গল্পঃ অনুসর্গ – মলয় চৌধুরী ( জলপাইগুড়ি)

অনুসর্গ
মলয় চৌধুরী

দুই হাঁটুর উপর মুখ গুঁজে বসেছিল শ্যাম। ভর সন্ধ্যেবেলা । আশপাশের বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ আসছে। শ্যামের এই টিনের শেড দেওয়া কারখানা ঘরে আজ অন্ধকার। বুকের মধ্যে হু হু করা শূণ্যতা। এ যেন খুব নিকট প্রিয়জনকে বিদায় দেবার যন্ত্রণা । কেন এমন হয় ?
শ্যাম শিল্পী। সে প্রতিমা গড়ে। ছোটবেলা থেকেই আঁকা আর মাটির কাজের সহজাত দক্ষতা ছিল তার। দারুণ অভাবের সংসার তাদের।
বাবা একটা সাইকেল তৈরীর কারখানায় কাজ করতো। সেই কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ছোট একটা পান- বিড়ির দোকান চালায় এখন। শ্যামেরা তিন ভাই, দুই বোন। মা চির রুগ্না। বড়ো ভাই শিবু একটা দাতব্য প্রাইমারি স্কুলে অতি অল্প বেতনে পড়ায়। তাদের কাছে খাওয়াপরা, স্কুলের পড়া চালানো এ সবই হল প্রতিদিনের লড়াই।
ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় শ্যাম নেহাৎই খেলাচ্ছলে তাদের কাঠকুটো রাখার চালাটার নীচে দূর্গা প্রতিমা গড়তে শুরু করে। কুমোর পাড়ায় যাতায়াতের সুবাদে প্রাথমিক একটা ধারণা তার ছিল। সেই মতো কাঠামো তৈরি করে খড় বেঁধে মাটি লেপা হয়ে গেল। কাঠকুটো, খড় সবই চেয়ে চিন্তে আনা। মাটি লেপার পরে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল প্রতিমার মুখ। শ্যামের কাছে মুখের কোন ছাঁচ ছিল না ।
শ্যাম তার কিশোর মনের কল্পনার সবটুকু ঢেলে দিল মা দূর্গার মুখ গড়তে। খালি গড়ে, পছন্দ হয় না। ভেঙে দেয়। আবার গড়ে। বহুবার ভাঙা গড়ার পরে একটা মুখ তার মনে ধরলো। সেই মুখের ছাঁচেই এখনো সে তার দূর্গার মুখ গড়ে।
এত দূর পর্যন্ত এগিয়ে আরো বড়ো সমস্যার সামনে পরলো শ্যাম। মাটি লেপার পরের ধাপে রঙ লাগাতে হবে। তারপর প্রতিমার সাজসজ্জার খরচ আছে। যে ভাবে বাঁশ, খড় চেয়ে চিন্তে যোগাড় করেছে, বাকি সব সরঞ্জাম তো ঐ ভাবে আসবে না। এতদূর এসে থেমে যাবে তার এই খেয়াল! শ্যামের ঘুম ছুটে গেল।
কথায় বলে, যোগায় চিন্তামনি। শ্যামের প্রতিমা গড়ার গল্প তার বন্ধুদের মুখে মুখে ছড়াচ্ছিল। পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠদের কানেও কথাটা গেল। তারা একদিন কৌতুহলী হয়ে শ্যামের কাজ দেখতে গেলেন এবং মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এর আগের পর পর দু বছর বিভিন্ন কারণে পাড়ায় দুর্গা পুজো হয় নি। বড়োরা ঠিক করলেন,পাড়ার ছেলে শ্যামের গড়া প্রতিমা দিয়েই আবার পুজো শুরু হবে। ক্লাবের পক্ষ থেকে শ্যামের প্রতিমার মূল্য ঠিক করে বায়না হিসাবে অর্ধেক দাম দিয়ে দেওয়া হল।
শ্যাম পায়ের তলায় শক্ত জমি পেল। রঙ ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কেনার টাকা সে পেয়ে গেল। এবার বাবা আর সব ভাই বোন হাত লাগালো শ্যামকে সাহায্য করতে। ছোট ভাই দীপু সব থেকে বেশী নেওটা, প্রায় সবসময় সে দাদার পাশে পাশে থাকতো, কাজ করা দেখতো আর এটা সেটা এগিয়ে দিত। শ্যামের প্রথম সৃষ্টি ভালমতন উতরে গেল।
এরপর চার বছর কেটে গেছে। এখন শ্যাম আট- দশটা দুর্গা প্রতিমা গড়ে। টিনের শেড দেওয়া কারখানা হয়েছে। বেশ কয়েকটি কালী মূর্তিও গড়ে। তার তৈরি প্রতিমার কদর আছে। তাদের অভাবের সংসারে একটু একটু করে স্বচ্ছলতা আসতে শুরু করেছে। দীপু এখন আর ছেঁড়া জামা পরে ঘোরে না। বোন দুটো একটু সাজার সুযোগ পেয়েছে। মায়ের ওষুধ কিনতে পারে ঠিকঠাক। বাবা ময়লা, ছেঁড়া লুঙ্গি পরে আর দোকানে বসে না। সবাই এক ডাকে শ্যামকে চেনে।
এই বছর শ্যাম দশটি দুর্গা প্রতিমা গড়েছে। বাড়ির সবাই হাত লাগিয়েছে। আজ শ্রী পঞ্চমী। সকাল থেকে শ্যামের কারখানায় কর্মব্যস্ততা। তুলির শেষ টান দিতে হবে। শাড়ি, গয়না ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নিতে হবে। পুরো পরিবার কাজে ব্যস্ত। তার মধ্যেই কোথায় যেন বিষাদের সুর বেজে চলেছে। প্রতি বছরই এমন হয়। একে একে সব প্রতিমাকে বিদায় দিতে হবে যে !
জাগরণ সংঘের থিমের পুজো। সেই মতো প্রতিমার বায়না করে গেছিল চারমাস আগে। টাকাও ভাল দেবে। পরিকল্পনা মাফিক প্রতিমার গড়ন ও কারুকাজ কেমন হবে সে সব থিম মেকার সুজিতবাবু বুঝিয়ে দিয়েছিল শ্যামকে। শ্যাম বুঝতে পেরেছে এই প্রতিমাই এবার তার হাতে গড়া সেরা প্রতিমা হবে। চার মাস ধরে তিলে তিলে নিজের সবটুকু দিয়ে প্রতিমাটি সে গড়ে তুলেছে।
একে একে সব প্রতিমা মন্ডপের পথে পারি দিল। জাগরণ সংঘের ছেলেরা যখন তাদের প্রতিমা গাড়িতে তুললো, শ্যামের চোখ ফেটে জল এসে গেল। কিন্ত পেটের দায় বড়ো দায়। যা একদিন তার শখ ছিল, আজ সেটাই তার পেশা হয়ে গেছে। এখানে আবেগ সামলে রাখতে হয়।

শেষ প্রতিমাকে বিদায় দেওয়া হয়ে গেছে। বাড়ির সবার চোখে জল। শ্যাম তার শূণ্য, অন্ধকার কারখানা ঘরে ঢুকলো। ইতস্তত ছড়ানো রঙের কৌটো, তুলি,মাটির ঢেলা, কাঠের টুকরো, কাপড়ের ফালি, পাটের চুল।
শ্যামের বুকের ভিতর কেমন করে উঠলো। গতকালও এই ঘরে আলো ছিল, মূর্তিগুলো ছিল –
তার চার মাসের সঙ্গী। চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল বেরিয়ে আসে। শ্যাম বসে পড়ে। দুই হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে দেয়।
” দাদা! ” ছোট ভাই দীপুর ডাকে মুখ তোলে শ্যাম।
” তোর খুব কষ্ট হচ্ছে না? ” শ্যাম উঠে দাঁড়ায়। দীপু এসে হাত ধরে।
“আমার সাথে একটু আয়! ” শ্যামের হাত ধরে টানে দীপু।
” দাঁড়া একটু। ” শ্যাম কারখানা ঘরে প্রদীপ জ্বালায়। দীপুর সাথে বেরিয়ে আসে।
দীপু তাকে টেনে নিয়ে আসে উঠোনের এক কোণে কাঠ- খড় রাখার ছাউনি দেওয়া ঘরটায়। ঘরের এক কোণে প্রদীপ জ্বলছে। ছোট একটা দুর্গা প্রতিমা গড়েছে দীপু। অপূর্ব সুন্দর তার চোখ মুখ। দাদাকে সাহায্য করতে করতে তার ছোট্ট হাতে প্রতিমা গড়ে ফেলেছে দীপু। শ্যামের দশটা মূর্তি তৈরির বেঁচে যাওয়া, ফেলে দেওয়া রঙ আর সাজপোশাকের টুকরো দিয়ে সাজিয়েছে তাকে।
প্রতিমার রূপে চারপাশ আলোয় ভরে গেছে। এ প্রতিমা বিক্রির জন্য নয়। ভাইকে জড়িয়ে ধরে শ্যাম।।

6 thoughts on “গল্পঃ অনুসর্গ – মলয় চৌধুরী ( জলপাইগুড়ি)

  1. দারুন লিখেছিস। এই লেখা পড়ার পর চোখে জল এসে যায়।

  2. বাঃ খুব সুন্দর গল্প। ফুরায়ে ফেলে আবার ভরে ওঠার গল্প।

  3. একটা নিখুঁত ছোটগল্প। ধন্যবাদ।

  4. পরম প্রাপ্তি ভাই। অনেক অনেক ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *