আত্মজা
ভূমিকা গোস্বামী
এইমাত্র ও চলে গেল। এখনও শঙ্খ আর উলুধ্বনির রেশ রয়েছে। সারা বাড়িটা যেন ভাঙা মেলার মতো ছড়ানো ছিটানো। পঁচিশটা বছর যাকে ঘিরে মণি আর দীপের জগত ছিল। যার সব ভাললাগা মন্দলাগাকে গুরুত্ব দিতে দিতে নিজেরা কী পছন্দ করে ভুলে গিয়েছিল , সেই নীপা আজ শ্বশুরবাড়ি গেল।
একমাসের ছুটিতে এসেছে শুভঙ্কর। বৌ নিয়ে আমেরিকা ফিরে যাবে।
মেডিকেল কলেজে পড়ার প্রথম বছরেই সকলের নজর কেড়েছিল সুন্দর ব্যক্তিত্বময়ী নীপা। কলেজের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে স্টেজ থেকে নামতেই তখন ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র শুভঙ্কর ই প্রথম একগুচ্ছ গোলাপ দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিল নীপাকে। সেই থেকে ওদের সম্পর্কের শুরু।
এরমধ্যে শুভঙ্কর ডাক্তারী পাশ করে স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে গেল। নীপাও ইনটার্ন শেষ করে গায়নোকোলজি তে স্পেশালাইজড করেছে। কলকাতার এক নামকরা বেসরকারি নার্সিহোমে কাজও করছে। পাশাপাশি গানটা শিখে যাচ্ছে। স্কাইপিতে দুজনে মুখোমুখি হলেই শুভঙ্কর বলতো- নীপা একটা গান কর । রবীন্দ্রনাথের গান যেন ওদের সম্পর্ককে বেঁধে রেখেছে। বাসরঘরেও অনেক গান গেয়েছে নীপা।
আজ ওদের দুটিকে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় মণির। দীপকে আড়ালে ডেকে বলে — আমাদের নীপা সুখী হবে, বল ?
ওরা আজ দুজনে ফিরে যায় সেই তিরিশ বছর আগে। যখন দীপ বোলপুরের এক সরকারি স্কুলের কেমিস্ট্রির শিক্ষক। মণি হেল্থ সেন্টারের নার্স। বোলপুর স্টেশনের কাছে ওদের তখন ভাড়া বাড়ির ছোট্ট সংসার।
বাড়ির মালিক একজন ডাক্তার। কলকাতায় বিশাল বাড়ি। শান্তিনিকেতনে বেড়াতে এসে, পলাশ শিমুলের টানে এখানে একটা ঠিকানা করেছিলেন। প্রথম প্রথম মাসে একবার আসতেন । বয়স বেড়েছে । আর যাতায়াত করতে পারেন না। ওরা বোলপুর স্টেশনে লাইট পোস্টের গায়ে “বাড়ি ভাড়া” বিজ্ঞাপন দেখে ল্যান্ড ফোনে যোগাযোগ করে বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিল। প্রয়োজনীয় ফার্নিচার দিয়ে সাজানো। দেখতে দেখতে আনন্দে পাঁচটা বছর কেটে গেল। নিজের বাড়ির মতো নানারকম ফুল ফল সবজির গাছ করতে লাগল। লাল রুক্ষ মাটিতে লাউ, লঙ্কা, টমেটো ফলিয়ে আনন্দে আটখানা ওরা। আর ওদের সাহায্য করতো ওখানকার আদিবাসী মেয়ে মউল। প্রায় দুকাঠা জমির মাটি কুপিয়ে গোবর সার মিশিয়ে দিয়েছিল ও।
মউলের বাবা পরের জমিতে চাষ করতো। মদ খেতে খেতে মরে গেছে। চির-রুগ্ন মা ও চোখ বুজলো মউলকে ফেলে। সেইথেকে কালো রোগা লম্বা নিরক্ষর আঠেরো বছরের অনাথ মেয়েটা নিজেই নিজের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়ে নিল। পাঁচ বাড়ির বাসন মেজে , কাপড় কেচে , ঘর মুছে কোনরকমে নিজের পেট চালাতো। ছোট থেকে কেউ ওকে কখনও আদর করে কথা বলে নি। সবাই দাঁড়কাক বলে ডাকতো। মণির কাছেই প্রথম ও স্নেহের ছোঁয়া পেয়েছিল। মণির হাতের ছোঁয়ায় বাগান আলো হলেও ওদের কোল আলো করে কেউ এলো না। অনেক ডাক্তার, অনেক পরীক্ষার পরও ওরা কোন আশার আলো দেখতে পায় নি।
সেদিন ছিল রথযাত্রা। সারারাত প্রচণ্ড বৃষ্টির পর ভোরে সূর্যের নরম রোদ মণির বাগানে পড়েছে। রাধাগোবিন্দ মন্দিরে সকালের আরতির ঘণ্টা ধ্বনি ভেসে আসছে। মণি আর দীপ দু’কাপ চা নিয়ে বসার ঘরে এসে বেতের সোফায় বসেছে। এমন সময়ে দরজায় ঘনঘন কড়া নাড়ার শব্দে ওরা দুজনেই প্রথমে চমকে উঠলো। দরজা খুলে হতবাক মণি। মউলের একি চেহারা ! হাউ হাউ করে কাঁদছে মেয়েটা। কাঁদতে কাঁদতে বলছে — ঐ ঘোষবাড়ির কাকুটো মুকে নষ্ট করলো বটে।
মণি ওর কান্না মেশানো কথা থেকে উদ্ধার করলো — গতকাল বিকেলে ও ঘোষবাড়িতে বাসন মাজতে গিয়েছিল। ঘোষগিন্নী বাপেরবাড়ি গিয়েছিল বাচ্চাদের নিয়ে। অবস্থাপন্ন ধোপদুরস্ত আপাত দৃষ্টিতে ভদ্রলোক ব্যবসায়ী ঘোষবাবু সারারাত মেয়েটাকে অত্যাচার করেছে।
মণি ওকে নিয়ে থানায় যেতে চেয়েছিল। মউল যেতে চায় নি , লোক জানাজানির ভয়ে। বারবার বলছে –লোকে মুকেই দোষ দিবে বটে । কেউ মুর কথা বিশ্বাস যাবে না।
কিছুদিন পর আবার সব স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবে ঘোষবাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়েছে মউল। মণির বাগানে বর্ষার জল পেয়ে গাছপালা সবুজ আর সুন্দর হয়ে উঠেছে।
দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল। হঠাৎ মণির অভিজ্ঞ চোখে মউলের শারীরিক পরিবর্তন ধরা পড়ল। মউলকে কাছে ডেকে কিছু পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয় মণি। মউলের শরীরে আর একটি প্রাণ । সেই দিন থেকে মউলকে বাড়ির বাইরে আর যেতে দেয় নি মণি। মউলকে আগলে রেখেছে। আশ্বস্ত করেছে।
দোল পূর্ণিমার রাতে বাড়িতেই মউল একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। মণি আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে ছিল সেই সদ্যজাতার দিকে। ওর হাতে এতদিন শতশত বাচ্চা প্রসব হয়েছে। কিন্তু এমন অনির্বচনীয় রূপ, এমন আলোর মত উজ্জ্বল কাউকে দেখে নি ও। মউল কিন্তু একটি বারের জন্য শিশুটির মুখের দিকে তাকায় নি। বলেছে –উ পাপ বটে। সরায়ে নাও কেনে।
মণি জোর করে নি। মনে মনে বলেছে –কোন শিশু পাপ নয়। প্রতিটি প্রাণে সৃষ্টির সমস্ত শক্তি নিহিত। মণির কাছে ও ঈশ্বরের অমূল্য সম্পদ।
মণি আর দীপ পরেরদিন ই রাতের ট্রেনে বোলপুর ছেড়েছিল শিশুটিকে নিয়ে।
ছ’মাস আগেই দীপ ট্রান্সফারের আবেদন করে । দমদমের একটি স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ পেয়ে যায়। সেখানকার কেমিস্ট্রির শিক্ষকের বাড়ি বোলপুরে। তিনি অনেক দিন ধরেই বদলির আবেদন করে রেখেছিলেন। তাই বেশী খড়কুটো পোড়াতে হয় নি। মণি হেল্থ সেন্টারে নার্সের চাকরির ইস্তফা দিয়ে এসেছে। ডাক্তার ম্যাডাম কে আবেদন করেছিল- সাফাই এর কাজে মউলকে রাখার জন্য। আবেদন মঞ্জুর হয়েছে দেখে এসেছে। একমাস পরে জয়েন করবে ও। একমাস পরে বাড়িটাও ছাড়তে হবে । এ কদিন মউল এ বাড়িতেই থাকবে। ওর সারা মাসের চাল ডাল তেল মশলা । ফ্রিজ ভর্তি মাছ, ডিম, সবজি ফল সব গুছিয়ে রেখে এসেছে মণি। হাতে কিছু টাকাও।
ট্রেন ছুটছে। ওরা দুজনে ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে। দীপ বলেছিল — মণি আর দীপের মেয়ে নীপা। আমাদের মেয়ের নাম হবে নীপা।
ফোনের বাঁশির সুরে স্বম্বিত ফিরলো ওদের। নীপার ফোন। –কেমন আছ মা ? বাবা কেমন আছে ? দেখো না, এইমাত্র রিচুয়ালগুলো শেষ হল। ডিনার করেছ তো তোমরা ?
–না মানে , এই তো করবো ভাবছি।
— এগারোটা বেজে গেছে মা, এখনও খাও নি কেন বল তো ? কী যে কর না! বাবার বয়স হয়েছে। শরীর খারাপ করবে তো! …
নীপা বলে যাচ্ছে। অন্য সময় হলে মণি হয়তো ওকে থামিয়ে দিত। বলতো,- পাকাবুড়ি মা আমার।
আজ কিন্তু মণির বেশ লাগছে। নীপার শাসনের ভঙ্গি। ওর এই গভীর টান। উদ্বেগ। সব কিছু । সবকিছু।
সুন্দর লেখনী।
খুব সুন্দর গল্প । খুব ভালো লাগলো ।
ধন্যবাদ।
অসাধারণ আবেগপ্রবণ আনন্দদায়ক একটা গল্প