পরিবর্তিত সমাজ এবং মানসে আজকের নারী
প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত – সোমা মুখোপাধ্যায়
সাধারণত প্রত্যেক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ হলো নারী, যাদের সংখ্যা প্রায় পুরুষের সমান । ভারতীয় সমাজে নারীদের খুবই উচ্চ স্থান প্রদান করা হয়েছে, এই কারণে নারীদের পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী বলে মনে করা হয়। ধীরে ধীরে এদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে এই সমাজে।
বর্তমানে আমরা এক নব পরিবর্তিত সমাজে বসবাস করছি। সভ্যতার সাথে সাথে শিক্ষা এবং প্রযুক্তির যেমন পরিবর্তন হয়েছে, তেমনই এই পরিবর্তিত সমাজে আজকের নারীদের অবস্থানও বেশ কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে ।
বিশেষ করে স্বাধীনতা লাভের পরে নারীদের অবস্থানের একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। পরিবর্তিত সমাজে এখন তাদের অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে । পশ্চিমীকরণ ও জাতীয় গতিশীলতা নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার অনেক উন্নতি ঘটিয়েছে । বর্তমানে স্ত্রী শিক্ষার প্রসার হয়েছে । তারা এখন অর্থনৈতিক দিক থেকেও অনেক আত্মনির্ভর হয়ে উঠেছে । নারীদের পারিবারিক অধিকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ।
পরিবর্তিত সমাজে নারীরা পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণও গ্রহণ করছে । শিক্ষণের সাথে সম্পর্কিত ট্রেনিং কলেজ এবং মেডিক্যাল কলেজ গুলিতে মেয়েদের সংখ্যা প্রতিবছর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। স্ত্রী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার নারীদের নিজ ব্যক্তিত্ব বিকাশে প্রভূত সাহায্য করেছে। গত কয়েক বছরের মধ্যে নারীদের সামাজিক সচেতনতা অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে । আজকাল কোনো কোনো নারীর বিচারধারা ও দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যেও বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তারা আজ রক্ষণশীল সামাজিক বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে অত্যন্ত আগ্রহী । নারীরা এখন বহু সংগঠন এবং ক্লাবের সদস্যপদ লাভ করেছেন। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
আজকের পরিবর্তিত সমাজে নারীদের দাসী বানিয়ে রাখা যায় না । বন্ধু এবং সহযোগী রূপে তাদের ভূমিকা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে । কিন্তু এতকিছুর পরেও এই পরিবর্তিত সমাজে নারীরা আজও অবহেলিত, অপমানিত হচ্ছে কারণ তারা নারী। অনেক ক্ষেত্রেই প্রাপ্তির বদলে মিলছে শুধুই শূন্যতা । সময়ের সাথে সাথে অবস্থার উন্নয়নে বিভিন্ন নীতি ও আইন প্রণয়ন করা হয়েছে । বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রায় প্রতিদিনই সমাজের নিম্নস্তর থেকে শুরু করে উর্ধতন কর্মচারী নারীরা বিভিন্ন কৌশলে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে ।
শুধু যে ঘরে তা নয়, বাইরের কর্মক্ষেত্রেও নারীদের নিরাপত্তা কতখানি, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। সবচেয়ে বেশি আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো এই যে অনেক পরিবারেই এখনো কন্যাশিশু জন্মলাভ করলে হয় তাকে হত্যা করা হয়, নয়তো কোনও পরিত্যক্ত স্থানে তাকে ফেলে দিয়ে আসা হয়। এমনকি কোনো যানবাহনে চলাচল করলেও অনেকসময়ই ধর্ষণ বা বিশেষ যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয় নারীদের ।
কন্যাসন্তান এখনও অবাঞ্ছিত , বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। কোনো কোনো পরিবারে ছেলে এবং মেয়ে সন্তানের প্রতি আচরণেও প্রভেদ দেখা যায়। সামাজিক রক্ষণশীলতা, বিশেষ করে অনগ্রসর সম্প্রদায় ও উপজাতির মধ্যে নারীশিক্ষা প্রসারে বাধার সৃষ্টি করে । বাল্যবিবাহ এখনও অনেক জায়গায় ব্যাপকভাবে প্রচলিত ।
পরিবর্তিত সমাজে নারীদের মর্যাদা কতখানি তার আর একটি মাপকাঠি হলো স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণের প্রকৃতি । এখনও অবহেলা ও অযত্নের দরুণ প্রসূতি মৃত্যুর হার আমাদের দেশে অপেক্ষাকৃত বেশি ।
এতকিছুর পরেও দেখা যাচ্ছে , গ্রাম ও নগর উভয় ক্ষেত্রেই অধিকাংশ মহিলা আজও সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্রিয়াকান্ডে অংশগ্রহণ করতে পারছে না । এর একটি কারণ হলো স্ত্রীদের মধ্যে শিক্ষার অভাব এবং অপরটি হলো পরম্পরাগত মূল্যবোধ ।
পরিবর্তিত সমাজে মেয়েরা নিজেদের অবস্থার উন্নতির জন্য পুরুষের প্রচেষ্টায় সহায়তা প্রদান করেছে। তারা সমাজ সংস্কার আন্দোলন এবং রাষ্ট্রীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছে।
সরকারী বিভিন্ন ব্যাবস্থা নেওয়ানেওয়ার ফলে নারীশিক্ষার প্রগতি অবশ্যই সুনিশ্চিত হয়েছে । শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে নারীরা নিজস্ব স্থান তৈরি করে নিতে সমর্থ হচ্ছেন। তবুও অনুন্নত শ্রেণী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার আলোক পৌঁছে দেওয়ার জন্য এখনও অনেক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার । এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে বাধা হলো সমাজে নারীর পদমর্যাদা । নিয়মমাফিক পুরুষ ও নারীর সমানাধিকার থাকলেও এ কথা সত্যি যে নারীর অধিকার বা ক্ষমতা অনেকাংশে সীমিত এবং সত্যিকারের ক্ষমতায়ণ না হলে নারীর পদমর্যাদা সম্পূর্ণভাবে সার্থক হবে না ।
আজকের এই পরিবর্তিত সমাজে নারীদের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে মনে রাখতে হবে এক এক সময়ে তাদের অবস্থা এক এক রকম ছিল । উচ্চ ও নিম্ন জাতির নারীদের মধ্যে অবস্থার পরিবর্তন বিশেষভাবে পরিলক্ষিত ।
শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেয়েদের ভর্তির সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকলেও একটি বিশেষ সমস্যা হল ড্রপআউট । পরিবর্তিত এই সমাজে নারীদের শিক্ষা ও তার সাথে সমাজে নারীদের স্থান ও মানসিক মর্যাদার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। তাই সমাজে নারীদের স্থান কোথায় এবং সমাজ নারীকে কতখানি মর্যাদা দেয় , সেটাও দেখা দরকার । নারীদের অনেক সময়ই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তার ফলে তাদের শিক্ষা ও বিকাশ দুটিই ব্যাহত হয়ে থাকে । আরও প্রয়োজন হলো সামাজিক কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ইত্যাদি যা নারীর মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে , তা দূর করা ।
পরিশেষে বলা যায় উন্নত দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে দেখা যাচ্ছে যে কয়েকটি আইনি ব্যবস্থার দ্বারা নারীদের সকল রকম অযোগ্যতা দূর করার চেষ্টা করা হয়েছে । শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি ও কর্মক্ষেত্রে যথাযথ প্রতিষ্ঠা পাওয়া , তাই বেশি বয়সে মেয়েদের বিয়ে , পিতার সম্পত্তিতে অধিকার , বিধবার পতিগৃহে থাকবার অধিকার , পুনর্বিবাহ আইন ইত্যাদি আইনি পরিবর্তন নারী জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সংগঠিত করে। এইসব প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য হল সমাজে নারীদের অবস্থার উন্নতি, জীবনের সকল ক্ষেত্রে এবং মানসিক বিকাশ কার্যে নারীদের সক্রিয়ভাবে অংশীদার হতে পারা।
লেখা খুব ভাল। সংগে কিছু পরিসংখ্যান দিলে মনে হয় সমৃদ্ধ হত।
পরে আমারও একথা মনে হয়েছে । ধন্যবাদ ।
খুব ভালো লেগেছে