ছোটগল্পঃ এক অতিমারি শেষে- পার্থ রায় (কলকাতা)

এক অতিমারি শেষে
পার্থ রায়

দিনভর অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়েছে। আষাঢ়ের ধারাপাত। প্রবল অতিমারি আর অসংখ্য মানুষের মৃত্যু মিছিল শেষে ভাইরাসের সাথে শান্তিচুক্তি হয়েছে। পারস্পরিক সহাবস্থানের। খুব দ্রুত লয়ে না হলেও জনজীবন ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো ক্রমশ স্বাভাবিকতায় ফিরতে উন্মুখ। ঠিক যেমন শিশুরা স্কুলের আঙ্গিনায়। আজ আবিরের জন্মদিন। যার জন্মদিন সেই মানুষটাই নেই। অতিমারির রুগিদের সেবা করতে করতে খেয়াল করেনি কখন সেই মৃত্যু লোভী ভাইরাস ওর শরীরে ডালপালা বিস্তার করেছে। খেয়াল করেনি? নিজে ডাক্তার হয়েও বুঝতে পারেনি? এটা বিশ্বাসযোগ্য? আসলে অবহেলা করেছে। চরম অবহেলা করেছে নিজেকে, স্বজনদের আর ওর বৃষ্টিস্নাতাকে। বৃষ্টিস্নাতার অভিমানি মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে। আসল নাম সুচরিতা। বৃষ্টিতে ভিজতে ভালবাসত বলে আবির ওর নাম রেখেছিল বৃষ্টিস্নাতা। এমনই এক বৃষ্টিমুখর বিকেলের শেষে নিজের আর ওর ভেজা কাপড়ের খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে ঘন মুহূর্তে ওই নাম রেখেছিল আবির। আদর খেতে খেতে মজা করে বৃষ্টিস্নাতা বলেছিল, “তোমার তাহলে কী নাম হবে? আষাঢ়ে?”।
“যে নামে তুমি ডাকবে”
অতলে ডুবে যাবার আগের মুহূর্তে ফিসফিস করে বলেছিল, “তুমি বৃষ্টিস্নাতার আবির। তুমি দোল ভালোবাসো। তুমি রঙ ভালোবাসো। তাই সবার কাছে ডাঃ শিবাঙ্গ সান্যাল। আমার কাছে শুধু আবির। আবির। আমার আবির। আবির”।
এখন আর বৃষ্টি ভাল লাগে না বৃষ্টিস্নাতার।
সন্ধ্যায় এক জায়গায় যাবার কথা। অনেক করে বলেছে ওরা।
“আসতেই হবে। না আসলে আড়ি”।
সারাদিন শুয়ে বসে কাটিয়েছে। অফিস যায়নি। কোন কাজ করতে ভাল লাগেনি। পরম মমতায় আবিরের স্মৃতিগুলোকে ছুঁয়ে দেখেছে। অনেকদিন পরে ফেসবুকে নিজের টাইমলাইনে পা রেখেছিল। ওদের দুজনের বিভিন্ন মুহূর্তের অজস্র ছবি। বাইরের বৃষ্টি বুকের জলাধার ছাপিয়ে চোখ উপচে পড়েছে- বারেবারে, অজস্রবার। মাঝে মাঝে মা এসে আদর করে গেছে। সেই ছোটবেলার মতো কোলের কাছে নিয়ে চুল বেঁধে দিয়েছে।
কলিং বেল বাজল। মা ঠাকুরঘরে সন্ধ্যা দিচ্ছে। সুচরিতা উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই এক দঙ্গল প্রজাপতি হইরই করে ঢুকে পড়ল। ওরা কেউ রেল লাইনের ওপারে বস্তির ছেলে মেয়ে, কেউ অনাথ। ওরা “আশ্রয়” এর সব খুদে সদস্য। মাদার টেরিজার আদর্শে শিক্ষিত আবিরের স্বপ্নের সংস্থা “আশ্রয়”। ওদের থাকা খাওয়া লেখাপড়ার জন্য নিজের অর্থ, শ্রম, স্বেদ আর সাধ বিনিয়োগ করে গড়ে তুলেছে। অবশ্য দেশ বিদেশের কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংঘটন এবং ইন্ডাস্ট্রি হাউসও আর্থিক এবং অন্য নানা রকমের সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছে।
কেক কেটে, গান গেয়ে, নাচ করে ওরা আজ আবিরের জন্মদিন পালন করবে। তাই ওদের প্রিয় সুচরিতা আনটিকে নিতে এসেছে।
হাত ধরে টানাটানি, ঝুলোঝুলি, অভিমান।
“চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে। চলো না গো”।
ছোট ছোট শিশুগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হল। “আশ্রয়”কে বাঁচিয়ে না রাখলে এরা কোথায় যাবে? ওর আবিরের স্বপ্নকেও তো জীবিত রাখতে হবে ওকে। ক্ষুদেদের হাত ধরে বাড়ির বাইরে পা রাখল। আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইতে দেখল মেঘ কেটে যাচ্ছে। দু একটা তারা উঁকি দিচ্ছে। পৃথিবী ফিরছে আগের ছন্দে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *