স্বাধীনতা দিবসে শ্রীঅরবিন্দের বাণী
ভূমিকা গোস্বামী
আজ পঁচাত্তরতম স্বাধীনতা দিবস। এই হীরক বর্ষে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা — ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করুক। ভারত মা-কে সহস্র প্রণাম। পাশাপাশি প্রণাম জানাই ওই মায়ের লাখ লাখ সন্তানদের। যাঁরা তাঁদের জীবন দিয়ে এই স্বাধীনতা এনেছেন। যাঁদের আত্মত্যাগের ফলে আমরা স্বাধীন ভারতে জন্ম নিতে পেরেছি।
এই মহতী দিনটি ভারত মায়ের অত্যন্ত আদরের এক সন্তান শ্রীঅরবিন্দেরও জন্মদিন। তাঁকে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম।
রবীন্দ্রনাথের এগারো বছরের ছোট ছিলেন শ্রীঅরবিন্দ। তবুও তিনি তাঁকে প্রণাম জানিয়ে ৭ই ভাদ্র ১৩১৪ বঙ্গাব্দ তে (২৪শেআগস্ট ১৯০৭ ) লেখেন – “অরবিন্দ রবীন্দ্রের লহো নমস্কার ” কবিতাটি।
জাগরীর পক্ষ থেকে ২০০৭ এ শান্তিনিকেতনের হাতিপুকুরে অরবিন্দ নিলয়ে এই কবিতার শতবর্ষ পালিত হয়। এরপর প্রতি বছর সেখানে অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এর বেশ কয়েকটি এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার।
![](https://abekshanpatrika.com/wp-content/uploads/2021/08/1628791944361-1024x677.jpg)
১৯৪৭ সালর ১৫ই আগস্ট অল ইন্ডিয়া রেডিও, ত্রিচিনোপলির অনুরোধে শ্রী অরবিন্দ যে অমূল্য বাণী দিয়েছিলেন তার হুবহু টাইপ করে আপনাদের জন্য দিলাম। ( কলকাতা শ্রী অরবিন্দ ভবন থেকে পাওয়া )
” ১৫ই আগস্ট স্বাধীন ভারতের জন্মদিন। এদিন ভারতে একটা যুগের শেষ হল, আরম্ভ হল নতুন যুগ। কিন্তু কেবল আমাদের জন্যেই নয়, এশিয়ার জন্যে, সমগ্র জগতের জন্যে এদিনের অর্থ রয়েছে। সে অর্থ হল নেশনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা নূতন নেশন-শক্তির আবির্ভাব, অফুরন্ত যার ভবিষ্য সম্ভাবনা, মানব জাতির রাষ্ট্রিক, সামাজিক , সাংস্কৃতিক , আধ্যাত্মিক ভবিতব্য গঠনে যার থাকবে বৃহৎ অবদান।
ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এ জিনিসটি নিশ্চয়ই প্রীতিকর যে, যেদিনটি আমার স্মরনীয় ছিল আমার নিজের জন্মদিন হিসেবে, আমার জীবন-সাধনা যারা গ্রহণ করেছে তারাই যে দিনটির উৎসব করে এসেছে, ঠিক সেই দিনটি আজ অর্জন করেছে এক বিপুল অর্থ।
অধ্যান্তপন্থী হিসেবে এই যোগাযোগটি আমি কেবল একটা হঠাৎ যোগ বা আকস্মিক-ঘটনা রূপে গ্রহণ করি না, তা হল যে কাজ নিয়ে আমার জীবন আমি শুরু করি তাতে ভগবৎশক্তির সম্মতি ও তাঁর অনুমোদন সূচক আশীর্বাদ। এই ভগবৎশক্তির নির্দেশ ই আমার প্রতিপদ চালিয়ে নিয়েছে। ফলতঃ যে সব জাগতিক আন্দোলনের পূর্ণ সাফল্য আমি দেখে যেতে পারব আশা করেছি , একসময়ে যাদের মনে হত অসম্ভব স্বপ্ন বলে , আজ দেখছি তারা তাদের গন্তব্যের নিকটে গিয়ে পৌঁছেছে , অন্ততঃ তাদের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে , সাফল্যের পথে উঠেছে গিয়ে।
আজকের এই মহৎ উদ্যোগে আমার কাছে বাণী চাওয়া হয়েছে, কিন্তু বাণী দেওয়ার মতো সম্ভাবনা এখন আমার নেই। তবে আমি সকলকে জানাতে পারি শুধু আমার ব্যক্তিগত আশা আকাঙ্ক্ষার কথা , শৈশবে যৌবনে যারা অঙ্কুরিত হয়েছে , এখন যাদের ফলোদ্ গম হতে চলেছে — কারণ ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সংযোগ , এইজন্যে যে যে সব হল আমার মতে ভারতের যা ভবিষ্য কর্ম , যাতে ভারত নেতৃস্থান না গ্রহণ করেই পারে না , তার অঙ্গীভূত।
আমি চিরকাল বিশ্বাস করেছি , বলে এসেছি যে ভারতের অভ্যুত্থান , তার স্থুল স্বার্থ সেবার জন্যে নয় কেবল , নিজের প্রসার , মহত্ত্ব , শক্তি সমৃদ্ধি লাভের জন্যে নয় —- যদিও এ সকলকে অবহেলা করা তার উচিত হবে না —– তার জীবন ধারণ হবে ভগবানের জন্যে , জগতের জন্যে , সকল মানবজাতির সহায় ও নেতারূপে। এই সব আশা আকাঙ্খা তাদের স্বাভাবিক ক্রমানুসারে এই হবে :
(১) এক বিপ্লব , যার ফলে ভারতের আসবে মুক্তি ও ঐক্য।
(২) এশিয়ার পুনরুথ্থান ও মুক্তি — মানবসভ্যতার ক্রমোন্নতিকল্পে একসময়ে তাঁর ছিল যে সুমহৎ অবদান সেই ব্রত গ্রহণ করা ,
(৩) মানুষের জন্যে একটা নূতন , মহত্তর , উজ্জ্বলতর , উন্নততর জীবনধারা —– তার পূর্ণরূপ বাহ্যতঃ প্রতিষ্ঠিত থাকবে আন্তর্জাতিক ঐক্যের উপর —- প্রত্যেক নেশন অক্ষুন্ন রাখবে তার পৃথক স্বকীয় জাতীয় জীবন , সেই সঙ্গেই সকলে সম্মিলিত থাকবে সকলের উপরে সকলের অন্তিমে রয়েছে যে অনিবার্য একতা তার মধ্যে।
(৪) ভারত জগতকে দেবে তার অধ্যাত্মজ্ঞান , আর জীবনকে আধ্যাত্মিক করে তুলবার সাধনা
(৫) সর্বশেষে এক উর্ধ্বতর চেতনায় মানুষের উত্তরণ , ফলে প্রকৃতির বিবর্তনে একটা নূতন পর্যায় — তখনই আরম্ভ হবে জাগতিক যাবতীয় সে – সব সমস্যার সমাধান , মানুষকে যা বরাবর বিমূঢ় , আর ক্ষুব্ধ করেছে , যেদিন থেকে মানুষ ব্যক্তিগত পরমোৎকর্ষের সর্বাঙ্গ সুন্দর সমাজের চিন্তা করেছে , স্বপ্ন দেখেছে।
ভারত স্বাধীন , কিন্তু একত্ব সে লাভ করে নি , এ তার দীর্ণ খণ্ডিত স্বাধীনতা। এমন কি এক সময়ে প্রায় বোধ হয়েছিল হয়তো বা সে ফিরে চলেছে ব্রিটিশ অধিকারের অব্যবহিত পূর্বেকার বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্ররাজির বিশৃঙ্খলার মধ্যে। সুখের কথা , বর্তমানে বিশেষ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে যে এই সাংঘাতিক পুনরাবর্তন তার আর ঘটবে না।
সংগঠনী – সমিতি ( Constituent Assembly ) কর্মব্যবস্থায় যে দৃঢ়তা ও সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন তাতে মনেহয় অনুন্নত শ্রেণীর সমস্যার সুসমাধানই হবে। ভাঙন-খণ্ডন কিছু ঘটবে না। কিন্তু হিন্দু – মুসলমানের সেই সুপ্রাচীন ধর্মগত দ্বন্দ্ব এত গাঢ় হয়ে উঠেছে যে মনেহয় তা দেশকে যেন স্থায়ীভাবে খণ্ডিত করেছে রাজনৈতিক হিসাবেও। তবে আশা করা যায় জাতীয় মহাসভা আর দেশের লোক এই আপাতবাস্তব সত্যকে স্থায়ী সত্য বলে গ্রহণ করবে না , সাময়িক ব্যবস্থার বেশী মূল্য একে দেবে না। কারণ , তা যদি স্থায়ী হয় তবে ভারত সাংঘাতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে , এমনকি বিকল হয়েও পড়তে পারে। অন্তর্দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা সর্বদাই রয়ে যাবে , এবং নূতন এক বিদেশী আক্রমণ ও অধিকারের সম্ভাবনা পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। দেশের বিভাগ দূর করা চাই — যে উপায়েই হোক। আশা করা যায় বিরোধের উগ্রতা সময়ে স্থিমিত হয়ে আসবে , কিম্বা শান্তির , সৌভ্রাত্র্যের প্রয়োজন উভয়পক্ষ ক্রমেই হৃদয়ঙ্গম করবে , অথবা একই কর্মে একসঙ্গে সহযোগ যে নিরন্তর প্রয়োজন , এমনকি এ উদ্দেশ্যে একটা ঐক্য সাধনের যন্ত্রও যে দরকার এ উপলব্ধি হবে।
ঐক্য এইভাবে আসতে পারে যে আকারেই হোক না — বিশেষ আকারটির প্রয়োজন কাজের সুবিধার দিক দিয়ে , তার নিজস্ব নিত্য মূল্য কিছু নাই। কিন্তু যে উপায়েই হোক খণ্ডতাকে যেতে হবে , যাবেই । তা না হলে ভারতের ভবিতব্য সাংঘাতিকভাবে ক্ষুন্ন হবে , এমনকি ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তা ঘটতে দেওয়া হবে না।
এশিয়া উঠে দাঁড়িয়েছে , তার অনেকাংশ স্বাধীন হয়েছে কিম্বা স্বাধীন হতে চলেছে —- অন্যান্য অংশ যারা এখনও পরাধীন তারা , যত দ্বন্দ্বসংঘর্ষ ই হোক না তার ভিতর দিয়ে মুক্তির দিকে এগিয়ে চলেছে। সামান্য ই একটু করবার বাকী আছে , আজ হোক কাল হোক , সেটুকু করা হবেই । এখানেও ভারতের করণীয় কাজ আছে , এবং সে কাজ সে আরম্ভ করেছে সামর্থ ও নৈপুণ্য সহকারে — তাতে ইতিমধ্যে ই নির্দেশ করে কতখানি তার ভবিষ্যৎ — সম্ভাবনা আর কোন স্থান সে অধিকার করতে পারে জাতিসংঘের আসরে।
মানবজাতির ঐক্য সাধনাও শুরু হয়েছে , সূত্রপাত যদিও তার ত্রুটিবহুল , বাহ্য – ব্যবস্থা একটা পেয়েছে বটে কিন্তু বিপুল বিঘ্নের বিরুদ্ধে তাকে চলতে হয়েছে । তবে ভিতরের বেগ সে অর্জন করেছে , আর ইতিহাসের শিক্ষা দিয়ে যদি দিকনির্নয় করা যায় তা হলে বলা যেতে পারে সে- বেগ ক্রমে বৃদ্ধি পাবে শেষে জয়লাভ হবেই।
এক্ষেত্রেও ভারত এক প্রধান অংশ গ্রহণ করেছে —- যদি অনুশীলন করে চলে সেই উদারতার রাষ্ট্রনীতি বর্তমানের ঘটনা আর আশু সম্ভাবনার মধ্যেই যা সীমাবদ্ধ নয় — যার দৃষ্টি ভবিষ্যতের মধ্যে , এবং ভবিষ্যতকে যা নিকটে নিয়ে আসে — তবে ভারতের উপস্থিত সান্নিধ্যের অর্থ হবে মন্থর আর শঙ্কিত গতির পরিবর্তে ক্ষিপ্র নির্ভিক গতি ।
দুর্যোগ একটা অতর্কিতে অবশ্য এসে পড়তে পারে , যে কাজ করা হয়ে চলেছে তাকে ব্যাহত করতে পারে , তাকে ধ্বংসও করতে পারে —– তাহলেও শেষ ফল সুনিশ্চিত । যাই ঘটুক না ঐক্যসাধন প্রকৃতির ধারায় একটা অবশ্য প্রয়োজনীয় , অপরিহার্য ক্রিয়া , এবং তার সংসিদ্ধির সম্বন্ধে নিঃসন্দেহে ভবিষ্যৎ – বাণী করা যায়। নেশন – সকলের জন্য তার স্পষ্ট , কারণ তৎব্যতিরেকে ক্ষুদ্রতর জাতিরা অতঃপর কখনও নিরাপদে থাকতে পারে না । আর ভারতবর্ষ খণ্ডিতই যদি থাকে তবে তারও নিরাপত্তা সন্দেহাকুল ; সকলের স্বার্থের দিক দিয়েই , ভারতের ঐক্য বাঞ্চনীয় । কেবল মানুষের ঘোর পঙ্গুতা আর মূঢ় আত্মপরতাই তাকে ব্যর্থ করতে পারে — মানুষের এ গুণের বিরুদ্ধে , শোনা যায় , দেবতাদের পর্যন্ত আয়াস বৃথা ; কিন্তু প্রকৃতির প্রয়োজন আর ভগবৎ ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ জিনিস কখনও দাঁড়াতে পারে না। এ-রকমেই জাতীয়তা পূর্ণ সার্থকতা লাভ করবে ;
তারপর প্রয়োজন হবে যাতে একটা আন্তর্জাতিক ভাব ও দৃষ্টি গড়ে ওঠে , গড়ে ওঠে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান । এমনকি যে পরিবর্তন ঘটছে সেই ধারায় চললে এক দেশের অধিবাসী দুই বা ততোধিক দেশের নাগরিক -অধিকার লাভ করতে পারে। বিভিন্ন নেশনের সংস্কৃতি স্বেচ্ছায় পরস্পরে সম্মিলিত হয়ে একীভূত হয়ে উঠতে পারে। নেশনবাদ তার যোদ্ধৃভাব পরিত্যাগ করে , নিজের নিজত্বকে অক্ষুন্ন রেখেও এ-সকল জিনিসকে বরণ করে নিতে পারে , সমস্ত মানবজাতি নূতন একটা ঐক্য ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠবে তখন।
জগতকে ভারত তার আধ্যাত্মিক বিদ্যা দান করতে ইতিমধ্যেই আরম্ভ করেছে। ভারতের আধ্যাত্মিক বিদ্যা ইউরোপ ও আমেরিকায় ক্রমে অধিকতর পরিমাণে প্রবেশ লাভ করছে। এই গতি ক্রমেই বৃদ্ধি লাভ করবে। এ যুগের দুর্যোগের মধ্যে মানুষের দৃষ্টি আশায় ভরসায় ভারতের দিকে বেশী করে ফিরছে , কেবল তার শাস্ত্রই নয় , তার সাধনা আন্তর ও আধ্যাত্মিক
অনুশীলন-পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করতে উন্মুখ হয়েছে ।
অবশিষ্ট যা রইল তা আমার ব্যক্তিগত আশার ও আদর্শের কথা ।
ভারতবর্ষে ও পাশ্চাত্যে যাদের দৃষ্টি ভবিষ্যতের মধ্যে কিছু গিয়ে পড়েছে – তারা ধীরে ধীরে একে গ্রহণ করছে , অবশ্য অন্যান্য ক্ষেত্র অপেক্ষা এখানে বাধাবিঘ্ন অত্যন্ত বিপুল – কিন্তু বাধাবিঘ্ন হয়েছে জয় করবার জন্য – ভগবৎ অনুজ্ঞা যদি থাকে তবে এসব জয় করা হবেই।
এখানেও এই বিবর্তন–ক্রমের আবির্ভাব সম্ভাবনা যদি থাকে , তবে তা ঘটবে , অধ্যাত্বসত্তার ও আন্তর চেতনার পরিণতির ফলে ; এবং এইজন্যেই সে প্রেরণা আসতে পারে ভারতবর্ষ হতে – বাহিরের ক্ষেত্র থাকবে পৃথিবী জুড়ে , কিন্তু উৎস হবে ভারত ।
ভারতের আজকের মুক্তিদিবসের মধ্যে আমি এই অর্থ দেখেছি –
এই যোগাযোগ কত দূরপ্রসারী বা কত শীঘ্র তা বাস্তবে পরিণত হবে তা নির্ভর করছে নূতন ও মুক্ত ভারতবর্ষের উপর।
এভাবে পুরো বাণীটা কখনো পড়িনি। ভীষণ ভালো লাগল। আমার অন্তরের শ্রদ্ধা জানাই।
অসাধারণ অমূল্য সম্পদ এ লেখা। পরম শ্রদ্ধা জানাই ।
কত অজানারে জানাইলে তুমি.……………. খুব সুন্দর উপস্থাপনা। ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।
সবাই কে ধন্যবাদ প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই