দীর্ঘ কবিতাঃ পার্থ-পারমিতা ৫ – অনিরুদ্ধ সুব্রত (বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা)

পার্থ-পারমিতা– ৫
অনিরুদ্ধ সুব্রত

দুরন্ত আত্ম-আলোড়নের বাঁধ ভাঙার সীমান্তে
উদভ্রান্ত পার্থ, বার্তা লিখনে অতৃপ্ত, দ্বন্দ্ব আর
অভিমানী পাথর-সভ্যতা ভেঙে চরম উদগ্রীব,
চলভাষের অথর্ব জড় শরীরে ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে কাঁপা
আঙুল— বড়ো চেনা দশ ডিজিটে আছড়ে পড়েছে।
হৃদয়ের উথাল পাথালের মতো রিং হয়ে গেছে ,
এক একটি অপরপ্রান্ত ধ্বনিতে সুতীব্র
আকাঙ্খার তোলপাড় নিজের বুকে, পৃথিবীর
মধ্যাকর্ষণ হ্রাস বৃদ্ধির মতো বিরাট অঘটন-ভার
বিচলিত করেছে তাকে।

অথচ আশ্চর্য ! তিন তিনবার রিং হয়ে গেছে,
কোথায় নিবদ্ধ সেই কাঙ্ক্ষিত কর্ণকূহর !
নাকি পক্ষকালের পক্ষাঘাতে আজ বিব্রত,
এই রিংটোনে বিচ্ছেদ পাথরের কাল-ঘুম
ভাঙলো না ?
ব্যথিত বুকে এ কি প্রলয়ের নতুনতর ঘা !
পার্থ বিস্রস্ত, পুনঃ খণ্ড বিখণ্ড, ভগ্ন
অনাথ-বোধ তার গভীর থেকে ফের ওঠে,
নষ্ট-মন, তাই ধৈর্য্য ধরতে জানেনা ।
রিং করে আবার, আবার— নিরুত্তর !
অকাল সন্ধ্যার মতো চারদিক থেকে নামে
অন্ধকার, পার্থ হৃদয়ে ভেঙে ভেঙে ক্রমশ
ছোটো হতে হতে ক্ষুদ্র বিন্দুবৎ,
পক্ষকালের অবকাশে পেরেছে পারমিতা—
সৃজন করতে পেরেছে, চরম উপেক্ষা !
যদি সেই সত্যি ! তবে স্বপ্নের গান গাইবে না
পৃথিবীতে আর… পরাজিত পার্থ !
এ এক অন্য অলৌকিক মহাভারত।
দেয়ালে বজ্রমুঠির প্রবল আঘাত করে
পার্থ স্তব্ধ, অপর দেয়ালে ছায়ার দিকে চোখ,
বুকের গভীরে থামিয়ে দিয়েছে বুলডোজার-
বর্ষায় জল চুঁইয়ে ভিজে ওঠা ফ্যাকাশে
ঘরের পলেস্তারায় পার্থ যেন ধ্বংসপ্রায় এক
সভ্যতার মানচিত্রে স্থির,
আসন্ন কালের বোবা কোনও নৃতাত্ত্বিক।

যথারীতি বেজে ওঠে পার্থর ফোন,বিলম্বিত—
সুতীব্র রিং হয়,পার্থ বিরক্ত তাৎক্ষণিক
বিড়ম্বিত দগ্ধতায়,
এ আবহে কী ফোড়ন কে ফোটায় ?
তবু চোখ ধীরে নামে,
অলস তাকায় ডিসপ্লের দিকে—
তারপর হতবাক মুহূর্ত,হুড়মুড় করে ভেঙে তছনছ হয়ে পড়ে পার্থ,
অস্তিত্ব জুড়ে তীব্র কাঁপে, যন্ত্রের তাড়নাসংজ্ঞাত
স্বয়ংক্রিয়, পারমিতা ? তুমি ?

—- হ্যাঁ…
( আর একটাও শব্দ যেন কন্ঠ থেকে উঠে আসে না। কেবল কান পেতে নিতে থাকে
পক্ষকাল বিলম্বের বিপর্যস্ত অধ্যায়ের ভেঙে
পড়া মিথ্যের গগণচুম্বী সৌধের ধুলো,ধ্বনি)

—-তোমার কল, আমি রিসিভ করতে
পারিনি।
মিসডকল দেখে আত্মহারা হয়ে গেছি।
বিশ্বাস করো পার্থ— আমি পেরেছি !
সে মালা মিথ্যে মালা ছিল না যে, আজ বিলক্ষণ জেনেছি।
প্লীজ নিঃশব্দ ভাঙো…, শোনো এই আমি,
চতুর্দশ দিন-রাত বিচ্ছিন্ন যতটা ভেবেছি
ছিলাম— ততটাই বিপন্ন, বিক্ষুব্ধ, ব্যথিত…

—- জানি, আমিও
হয়তো তাই পারিনি…
পক্ষকালের প্রবল পক্ষাঘাতে পঙ্গু,
পারমিতা এই আমি চরম উদ্বেগ-দগ্ধ
পলে পলে পরাজিত হয়েছে পার্থ…

—— না, এ কোনও প্রতিস্পর্ধী লড়াই তো নয়,
এ গভীর থেকে পরস্পরেরই পরাজয়
অথবা নতুন করে শুদ্ধ জয়।

——কতবার নদীর পারে এসে নিস্পন্দ অন্ধকার
দেখে ফিরে গেছি,
রাত্রির কালপেঁচা মুখ ফিরিয়ে বলেছে—
হলো না তোর সিনেমা আর
সমস্ত স্থির চিত্রকে শুধু ব্যর্থ গেঁথেছিস।

—- দুঃস্বপ্নের ঘন বাষ্পাকূল কতগুলো পাথর
দেয়ালের বেষ্টিত অসহায় গারদের গুমোটে
হাত পা ছুড়তে ছুড়তে এতো গুলো দিন,
কী প্রচণ্ড ! অথচ কী বিকলাঙ্গতায় আজ
দূর করে দিয়েছি অভিযোগ।
আমি পারব না, পারব না পার্থ, পারিনি
এক মুহুর্ত !
কেবল ডানা ভাঙা একটা পাখির মতো
গেঁথেছি প্রতীক্ষার ফুল,
নেবে না ?

—– না নেবার শক্তি আছে আমার !
অভিমানে বিক্ষুব্ধ মন এইরূপে পুড়িয়ে
ছাই করে দিতে পারো পারমিতা ?
বিস্তৃত ধুলো-প্রান্তরের অতলে
এতো জন্মে দিতে পারো কান্নার ফল্গু জল !
বিরূপ,ক্ষুব্ধ, নষ্ট,ধষ্ট,রুঢ় পার্থকে এতো দগ্ধ
ক্লান্ত করে,
এতো ব্যাকুল করে ঘুরিয়ে মারতে মারতে
কণায় কণায় উড়িয়ে দিতে পারো—
পারমিতা তুমি জমাট পার্থর ভঙ্গুর সুর…

—- একবার দিগন্তের অন্ধকারের দিকে
দেখো, একবার ছায়া মানবীর আকূতি
করো খেয়াল ?
বহুকাল বিলম্বে যে হুতাশী গবাক্ষে চোখ
রেখেছিল, দূরের মাঠে যে বাঁশীর ধ্বনিতে
তন্ময় ছিল শ্রবণ— শুধু তার,
প্রতি অভিযোগ আগুনের উত্তাপ নিয়ে
যে আত্ম-দহনে খুঁজেছিলে ব্যর্থ সমাধান ।
পাগল বুঝি কাঙালকে না চিনে
ধূসর প্রান্তরে হাঁটতে চেয়েছে একা ?

—– না, পাগলা ফকির নেমেছে দুঃখ-খনির
গভীরে, বুকের অন্ধকারে…
রোজ কালো, ঘন কালো মায়াময় গুহার
গর্ভে— পাথরে পাথরে যেখানে কালের স্তব্ধ
যন্ত্রণা, ছুঁয়ে ছুঁয়ে সংগীতের সন্ধান মেলেনি,
এতো কার্য-কারণ হীন কান্না থাকে সেখানে
কে জানত !
কিন্তু জেনেছে নিঃস্ব, আছে তার কত
দামি সম্পদ,
শুনতে গিয়েছে রক্ত হৃদয়ের কাছে
উদভ্রান্তি নিরসনের হারানো রসদ কোথায়,
দেখেছে সেখানে সব কৌণিক বিন্দু থেকে
একটিই নাম শুধু নিঃসৃত হয়ে চলেছে—
মিতা মিতা বলে কোন এক মায়ার জগৎ
হতে, চরম চিৎকার এসে ভরিয়ে দেয়
হতভাগ্যের এই অন্তর,
তখন আপ্রাণ তার গলা জড়িয়ে আমি
এ জন্মের কান্নায় নিয়েছি আশ্রয়…
সেই সিনেমা-চিত্রকল্পে হয়তো
কেবলই ভুল ছিল, ভ্রান্তকে অভ্রান্ত ধারণা,
জানো না পারমিতা, তুমি জানো না…

—– না, পার্থ, কোথাও তোমার চিত্রকল্পে
ভুল ছিল না।
তোমার স্বপ্নের সিনেমায়, যেভাবে তুমি
ছবিকে ছায়াছবি হয়ে উঠতে বিশ্বাস করো,
ক্যামেরা তো তেমন করে অন্তর্লোকে
যেতে পারে না, সে ভয়ানক হোঁচট খাওয়ার
পথ, কিন্তু অবিশ্বাস্য নয়— তুমি ঠিক চেনো,
তোমার দর্শনে ভুল নেই।
আমার সাধ আর সাধনা দিয়ে স্পষ্ট-স্বপ্নে
দেখতে পাই

—– আহা ! স্বপ্নের ঐ আঙুল গুলো একবার ছুঁতে চাই মিতা…
আর, আর কিছু না।

—– ভগ্ন ডানা এ পাখির পালকও টের পায়,
এতো বড়ো আকাশ,
তবু আমাদের পৃথিবীর জন্য বড়ো
অকৃপণ পার্থ…।

—– জানি, অথবা তাও না, আন্দাজ করি—
আসলে ছোট্টো এ পৃথিবী, বিশাল অনন্ত
আকাশের নিচে শুধু ভেসে আছে ;
মানুষের জগতের মানুষ পৃথিবীর নিয়মে
চলে, বিশ্বাস করে— ।
আকাশের মতো মুক্তিকে
হয়তো কেবল আন্দাজ করে করে
কিন্তু দু’পা ছড়িয়ে
ছুঁতে তো জানে না…

—– অথচ সর্বক্ষণ— কী অসহ্য কম্পন,
কী সে সংগীতের সুরের যাপনে আঙুলে
ছুঁয়ে থাকে বাজনার সরগরম,
পারমিতাকে তুমি কি দূর হতে দূরতর করে দেখো ?
নিকটবর্তী বোধে ছুঁতে পারোনি কখনও ? পার্থ ?

—— দূর যদি আরও দূর হয় মিতা, দৃষ্টি মেনে নেয় একদা, মনেরও তাতে থাকে না দ্বিধা—
কিন্তু হাতে এসে বসে যে বিহঙ্গ…

—- যতদূর হোক, যে উষর ধূ ধূ প্রান্তর, গ্রীষ্মময়
দহনে রাখুক আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে— সে তো সব
নয়, হৃদয়ে গান আছে— গানের আহ্বান
আছে, সে-ই জয়।

—— জয় নয় পারমিতা, জয়ের আকাঙ্খাই নিয়ে
যেতে চেয়েছে বিস্তীর্ণ আকাশে,
সেই তো মুক্তির উচ্চারণ

—— এই চোদ্দো দিনের গদ্য-গুমোটে
শ্বাস-যন্ত্রণা প্রথম মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে—
অথচ বিশ্বাস করো—মৃত্যুকে ভীষণ
হয়নি মনে, বরং ভেবেছি তোমার কল্পিত ফ্যাকাশে-হলুদ মুখ,
সেই যে একা, একা, ভীষণ নিঃশব্দ
একার তুমি…
ঘরের দেয়ালে আবছা ফুটেছে সেই
সকরুণ পার্থর দুটি চোখ, আমার চির
ছন্নছাড়া কবি—
সেই সবচেয়ে বড়ো বিরহ জানো, আমার অকাল মৃত্যুর হুতাশ নয়।

—— হায় ! যন্ত্রণা, তুমি এত ঐশ্বর্যময় ?
মৃত্যু সত্যিই তুচ্ছ হলো পারমিতা, মানুষের
অনন্ত মনের দিগন্ত-হীন প্রেমের কাছে।
দেবত্বে কোনও দুর্বলতা ছিল না,
একটি প্রণাম তবু করি তোমাকে…
ক্রোধী, নষ্ট, ভগ্ন-বিলাসী চণ্ডালকে
ক্ষমা করো।

—— না, পার্থ, দেখো ঈশ্বর হাসছেন প্রকৃষ্ট।
পরস্পরে অন্ধকারে চিনিয়ে দিয়েছেন তিনি
এখনও সব অশ্রুভার তার হাতে—
তোমার রাগ গরীয়সী করেছে আমাকে
অভিভূত করেছে অভিযোগ,
বিমোহিত করেছে বিরহ…

—— জানিনা, মানুষের অন্তর্লোকে এতো বিস্ময়
কেন ? এই কি অনন্তের সংকেত ?
কবিতার উষ্ণ-প্রশ্রবন ?

—– যেমন করে আমরা ভেবে নেব
যেমন করে ক্ষুদ্রকে বৃহতে টেনে নেব
যেমন করে দুটি মুখ, সুখ বলে জানব।

—– আমিও জানি না—
পারমিতা এতো আনন্দ কেন
আবার সে-ই এতো দুঃখ কেন
আমার কাছে !

—– তুমিও যে সেই
আনন্দ-ব্যথার বিস্ময় হয়ে আসো

—– দুঃখের গভীর পূর্ণ আনন্দে ভরা।
পাথরের ফাটলে ফুটেছে ফুল
পৃথিবী জানে না,
ঘন কালো মেঘের রাশিতে ফুটেছে হাসিমুখ
শিশুর মতো আহ্লাদি—
ক’জন দেখেছে সে দুর্যোগের অন্তর-রূপ !

—– এই নিঃশব্দ পক্ষকাল তোমাকে কবিতা
দেয় নি ?

—– হেতু যে তুমি, কবিতা এমনিই জন্মে,
দিয়েছ— ঘাম রক্ত অশ্রু জমানো
কালো পাথরের কবিতা,
নষ্ট মনের কষ্ট চিৎকারের বিবর্ণ ভাষ্য
দিয়েছ বিনিদ্র রাতের হুতাশ প্রতিমা,
লিখেছি বিচ্ছিন্ন পঙক্তির পুঞ্জ পুঞ্জ
গুচ্ছ অভিমান—
যে হতে পারে ভগ্ন পক্ষকালের
জড়ত্বের বিবৃতি বা ব্যর্থ গান।

—— পার্থ না, আমি জানি
মর্ম ছুঁয়ে যাবে সে অনুভূতি-মালা,
কিন্তু সে পাঠ আমাকে হীন করবে না,
প্লাবিত চোখের পারমিতার সে অহংকার
শিহরিত হওয়ার শব্দ উদযাপিত হবে
ধ্বনিতে বিলীন হতে হতে —
এই পৃথিবীর এমন একটি সম্পর্ক
একজন পারমিতা একজন পার্থ
শুধু ভাষার উপর ভেসে থাকে
নিদারুণ একটা জীবন।

—– পারমিতা কি কখনও লেখে না
একান্ত তার মতো করে পার্থকে ?
পার্থর জন্য—
একদিন একটি অনুভবের কবিতা ?

—– পারমিতা তো কবি না।

—– পৃথিবীর মানুষের সব প্রেম ও বিচ্ছেদ
সবই কবিতা।
সে কারও স্বীকৃতির অপেক্ষা করে না,
এক প্রাণ থেকে উড়ে গিয়ে
বসে আর এক প্রাণের জানলায়।

—– এতো অভয় যখন, তখন শোনো,
লিখেছি একটি গোপন, তোমাকে বলি
আনন্দ থেকে তার জন্ম—,

” চোখের গভীরে অমোঘ টান
টেনে রাখে কোন জাদুবলে, জানা নেই,
এভাবেই ভালবাসা বাসা বাঁধে
হৃদয় থেকে হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়—
মনে হয়— তুমি মেখে আছি,
প্রাণে প্রাণ ছুঁয়ে গেছ,
গভীরেরও গভীরে সাজিয়ে তুলেছ
ভালবাসার উৎসব।
পৃথিবীর নিষেধাজ্ঞা আমিও অমান্য করি
এসো স্বপ্নের কাছে যাই
নাম না জানা প্রেমের উপত্যকায়
চলো হাতে হাত ধরে হেঁটে বেড়াই।”

—– আহা ! অকপট, অনায়াস, সত্য স্পর্শ,
জানো পারমিতা, কেউ কখনও
কবিতা উপহার দেয়নি,
হয়তো এই-ই প্রথম এক গুচ্ছ পঙক্তির
উপহারে আমি ধনী হয়ে উঠেছি।
নষ্ট ঘরের ফুটো চালা দিয়ে
আস্তো চাঁদ আমার বুকের পরে হঠাৎ।

—– তুমি যেমন করে বলো, আমি পারিনা,
তবু যে খুব বলতে ইচ্ছে করে।
যার সৃজন আমার অস্তিত্ব জুড়ে দায়,
যার যাপনে এই সন্ধ্যে সকাল মহিমময়
তাকে শব্দ দিয়ে ছুঁয়ে দিতে খুব ইচ্ছে হয়।

—– এতো দিন ধরে, অনেক কথা দিয়েছ,
শব্দ, ধ্বনি আর অনেক নিঃশব্দতায়—
অস্তিত্বে এসে মিশেছে, উপকরণের মতো
যার উচ্চারণ থেকে উৎসারিত হয়েছে
ব্যথা, ভাব, আনন্দ— মননের উৎসব,
তাই কুড়িয়ে নিয়ে এই হৃদয় তোমাকে লিখেছে–
প্রত্যেক কবিতার গহনে, নির্মাণে
তুমি ছিলে ব্রহ্মানন্দের মতো, তুমি আছো
ফুল-সাজির মতো, তোমাতে কুড়িয়ে রেখেছি স্বপ্ন-বাগানের সংগ্রহ
গণনা হীন, আমার সকল ফুল।
উৎসাহ দিয়ে ছুঁয়ে দিয়েছ রোজ
অদৃশ্য শব্দের একটানা সংগীতেও,
আমি যদি ভুলেও যাই,
কবিতা তো ভুলবে না সেই নির্মাণ ইতিহাস।

—– ভুলে যাই ?
নিষেধ করতে পারো না
তোমার উচ্চারণ কে ?
আমি বলি— মরণ এসে পারে তো
ধ্বংস করুক,
এই আমি ভুলে-যাওয়াকে ভুলতে চাই।

—– তা নয় পারমিতা, ব্যক্তি-মানুষ আমি
আর আমার কবিতা-নির্মাণের আমি
দুইয়ের মধ্যে যদি কখনও বিচ্ছেদ হয়—,
তাদের মাঝখানে এক অদৃশ্য ভয়,
সর্বক্ষণ মিলমিশ থেকে গেলে
ব্যক্তি-আমির সমূহ পরাজয় !
কথায় কথায় ঐ ব্যক্তি-আমিকে শাসনের
চাবুক দেখাতে হয়,
তুমি জানো— দুই আমির
চাওয়ায় ভুল হয়…

—– চাবুক !
সে তো শাসন নয়, প্রহসন।
রক্ত-মাংসের আমি -কে নিষ্ঠুর কষাঘাতে
দীর্ণ করতে করতে কঠিন হবে শুধু,
আমিও কি অনুভবে, দহনের দাহ্য-বোধে
দাউদাউ-এ মরিনি ?

—– জানি অথবা জানি না, পারমিতা ;
কিন্তু কবিতার পাতায় একটা অবয়ব—
মৃৎ-কুশলী হাতের স্পর্শে
বিন্দুর সংগ্রহ হতে বিমোহিত রূপ নেয়
যা বুকের গোপন আঁধার দিয়ে ঢেকে
জোছনার আপন চরাচরে যাই,
দুই হাতে পৃথিবীর আশ্লেষ, ঠোঁটে, চিবুকে
ফুল ফুটছে দেখে— অনন্ত আনন্দ গানে
তুমি আমি শিল্প-শিল্পী দোসর।
যখন সেই দুই আমির ওতোপ্রোত রূপ থেকে
স্বাতন্ত্র্য উধাও,
পারমিতা তুমি তখন আমাকে পাগল বলে
সম্বোধন করেছ, আমি মহাকাশে তার
প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছি।

—– আশ্চর্য ! এই বিগলিত সংগীতের মুর্ছনায়
আমি যে বেজেছি, সুর থেকে সুরে
এই দেহ-মন-ভূগর্ভে, বিচিত্র
মাটিতে এতো সুর হয়ে বেজে ওঠা যায়—–
তিতির পাখির মতো নিঃশব্দ ডানায় যেন
টের পাই পার্থ, হয়তো নিস্তব্ধ ;
কত রাত— অন্ধকারের গা ধুয়ে বৃষ্টি পড়ছে,
ধ্বস্ত, রুঢ়, সৈনিক জীবনের নিয়ত রুটিনের
ধার ঘেঁষে কেবল লেনদেনের পাত্র ভরিয়ে
ফের উপুড় করে মিটমাটের দামামা—
উঠোনের কোথায় সে স্নিগ্ধ বাগান ?
আমিতো ব্রহ্ম-কমলের পিয়াসী নই,
মাত্র দুটি শান্ত সন্ধ্যার মালতীফুল চেয়েছিলাম,
বুকের কাছে রেখে ঘুমিয়ে পড়ব
শেষের রাত।

—– পৃথিবীতে এতো মৃত্যুর অত্যাচার, এতো
বিপন্নতার পচনে ক্লেদ-দীর্ণ দিন, তবু
তাকেই করেছি কাঁচের দেয়াল—
মিতা মনের তো কোনও বারণ নেই, সে
ভেদ পারাপারের।
শত অভিমান তার আদরের মতো সুখের
রূপাতীত উৎসবে ছুঁয়ে নেয় জীবন্ত মুখ।
অতীন্দ্রিয় রসের গভীরে ডুবে খুঁজে নেয়
অছোঁয়া সুখের প্লবতা,
তুমি নিকট হয়ে এসেছ— পারমিতা
কাছাকাছি দাঁড়াবার জন্য আছে তো
এই আমাদের স্বপ্নের বারান্দা।

—– পার্থ ! পার্থ !

—- তুমি কাঁদছ পারমিতা ?

অতঃপর বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ, অপ্রত্যাশিত, অথচ
কার্য-কারণ সঙ্গত,একটা গোপন বেদনার বাজনা
অনবরত বাজতে থাকল— দীর্ঘ রাত্রি ধরে,ক্রমে ক্ষীণ হতে হতে মেঘলা আকাশে খণ্ড চাঁদ ডুবে যেতে থাকলো প্রাত্যহিক বিকিয়ে চলা পুনঃ আলোকের দিনে।

(পরবর্তী অংশ আগামী পর্বে)

—-অনিরুদ্ধ সুব্রত

One thought on “দীর্ঘ কবিতাঃ পার্থ-পারমিতা ৫ – অনিরুদ্ধ সুব্রত (বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা)

  1. ভালো লাগলো । পড়ে যাচ্ছি‌। বাকি অংশ পড়তে ইচ্ছে থাকল। ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *