বাউণ্ডুলে
সৌমী আচার্য্য
চাই তো যেমন ইচ্ছে তেমন থাকতে।সকাল হবে মাহেন্দ্রক্ষণে আমি ফুলের সাজি নিয়ে এক ডুবে পৌঁছে যাবো ঝাঁপিয়ে পড়া শিউলিতলায়।সাজি উপচে এলে দু চারটে স্থলপদ্ম তুলে ঠাকুর দালানে রেখে ঐ বুড়ি আঁচলের নরমে মুখ ডুবিয়ে দেবো।সূর্য ওঠার ঝাঁঝ গায়ে লাগার আগেই কয়লা উনুনে মনোযোগী ধোঁয়াখোর হবো।দূর থেকে ভেসে আসবে পূর্বজন্মের ডাক,ওরে মেয়ে সরে দাঁড়া গায়ে ধোঁয়ার গন্ধ হবে যে।আমি তখন চরাচর হাঁমুখে গিলছি,আকাশ কাঁপিয়ে বলছি,আমি ধূমাবতী।আবার ইচ্ছেমতো এক ডুবে গ্লেনারিসে গিয়ে উঠবো।দুজন বিদেশী আমার খোলা চুল থেকে চুঁইয়ে পড়া শিশির দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে আমি মোটেই দেখবো না তাদের।আমি তো তখন গার্লিক ব্রেড খেতে খেতে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখছি।আর মনে মনে ভাবছি মির্চা ইউক্লিডের চোখের নীলে আমার রসুন গন্ধী ঠোঁট কতটা কাব্য লিখছে?সব ছাপিয়ে নিশ্চিত বুকে কাঁপন ধরাবে পাহাড়ী তরুণ।ওর ছোট চোখে আকাশের গভীরতা,ফর্সা চিবুকে প্রাণঘাতী কালো তিল আর আদর চাওয়া খোলা ঠোঁট।এরপরেই হাঁটা শুরু করবো দুজনে সিঙ্গালীলা ফরেস্ট ছুঁয়ে।নাম না জানা পাখিদের ছবি তুলে নেবো ক্যামেরায়।পাহাড়ের উঁচুতে কাঠের ফুলেল বাড়িতে দ্বিপ্রহরের আহ্বান।আমার বাদামী গাল সংকোচে অচল।আবদারের সুর আসবে চিলগোজা গাছের বীজ উড়িয়ে।আমিও লক্ষ্মী মেয়ে হবো।চিকেন ফালে আর স্যূপ।জিরিয়ে নেবো লালি গুরাসের নরম গন্ধে।গরানের ঢাল বেয়ে দুপুর বেলা গোয়ার পালোলেম বিচে সূর্যাস্ত দেখবো একা।বিষাদ ছুঁয়ে যাবে আমার চোখ।শরীর জুড়ে খরা আনে ফ্যাকাশে হেমন্ত।নিজের বাড়ির সাধারণ ঘরের পরিচিত বিছানায় ফিরতেই হয়।সবাই যখন ঘুমায় আমি খুলে বসি সাদাত হোসেন মান্টো।অসহ্য যন্ত্রণায় বুক টনটন করে।যেচে নেবো সেই অসুখ।সন্ধ্যেয় মেকাপ নিয়ে একাডেমি কাঁপিয়ে অভিনয় করবো।ফ্রন্ট রো থেকে হাততালি দেবেন মি.সেন মুখে অলৌকিক বার্তা।আমি আনন্দে ভাসতে ভাসতে ফড়িং হয়ে ছাদে এসে বসবো।কলিংবেল বাজলে আকস্মিক বন্ধুমুখ।দেদার আড্ডা আর বরফকুচি দেওয়া উষ্ণ পানীয়।কবিতা বলবো একের পর এক।কে অকবি বললো তার ভয় বিন্দুমাত্র থাকবে না।প্রিয়জন আর সন্তান পিঠ চাপড়ে ঘোষণা করে দেবে আমি শ্রেষ্ঠতমা তাদের কাছে।মা বাবা ছাদ বাগানে আসবে বেলফুলের গন্ধ নিতে।আমার ছোটোবেলার গল্প উচ্চারণ করবে অহঙ্কারী চোখে।আমার জুড়িয়ে আসা চোখে সুধন্ন কাকার কালো মেয়ে।ওর সাথে মিতালী পাতাতে গেলে সেও এক বৃষ্টিভেজা পথের গল্প বলে।হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় আইশতলায়।বারবাড়ির উঠোনে পাটের ঠাকুরের গায়ে তখন তেল সিঁদুর মাখানো হচ্ছে।আরে ছ্যামড়ি বেতালা কতা কয়,এবিনে সেবিনে ঘোরে।ধমক লাগায় অতি সাবধানী পাড়াতুতো পিসি।চাঁদপানা ফিরিঙ্গি মেয়ের কোমড়ে ঘাঘড়া বেঁধে দিলে সেও বেনারসের মুলুক ছাড়তে চায়না।আমি ঘুরি পিছু পিছু।ওর সাদা চামড়ার গল্পের টানে।রাতে গাঁজায় দম লাগালে পুরো জীবনটাই উপন্যাস হয়ে যায়।রাজস্থানের উট সাজাতে দেখেছিলাম রামদুলারাকে।সে বলেছিলো,বালির খিদে খুব।ওর বাপকে জোয়ান কালেই গিলেছে।বালি নাকি ঢবকা মাগ।তাজা রক্ত চাখে।বুড়া ঠাকুর্দাদা বারবার ফিরে আসে কিন্তু বাবা আসেনা।যোধপুরের প্যালেসে উঠতে ইচ্ছা করেনা।পাথরের রাস্তার পাশে থম মেরে থাকি।বালিঘড়ি সময় মাপে।আমি যোধাবাঈ হয়ে যাই অচিরেই।লাল কামিজ আর সাদা ঘাঘড়ায় বসন্ত খুঁজি।শরীর জাগেনা।চির শীত।বড্ড ঘুম পায়।অথচ স্পষ্ট শুনি বিসমিল্লাহ খাঁ,অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় এসে দাঁড়ায় মাণ্ডুর রানী রূপমতী।চন্দনের গন্ধ তীব্র হতেই একে একে ভীড় জমায় মীরাবাঈ,পদ্মাবতী,প্রীতিলতা,কাদম্বরী।একটা একটা করে অগুরু গন্ধী সাদা কাগজ তুলে দেয় আমার হাতে।না অদৃষ্ট তখন তুমি বৃষ্টি হবেনা,ভিজিয়ে দেবেনা আমার প্রাপ্তি বরং তুমিও মেতে ওঠো আমার সৃষ্টির পথে দোসর হয়ে।বাউণ্ডুলে মনে ঝরুক প্রশ্রয়ের ভরসা।আমি লিখতেই থাকি,ভাসতেই থাকি,ভবঘুরে হতেই থাকি…দিগন্তরেখায় শুকতারার পাশে আমার একখণ্ড জমি হোক।তক্ষক জেগে উঠুক। হবে হবে হবে।
তথাগত চোখ বন্ধ করেন অর্বাচীন গতির সাথে সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই হয়তো।ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে বেত্রবতীর তীরে দাঁড়িয়ে কে আমি এই প্রশ্ন দীর্ণ করে তোলে অন্তর।একটানা সুর ভেসে আসে কালপেঁচার ভয়ার্ত বেদনায়।রত্নাকরের মতো আমিও প্রত্যাখ্যান পাই বারবার।তবু ঘুরেফিরে নিজেকে সঁপে দিই।কারা যেন ধরেবেঁধে পাহাড়ায় বসায় আমায়।হাতে লাঠির বদলে সোনার শিকল।ভ্রম হয় আমি কি তবে আসলে বন্দী!বিয়াসের হাওয়া পালে লাগে,দূর থেকে ভ্যানগঘ হাঁকেন,স্টারি নাইট তোমায় দিলাম।তোমার একার অধিকার।নীলগাই চরে আমার কংক্রিটের শহরে,দুএকজন বলে এসব দেখতে পাওয়া কুলক্ষণ,ঘর দুয়ার উচ্ছন্নে যায়।আমি গাজনের বাজনা শুনি।ধেইনেত্য জুড়ি।উচ্ছন্নে যাবার আকাঙ্খায় রাত জেগে চোখ রাখি জয় গোস্বামী আর শঙ্খ ঘোষে।কলম চিবোতে চিবোতে অর্দ্ধেক উদরে পুরে রাখি।সামনে দিয়ে হেঁটে যায় মুখোশ মিছিল।মাঝে মাঝে মরাদের ভীড়ে হেঁটে যান লম্বা দাড়ি,সাদা জোব্বা।আমি ইছামতীর জলে বৈঠা বেয়ে মানুষ খুঁজি।হারিয়ে যাওয়া কালি কলম খুঁজতে আসেন বাণী বসু।আমি মুন্নারের কফির গল্প শোনালে মুচকি হেসে বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে যান।ক্ষণা মিহিরের ঢিবিটা পেলে হয়তো নিজেকে চিনতাম।ফোটন কণার মতো ছুটে বেড়াই,আভ্যন্তরীণ পূর্ণ প্রতিফলন মরিচীকা দেখায় আর আমি গতি বাড়াই।ছুটতে আমাকে হবেই।রোহিনী নক্ষত্রের জন্ম জাতিকা অলক্ষ্মীর মতো বাতাসে ভর করে উড়ে যায় নিজেকে খুঁজতে।বাউণ্ডুলে মন ঘর বাঁধে পাহাড়ের কোলে যেখানে রাত হলেই দেবতারা অগুরু গন্ধী পাতায় কি লেখা হল তার খোঁজ নিতে আসে।আমি তারা দেখি,জীবন দেখি প্রকৃতি দেখি সাদা পাতায় দৈব অক্ষর দেখি।
বাঃ। খুব ভাল লাগল।
অপূর্ব বাচনভঙ্গি। অপূর্ব অন্তকরণের চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া বিন্দুরা কি মুক্তো হয়ে ধরা দেয় না ?
ভালো থাকবেন।