ছোটগল্পঃ মানুষ – সৌমী আচার্য্য (কল্যানী, নদীয়া)

মানুষ
সৌমী আচার্য্য

হেই ঠাকুর,পেন্নাম করি। আপদ বালাই দূর কর। ছেলেটার সুবুদ্ধি দাও। মেয়েটা বাচ্চা বিয়াক। আমার আর কি? এবার যেতে পারলে বাঁচি।
–ও দীনেশের মা,বকবক করে কি বলছো? শাপ শাপান্ত করছো কাকে?
আটকুড়ির বেটি সব আমার দিকে নজর খালি। কেনরে মরগে না ভাতারের গায়ের মধ‍্যে গিয়ে। ছেলেটা আজ তিনদিন হাসপাতালে পড়ে রয়েছে। শালারা মেরে পাটপাট করেছে। কি এক জ্বালা ওর শরীরে কে জানে? তা ঘরে অমন তারকা রাকখুশি বৌ যার সে আর কি করবে? ট্রেনে বাসে তেমন লককি পতিমা দেখলে আগুনের মতো অঙ্গ হাত বুলিয়ে শান্ত করবে না তো কি করবে? তাতে পাবলিকের এত ঝাল কিসের বুঝিনা। আমি একটু ঠাকুর পেন্নাম করি তাতেও এদের জ্বালা। মর্ মর্ সব। ঐ দেক দুধের ছেলেটাকে ঘুমের বড়ি খাইয়ে দাঁতের ফাঁক দিয়ে পিচিক পিচিক থুতু ফেলে বাড়ির বৌ একুনি বেরোবে ভিকখে করতে। হাড়গিলে কুষ্টি কালো চেহারায় বসন্তের দাগে ফোঁপড়া ধরা মুখ এই মুখে ইনিয়ে বিনিয়ে বাচ্চার অসুকের মিত্তে গল্পের ফাঁদ পাতে। মর্ মর্ এমন রাকখুশি মার মরণ হয় না কেন? দীনেশের বাপ মরলে দুটো বাচ্চা নিয়ে কি কষ্টই না পেয়েছি। কই এমন কতা তো ভাবতে পারিনি। যোগেন কর্মকারের বাড়ি মুড়ি ভেজে,ঠোঙা বানিয়ে দিন কেটেছে। পুকুর পাড়ের শুশনি শাক,কলমি,কচু আহা ছেলেমেয়ে গুলো সোনা মুখ করে খেত। গেঁড়ি গুগুলি তুলে আনত পুকুর থেকে দীনেশ। ওদের গায়ের জল মুছিয়ে চিরুনিতে চুল এঁকে কত সুখ পেয়েছি।এমন সব্বোনাশের টাকায় যারা মাছ মাংস খায় তাদের মুখে আগুন।
–এই যে রাজ্জো জয় করে বুড়ি এলেন। বলি,অমন রিষ চোকে তাকাও কেন হ‍্যাঁ? দুবেলা যে দুমুঠো জুটছে পায়ের উপর পা তুলে গিললেই হবে সেগুলো? একটু ঘরের কাজ করতে কি হাতে কুড়িকুষ্টি লাগে।
–কি খেতে দিয়েছিস! সেজেগুজে ছেলে কোলে চললেন। ফিরবেন সেই দুপুরে তা এতক্ষণ বুড়ি মানুষটা কি খায় তার খেয়াল আছে?
–কেন ঐ রাধেমোহনের পোসাদ বুঝি হজম হয়ে গেল? সকাল থেকে হত‍্যে দিয়ে পড়ে থেকে কিছু জোটেনি বুঝি।
মুকে হাগি এমন বৌয়ের। এট্টু চালকলা আর চাট্টি ফল ছাড়া এই সকালে কে কি দেয়? ঘরের দরজায় তালা দিয়ে খলবল করে হেঁটে চলে যাচ্চে দেক। কোনো দুককো শোক কিচু নেই বরের জন‍্যে।শুধু পেট ভরলেই খুশি। আস্ত একটা সজনেপোঁতা সেঁধিয়ে আচে ওর পেটের মদ্দে।আমার বলতে এই সমসারে আর কিচুই নেই। ঐ বারান্দার কোণের চৌকিটুকুই সার। এই বয়েসেও ঝাঁটাল দিই থু থু এমন বৌ কারো যেন না হয়।

–মা!
–কে রে দীনু এলি? ছেড়ে দিলো তোকে বাবা, আয়।
ভূতের মতো কালি ঝুলি মাখা লাল চোখের ছেলে। মাথায় যেন জম্মের ছাইভস্ম। এক ঝলক দেকে মেয়েটার কতাই মনে পড়লো। ছয়মাস আগে শ্বশুড় বাড়ি থেকে মেরে ধরে তাড়িয়ে দিলে এমন পোড়োবাড়ির মতো এসে দাঁড়িয়েছিল। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে সিদ্দেশ্বরীর পোসাদি ফুল তাবিজ করে পরিয়ে আবার পাঠালো দীনেশ। তাতেও রাগ ছিল ঐ বৌয়ের। বলে,পাটাচ্চো পাটাও। মেরে ফেললে কপাল চাপড়িও। বাচ্চা বিয়ায় না তো দোষ কি সুদু ওর? ছোড়াটাকে ডাকতার দেকাতে বলো। যত পোঁদপাকা কতা। ছেলেদের আবার দোষ। আমার দীনেশটা কলপাড়ে গামচা পরে চান করচে দেক। আহা গো। পিটে,ডেনায় কত কালসিটে। বাপ আমার কত ব‍্যতাই পেয়েচে।
–আরে একি? গায়ে হাত দিচ্ছ কেন? ভেজা এখনো। ছাড়। তা তোমার বৌ কোথায়?
–কোতায় আবার টেরেনে।
জামরুল গাচে ফুল নেবেচে অনেক। ওর ছায়ায় বসে বিড়ি ধরিয়েচে দীনেশ। কি যেন ভাবচে। এদিকে আমার পেটে গুড়গুড় শুরু হয়ে গেচে। খিদেয় চাঁদি জ্বলচে। বেলা কত হবে একন কে জানে? ঐ যে ছেলের হাত ধরে হেসে হেসে বাড়ি ফিরচে। ঘুমের ওসুদের নেশা কেটে গেল মনে হচ্ছে তাড়াতাড়ি। ছেলেটার হাতে কি? বাবা এ যে মাংসের প‍্যাকেট। জানতো নাকি আজ দীনেশ আসবে? মুখের হাসি মিলিয়ে খোককসির চেয়ারায় তাকিয়ে আচে আমার ছেলেটার দিকে। ছেলেও তেমনি,পুরুষ মানুষ রোয়াব নেই কোন? ঘাড় নেতিয়ে ধূলো চাটচে।
–মামাবাড়ি থেকে ছেড়ে দিল ভাগনেকে? তা ভালো। ঐ বারান্দার চোকি ছেড়ে ঘরে যেন পা না রাখা হয়। আর টাকা কামিয়ে তবে যেন পাত পাড়া হয়। মা এদিকে এসো মাংসটা নাতির হাত থেকে নিয়ে ধুয়ে রান্না ঘর এস। চাল ভেজানো আচে। তাড়াতাড়ি ভাত মাংস হয়ে যাবে। জিৎ ঠাকমাকে ব‍্যাগ থেকে পাউরুটি দাও একটু খাক।
-আর আমার ছেলেটা কি খাবেনা?
-কেন খাবেনা? রাস্তার লোকের মার খাবে। নোংরা ইতরের হয়ে ফোঁপরদালালি করতে হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও মা। পার্টি থেকে এই জমি আমার নামে করে দিয়েচে ভুলো না যেন।
মর্,মর্ তারকা রাকখুশি মর্। দীনেশের চরিত্তির খারাপ,মদ খায়,জুয়ো খেলে,মাকে বৌকে পিটায় এসব পাটির কাচে বলে কেঁদে কেটে সব নিজের নামে করিয়ে নিল। এমন শয়তানের সাথে ঘর করা যায়?

–কি হলো তুমি মাংস ধোবেনা? যে ছেলে মারে,খেতে দেয়না, রাস্তার মেয়েছেলেদের নিজের অঙ্গ দেকিয়ে কুইঙ্গিত করে তার জন্নে প্রাণটা হাঁকুপাঁকু করচে? তালে যাও বেরিয়ে যাও একুনি।
–ছেলেটার সারা গায়ে মারের দাগ,কখন এসেছে আর এই ভর দুপুরে কিচু না খাইয়ে রাকবি বৌ। তোর মায়া দয়া নেই।
–না আমার মায়া দয়া নেই। তোমার আচে। থাক আর কাঁদতে হবে না। স্বামী থাকতে আমাকে বাচ্চার মুখে ঘুমের বড়ি দিতে হয় মিত্তে অসুকের কতা বলে কেঁদেকেটে ভিককে করতে হয়। যা পাই তার থেকে রোজ একশ টাকা দালালকে দিয়ে তবে বাড়ি ফিরি তকন তোমার কান্না পায়? ছেলে আমার আলাভোলা হয়ে যাবে যদি না ওসুদ খাওয়ানো বন্দ করি ডাক্তার বলে দিয়েচে তাও করি এসব নইলে বাঁচবো কি করে? নিজের শরীর অন‍্যের হাতে দিতে তো পারবো না। যতবার চেষ্টা করেচি তোমার ছেলের মতো কোনো না কোনো হাড় বজ্জাত জুটে গেচে। তকন তোমার কান্না পেয়েছে মা?

কখনো কখনো রাকখসিটার মুক ঠাকুরের মতো লাগে। এই যে ছেলেটাকে খেতে দিল,অনেকটা ভাত,দুটো আলু আর একটা মাংস। আমার বুকটায় যেন গাংগুলি মশাই শান্তিজল ছিটিয়ে দিলো। থালাটা নিয়ে বৌটার কাচে উটে গেলাম। ওকি হাঁটুতে মুক গুঁজে কাদে কেন?
— বৌরে আমার পাতের একটা মাংস তুই নে। আমার বয়স হয়েচে বেশি খেতে পারিনা।
— তোমার ছেলেকে দাও গে।আমার লাগবে না।
–ওর লাগবে না,শরীরে যত জোর বাড়বে তত তো লুচ্চামি বাড়বে। তুই খা বৌ। তুই খা। তুই খেলে আমরা বাঁচবো। আর বলছি তুই টেরেনে করে ঐ মছলন্দপুর যা। ওকানে বাসনমাজা,ঘরমোচার কাজ নে। আমি দাদুভাইকে নিয়ে কোলে করে মন্দিরে যাব,ঘরদোর পরিস্কার করবো। চাল আলু এনে রাখবি। ফ‍্যানভাত করে রাকবো। দাদুভাইকে আর অসুধ খাওয়াসনা।

ছেলেটা চৌকির উপর শুয়ে ভ‍্যাদভ‍্যাদ করে নাক ডাকচে। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বৌটা হাঁ করে দেকচে, চোকের কোলে জল। হেই ঠাকুর পেন্নাম করি, ছেলেটার সুবুদ্ধি দাও। নাতির গা ঘেঁষে পাটিতে শুয়ে ঘুমের কথা ভাবতেই একটা মশা আমার বাঁ কানে পোঁ পোঁ করে উঠলো। মর্ মর্ কেউ না কেউ আমার শান্তি নষ্ট করার জন্ন হাঁ করেই আছে। মর্ সব। একটু শান্তিতে ঘুমতে পজন্ত দেয়না।

2 thoughts on “ছোটগল্পঃ মানুষ – সৌমী আচার্য্য (কল্যানী, নদীয়া)

  1. অসম্ভব বলিষ্ঠ কলমে লেখা অসাধারণ গল্প।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *