শেষ নাহি যে
অদিতি ঘোষদস্তিদার
“নবীনায় ম্যাকেনাস গোল্ড এসেছে যাবি দাদাভাই?” কানের কাছে চাপা গলায় ফিসফিসানি।
প্রথমবার ঠিক শুনতে পায়নি বিমু। মাথার ওপর আদ্যিকালের ফ্যানটা ঘুরছে বিকট শব্দ করে।
“কী বললি, শুনতে পাইনি, জোরে বল না…” কথা শেষ হল না। তাড়াতাড়ি এসে মুখে হাতচাপা দিলো ছোটকু।
চারদিক তাকিয়ে দাদার হাত ধরে বাইরে নিয়ে এল। সাবধানের মার নেই।
বাইরে এসে আবার অনুরোধ।
“যাবি? চলনা! শুনেছি দারুণ সিনেমা! গ্রেগরিপেক…”
গরমের ছুটি। দুপুরবেলা। বাবা অফিসে। দাদু ঠাকুমা নিজেদের ঘরে ঘুমোচ্ছেন। মা মাঝের ঘরে মেঝেতে মাদুর পেতে খবরের কাগজ নিয়ে শুয়েছেন খানিক আগে। ছেলেরা পাশে বসে স্কুলের কাজ করবে এই হুকুম। বিকেল চারটে বাজলে তবে খেলতে যেতে পারবে মাঠে।
আড়াইটে বেজে গেছে। রোজকারের মত চশমা চোখেই মায়ের বোজা চোখ, কাগজ খসে পড়েছে হাত থেকে।
সেই সুযোগেই এমন প্রস্তাব।
দুই ভাই পিঠোপিঠি। একজন নাইন আর একজন টেন। ঝগড়া ভাব দুই-ই চলে সমান তালে। তবে বিমু একটু শান্ত প্রকৃতির। ছোটকুর মাথায় সারাক্ষণ ঘুরছে দুষ্টুবুদ্ধি। এখনো প্রায়ই পিঠে দু-এক ঘা পড়ে।
“পয়সা কোথায় পাব? টিকিট, বাসভাড়া।”
“আরে দৌড়ে পনেরো কুড়ি মিনিটে পৌঁছে যাব। জন্মদিনে ঠাম্মু টাকা দিয়েছিল তার কিছু আছে। হয়ে যাবে।”
“কিন্তু মা!”
“মা ঘুমোচ্ছে! এখন উঠবে না। আর আমরা তো বিকেলে খেলতে যাই! ঠিক সময়ে ঘরে ঢুকলেই তো হবে!”
“তা ঠিক, আর ইংরেজি সিনেমাগুলো ছোটই হয়, তাই না রে!”অভিজ্ঞ বিমু।
খেলার পোশাকেই বেরিয়ে পড়লো দু’ভাই!
সময়ের হিসেব একেবারে পাক্কা ছোটকুর। যখন পৌঁছলো তখনও সিনেমা হলের ঘড়িতে সাড়ে তিনটে বাজেনি।
বুক ঢিপঢিপ। চেনা কেউ আছে কি!
বিমুর ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ছবিটা দু’ঘন্টার বেশি। তারপর ট্রেলার, হাফ টাইম মিলে শেষ হতে হতে প্রায় সাড়ে ছটা।
ছটার মধ্যে বাড়ি ফেরে ওরা রোজ মাঠ থেকে। দেরি হলেই কৈফিয়ৎ দেওয়া।
“চল বেরিয়ে যাই, পয়সা গেছে যাক!”
আরেকজনের কানে কথাই ঢুকছে না। সে তখন হারিয়ে গেছে সোনার খোঁজে।
বিমুর মনে শান্তি নেই। হাফটাইমের খানিক পরে পাশের লোকটিকে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো সময়, সাড়ে পাঁচটা।
“চল, বেরিয়ে পড়ি, এরপর মার জুটবে।”
“আর একটু।”
সিনেমায় তখন সূর্যের ছায়া পড়ছে স্ট্যাচুতে! ম্যাকেনাস গোল্ডের বিখ্যাত সিন্।
একরকম টেনে টেনেই ভাইকে হলের বাইরে বের করে আনল বিমু।
এবার আবার ছোটা। কিন্তু রোজ খেলা শেষে যেমন ঘেমে নেয়ে ফেরে তার তো কোন চিহ্ন নেই শরীরে এসি হলের দৌলতে।
উপায় বের করতে ছোটকুর জুড়ি মেলা ভার!
সামনের একটা টিউবওয়েল থেকে থাপড়ে থাপড়ে সারা গা ভিজিয়ে নিয়ে ছুট ছুট ছুট। একেবারে থামল বাড়ির বারান্দায়!
ছটা পনেরো!
আরে! মায়ের এত হাসি হাসি মুখ কেন?
ওমা, ছোটমাসীরা এসেছে জলপাইগুড়ি থেকে! ইস! মায়ের খেয়ালই নেই ওদের কথা!
“সিনেমাটা দেখে এলেই হত রে দাদাভাই! কি যে হলো শেষটায়!”
“ও দাদু, তুমি দেখছো নাতো ভালো করে! একী উঠে পড়ছ! দেখবে না?”
“না রে, মাথাটা ধরেছে! পরে দেখে নেব!”
উঠে পড়লেন বিমলবাবু।
নেটফ্লিক্সে চলছে “ম্যাকেনাস গোল্ড!”
নাতি বিল্টুর জোরাজোরিতে বসেছিলেন আজ দুপুরে দেখতে।
টিভির পর্দায় এখন সেই বিখ্যাত সিন!
নাঃ! আজও বিমল শেষ সিনটা দেখবেন না। কোনদিন দেখতে পারেননি।
ছোটকুটা এত দেখতে চেয়েছিল!
সোনার খোঁজেই বোধহয় চলে গেলো সেই সিনেমা দেখতে যাওয়ার এক মাসের মধ্যে বাস অ্যাকসিডেন্টে!
খুব ভালো লাগলো, এক টুকরো ছবি চোখের সামনে চলে এলো।
অনেক ধন্যবাদ প্রবীর!
টিলার ওপর দাঁড়াইয়া সূর্যাস্ত দেখিবার সখ ছোটকুর এ জীবনে মিটিলো না। কে যেন লিখেছিলেন লাইনটা!
বড় ভালো লাগল..তবে মন খারাপি সুর রেখে যাওয়া..লেখিকার শব্দের বুননে আমরা একটুকরো ছবি দেখলাম যেন..❤️
অনেক ভালোবাসা পায়েল।
ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।