আদরের ডাকনাম।
ভালো লাগলো। আরও লিখতে থাকুন।
আগামী র সুস্পষ্ট ছবি। বড় ভালো লাগলো।
খুব ভাল। আনন্দদায়ক।
বেশ সুন্দর! দারুণ লাগল।
দারুণ লাগল