মুক্তগদ্যঃ এক অনুল্লেখিত স্বাধীনতা সংগ্রামী স্মরণ – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

এক অনুল্লেখিত স্বাধীনতা সংগ্রামী স্মরণ
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

১৯৪৭ এর পর দেখতে দেখতে ৭৪ টা বছর পার হয়ে ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবসে এই লেখার জন্য সবার আগে অবেক্ষণের বর্তমান সম্পাদক কল্যাণীয়া মন্দিরা গাঙ্গুলীকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাখলাম এরকম এক গুরুত্বপূর্ণ দিনে বর্তমান লেখককে এই গুরুত্বপূর্ণ দিনের কথা লিখতে বলার জন্য।
দিনটার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে থাকি। কখনও কাঁদি। কেন যে বুকের ভেতর থেকে কান্না আসে তা এক কথায় বোঝাতে পারবো না। আমার ভাষায় কুলোবে না। বঙ্গ ভেঙে দু টুকরো আর পঞ্জাব ভেঙে দু টুকরো। ভুক্তভোগীরা কমবেশি কাঁদতে কাঁদতে চলে গেছেন পৃথিবী থেকে অনেক দূরে দাঙ্গাবাজ লোভী আর কূট রাজনৈতিক নেতাদের রক্তঘোলা চোখের সীমানা ছাড়িয়ে। সেদিনের যেসব শিশু বা মায়েরা প্রাকৃতিক কারণে আজও বেঁচে আছেন তাঁদের অন্যতম বর্তমান লেখক যার জন্ম ভারতবর্ষের এই ভাগাভাগির আগে অথচ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে হাঁটি হাঁটি পা পা করে বা মায়ের কোলে চেপে। তেমন মানুষের মধ্যে কান্না থাকবে না ? তাই জন্মদিনের হীরক জয়ন্তীতে তাঁদের অশ্রু বিশাল বিরাট বিচিত্র সংহত একত্রিত গরিয়সী ভারত মায়ের চরণে নত হতে গিয়ে মায়ের পায়ে পড়ে দু এক ফোঁটা পড়লে মা অসন্তুষ্ট হবেন না।
মায়েরওতো ব্যথা, অজস্র সন্তান হারানোর ব্যথা আর অঙ্গচ্ছেদ হবার যন্ত্রণা। মা তবুও আছেন। তাঁর এক কোল থেকে অন্য কোলে চলে গেলেও তাঁর কোলে চেপেই চলে এসেছি আস্তানার সন্ধানে। মাগো আমার প্রণাম নিও।
নিজের ব্যক্তিগত হলেও অনুল্লেখিত এক নীরব দেশপ্রেমিক ও সমাজ কর্মীর কথা বলে নিতে চাই। তিনি দেশ ও সমাজের প্রতি নিষ্ঠাবান এবং নিজের বিশ্বাসের ভগবানের সাধকছিলেন। বাবা যে আমাকে কোলে তুলে নেননি, তা কিন্তু নয়। হেঁটে হেঁটে কখনও রেলগাড়িতে চলতে চলতে ক্লান্ত মায়ের কোল থেকে বাবা তাঁর বক্ষে টেনে নিতে দেরী করতেন না। এই ভাবে দর্শনার পথ হয়ে রাণাঘাট হয়ে আসানসোল দিদি জামাইবাবুর বাসায় এসে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। শুরু হলো জীবন সংগ্রাম।
রিফিউজি ক্যাম্প নয়, ডোল নয়, লোন নয়, চাল গমের রেশন নয়। কেননা ঐ ঐতিহাসিক মানুষটা চেয়েছিলেন একটু নিরিবিলি আশ্রয় যেখানে থেকে তিনি তাঁর সাধনা চালিয়ে নিতে পারবেন। সেজন্য দিদি জামাইবাবুকে অশেষ সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ। ধন্যবাদ আমাদের সকলের।
দেশ স্বাধীনতার জন্য সাধক মনের মানুষটি বেছে নিয়েছিলেন হিংসা হীন আন্দোলনের পথ। সারা ভারতের স্বাধীনতার জন্য বাপুজীর ডাকে তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষার জন্য গিয়েও পরীক্ষা হলের সীটে না বসে বাইরে ঢাকা শহরের রাস্তায় পিকেটিং করা মানুষদের মধ্যে বসে পড়লেন। পরীক্ষা নষ্ট হলেও ভারতের স্বাধীনতা আগে চাই। জীবন যাক্, ভবিষ্যতে বড় চাকরির হাতছানি যাক্, তবু ভারতের স্বাধীনতা চাই। বিদেশী বৃটিশ সরকারের অপশাসন, অত্যাচার, পক্ষপাতিত্ব এসব দূর করতে গেলে কিছুতো দিতেই হবে। নিরীহ নিষ্ঠাবান মানুষটি তাঁর জীবনের ভবিষ্যতকে বলি দিয়ে বাড়ি ফিরে চরকায় হাত দিয়েছিলেন। নিজের পরিধেয় তাঁতের ধূতি আর খদ্দরের পাঞ্জাবী।
তবে মাত্র দশ বছরের বয়েসে পিতৃহারা বিধবা মা আর দুই বোন ও এক ভাইয়ের দায়িত্ব আর শিষ্য যজমানদের দেখা শোনার ফাঁকে স্কুলে যাওয়ার নিত্য কর্তব্যকে অবহেলা করা চলেনা। এসবের মধ্যে সত্য সন্ধানে চলতো তাঁর পড়াশোনা আর লেখা। অনেক গুলো ছোট পুস্তক রচনা করে তিনি বৈষ্ণব মহলে তোলপাড় তুলতে পেরেছিলেন। তাঁর রচনাই শেষ পর্যন্ত জয়মাল্য পেত। সেসব গ্রন্থের এক একেকটি কপি নিজের ব্যয়ে পাঠাতেন বিদগ্ধপণ্ডিতদের আর ঢাকা ও কলকাতার বড় বড় লাইব্রেরিতে।
(দুঃখের বিষয় পরিচিত কয়েক জন গবেষক বন্ধুরা অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পাননি।)
এসবের মধ্যেও তিনি সত্য ন্যায় নীতি ও নিষ্ঠার মধ্যেই থাকতেন। বাপুজীর আদর্শে সারা জীবন সংগ্রাম করে গেছেন, কোনদিন যশ বা অর্থের জন্য প্রচারবিমুখ এই মানুষটি রয়ে গেলেন অন্তরালে। চলে গেছেন তাঁর সাধনোচিত ধামে।
তারপর অহিংস ও সহিংস আন্দোলন আর আজাদহিন্দ বাহিনীর পতন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে ভারত মাতার পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন হলো গর্বের স্বাধীনতা পেলাম ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্টে। জয়হিন্দ।

One thought on “মুক্তগদ্যঃ এক অনুল্লেখিত স্বাধীনতা সংগ্রামী স্মরণ – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *