মুক্তগদ্যঃ দোল ফাগুনের বসন্তের ফাগ – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

দোল ফাগুনের বসন্তের ফাগ
রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

দোল ফাগুনের বসন্তের ফাগ। চারদিকে প্রকৃতি পরিবেশ মানুষজনের কথাবার্তা টিভি, রেডিও, পাড়ায় পাড়ায়, মন্দিরে মন্দিরে প্রস্তুতি জানান দিচ্ছে আসছে দোল উৎসব। করোনা-কোভিদের আতঙ্ক গত বছরে উপভোগ করতে দেয়নি ফাগুনের ফাগ খেলা। এমনকি বাঙ্গলার মানুষের হৃদয়ে মনে তৃপ্তি এনে দেয় শান্তিনিকেতনের যে বসন্তোৎসব তাও ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়ে আমাদের উজিয়ে যাওয়া হয়নি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে তৈরী শান্তিনিকেতনে। দেখা হয়নি হলুদ রঙের পোশাক আর অফুরন্ত পলাশ ফুলের সমারোহ সজ্জা।
এবারও করোনা-কোভিদের দাপট তুলনায় হ্রাসমান হলেও থাকছে মুখে মাস্ক পরা আর সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সামাজিক বিধি নিষেধ মেনে চলা, কেননা সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি ভয় জাগায়। জানিনা কী আছে কপালে।
ফাল্গুন মাস চলে গেছে, তবুও ফাল্গুনের আবেশ রয়ে গেছে। তাছাড়া ফাল্গুনের ফাগ খেলা হতে আরো কয়েকটা দিন বাকি আছে। কাজেই কিছু ফাল্গুনের কথায় আসি। আগেই একটা লেখায় জানিয়েছি,
এই ফাল্গুনেই আমার শ্রদ্ধেয় বাবার জন্ম, বিবাহ এবং মৃত্যুও। এই মাসেই শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু জন্মেছিলেন বাঙ্গলার নবদ্বীপে ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিন সন্ধ্যায়, চন্দ্র গ্রহণের সময়।
সাধিকা মীরা বাঈ অজস্র গান লিখেছেন শ্রীকৃষ্ণকে উদ্দেশ্য করে। তাঁর একটি গানে তিনি বলেছিলেন –
ঝুলত রাধা সঙ্গ গিরিধর।
আবীর গুলাল উঠাবত রাধা, ভরি পিচকারী রংগ।
লাল ভই বৃন্দাবন যমুনা কেশর চুবত রংগ।।
নাচত তাল অধর সুর ভরে, ধিমধিম বাজে মৃদঙ্গ ।
মীরাকে প্রভু গিরিধর নাগর, চরণ কমল কুরংগ।।
(কেশর – ফুলের ভেতরে কেশের ন্যায় সূক্ষ্ণ বস্তু, কিন্তু এ ক্ষেত্রে গাছ। কুরঙ্গ – হরিণ, কিন্তু এক্ষেত্রে তীর্থ) ।
শ্রীমতী রাধা গিরিধারীর সঙ্গে দুলছেন। তিনি আবীরসহ পিচকারী রঙে পরিপূর্ণ করেছেন । সমগ্র বৃন্দাবন ও যমুনা রাঙা হয়ে গেছে। বৃক্ষ সমূহ থেকে রঙ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে । আর গিরিধারীলাল মৃদঙ্গে তাল ঠুকতে ঠুকতে নৃত্য করছেন এবং সুমধুর কন্ঠে ফাগুনের গীত গাইছেন।
ফাল্গুন চৈত্র দুমাস বসন্ত চলে। এসময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সময়। চারদিকে শুধু আনন্দ আর আনন্দ।গ্রীষ্মের দগ্ধকরা তাপের বা ঘাম ঝরানো বিরক্তিকর অবস্থায় পৌঁছনোর জন্য এখনও হাতে কিছু সময় রয়েছে। এছাড়া কালবৈশাখীর ঝড় বা প্রবল বর্ষণের দিন আসতে ঢের দেরী আছে। তাই আকাশ বাতাস নদী গাছগাছালি এমনকি পাখিরা পর্যন্ত আনন্দে মাততে চায়। তাই অতি অল্পতেই উৎসবের আনন্দে মেতে থাকা যায়।
অনাদি কাল থেকে, বরং বলা চলে প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে দোলনায় ঝোলা এসব একটি মজার খেলা বিশেষ। যার যার বাড়ির উঠোনে বা কাছাকাছি বনের মধ্যে গাছের ডালে দড়ি বেঁধে নীচে কোন তক্তা দুলিয়ে এবং সম্ভব হলে সেই তক্তার উপর নরম গদি বসিয়ে তার উপর বসে দোল খাওয়া বহু প্রাচীন রীতি চলে আসছে। শ্রীকৃষ্ণ নিজে মাঝে মাঝেই দোলনায় চড়তে ভালোবাসতেন। তাঁর বালক সখারা মাঝে মাঝেই পেছন থেকে বা পাশ থেকে দোলনায় বেশি গতির জন্য ঠেলে দিতেন। আরাম বোধ হত নন্দনন্দন শ্রীকৃষ্ণের, মজা পেতেন সুবল সখারা। মাঝে মাঝে সখারাও দোলনায় উঠে বসার সুযোগ পেতেন।
অনুরূপভাবে বৃন্দাবনের বর্ষাণা গ্রামের বৃষভানুনন্দিনী শ্রীমতী রাধারাণীও তাঁর সখীদের সঙ্গে দোলনায় দুলতেন, সখীদের দোলাতেন। এরপর বৃন্দাবনের তথা ব্রজের নানান স্থানে এমনকি যমুনার ধারেও চলত জগৎস্রষ্টার সঙ্গে জগৎঈশ্বরী তথা শ্রীরাধাকৃষ্ণের দিব্য মিলনের এই দোলা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের হিসেবে এই লীলার কথা স্মরণ করে কিছু কিছু ভক্তদের দেহ ও মনে দিব্য পুলক সঞ্চারিত হতে পারে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও একরকম আনন্দানুভূতি হ‍য়ে থাকে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাধারণ মানুষের এই অনভূতিতে লিখেই ফেললেন ১৩ ফাল্গুন ১৩৩২ বঙ্গাব্দে —
দোলে প্রেমের দোলন চাঁপা হৃদয়-আকাশে,
দোল-ফাগুনের চাঁদের আলোর সুধায় মাখা সে।
কৃষ্ণরাতের অন্ধকারে বচনহারা ধ্যানের পারে
কোন্ স্বপনের পর্ণপুটে ছিল ঢাকা সে।
দখিন হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল গোপন রেণুকা
গন্ধে তারি ছন্দে মাতে কবির বেণুকা।
কোমল প্রাণের পাতে পাতে লাগল যে রঙ পূর্ণিমাতে
আমার গানের সুরে সুরে র ইল আঁকা সে।
কবিগুরু আরেকটি গানে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে অগ্রহায়ণ মাসে বসন্তের আগে লিখেছেন –
রঙ লাগালে বনে বনে।
ঢেউ জাগালে সমীরণে।
আজ ভুবনের দুয়ার খোল দোল দিয়েছে বনের দোলা –
কোন্ ভোলা সে ভাবে ভোলা খেলায় প্রাঙ্গণে।
আন্ বাঁশি — তোর আন্ রে,
লাগল সুরের বান রে,
বাতাসে আজ ছড়িয়ে শেষ বেলাকার গান রে।
সন্ধ্যাকাশের বুক-ফাটা সুর
বিদায়-রাতি করবে মধুর,
মাতাল আজি অস্তসাগর সুরের প্লাবনে।
কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য (1890–1975) ১৩৬১ বঙ্গাব্দের ৩০ শে ফাল্গুন কলকাতায় বসে এক সৌন্দর্যপূর্ণ ছন্দে লিখেছিলেন –

।‌। বসন্তে।।

হায়,
বর্ষ যায়!
রেখে যায় স্মৃতি,
বুকে বাজে ব্যথা-গীতি!
অন্তরের অন্তস্তল ব্যাপি,
আলোড়নে প্রাণ ওঠে কাঁপি কাঁপি।
হাসে পুষ্প, দোলে ফল মুকুল শোভন;
গাহে পিক ,মধুমাছি গুঞ্জে অগণন !
দিবানিশি মনঃপ্রাণে জাগে সাড়া,
প্রেমে থাকি সদা মাতোয়ারা!
হিয়া শুধু যাচে হিয়া,
উঠি আকুলিয়া !
ঠেকে বিশ্ব
নিঃস্ব !
কায়া
প্রীতি মায়া
যাচে অহরহঃ !
এ বিরহ কী দুঃসহ !
বহির্বিশ্বে খুঁজি যেন কারে,
না পেয়ে তাহারে প্রাণ বারে বারে
করে শুধু হাহাকার, এ কি হোলো , হায় !
না জানি কোথায় সে যে, কোথায় কোথায় !
জুড়াতে প্রাণের জ্বালা যাচি প্রাণ
ভুলে যেতে সব অভিমান !
কোথা আছ, বাসন্তিকা !
অনিভন্ত শিখা
হোক্ শেষ !
বেশ !
তব
অভিনব
সৌন্দর্য মধুর !
করে সদা প্রেমাতুর !
পুষ্পে পাই তনুর সুবাস,
হেরিনু শশীতে মুখের আভাস !
কচি কিশলয়ে দেখি সবুজ আঁচল,
মৃদু বায়ু-আন্দোলনে দুলিছে কুন্তল !
শন্ শন্ রবে ডাকিছে আমায় !
মূর্তি চোখে দেখি না তো, হায় !
ব্যাপ্ত হয়ে আছ তবু ,
পাবো না কি কভু !
এসো বুকে
সুখে !
পিক
চতুর্দিক
করিছে মুখর
শুনায়ে মধুর স্বর !
সেই স্বরে মিলাইয়া সুর
পূর্ণ করো মোর শূন্য অন্তপুর !
জুড়াইয়া দাও ওগো রূপের পিপাসা,
অন্তরের চিরন্তন দুরন্ত নিরাশা !
রূপ হতে যাও অরূপেতে নিয়া,
শান্ত করো অশান্ত এ-হিয়া !
রাখিও না মুহ‍্যমান,
তৃপ্ত করো প্রাণ !
দাও দেখা
একা !
(কবিতাটি ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য সম্পাদিত কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থ থেকে সংকলিত।)

One thought on “মুক্তগদ্যঃ দোল ফাগুনের বসন্তের ফাগ – রাধাকৃষ্ণ গোস্বামী (রাধু)

  1. কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্যের উদ্ধৃত কবিতার ছন্দ দেখে বিস্ময়ে আপ্লুত হলাম। লেখককে এমন উপহার দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *