আ্যাট ইওর সার্ভিস
মৌমিতা রাবেয়া
অনেকক্ষণ ধরে পাশ ফিরতে পারছে না অমিত। খালি মনে হচ্ছে খাদে পড়ে যাব। একপাশে শুয়ে একপেশে হয়ে যাচ্ছে তবু ফিরতে পারছে না। খুব আস্তে আস্তে সোজা হবার চেষ্টা করল। ভোর হয়ে গেছে। চৌকি থেকে মাটিতে পা দিতে যাবে দেখে পায়ের নিচে সুমুদ্দুর বয়ে চলেছে , ঢেউগুলো এসে পায়ের পাতায় লাগছে আর মাথার উপর অনন্ত আকাশ। কয়েক মুহূর্ত ভালো লাগল, তারপরই অনুভব করল বাথরুমে যেতে হবে, কিভাবে যাবে ; অমিত ডুবে যাব তো ! আলমারি আলনা ধরে ধরে পাড়ের ধার ঘেঁষে ঘেঁষে অবশেষে বাথরুমে যেতে পারল।
কি সর্বনাশ! বাথরুমের দরজা খুলতেই এক খরস্রোতা পাহাড়ি নদী, একটু এদিক ওদিক হলেই এক্কেবারে — ভাবতে না ভাবতেই পা স্লিপ খেয়ে গড়িয়ে পড়ল, পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে চলেছে পাহাড়ি এবড়োখেবড়ো পথে। কিচ্ছু পাচ্ছে না ধরার মতো, খালি ধাক্কা খাচ্ছে।
—- “মিতু ওঠ অনেক বেলা হল, সারা দিন ঘুমাচ্ছে! ওঠ নিচে বাজার এসেছে যা হোক কিছু নিয়ে আয়.. আজ কিছু নেই রান্না করার মত। দুটো ডিম আর আলু নিয়ে আয়। এইভাবে ক’দিন চালাতে পারব কে জানে। কাল যে তোর অনলাইন ইন্টারভিউ হল কবে জানাবে রে ? তোর টিউশনিগুলো থাকলেও আজ এই দিন দেখতে হত না। ইংরেজি তে এম এ পাস করে ছেলে আমার ফরমায়েশি খাবার বাড়ি বাড়ি ফেরি করে বেরাবে। গাল ভরা নাম তার ‘ডেলিভারি বয় ‘। হা কপাল—
–ওঠ একটু চা চিনিও আন —
কিরে কথাগুলি কানে গেল? –ওঠ বাবা, সোনা বাপ আমার, আজ তোর পছন্দের ঝাল ঝাল ডিম বানাব ; ওঠ বাবা “
মায়ের গলা শুনে বুঝল, না সে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে না; কিন্তু ধাক্কা তো খেয়েই যাচ্ছে সেই ছোট্টবেলা থেকে। অফিসে গেল বাবা ভাত খেয়ে, ফিরল চার পেয়ে খাটে শুয়ে। সেই থেকে মা আর ও ধাক্কা খেয়েই চলেছে।
টিউশনি করে সবে দুটো পয়সা হাতে আসছিল দুবছর ধরে করোনায় সব শেষ হয়ে গেল। যেকটা পয়সা জমিয়েছিল সেও প্রায় শেষে। এমন কপাল লেখাপড়া জানা ছেলে জনসমক্ষে হাতও পাততে পারে না, কারুর দয়া করুণা সহ্য হয় না।
রমাও আজ কাল আর আসে না এদিকে। বুঝে গেছে পড়াশোনায় ভালো মানেই ভবিষ্যৎ ভালো নাও হতে পারে। তাই আর যখন তখন ঝমঝমিয়ে ঝরে পড়ে না তার বুকের উপর – ঠোঁটের উপর।
চাতক হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে অমিত, ও জানে এই তাকিয়ে থাকাটা-ই সার।
কোন ক্রমে শরীরটা তুলে বাইরে এলো। একটা তাদের বয়সি ছেলে ভ্যান গাড়িতে করে সব্জি ডিম বিক্রি করছে। হিসেবে বড্ড কাঁচা ছেলেটি, মনে হল ছেলেটি অন্য কিছু করে। অমিত জিজ্ঞাসা করার আগেই বলল, –” দাদা প্রায় দুই বছর হয়ে গেল মঞ্চে কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে না। আমি মিউজিক করি। মানে ইন্সট্রুমেন্টাল ; কি করব দাদা বাধ্য হয়েই সব্জি নিয়ে বেরিয়েছি। কবে যে সব ঠিক হবে। পেট কি দাদা করোনা মানে? প্রথম প্রথম অসুবিধা হত এখন অনেকটা সামলিয়ে নিয়েছি। আসছি দাদা। ভালো থাকবেন। “
পেট করোনা মানে না। সত্যি-ই তো মানে না। বড় লোকেরা দিনের পর দিন বাড়িতে বসে থাকতে পারে। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলি কি যে করে ? তাদের কথা, না ভাবে সরকার না ভাবে ঈশ্বর।
হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে উঠে শুনলো ‘লকডাউন’। ‘লকডাউন’ শব্দ -টাই বা কি -?-খায় না গায়ে মাখে এর আগে অমিতের জানা ছিল না । প্রাণোচ্ছল চারপাশটা হঠাৎ একদিনের নোটিশে থম মেরে গেল, মুখ থুবড়ে পড়ল যেন । প্রাণহীন হয়ে গেল সব, সব কাজ কর্ম বন্ধ হয়ে গেল , টিউশনিগুলি বন্ধ, আঁকা শেখাতো রবিবার করে তাও বন্ধ।
দুইজন অনলাইনে পড়ে বাকিদের স্মার্ট ফোনই নেই তো অনলাইন ক্লাস করবে কি করে ! দুইজন মেয়ের বাবাও — টাকা দিতে পারছেন না। বেশির ভাগ গার্জেনের চাকরি নেই।
একি পায়ের তলা থেকে বালি সরে সরে যাচ্ছে মনে হচ্ছে সে ক্রমেই বালিয়াড়ি তে ডুবে যাচ্ছে।
দম বন্ধ হয়ে আসছে। “মা — মা..”. বলে হাত পা ছুঁড়ছে বালির মধ্যে অমিত। চোখ তুলে দেখে মা ডাকছে –
—” মিতু উপরে আয়, ফোন এসেছে তোর, হোম ডেলিভারির চাকরিটা হয়ে গেছে। যাক বাবা ঈশ্বর মুখ তুলে তাকিয়েছেন।”
অমিত উটের উপর বসেছে, সঙ্গে অনেক গুলো খাবারের ক্যান। খাদের ধার দিয়ে দিয়ে ত্রিশ চল্লিশ তলা গুহায় ঢুকে পড়ে। সময়ে পৌঁছাতে হবে খাদে তলিয়ে যাও আর গাড়ির তলায় যাও টাইমের মধ্যে ডেলিভারি দিতে-ই হবে। এক মিনিট লেট হল বা কাস্টোমার এর স্টার একটা কম পড়ল তো চাকরি-টি নট, পিছনে প্রচুর অমিতদের লাইন।
বাড়িতে অমিতের মায়েরা অপেক্ষা করে। পেটের খিদে ড্রেসের মধ্যে গুঁজে আগের বাড়ির অপমান ঢোক গেলার মতো করে গিলে নিয়ে মুখে হাসি রেখে হাজির ফরমায়েশি খাবার নিয়ে অমিত -রা.. ..
— “আ্যাট ইওর সার্ভিস ম্যাম”
বাড়ি পিছু ৩০ টাকা।।
লেখনী’তে বাস্তবতা’র একটি নিখুঁত চিত্র ফুটে উঠলো। Kudos!!!!!!!
সুন্দর লেখা। বাস্তব। ধন্যবাদ।
নির্মম বাস্তব চিত্র। খুব ভাল লাগল।
খুব ভালো লাগল।