শ্রীমদ্ভাগবত কথা
ভূমিকা গোস্বামী

এদিকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ। হস্তিনাপুরের রাজা এখন যুধিষ্ঠির। কুন্তী গান্ধারী সহ ধৃতরাষ্ট্র স্বেচ্ছায় বনে গিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন। মহাত্মা বিদুরও প্রভাসতীর্থে নিজের দেহ বিসর্জন দিয়েছেন। কিছুদিন পর অর্জুন খবর নিয়ে এলেন – যদুবংশ ধংসের পর তাদের পরম সুহৃদ শ্রীকৃষ্ণ স্বধামে গমন করেছেন, আর সেই সঙ্গেই কলি যুগেরও শুরু হয়েছে।
এই সমস্ত ঘটনায় অত্যন্ত মর্মাহত যুধিষ্ঠির , অভিমন্যুর ছেলে পরীক্ষিতকে সিংহাসনে বসিয়ে দ্রৌপদী সহ পঞ্চপাণ্ডব মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করলেন।
অভিমন্যু ও উত্তরার ছেলে পরীক্ষিত ছিলেন অত্যন্ত সুদক্ষ রাজা। পরীক্ষিত মায়ের গর্ভে থাকাকালীন দ্রোণাচার্যের ছেলে অশ্বথ্থমার অস্ত্রে দগ্ধ হলেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনুগ্রহে তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন। পরীক্ষিত উত্তরের কন্যা ইরাবতীকে বিয়ে করেন। তাঁর ছেলে জনমেজয়।
চারটি যুগ –সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর,কলি। সর্বশেষ যুগ এই কলির অনেক দোষ।
সত্য যুগে-তপস্যা, শুচিতা , দয়া ও সত্য । মানব ধর্মের চার চরণ ছিল। ত্রেতাতে একটি চরণ হারিয়ে শুচিতা , দয়া , সত্য ছিল। দ্বাপরে দুটি চরণ গিয়ে দয়া আর সত্য ছিল। কলিতে মাত্র একটি চরণ সত্য। সেটাও খোয়া যাওয়ার উপক্রম। তাই রাজা এই কলিকে থাকার জন্য পাঁচটি জায়গা নির্দিষ্ট করে দেন- মিথ্যা , মদ্যপান , পরস্ত্রীসঙ্গ , প্রাণিহিংসা ও শত্রুতা। অতএব যাঁরা নিজেদের মঙ্গল চান তাঁরা এই পাঁচটি আশ্রয় থেকে দূরে থাকবেন।
একবার পরীক্ষিত মৃগয়ার উদ্দেশ্যে বনে বিচরণ করছিলেন। কতগুলো হরিণের পিছনে তিনি ছুটে বেরালেন। শিকার করতে পারলেন না। ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত হয়ে জলাশয়ের খোঁজ করতে করতে তিনি শমীক মুনির আশ্রমে ঢুকলেন। মুনি তখন চোখ বুজে ধ্যানে বসে আছেন। তাঁর প্রাণ-মন-বুদ্ধি -ইন্দ্রিয়ের কাজ স্তব্ধ। তাঁর অবস্থা তখন জাগ্রত , স্বপ্ন ও সুষুপ্তি -এই তিনের ঊর্ধ্বে তুরীয় অবস্থায় নিবদ্ধ। তিনি তখন ব্রহ্মভূত, বিকাররহিত। তাঁর মাথায় জটা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। দেহ মৃগ চর্মে আচ্ছাদিত। মুনিকে এই অবস্থায় দেখেও রাজা পরীক্ষিত মুনির কাছে জল চাইলেন। কারণ রাজা প্রচণ্ড তৃষ্ণার্ত। তৃষ্ণায় তালু শুকিয়ে গিয়েছিল।
রাজা দেখলেন, তাঁকে বসার আসন দিতেও কেউ এল না। এতে তিনি যথেষ্ট অপমানিত বোধ করলেন এবং প্রচণ্ড রেগে গেলেন। রাগ হল মানুষের সবচেয়ে শত্রু। রাগলে হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে সুন্দর করে বলা হয়েছে —
ধ্যায়ত বিষয়ান পুংসঃ সঙ্গস্তেষূপজায়তে।
সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে।।
ক্রোধাৎ ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ।
স্মৃতিভ্রংশাদ্ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি।।
বিষয়ের চিন্তা করতে করতে বিষয়ে আসক্তি জন্মে। আশক্তি থেকে কামনার জন্ম হয়। কামনায় বাধা এলে তা থেকে ক্রোধের উদ্ভব হয়। ক্রোধ থেকে মোহের সঞ্চার। মোহ থেকে উৎপন্ন হয় স্মৃতিভ্রংশ। স্মৃতিভ্রংশ থেকে বুদ্ধিনাশ ঘটে এবং বুদ্ধিনাশ থেকেই ঘটে বিনাশ।
রাজার ক্ষেত্রেও দেখুন তাই হল। রাজা তাঁর পদের কথা ভেবে আশক্তি হল। তিনি চাইলেন যোগ্য সমাদর পাবেন। তৃষ্ণার জল পাবেন কিন্তু পেলেন না। তাই তিনি প্রচণ্ড রেগে গেলেন। ভাবলেন , মুনি তাঁকে অবজ্ঞা করে ধ্যানের অভিনয় করছেন। তাই মুনিকে যথেষ্ট কটু কথা বলে আশ্রম থেকে বেরোবার সময় একটি মরা সাপ ধনুকের মাথায় তুলে মুনিবরের কাঁধে ছুড়ে দিলেন এবং রাজপ্রাসাদে ফিরে এলেন।
এদিকে শমীক মুনির বারো বছরের ছেলে , ব্রহ্মতেজসম্পন্ন। তিনি তখন অন্যান্য ঋষিকুমারদের সাথে খেলা করছিলেন। তিনি যখন শুনলেন রাজা তাঁর বাবার সাথে এমন দুর্ব্যবহার করেছেন , তখন তিনিও ক্রোধে অন্ধ হয়ে পৈতে ছিঁড়ে অভিশাপ দিলেন– আজ থেকে সপ্তম দিনে কুলাঙ্গার পরীক্ষিতকে তক্ষক নাগ দংশন করবে।
এদিকে রাজধানীতে ফেরার পর পরীক্ষিতের নিজের নিন্দিত কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ হতে লাগল। তিনি প্রায়শ্চিত্ত করবেন ভাবলেন। এমন সময়ে তিনি জানলেন ঋষিপুত্রের অভিশাপের কথা। এমনিতেই অনুতপ্ত ছিলেন, তারপর এই অভিশাপ রাজাকে সংসারের প্রতি বৈরাগ্য এনে দিল। তিনি শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্ম চিন্তা করতে করতে গঙ্গার তীরে গিয়ে আমরণ অনশন করবেন সংকল্প করলেন। সেই সময় ত্রিলোকপাবন মহানুভব ঋষি- মুনিরা তাদের শিষ্যমণ্ডলীসহ সেখানে উপস্থিত হলেন। সকলে সুখাসনে বসলে , রাজা সকলকে প্রণাম করে নিজের পাপ স্বীকার করলেন । আকাশে দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন।
সেই সময় ব্যাসপুত্র শুকদেব মহারাজ পৃথিবী ভ্রমণ করতে করতে সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি ষোড়শবর্ষীয় যুবা পুরুষের মতো। তাঁর সমস্ত দেহ অত্যন্ত কোমল। মনোহর আয়তলোচন, উন্নত নাসিকা, সম ও সুললিত কর্ণদ্বয় এবং সুচারু ভ্রুযুগলে মুখমণ্ডল সুশোভিত। শঙ্খের মতো তিনটি রেখা তাঁর গলায়। বিশাল ও উন্নত তাঁর বুক। জলের ঘুর্ণির মতো তাঁর নাভি। আজানুলম্বিত দীর্ঘ বাহু। দিগম্বর। শ্রীকৃষ্ণের মতো শ্যাম কান্তি। গৃহস্থের বাড়িতে , গো দোহন করতে যতটুকু সময় ততটুকু সময় তিনি থাকেন তার বেশী নয়।
সকলেই নিজের আসন ছেড়ে তাঁকে সম্মান দেখালেন। যোগিদেরও পরম গুরু শুকদেবকে প্রণাম করে মহারাজা পরীক্ষিত কয়েকটি প্রশ্ন করেলেন। মৃত্যু পথ যাত্রীর কল্যাণ কিভাবে হবে, এই প্রশ্ন আমাদের এই মর জগতের সমস্ত মানুষের হয়ে যেন পরীক্ষিত করছেন। পরীক্ষিতের সাতদিন আয়ুকাল নির্দিষ্ট। আমরা জানি না কখন আমাদের ডাক আসবে।
পরীক্ষিত বললেন – হে ভগবন, আমার এই অবস্থায় আমাকে উপদেশ দিন। মানুষমাত্রেরই কী করা উচিত ?
কী শুনবো, কী জপ করবো, কী ভজনা করবো সব আমাকে বলুন। পাশাপাশি কী ত্যাজ্য তাও বলুন।
শুকদেবের মুখে ভাগবত কথা শ্রবণ করছেন পরীক্ষিত। সাত সাতটি দিন উপবাসে থেকে ভাগবতের আঠের হাজার শ্লোক শ্রবণের পর তাঁর মৃত্যু ভয় চলে গেল। শ্রেয় আর প্রিয়র তফাৎ বুঝে ,অনিত্য বস্তু এই দেহ গৃহর প্রতি পুরোপুরি অনাশক্ত হয়ে গেলেন। ধ্যানস্থ হয়ে রইলেন। তক্ষক এল। তাঁর জড় শরীরকে দংশন করলেও পরীক্ষিত কিছুই অনুভব করলেন না।
এই সমস্ত কথা আমরা কেমন করে জানতে পারলাম ? সেইখানে উপস্থিত ছিলেন সূত নামে এক মুনি । তিনি একবার শৌনক মুনির আশ্রমে গিয়েছিলেন। সেখানে মানব কল্যাণের জন্য শৌনক মুনি তাঁর অষ্টাশি হাজার শিষ্যের সামনে সূতকে প্রশ্ন করলে – শ্রীসূত শুকদেবের মুখ থেকে শোনা ভাগবত কথা ওঁদের শ্রবণ করান ।
এইভাবেই এতকাল ধরে ভাগবতী গঙ্গা প্রবাহিত হয়ে আসছে দেশে দেশে , দিকে দিকে। রূপকের মাধ্যমে শাস্ত্রের কঠিনতম বিষয় সুন্দরভাবে সাধারণের বোধগম্য করা হয়েছে ভাগবতে। আমাদের দেশে যখন মেয়েদের স্কুলে যাবার উপায় ছিল না। গ্রামের মায়েরা নিরক্ষর থাকলেও অশিক্ষিত ছিলেন না, কারণ তাঁরা মানুষের কল্যাণকর ভাগবত কথা শ্রবণ করতেন।
বিরতি
তথ্য সমৃদ্ধ লেখা । খুব ভালো লাগলো ।
ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা।
অপূর্ব লেখনী শক্তি। শুকদেব, ব্যাসদেব সুন্দর ও সংক্ষেপে যেন চিত্রায়িত। কাহিনী, যা পুরাণের প্রধান অবয়ব, তাকে ছাড়িয়ে, জীবনের সত্য ও প্রয়োজনীয় তত্বের সুচারু রূপে পরিবেশন অভাবনীয়। লেখিকা যথেষ্টভাবে অভিনন্দিত হবার যোগ্য।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।শুভেচ্ছা।
কতকিছু জানতে পারি আপনার লেখা পড়ে। সমৃদ্ধ হই। এই বিষয়ে লেখা পড়তে আমার ভীষণ ভালো লাগে।