বিপন্ন
ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না
শনিবার রাত থেকে বৃষ্টি নামল। আবহাওয়া দপ্তর আজকাল প্রায় নিখুত পূর্বাভাস দিয়ে থাকে। এই আভাসের কারণেই শনিবার এই দূর থেকে কলেজ স্ট্রিট যাওয়ার প্ল্যানটা ছাড়তে হল। আজকাল এই এক হয়েছে কোথাও যাবার কথা হলেই শ্রবণা সারাক্ষণ দোলাচলে থাকে। কোভিড পরিস্থিতিতে না ঠিক মত ট্রেন চলে না মেট্রো– সেও তো প্রায় দশ কিমি দূরে। যেখানেই হোক যেতে গেলে দু’ বার তো যান বদলাতেই হয়। মনে মনে সে কুঁড়ে হয়ে যাচ্ছে। অথচ বড় বাড়িটায় প্রায়ই তো একা থাকে সে। আজকাল ফোনেও কথা বলতে ভাল লাগে না। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানা আপদ। চার পাঁচটা সমস্যা একসাথে চলে। জীবনের কোনো ঘটনাই যে মানুষের কল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের ধার ধারে না সেতো কতবার প্রমাণ হল।
শণিবার যে বৃষ্টি শুরু হলো তা সোমবারে অবিরাম চলল। মাঝখানে রবিবারে দুপুরবেলাটা একটু ধরেছিল। প্রতিবছর তার বাড়ির সিঁড়ির তলায় গোড়ালির ওপর জল ওঠে। বাড়িটা তৈরির সময় সামান্য ভুলের জন্য এই অবস্থা। পাড়াটাও জলে ভেসে যায়। গরমে আর বর্ষায় শ্রবণাকে কমান্ডোর মতো চারদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে থাকতে হয়। প্রচুর সাপ এ অঞ্চলে। বেশ কয়েকবার ঘরেও ঢুকেছে। দাঁড়াশ, চন্দ্রবোরা, বেতআঁচড়া, ঢোঁড়া আর হেলে সবের দেখা পাওয়া যায়। শ্রবণা ভাবে প্রকৃতির মধ্যে
থাকবে বলে বাড়ি করেছিল কিন্তু অনেক বালাই বিপত্তি নিয়ে থাকা। এইতো এবার সিঁড়ির তলা থেকে জল দু’ধাপ ছাপিয়ে খাবার ঘরে ঢুকল বলে। এরকম জল জমতে দেখেনি কোনদিন। ঘরে জল ঢোকার আশংকা এবারই প্রথম। চা ছাঁকতে ছাঁকতে নিজের কথাই ভাবছিলাম সে। তার ভাই বোনের বাস মহানগরীরতে। সে- ই সারা জীবন রয়ে গেল গ্রামে বা মফস্বলে। মৈনাকের হঠাত মৃত্যুই সব যেন থামিয়ে দিয়ে গেল। এখন সবাই বাড়িটি বিক্রি করে দিতে বলে।
মনে মনে গজগজ করতে করতে খবরের কাগজ আনবে বলে দরজার দিকে এগোল শ্রবণা। এগোব বললেইতো হল না হাঁটু ভেজা জল। পোশাক সামলে দরজা খোলাই ঝক্কির। খোলার পর প্রতিদিনই লক্ষ্য করে টবের গাছগুলো জলের তলায়। আজ দরজা খোলার পর দেখল পাঁচিলের ওপর বেড়ালটা বসে আছে। পোষা নয় কারো। আধুনিক ভাষায় বললে বলতে হয় ‘স্ট্রে’। শ্রবণাই খেতে দেয় দুবেলা। বেড়ালটা জলে নামবে না। শ্রবণা তাকে বহু তুইয়ে বুইয়ে জানালার ওপর তুলে দিল। বেড়ালটা কিছু একটা বলল ম্যাও ম্যাও করে কৃতজ্ঞতা জানাল হয়তো নয় আপত্তি জানাল। ঠান্ডা জলে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা হয়তো ঠিক হল না। কী আর করা যাবে। নীচের ঘরগুলো খোলার দরকার। আকাশ আবার কালো। আবার ঢালবে। চট করে একটু দেখে নেবার জন্য পূবের বক্স জানালাটা খুলল। খুলেই দেখল একটা বেজির বাচ্চা। জ্বল জ্বলে দুটো পুঁতির মত চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি। আহা বেচারা! থাকুক বসে। বাগানে ওদের বাসায় জল ঢুকেছে তার মানে। অন্যবারতো এমন আসে না! এবার কি অতিমারি আর রুষ্ট প্রকৃতি সব কিছু বদলে দিল? এসব ভাবতে ভাবতে সরে এল জানলা থেকে। একতলা বাথরুমটাও ব্যবহার হয় কম,ওটাও দেখা দরকার। দরজাটা খুলে হকচকিয়ে গেল শ্রবণা। শয়ে শয়ে কালো পিঁপড়ে দেয়াল দখল করছে। ঝাঁঝরি দিয়ে উঠে আসছে। অভিজ্ঞতা বলছে এরা কামড়ে রক্ত বের করে দেয়। জীব হত্যা কপালে লেখা আছে। ভাল থাকতে দেবে না জীবন। খুব বিরক্ত মুখে ইনসেক্টিসাইড স্প্রে করতে গিয়ে বাথরুমের জানালায় চোখ গেল, গ্রিল জড়িয়ে রয়েছে একটা সাপ। ছোট মাপেরই কিন্তু সাপ তো। এত কাছে সাপ দেখে শ্রবণার শরীর মন বিবশ হয়ে গেল। হুঁশ ফিরতে মনে হল কী সাপ? ঘিয়ে রঙের ওপর কালো চাক চাক ছোপ, মানে এ অঞ্চলের বিখ্যাত বোরা সাপ। মাথার তুলনায় চোখ বড়। রাগ কান্না অসহায়তা মিশে মনটা ফুটছে তার। ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। পাশের বাড়ির কাউকে ডাকা অসম্ভব। ছেলে বাড়ি নেই , দিন তিনেক পরে ফিরবে। মিনতি এই পরিস্থিতিতে আসতে পারবে না। একটা জেদ চেপে গেল। স্প্রেয়ারটা রেখে কার্বলিক অ্যাসিডের শিশুরা তাক থেকে নিল। একটু অ্যাসিড ছিপিতে ঢেলে ছুঁড়ে দিতে গিয়ে থেমে গেল সে। অ্যাসিডের গন্ধে সাপটা যদি লাফিয়ে মেঝেতে পড়ে তাহলে পিঁপড়েরা ওকে ছিঁড়ে খাবে। তার মানে স্প্রে করাও যাবে না। সাপটার কোনো হেল দোল নেই। শ্রবণা কার্বলিক অ্যাসিডের শিশির মুখ খুলে মেঝেতে রেখে দিল। ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে দিল অনেকটা। বুকের মধ্যে গুনগুন আওয়াজ টের পেল। তার তো আবার হৃদয় দুর্বল। পিঁপড়েগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সাপটা একটু নড়ল। খাবার ঘরে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল সে। পায়ের কাছে পিঁপড়েদের ছড়িয়ে পড়া অনুভব করল। কয়েকটা তাকে কামড়াবেই। কিন্তু এই হাঁদা মার্কা সাপটাকে চোখে রাখতে হচ্ছে। টেবিলের ওপর ফোনটা বাজছে। ছেলের ফোন। ফোনটা লাউড করে দিল। ওদিক থেকে বাবান জানতে চাইছে জল কতটা জমেছে,বৃষ্টি হচ্ছে কিনা,খেয়েছে কিনা, মিনতি এসেছে কিনা, পাওয়ার আছে কিনা সব শেষে “সাপ টাপ ঢোকেনি তো?” এতক্ষণ মনোসিলেবেলে উত্তর দিচ্ছিল শ্রবণা। এবার বলল,” না রে কিছু অসুবিধে হচ্ছে না, তুই খেয়েছিস তো?” বাবানের সাথে কথা বলতে বলতে চেয়ার টেনে বসল। “তুমি হাঁপাচ্ছো কেন মা?” “না রে ও কিছু না।” “ছাড়া তাহলে”। ফোনটা বন্ধ করে খেয়াল করল সাপটা জানালায় নেই । কোথায় গেল ? শ্রবণা এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরায়নি। ঘরে ঢুকে এল! এতগুলো ঘর ,কীভাবে নিশ্চিন্ত হবে সে ? কার্বলিকের শিশি হাতে নিল। আর স্প্রেয়ারটা। রান্না ঘরের কোণ থেকে লাঠিটাও নিল। থমকে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল এছাড়া আর কী কী করতে পারে ?
ঠিকঠাক ছবি। এর চাইতে কম না, একটুও বেশি না। ধন্যবাদ।
একদম মিলে গেল ছবিটা। দারুন।